নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছেঁড়া পান্ডুলিপি

আলমগীর হোেসন িনলয়

আমি ছাত্র

আলমগীর হোেসন িনলয় › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: তুলি ও ছোটকাকু-আলমগীর হোসেন নিলয়

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:১৫

তুলি এবার তার বার্ষিক পরীক্ষা শেষে গোমড়া মুখে বসে আছে। এখনো তাকে কেউ বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি। ছোট কাকু ছাড়া কেউ তাকে বেড়াতে নিয়ে যায়না। ছোট কাকু কিন্তু মেয়ের মনের ভাব বুঝতে পেরেই সময় ঠিক করে ফেলল।

তুলির মা-বাবা, দাদা-দাদী এবং ছোট কাকু সহ সবাই শহরে থাকে। শহরে ওদের বড় বাড়ি আছে। বাবা ব্যবসা করে। ছোট কাকুর এখনো লেখাপড়া শেষ হয়নি। তাই ছোট কাকু মহাবিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। ছোট কাকু তুলিকে খুব ভালবাসে। তুলির আর কোন কাকু নেই তবু বাবাকে বড় কাকু বলে না ডাকলেও কাকুকে ছোট কাকু বলেই ডাকতে পছন্দ করে। তাতে কেউ কোন আপুত্তি করে না।

ছোট কাকু তুলিকে খেলনা, কলম, রং পেন্সিল এটা সেটা আরো কত কি এনে দেয়। তুলিও যখন যা চায় কাকু তাকে নিরাশ করে না।

প্রতিবারের মত এবারও নিশ্চই ছোট কাকু তুলিকে নিয়ে বেড়াতে যাবে? ছোট কাকু তুলিকে বলল, ‘ এবার তোমাকে অনেক দূর থেকে বেড়িয়ে নিয়ে আসব। যাবে না আমার সাথে? তুলি কাকুর কথা শুনে তো খুশিতে ডগমগ। সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ কাকু এবার কোথায় যাচ্ছ ?” কাকু কিন্তু কোথায় যাবে কিচ্ছু বললনা। বলল, যাবার আগেই যদি বলিতো পরিপূর্ণ আনন্দ পাবনা আমরা।



একদিন ছোট কাকু সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তুলিকে ডেকে বলল, তুলি, তুমি খেয়ে ধেয়ে ঘুমিয়ে পড়। তুলি বলল, কেন কাকু, এত তাড়াতাড়ি ঘুমোব কেন ? কাকু বলল, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব বলে।

তুলির আর ধৈর্য্য ধরেনা। মাকে গিয়ে বলল, খাবার দাও, আমি খেয়ে এখন ঘুমাবো। মা-তো অবাক! মা বলল, এ কথা বুঝি ছোট কাকু বলেছে ? তুলি মাথা নেড়ে সায় দিল।



তুলির তখনো ঘুম ভাঙ্গতোনা যদিনা গাড়ি গুলো এত জোরে হর্ণ বাজাতো। চোখ মেলে তুলি দেখল ছোট কাকুর কোলে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে ছিল। তখনো তুলির মোহ কাটেনি। আধো ঘুম আধো জাগরণে তুলি দেখল, ছোট কাকু তাকে নিয়ে যে আসনে বসে আছে তার চার পাশে আরো অনেক গুলো আসনে অনেক মানুষ। একটু পরেই বুঝতে পারল বিলাসবহুল একটি বাসের মধ্যে তারা আছে। অন্ধকারের বুক ছিড়ে স্যাঁ, স্যাঁ করে ছুটে চলছে বাসটি। তুলি ছোট কাকুর চোখের দিকে চেয়ে একটু হাসল। ছোট কাকু বলল, কি, কেমন তোমাকে অবাক করে দিলাম না ? তুলি কাকুকে জড়িয়ে ধরে জানালা দিয়ে তাকাল। দূরে তখনো অনেক গুলো আলো যেন পাশাপাশি জড়ো হয়ে হিরের মত জ্বলছে। কাকু বলল, ওটা হচ্ছে ভৈরব রেলওয়ে জংশন। তুমি এখন ঘুমাও, আমরা সকালে ঘুম থেকে জেগে একদম একটা নতুন জায়গায় পৈৗঁছে সুন্দর একটা দিনের সূর্যোদয় দেখব। তুলি ছোট কাকুকে খুব শ্রদ্ধা করে, তাই সে ছোট কাকুর কথা কখনো অমান্য করে না। কাকুর কথা মত সে ঘুমাতে চেষ্ঠা করল কিন্তু গাড়ির ঝাকুনিতে বার বার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতক্ষণে তুলি বুঝতে পারল কাকু কেন তাকে সন্ধ্যায় ঘুমাতো বলেছিল।



সকালে সূর্য জাগল সম্পূর্ণ এক নুতুন পৃথিবীর নুতুন পরিবেশ চোখের সামনে হাজির করে। এমন নিভৃত শান্ত পরিবেশ ইতিপূর্বে তুলি আর কখনো দেখেনি। বাইরে তখনো কুয়াশা ঝরছে। কিন্তু বনো পাখিদের কলতান বেশ কাছাকাছিই শুনা যায়। তুলি চোখ মেলে দেখল নরম তুলতুলে বিছানায় কাকুর পাশে শুয়ে আছে। তাদের পাশে দাড়িয়ে আছে ছাদওয়ালা রঙ্গিন দেয়াল। তুলি ভাবল গাড়ির ঝাকুনির দোলনায় হয়তো সে কোন এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।



বালি ভরা ছোট্ট একটা মাঠে কাঠের চেয়ার পেতে কাকু আর অন্যরা সবাই চা পান করতে করতে পুব আকাশে সূর্যের আবির্ভাব দেখছিল। তখন তুলি অবাক হয়ে দেখল তার বয়সী আরো অনেকে এসেছে এখানে। তাদের সাথে পরিচয় হল এবং সবাই মিলে একসাথে একটা ঢিবির উপরে দাড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রবির আলো এসে রাঙ্গিয়ে দিল তাদের।



নানান রকম ফল ফলাদি আর ক্রিম ব্রেড দিয়ে নাস্তা সেরে ধীরে ধীরে সবাই একদিকে হাটতে লাগল। তুলিও কাকুর হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে হাটছে। তুলিকে নিয়ে তার ছোট কাকু ঢালু একটা রাস্তা ধরে নামছে। রাস্তার দুধারে পাথুরে মাটি গুলো ক্রমেই পাহাড় হয়ে যাচ্ছে। একটু হাটার পর ছোট কাকু বলল, ‘ কি মজা তাইনা? আমরা ছোট খাট একটা গিরিপথ পেরিয়ে ঘাটে এলাম।’

ঘাটে এসে তুলি দেখল সারি সারি নৌকা বাঁধা ঘাটে। স্থানীয় লোকেরা একে ‘কিস্তি’ বলে। এখানে এসে তুলি ছোট কাকুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকু গিরি পথ কি?, ছোট কাকু তাকে বুঝিয়ে দিল-গিরিপথ হচ্ছে পাহাড় কেটে মানুষে যে চলাচলের রাস্তা তৈরী করেছে, তাকেই গিরিপথ বলে। তুলি ফের জিজ্ঞেস করল,‘ কাকু, পাহাড় কি?’ কাকু হেসে বলল,‘তা দেখাব বলেইতো তোমাকে নিয়ে এসেছি।’ সবাই তখন কথা বলতে বলতে অনেকখানি সামনে এগিয়ে গিয়েছে। সামনে এখন বিশাল এক বালিয়ারি। এই বালিয়ারির বুক কেটে এঁকে বেঁকে স্থির হয়ে আছে স্বচ্ছ জলাশয়। এই জলের ওপর লাগাম পড়া ঘোড়ার মত আটকানো আছে নৌকা গুলো। এগুলো পারাপারের নৌকা। আরো কর্ম ব্যস্ত নৌকা ও মানুষ জনকে দেখা গেল দূরে। তারা পানির নিচের বালি কেটে কেটে বের করে আনছে ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির পাথর। তুলি ছোট কাকুর নির্দেশ অনুস্বরণ করে এই বিশাল বালুকারাশির অপর প্রান্তে তাকাল। তখনই তার চোখের সামনে অপূর্ব বিস্ময় এসে হাজির হল। ওপ্রান্তে আকাশ দেখা যায়না। স্তরে স্তরে সাজানো সবুজের সুউচ্চ সমারোহ। তুলি কাকুকে জিজ্ঞেস করল, কাকু ওটা কি ? কাকু বলল, ‘ওগুলোই পাহাড়।’ তুলি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকল পাহাড়ের চূড়ার দিকে। কাকু বলল, এখন আমরা পাহাড়ের কাছে যাব। তুলি উল্লাসে নেচে ওঠে বলল, তাড়াতাড়ি চল কাকু।



পাহাড়ের কাছাকাছি হয়ে কাকু তুলিকে এক চমকানো কথা শুনাল। কাকু বলল, ঐযে কাটাতারের বেড়া দেখছ ওটাই আমাদের দেশের শেষ সীমানা। তুলি অবাক দৃষ্টিতে কাকুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তাহলে ওগুলো কাদের দেশ? কাকু হাত উঁিচয়ে আঙ্গুলি নির্দেশ করে বলতে লাগল,‘ এই যে আমাদের ডান পাশে বিশাল পাহাড়ের সারি দেখছ এ পাহাড় গুলো হচ্ছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, বর্তমানে ওকে ত্রিপুরা বলে। আর এই যে আমাদের নাক বরাবর দাড়িয়ে পাহাড় গুলো বামে সারি বেধে চলে গেছে, ওগুলো ভারতের আসাম রাজ্যে পড়েছে। ঐযে ছোট ছোট ঘর-বাড়ি গুলো দেখছ, ও গুলোতে ভারতের বিভিন্ন উপজাতিরা বাস করে। তুলি ছোট কাকুকে জিজ্ঞেস করল, কাকু পাহাড়ের উপর মানুষ ওঠতে পারে? ওদের ভয় করেনা? ওরা উপজাতি কেন? কাকু তুলিকে ঝটকরে নিজের কাধে ছড়িয়ে বলল, অনেক প্রশ্ন জাগছে মনে তাইনা বাবা? তুলি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল। কাকু বলল, তাহলে শোন,‘ তুমি যেমন নানা অজুহাতে, বুদ্ধি খাটিয়ে আমার কাঁধে ওঠতে পার ঠিক তেমনি মানুষও পাহাড়ের চূড়ায় চড়তে পারে। টাইগার হিল, যেখান থেকে বহু পর্বতারোহী অরুনোদয় দেখে। ওখান থেকে সূর্যদোয় দেখলে মনে হয় মাটি চাপা দেওয়া একটা গোল অগ্নিকুন্ড যেন অজস্র মাটি ঠেলে পৃথিবীতে ওঠে আসছে। আকাশ ছোঁয়া হিমালয়ের নাম শোননি তুমি, এভারেষ্ট, কাঞ্চনজংঙগা, তার চূড়ায়ও মানুষ চড়েছে। আর প্রথম হিমালয় বিজেতাদের নাম শোন, তারা হলেন, তেনজিং ও হিলারি। তেনজিং ছিলেন জাতিতে শেরপা। শেরপারা পাহাড়ের পাদদেশে বাস করে। গায়ে শক্তি ধরে বাঘের মত। তারা টুরিস্টদের গাইড হিসেবে কাজ করে। তাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়া তেমন কোন ভয় ডর নেই। অবশ্য প্রতিনিয়তই তারা প্রকৃতির বিরূপ ভাব আর পাহাড়ী ভয়াল দর্শন জানোয়ারের খপ্পরে পরে। তবু তারা ভয় করেনা। কারণ ভীতুদের জন্য বিজয় সম্ভব নয়। তবে তুমি যেমন ছোটবেলা থেকে তোমার পরিবেশে পরিচিত হচ্ছ,তারাও ছোটবেলা থেকে তাদের পরিবেশে পরিচিত হচ্ছে। আর উপজাতি হচ্ছে কোন একটি দেশের প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ছাড়াও আলাদা যে কয়টি জাতি বা গোষ্ঠি থাকে তারাই। উপজাতিদের উৎসব, পার্বন, ভাষাও অনেকখানি আলাদা হয়।



তুলি তন্ময় হয়ে কাকুর কথা শোনছিল আর অবাক হচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখের সামনে আরেক আশ্চর্যের সৃষ্টি হল। সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘কাকু ওটা কি?’ এবার কৌতূহলি খুকির দিকে চেয়ে কাকুর মনটা আরো ভাল হয়ে গেল। ছোট কাকু মুশকি হেসে বলল,‘ ওটা সত্যিই আশ্চর্য বটে! দেখ কি অভিনব কৌশলে ওটাকে স্থাপন করা হয়েছে। বিরাট একটা সাকো শূন্যে ঝুলে আছে। ওটার নাম ঝুলন্ত ব্রীজ। ওটাই আসাম এবং ত্রিপুরার যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের জীবন যাত্রাকে সহজ করেছে।



বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদের তেজও বাড়তে লাগল। ছোট কাকু একটা নৌকার মাঝিকে ডাকল। নৌকার মাঝি তাদেরকে নৌকায় চড়িয়ে ওপারে রওনা হল। ছোট কাকু তুলিকে নিয়ে পানিতে দৃষ্টি দিল। তুলি নৌকা থেকে উঁিক দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে পানিতে তাকিয়ে থাকল। পানি এত স্বচ্ছ যে দশ-পনের ফুট পানির নিচের পাথর গুলোকে পরিষ্কার দেখা গেল।

তুলির মন আনন্দ আর সতেজতায় ভরে গেল। তুলির খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এই পানিতে সাঁতার কাটতে। মনের ভাব ছোট কাকু ধরতে পেরেই বলল, ‘না বাবা, ওখানে সাতাঁর কাটা যাবেনা। ছুঁয়ে দেখ পানি কত ঠান্ডা। ও পানিতে নামলে অসুখ করবে। কাকুর কোলে চেপে তুলি পানি ছুঁয়ে দেখতে লাগল এবং সহসাই দুজন আনন্দে চিৎকার করে ওঠল। আ্যাকুরিয়াম! আ্যাকুরিয়াম! সত্যিই এ যেন স্রষ্টার সৃষ্ট এক প্রাকৃতিক আ্যাকুরিয়াম। এই আ্যাকুরিয়ামে ক্ষুদ্র-বিশাল সব আকৃতির মাছ গুলো সাঁতার কাটে, খাবার সন্ধান করে এক বিচিত্র গরিমায়। ছোট কাকু আর তুলি একই সাথে দেখল, দানবাকৃতির দুটি সোনালি কারপিও মাছ সাত-আট ফুট পানির নিচে অলস ভঙ্গিমায় সাতাঁর কাটছে।



তুলি নৌকায় পার হতে হতে দেখল একদল মহিলা নীলপেড়ে সাদা শাড়ী পড়ে অন্য নৌকায় পার হচ্ছে। কাকুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, তারা সবাই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী।

কাকু মাঝিকে জিজ্ঞেস করে জানল আসলে তারা যেটাকে বালিয়ারি ভাবছে সেটা মূলত একটা বিশাল নদী। শীতের শেষে শুকিয়ে গিয়ে তলদেশটা মরুবালিতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় লোকেরা এ নদীকে ‘ডাউকী নদী’ কেউবা ‘পিওর’ নদী বলে ডাকে। এর উৎপত্তি হয়েছে ইন্ডিয়ার অতিকায় পাহাড় মালা থেকে। বর্ষায় এ নদী জলে ভরপুর থাকে। কখনো কখনো পাহাড়ী ঝর রুদ্র রূপ নিয়ে জনজীবন করে বিপর্যস্ত। এতে মানুষের কেবল অসুবিধাই হয়না উপকারও হয় কারণ জল-ঝরে পাহাড় ক্ষয় হয়ে নদীতে নেমে আসে অজস্র পাথর।

ছোট কাকু তুলিকে পাহাড়ের শীর্ষে মসৃণ কালো কালো কয়েকটি স্থান দেখিয়ে বলল, এগুলো হচ্ছে ঝরণা। কেউ তাকে নির্ঝরণী, কেউ বা গিরিস্রাব বলে। শীতে বৃষ্টি নেই বলে এগুলো শুকিয়ে কালো পাথর হয়ে আছে। বর্ষা এলেই জীবন্ত হয়ে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে শীতল জল নেমে আসে নিচের এই নদীর জলে। জল ঝরার তীব্রতাও থাকে প্রচন্ড। দূর থেকে দেখলে এই ঝরর্ণা গুলোকে একেকটা অতিকায় ফুতন্ত শাপলার মত দেখায়।

মাঝি তাদেরকে ওপারে পৌঁছে দিলে ছোট কাকু তুলিকে নিয়ে বালির ওপর দিয়ে হাটতে হাটতে বলল, ‘এখন আমরা খাসিয়া পল্লীতে যাচ্ছি। তুলি জিজ্ঞেস করল, কাকু খাসিয়া কি? কাকু বলল, এই যে বললাম উপজাতি, ওরা হচ্ছে আমাদের দেশের একটি উপজাতি। উপজাতিদের বসবাস এখানে আছে।



কাকু তুলিকে নিয়ে খাসিয়া পল্লীতে ঢুকার মুখেই একটি রেষ্টুরেন্ট পেল। নাম ‘ক্যাফে সেংরাংপুঞ্জি’। এখানে টুরিস্টরা আহারাদি সম্পন্ন করে। ছোট কাকু তুলিকে নিয়ে সেখানে দুধের সর দিয়ে তৈরী একধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার খেল। একটু বিশ্রাম করে তারা পল্লীতে প্রবেশ করল এবং প্রথমেই ঝঞ চঅঞজওঈক ঈঅঞঐঙখওঈ ঈঐটজঈঐ নামের গীর্জা দেখতে পেল। গীর্জার গেটে খুব সতর্কতার সাথে বাঁধাই করে রাখা আছে যীশু খ্রিষ্টের প্রতিকৃতির ফটোগ্রাফ। তার পাশেই আরেকটি নিরাপদ বেষ্টনীর ভিতর মা মেরী আর তার প্রসূতি কালের তিনটি উপকরণ রাখা আছে সযতেœ। তারা যতই ভিতরে দিকে এগিয়ে গেল ততই তাদের সামনে একের পর এক বিস্ময় এস হাজির হল। খাসিয়া পল্লীর রাস্তা গুলো যেন রাস্তা নয় স্বপ্নের রং দিয়ে আঁকা কোন নিখুঁত ছবি। সরু সরু পথের দুধারে দাড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এদের মধ্যে সুপারির সারি গুলো প্রাণে শিহরণ জাগায়। বহু পর্যটক হোন্ডা করে, গাড়ি করে , কেউ বা হেটে উপভোগ করছে এই পল্লীর শ্যামল সৌন্দর্য। সমস্ত পল্লীটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। এই ভগ্নাংশটুকুকে একেকটি পুঞ্জি বলে। পুঞ্জি গুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। এর মধ্যে ‘পুরাতন সংগ্রাম পুঞ্জি’ তে আছে ‘‘খাসিয়া পনরয় সমাজ কল্যাণ সমিতি’’-র অফিস। একটি স্যাটেলাইট ক্লিনিক আছে কুনতুন খাসিয়ার বাড়িতে। একটি বাজার ও দুটি সরকারি প্রাইমারী স্কুল চোখে পড়ল কাকু ও তুলির। আরো কিছুটা সামনে যেতেই দেখতে পেল চোখে চমক লাগানো ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি এবং বিরাট বিরাট বাগান গুলো। ছোট কাকু বাগানে কর্মরত দুজন খাসিয়ার সাথে আলাপ করল। তারা অত্যান্ত বিনয় ও আন্তরিকতা নিয়ে কাকুর সাথে কথা বলল। কাকু তাদের কাছ থেকে জানতে পারল, তারা প্রায় শ’খানেক লোক বাগান গুলোতে বাৎসরিক দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। জমিদারের এরকম আটাশটি বাগান আছে। তাদের দৈনিক হাজিরা বেতন একশত চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট টাকা করে। তারা এই বাগান গুলোতেই খেটে খুটে জীবিকা নির্বাহ করে। এই বাগান গুলোর প্রধান জুম চাষ হচ্ছে পান ও সুপারি। এছাড়া আম, আনারস, কাঁঠাল, কমলা, কলা সহ আরো অনেক প্রজাতির ফলজ গাছ তো আছেই। তাছাড়া বনজ বৃক্ষও কম নয়। খাসিয়াদের চাষের পান গুলো বাংলা পানের চেয়ে স্বাদে একটু বেশি ঝাল।

তুলিকে সাথে নিয়ে ছোট কাকু হাটতে হাটতে জমিদার বাড়িতে গিয়ে হাজির হল। কাকু তাদেরকে সালাম দিয়ে কথা বলতে আগ্রহী হলে, তারা ‘শেবলাই’ বলে প্রতিত্তোর দিল। একটি ঘরের নিচে ঢালাই করা থামের ফাঁকে, ফাঁকে মহিলারা পান বাজারজাত করার জন্য বাছাই করছে। পুরুষেরা পানে বোঝাই ঝুড়ি গুলো বাগান থেকে এনে দিচ্ছে। তাদের কাছাকাছি হয়ে কাকুও বেশ আশ্চর্য বোধ করল কারণ তাদের বসত বাড়ি গুলোর মেঝে হচ্ছে মাটি থেকে প্রায় পাঁচ, ছয় ফুট উপরে। প্রতিটি বাড়িই একই আদলে গড়া যেমনটি তাদের মুখাকৃতির বেলায়ও মানায়। তুলিকে নিয়ে কাকু এই মহিলাদের সাথে কথা বলেছে। মেয়ে গুলো কিছুটা লাজুক আর শ্রদ্ধাভরে কথা বলল। তাদের সাথে কথা বলে কাকু কিন্তু প্রকৃত সত্যি উদঘাটন করতে পারলনা। বংশানুক্রমিক জমিদারের নাম জানতে চাইলে তারা কেউ ‘পান’ জমিদারের নাম করল, কেউ ‘ময়না’ জমিদারের নাম করল, আবার কেউবা ‘অঞ্জলি দেবী’-র। তবে বর্তমান জমিদার যে ‘শে-পাল’ এ সম্পর্কে প্রায় সবাই জ্ঞাত। পূর্ব পুরুষদের ব্যপারে তারা তেমন কিছু জানে না। তবে একজন আঙ্গুল তোলে একটি স্মারকলিপি দেখিয়ে দিল। তখন কাকু বুঝতে পারল ওখান থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। এই মেয়ে গুলো দিন মজুর খাটছে। তারা দরিদ্র এবং অতি অল্প শিক্ষিত তাই তারা বাঁচার তাগিদেই কেবল সারা। কাকু আর কথা বাড়ালনা। স্মারকলিপির পাশে দাড়িয়ে পড়তে লাগল, ‘ ১৯০৩ সালে মৃত্যুবরণকৃত এই মন্দির উ-হেট লম্বা জমিদারের, কা-লখমী লম্বা কর্তৃক নির্মিত হয়। উ-প্রকেশ লম্বাকৃত ১৯৯১পুনঃ সংস্কার করা হয়।’.....ইত্যাদি। কাকু তুলিকে নিয়ে এবার চা বাগান দেখতে গেল। সেখানে একটি চায়ের দোকানে তুলিকে ক্রিম বিস্কুট খেতে দিয়ে নিজে চা পান করতে করতে দোকানিকে তাদের এই চাষার মাথার মুকুটের মত করে তৈরী আবাস গৃহের রহস্য জানতে চাইল। দোকানি কাকুকে বলল,‘ তাদের নিজেদের শিল্প সত্তাকে আলাদা করে রাখতে এবং বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য ধরে রাখতেই এই অবকাঠামোতে বাড়ি গুলো তৈরী করা।

চা পান শেষে দোকানির পাওনা পরিশোধ করে কাকু তুলিকে নিয়ে পোষা হাতিতে চড়ল। তুলির খুব ভয় করছিল। কাকু শক্ত করে ধরে না রাখলে হয়ত সে ভয়ে চিৎকার করে উঠত। এরপর কাকু তুলিকে নিয়ে নদীর তলদেশ দিয়ে ফিরে আসার জন্য হাটতে লাগল। বালিতে হাটতে খুব কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে ছোট কাকু তুলিকে নিজের কাঁেধ চড়িয়ে নিয়েছে। ফিরে আসতে আসতে তারা দেখল শ্রমিকেরা অনেক গুলো শূন্য ড্রাম পাশাপাশি বেঁধে তার উপর কাঠের তক্তা পেতে শক্তিশালী পাম্প বসিয়েছে। মর্টার বেল্টের মাধ্যমে লোকজন পাথর উত্তোলন করছে। আরো দেখল ‘শেভ মেশিনে’ কি নিপুণ ভাবে পাথর ধরে। প্রতিদিন একেকটি মেশিন দশ থেকে বার ট্রাক পাথর ধরতে পারে। দিন মজুরেরা রোজ মাইনে হিসেবে কাজ করে।

চারপাশের এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে ছোট কাকু ও তুলি নদী পেরিয়ে পাড়ে ওঠে এল। নদীর পাড়েও বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে তাদের জন্য চোখ ধাঁধানো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। এখানে এসে দেখল বিভিন্ন কোম্পানী ছোট-বড় অসংখ্য টুকরো পাথরের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এখানে বৃহদাকৃতির পাথর গুলোকে বিভিন্ন আকারে ভেঙ্গে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। পাথর ভাঙ্গার মেশিন গুলো জিরাপের মত দীর্ঘকায় গলা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলোর নাম স্টোন ক্রাশার। এখান থেকেই ট্রাক ভর্তি পাথর ব্রীজ, কালবার্ট, সেতু, রাস্তা, ইমারত, দালান-কোঠা নির্মাণের নিমিত্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাপ্লাই দেওয়া হয়।

রেষ্টহাউজে ফিরে ছোট কাকু আর তুলি বিশ্রাম নিল। তারপর গোসল সেরে খাওয়ার পর্ব শেষে ক্লান্তি মিশ্রিত দেহে সারারাত ধরে ঘুমাল। ভোরে তাদের গাড়ী উচুঁ-নিচু পাহাড়ী রাস্তায় চলতে শুরু করল। ‘গ্রীন পার্ক’ পেরিয়ে যখন তারা তামাবিল বাজারে আসল তখন ছোট কাকু বলল, ‘এখানে ভারতের মেঘালয় থেকে খনিজ কয়লা ইমপোট করা হয়। তুলি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল খনিজ কালো হিরা গুলো কেমন সকালের রোদ গায়ে মেখে চিক্ চিক্ করে হাসছে।

তার পর তাদেরকে বহনকারী গাড়িটি গতি বাড়িয়ে দিল। তুলির চোখের মণি ছুঁয়ে পেছনে সরে যেতে লাগল বল্লা ঘাট, মামার বাজার, তামাবিল, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ। অবশেষে তাদের বাড়ির কাছে এসে থামল গাড়ি। তুলির দেহে কোন ক্লান্তি বা অবসাদ নেই। সদ্য আহরিত সৌন্দর্য-জ্ঞানের উত্তেজনা দুচোখের মণিতে ঝলক দিচ্ছে। মাকে অবাক করে দেবে অনিন্দ সুন্দরের গল্প-গানে। বাড়িতে ঢুকেই দৌড়ে চলে এল মায়ের কাছে। মা তুলিকে স্বস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরতেই তুলি আপন মনে গেয়ে উঠল,‘ এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী....’ এই গানটি সে ছোট কাকুকে অনেবার গাইতে শোনেছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.