![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবন ও যন্ত্রণার মরুচরে আমি প্রপাতের ধারা ।
মহিম অপেক্ষা করছে অলির জন্য। সে আসলে কলবা যাবে এরকম প্ল্যান আছে তাদের। কলবা শারজাহর পূর্বপ্রান্তে উপকূলীয় ছোট্ট শহর। লেক আর সমুদ্র মিশে আছে সেখানে। মৎস শিকারের উত্তম স্থান।
মহিম সৌখিন মৎস শিকারী। উইক এন্ডে লং ড্রাইভে যায়। কোন কোন উইক এন্ডে যায় আজমান অথবা রাস আলখাইমা। আবার কখনও যায় ফুজিরাহ অথবা কলবা। সঙ্গে থাকে অলি আর বড়শীর ছিপ। কিন্তু আজকের পরিকল্পনা বাতিল করতে হল বলে, তার মনে একটা যন্ত্রণার কাঁটা বিদে রইল। তার যত রাগ মেরুন কালারের কেমরি গাড়িটার উপর। ওটা আজ তার বাড়া ভাতে ছাই দিল। এই গ্রীষ্মের প্রবল উত্তাপে গাড়ির এয়ারকুলার কাজ না করলে লং ড্রাইভে সে একবিন্দু স্বস্থি পাবে না।
জুলাই মাসের গরমে দেহে প্রাণ থাকতে চায় না। সুযোগ পেলেই খাঁচা ছেড়ে যায় যায় অবস্থা। মহিম ভাবল আগে গাড়িটা সারানো দরকার। তারপর অন্যকিছু ভাবা যাবে। কিন্তু তারও আগে অলিকে জানাতে হয় প্রোগ্রাম বাতিলের কথা। অলিকে ফোন করে জানিয়ে দিল প্রোগ্রাম বাতিল।
শারজাহর শহরতলীতে গাড়ির গ্যারেজগুলো গড়ে ওঠেছে। নূরালীর গ্যারেজ সানাইয়া আরবা এলাকায়। সানাইয়া আরবা-র বাংলা করলে দাঁড়ায় শিল্প এলাকা চার। নূরালী এগিয়ে এল। আরে মহিম ভাই যে ! কি মনে করে গরীবখানায় ? এটিই নূরালীর স্টাইল।সব কাস্টমারকে সে এভাবে রিসেপ্সন দেয়। স্বভাবে হাড়কিপ্টে হলেও দিল খুলে কখা বলে। দেশের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে।বাইশ বছর ধরে আমিরাতে আছে। এসেছিল আঠারো বছর বয়সে। অর্থ-বিত্ত বানিয়েছ প্রচুর। এ লাইনের ধান্দা সে ভাল বুঝে।
নুরালী,এয়ারকুলার কাজ করছে না। চালু করলে গোঁ গোঁ শব্দ করে। মহিম ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল।
আপনি বসেন। নূরালী মেটালের টুল এগিয়ে দিল। আমি দেখতাছি সমস্যাটা কোথায়। সে এয়ারকুলার চালু করলে ওটা একটানা গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকে।
এর মধ্যে দেশে গিয়াছিলে? মহিম জিজ্ঞেস করল।
নূরালী কম্প্রেসারের নাট খুলতে খুলতে ডাক দিল, গফুর ছয় নম্বর রেঞ্চটা দিয়ে যা। সে আবার নাট খুলতে মনোযোগ দিল। তার ডান হাতের পেশী টানটান হয়ে ফুলে ওঠল। নুরালী জবাব দিল, গত মাসেই আসলাম দেশ থেইক্যা।
তো দেশ গেরামের খবর কী ? মহিম প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারে এটি একটি গতানুগতিক প্রশ্ন। দেশ থেকে কেউ ঘুরে আসলে এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। সে যখন গত জানুয়ারির দিকে দেশ থেকে ঘোরে আসল, যার সাথে দেখা হয় সবাই দেশের খবর জানতে চাইত। বোধ হয় দেশ থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কারনে প্রবাসী হৃদয়ে নিরন্তর দেশপ্রীতির অনুভূতি জাগ্রত থাকে। হঠাৎ একটা গরম হাওয়া আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে প্রচুর ধূলোবালি। মহিম দু’হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুল ঝাড়ে।
দেশে কোন পরিবর্তন নাই। মারামারি, কাটাকাটি, জ্বালাও, পোড়াও, হরতাল এসবের বন্ধ নাই। এবার গিয়া মনে হইল, দেশটা বুঝি অহনো ব্রিটিশের দখলে। নূরালী হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম মুছে নিল। মহিম ভাই কম্প্রেসার নষ্ট। বদলাতে হবে।
মহিম একটু চিন্তা করে বলল, রিপেয়ার করলে হয় না? মহিম বসা থেকে ওঠে গাড়ির খোলা বনেটের উপর ঝুঁকে দেখতে লাগল।
রিপেয়ার করা যবে। কিন্তু মনে হয় না দু এক দিনের বেশি চলবে। গ্যারান্টি নাই। নূরালি ছয় নম্বর রেঞ্চ দিয়ে পিঠ চুলকায়।
তাহলে কি আর করা, নতুন লাগিয়ে দাও। কত সময় লাগবে? মহিম হাতের কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখল।
এক ঘণ্টা টাইম তো দিতে হবে। নূরালী আবার ডাক দিল, গফুর !
ওকে। তুমি কাজ কর। আমি একঘন্টার মধ্যেই ফিরব। মহিম নূরালীর গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে আসে। এদিকের বাইলেনগুলো কাঁচা। কোন সময় পাকা হবে সেই আলামত চোখে পড়েনা। ধুলোর ভেতর গাড়িগুলো ছুটে গেলে বাতাসে কুন্ডলী ওঠে। এদিকে গ্যারেজ ও স্পেয়ার পার্টসের দোকান ছাড়া অন্যকোন স্থাপনা নেই। নেই আকাশ ছোঁয়া ভবন। মানুষের ঘরবাড়ি বেশ দূরে। পুরো এলাকা ফাঁকা ফাঁকা লাগে মহিমের। কিছুদূর হাঁটতেই সে একটা গ্রোসারী সপ পেয়ে গেল। ইতিমধ্যে তেজী রোঁদ তার বুকের কলস শুকিয়ে ফেলেছে। তার ইচ্ছে হচ্ছিল গোরুর মত জিব চাটতে। সে গ্রোসারী সপে ঢুকে পড়ল। দোকানি ইন্ডিয়ান মালোয়াড়ি। হাল্কাপাতলা গড়ন। গায়ের রঙ শ্যামলা। অনেকটা বাঙালিদের মত। নাকের নিচে ঘন ঘোফ। মহিম হিন্দীতে বলল, কোল্ড ড্রিংকস মিলেগি ?
কোনচা ওয়ালা ? দোকানি প্রশ্ন করল।
সেভেন আপ।
অর কুচ চাইয়ে ? দোকানি আগ্রহ নিয়ে তাকাল মহিমের দিকে।
এক প্যাকেট সিগারেট।
কোনচা ব্র্যান্ড ? দোকানি তার ঘোফের উপর একবার হাত বুলাল।
বেনসন এন্ড হেজেস।
ক্যানের গায়ে বিন্দুবিন্দু বাষ্প জমলে মহিমের হাত ভিজে গেল। সে রুমাল বের করে হাত মুছে নিল। বেনসন এন্ড হেজেসের প্যাকেট বুক পকেটে রেখে জিজ্ঞেস করল, বিল কিতনা হোগি ?
দশ দিরহাম।
দোকানি বারকোড মেসিন চালু করে বিল মিটিয়ে নিল। গ্রোসারি সপ থেকে বেরিয়ে মহিম হাঁটছিল আর মাঝে মাঝে কোল্ড ড্রিংকসে হাল্কা চুমুক দিচ্ছে। কিছুদূর এগোতেই রাস্তাটা ইংরেজি টি অক্ষরের মত ডান ও বাম দিকে মোড় নিয়েছে। সে মোড় পর্যন্ত এসে থামল। এদিকের রাস্তার দুপাশে সারি সারি খেজুরগাছ। সে একটা খেজুর গাছের ছায়াতে দাঁড়িয়ে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে নিল। মহিম দেখল, বাম দিকের রাস্তাতে বেশ কিছু ঘরবাড়ি আছে। ডানের দিকের রাস্তাতে খেজুর বাগান ছাড়া আর কিছু নেই। সে বামের রাস্তা ধরে এগিয়ে এসে একটা বড়ির সামনে দাঁড়াল। না,এই বাড়ি নয়। স্বগতোক্তি করল। সুবর্ণা সেন বলেছিল, তাদের গেটের রঙ নীল। মহিম আরও তিনটি বাড়ি পার হয়ে নীল গেট পেয়ে গেল। সে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, ভেতরে যাবে কিনা। কোথা থেকে একটা ইতস্তত ভাবনা এসে তাকে থামিয়ে দিল।
সুবর্ণার সঙ্গে পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। মাস দুয়েক আগের কথা। আল আইন গিয়েছিল বেড়াতে। অলি জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। সে মহিমকে লোভ দেখিয়েছিল আদিযুগের পুরাকীর্তি দর্শনের। পুরাকীর্তির প্রতি মহিমের আগ্রহ ছিল প্রবল। মহিম আর না করতে পারেনি। অলি ছেলেটা বেশ চটপটে। মহিমের চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট হবে। লেখাপড়ায় বেশি দূর এগোতে পারেনি। হঠাৎ পিতার মৃত্যু হলে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলতে হয় তাকে। তারপর ধারদেনা করে আমিরাতে চলে আসে। বাড়ি ঢাকার মিরপুরে। মহিমদের একই মহল্লা। মহিম ছোটবেলা থেকেই অলিকে চিনত।
আল আইনে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো সমাধি সৌধ দেখে মহিম অভিভূত হয়েছিল। মহিম বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে এসব সৌধের ছবি তুলছিল।হঠাৎ দেখে ডিজিটাল ক্যামারার ফ্রেমে ভেসে ওঠেছে একটি নারীমুখ। চেহারা মিষ্টি। ঘনকালো চুল ওড়ছিল বাতাসে। পাখির ওড়ালের মত ভ্রূ ভঙ্গির নিচে চোখ দুটিকে মনে হল, পাহাড়ের পদতলে শান্ত হয়ে বসে থাকা কাপ্তাই হ্রদ। নারীমুখ বন্দী হয়ে গেল ক্যামেরায়।
মেয়েটির নাম সুবর্ণা। এসেছে মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে। পরিচয় পর্ব শেষে সুবর্ণার মা দিয়েছিল বাসার ঠিকানা । মহিলার চেহারা ছিল দয়ালু দয়ালু। বলেছিলেন-বাসায় এসো। এখানে দেশের লোকজন দেখলে বড় মায়া লাগে। মহিম অনেকবার ভেবেছে, সুবর্ণাদের বাসায় যাবে। কিন্তু তার যাওয়া ঐ ভাবনা পর্যন্ত। সংকোচ আর কাটিয়ে ওঠতে পারেনা। আজ যখন এদিকে আসা হল, ভাবল এক ঢিলে দুই পাখি মারবে।
সুবর্ণাদের দেশের বাড়ি নেত্রকোণা। বাবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। অনেক বছর ধরে আমিরাতে আছেন। সুবর্ণার জন্মও এখানে। নেত্রকোণাতে আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউ নেই। সবাই নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত পার হয়ে ভারত চলে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি। সুবর্ণার বাবা জয়ন্ত সেনদের পরিবার দেশ ছেড়ে যায়নি। জয়ন্ত তখন বিশ বছরের যুবক। নাম লেখাল মুক্তিবাহিনীতে। সসস্ত্র যুদ্ধ করল পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে। আত্মীয়-স্বজন অনেকে পীড়াপিড়ি করেছিল দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য। জয়ন্তর সে এক কথা। মরতে হয় দেশের মাটিতে মরব।
মহিম ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া বেশ গৌরবের ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ছিল শিশু। নইলে সেও দেশকে শত্রু মুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ত। নীল গেটের সামনে এসব ভাবতে ভাবতে মহিম বুঝতে পারে তার দ্বিধা এখনও কাটেনি। সে গেটের উপর বাগানবিলাস ঝাড়টির দিকে তাকিয়ে থাকল এক দৃষ্টিতে। উজ্জ্বল রোদে সাদা ফুলগুলো বেশ সুন্দর লাগছিল তার। না, আজ নয়। আর একদিন আসা যাবে। মহিম ফিরে আসল গ্যারেজে। নূরালী দুহাতের তালু ঘষতে লাগল। মহিম বুঝল এটার অর্থ এবার মালপানি ছাড়।
মহিম যখন ঘরে ফিরে আসল তখন দুপুর বারোটা বাজে। গোসল করা দরকার। বাথরুমে ঢুকে দেখল, টেপের পানি প্রচন্ড গরম। বুঝল এই পানিতে গোসল সম্ভব না। গোসলের জন্য রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন মহিমের হাতে কোন কাজ নেই। অবসরে সে বই পড়ে। টেবিল থেকে বই নিতে গিয়ে সুবর্ণার ছবির দিকে তার দৃষ্টি চলে যায়। সে এখনও বুঝতে পারেনা কেন সে সুবর্ণার ছবিটি বাঁধিয়ে টেবিলে রেখেছে। তবে সুবর্ণার ছবির দিকে তাকালে সে তার হৃদয়ের পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারে। মনে হয় তা হৃদয়ে, নদীতে জোয়ার আসার মত ভাললাগার এক অনন্ত প্রবাহ নিয়ে আসে। মহিম মনের অজান্তেই সুবর্ণার ছবি হাতে তুলে নিল। দৃষ্টিকে আরও গভীর করল সে। ঠোঁটের কোণে সুবর্ণার হাসিকে বুঝতে চেষ্টা করে। মনে হল অবিকল মোনালিসা হাসি। তার উড়ন্ত চুল ঠিক বনলতা সেনের মত। এ চুল তাকে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে মহিম কী দিশা হারিয়ে ফেলছে ? মহিম বিড়বিড় করে ছবির সাথে কথা বলা শুরু করল। এই মেয়ে কী দেখ অমন করে ?
তোমাকে।
মহিম এদিক ওদিক তাকাল। বুঝতে পারল ছবিও কথা বলে। তার কথা বলার আগ্রহ আর একটু বাড়ল।
তুমি দেখতে বনলতা সেনের মত। সেই চুল, সেই মুখের আদল ... , তুমি আমার বনলতা।
তুমি বনলতাকে দেখেছ ?
মহিম অপ্রস্তুত হল। চিন্তাও করেনি সুবর্ণার কাছ থেকে এরকম প্রশ্ন আসবে। এখন কী জবাব দেবে বুঝতে পারেনা। মহিম উত্তর দিল, না দেখিনি। তবে যতবার বনলতা পড়েছি, মনে হত আমি বুঝি জীবনানন্দ।
কবিতা লিখ ?
মহিম ঘোরের মধ্যে বলে ওঠে, না, কখনও লিখিনি। তবে এখন কবি না হয়ে আমার উপায় নেই।
আমি বনলতা নই। আমি সুবর্ণা।
তুমি পূর্বজন্মে বনলতাই ছিলে। হয়ত তোমার মনে নেই।
আমার কিছু মনে নেই।
দ্বিতীয় জন্মে অনেক কিছু মনে থাকে না। আমার সমস্যাটা আরও গুরুতর।
কী রকম ?
তোমাকে নিয়ে যত কবিতা লিখছি, সব বনলতা হয়ে যাচ্ছে।
তাহলে পূর্বজন্মে হয়ত তুমিও জীবনানন্দ ছিলে !
যদি জীবনানন্দ হতাম,কচি নরম ঘাসের বুকে শুয়ে সোনালী ডানার চিলের উড়া দেখতাম কিংবা ধানসিঁড়ি নদীর তীরে শালিক হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। এখানে ধানসিঁড়ি নদীও নেই, সোনালী ডানার চিলও কোথায়? তবে পার্কের নিমগাছে শালিক দেখেছি প্রচুর।
ঐ তো, শালিক মানেই তো জীবনানন্দের ফিরে আসা।
মহিম হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল। এতক্ষণ সে সুবর্ণার ছবির সঙ্গে কথা বলেছে বুঝতে পেরে দ্বিতীয়বার হাসল।
সুবর্ণার কথা ভাবতে ভাবতে জুলাই মাস কেটে গেল। ধীরে ধীরে মহিমের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন হতে লাগল। মাঝে মাঝে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল খুঁজে পায় না সে। আবার কখনও গাড়ির চাবি, কলম খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যায়। একবার তো ট্রাউজারের জিপার লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। লংড্রাইভ, মৎস শিকার সব অনিয়মিত হয়ে গেল। উইক এন্ডে অলি আসে। কিন্তু লংড্রাইভে যাওয়া হয়না আর। দুজনে ঘরে বসে সময় কাটায়। মহিম বলে, লংড্রাইভ ভাললাগছে না অলি। মহিমের পরিবর্তন অলির দৃষ্টিতে আটকে থাকে। অলি বুঝতে পারেনা হঠাৎ মহিম ভাইয়ের কী হল। এমন একটা প্রাণবন্ত মানুষ দিনদিন শামুকের মত গোটিয়ে যাচ্ছে। অলির মস্তিষ্কে একসাথে অনেক ভাবনা এসে ভিড় করে। সবগুলোই দুর্ভাবনা। অলি একটা একটা দুর্ভাবনা বাছাই করে। নাহ, কোনটাই মহিম ভাইয়ের সাথে মিলানো যায় না। আপনার কী শরীর খারাপ ? অলির প্রশ্নে মহিম ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ তুলে তাকাল।
না তো। মহিম আবার ম্যাগাজিনে ডুবে যায়।
আপনাকে ভীষণ অন্যমনস্ক লাগছে। কোন সমস্যায় পড়েছেন?
মহিম ম্যাগাজিন বন্ধ করে টেবিলে পা তুলে দেয়। সোফায় হেলান দিয়ে দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে বলল, না, তেমন কিছু নয়। শরীর ঠিক আছে, ভাবছি মন নিয়ে। মানুষের মন বড় পাগল। এই যে আমার মন আমার কথাই শুনতে চাচ্ছে না। মনের বিদ্রোহ থামানোর চেষ্টা করতেছি।
আপনার কথা বুঝলাম না ? অলি সরাসরি মহিমের মুখের দিকে তাকাল।
অলি সব কথা সবাই বুঝতে পারে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিল মহিম।
তা ঠিক। খুলে বলুন ?
ব্যাপারটা ব্যাক্তিগত। আমি এখন শেয়ার করতে চাচ্ছিনা। সময় হলে জানতে পারবে।
অলি আর কিছু জানতে চায়নি। সে যাওয়ার পর মহিম আরও বেশি একা হয়ে গেল। কোনকিছুতেই তার মনে স্বস্তি ফিরে আসে না। তবে কী শান্তি তার জীবন থেকে চিরতরে উদাও হয়ে গেল ? এসব ভাবতে ভাবতে তার জীবনানন্দের কথা মনে আসে। সে বুঝতে পারেনা কীভাবে বনলতা জীবনানন্দকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল। মহিম আবার সিদ্ধান্ত নেয়, সুবর্ণাদের বাসায় যাবে এবং তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে আসবে। কিন্তু মহিম দেখে তার সামনে হিমালয় সমান এক বাঁধা। সুবর্ণা হিন্দু, মহিম মুসলিম। দুই জাতি দুই ধর্ম। পরক্ষণে মহিম ভুল শুধরে নেয়। না, না, এক জাতি ধর্ম ভিন্ন। তারা উভয়ে বাঙালি একথা ভেবে সে কিছুটা স্বস্তি পেল। তারপর ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ভালোবাসার কাছে ধর্ম সবসময় পরাজিত হয়েছে।
মহিম গাড়িটা এমন ভাবে পার্ক করল, যাতে সুবর্ণাদের ঘর থেকে দেখা না যায়। সে হেঁটে সুবর্ণাদের নীলগেটের সামনে এসে দাঁড়াল। এদিকের এলাকাটা বেশ নির্জন। রাস্তায় লোকজনের চলাচল নেই বললেই চলে। হঠাৎ দ্বিধা ফিরে এল তার মনে। মহিম আবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। তার কেবল মনে হতে লাগল, তার সামনে বিশাল খরস্রোতা নদী। পারাপারের নেই খেয়া। তাকে সাঁতরেই নদী পার হতে হবে। কিন্তু এদিকে তার পা দুটিও যেন মাটিতে গেঁথে আছে। নাড়ানোর বিন্দু পরিমাণ ক্ষমতাও তার নেই। মহিম কী করবে বুঝে উঠতে পারেনা। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না। সিদ্ধান্ত নিল ফিরে যাবে। তখন আবার জীবনানন্দে ফিরে গেল সে। তার মনে পড়ল, “আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে”। মহিম বুঝতে পারল না হঠাৎ এই লাইনটা মনে আসল কেন? তবে কী সে আবার আসবে এখানে? সে কি ধীরে ধীরে কবি হয়ে ওঠছে ? কেন মহিমের বলতে ইচ্ছে করছে- ‘আবার আসিব ফিরে সুবর্ণাদের নীল দরজার ধারে’।
এখন রাত। অন্ধকার ঘরে মহিম একা বসে আছে। সে আজ রাতে বাতি জ্বালাবে না। কারণ অন্ধকারে সে বুঝতে চায় সুবর্ণার চুলের রূপ। জীবনানন্দ কী এরকম অন্ধকারের কথাই বলেছিলেন ? তাহলে বনলতা ও সুবর্ণার মধ্যে পার্থক্য কই ? কেবল সময়ের ব্যবধান দুজনকে আলাদা করেছে। কিন্তু মহিম তো অন্ধকার চায় না। তবুও সে দেখে তার চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। মহিম বুঝতে পারে এই অন্ধকার আছে বলেই তার হৃদয় আলোর প্রত্যাশা করে।
কী ভাবছো ? অন্ধকারে কে যেন কথা বলে উঠল। মহিম অবাক হল। ঘরে তো সুবর্ণার ছবি ছাড়া অন্য কেউ নেই। ছবি কথা বলে কথাটা আবার মনে পড়ল তার।
ভাবছি সুবর্ণা সেনের কথা। আমি কোন পথের দিশা খোঁজে পাচ্ছিনা। মহিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আলো জ্বালাও। নচেৎ অন্ধকারে তুমি দিক হারাবে।
না। আমাকে বুঝতে দাও কেন মানুষ আলোর প্রত্যাশা করে।
কিছু বুঝলে?
এখনও অন্ধকারের ঘোর কাটেনি।
বলেছিলাম না তুমি জীবনানন্দ। কবিতার কী হল ?
যা কিছু লিখি সব এলোমেলো পঙতি। গতরাতে লিখলাম,
‘’হাজার বছর ধরে,
খুঁজিতেছি বঙ্গোপসাগর থেকে
ধূসর মরু নগরে’
কোথায় সুবর্ণা সেন?”
তারপর পছন্দ মত আর লাইন পাচ্ছি না।
এ তো জীবনানন্দ হয়ে গেল। আকাশের ওপর আরও আকাশে, খোঁজে দেখ, হয়ত আমাকে পাবে।
হঠাৎ মহিমের ঘোর কেটে গেল। সে বুঝতে পারল, এতক্ষণ সে সুবর্ণার ছবির সামনে বিড়বিড় করছে। নির্ঘাত পাগল হয়ে যাওয়ার লক্ষণ। মহিম এখন কী করবে। অলির সাহায্য চাইবে ? কিন্তু মনের সায় মিলছে না। সে আবার নিজেকে তৈরি করে। মনকে আরও দৃঢ় করে। এবার তাকে সফল হতেই হবে। সে সুবর্ণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবে, আমিই তোমার জীবনানন্দ।
আজ মহিমের মনে হল হঠাৎ তাপমাত্রা কমেছে। বিকেলের সূর্য যেন আরও নরম হয়ে এল। খেজুরের মওসুম। গাছে গাছে কাঁচাপাকা খেজুর দেখে তার পোয়াতি নারীদের কথাই মনে আসে। সে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করল গাছে গাছে পাখিদের আগ্রাসন।পাখিরা যতটা না খায়, তার চেয়ে নষ্ট করে বেশি। মহিমের মনে হল পাখি জীবন বড় আনন্দের। যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারে। ভিসা, পাসপোর্ট কিছুই লাগেনা।এমন কি ইমিগ্রেশনের ঝামেলাও পোহাতে হয় না। জীবনানন্দ কেন দ্বিতীয় জন্মে পাখি হতে চেয়েছিলেন, সে কথা ভাবতে ভাবতে মহিম অনেক পথ পার হয়ে এল। পথ যেন আর ফুরোতে চায়না। মনে হচ্ছে সে হাজার বছর ধরে হাঁটছে। আজ তার ক্লান্তিও লাগছেনা। অনেকদিন পর আজ আকাশে মেঘও দেখল সে। আরবসাগর থেকে একখণ্ড মেঘ ওড়ে এসে জমাট বেঁধে আছে।সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে।দিবসের বিদায়ের বিষণ্ণ সুর তুলে পারশ্য উপসাগরের পানি ছুঁই ছুঁই করছে। বাতাসও যেন ডেকে আনছে সন্ধ্যার অন্ধকার। ঠিক এরকম মুহূর্তে মহিম পৌঁছে গেল সুবর্ণাদের নীল গেটের সামনে। হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেল পাশের খেজুর বাগানের দিকে। দেখল, সুবর্ণা এক যুবকের হাত ধরে বাগানে ঢুকে যাচ্ছে।
মহিম হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল। বুঝতে পারল সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। তার আবার জীবনানন্দের কথা মনে পড়ল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, দাঁড়াও সুবর্ণা, তুমি যেয়ো নাকো অই যুবকের সাথে।
©somewhere in net ltd.
১|
১০ ই মে, ২০১৪ রাত ৯:৫৪
আসোয়াদ লোদি বলেছেন: গল্প টি দুই বছর আগের লিখা । ব্লগে প্রথম প্রকাশ হল । প্রবাস জীবনের নিঃসঙ্গতা থেকে এই গল্পের জন্ম । গল্পের চরিত্রগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক ।