নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বসে আছি অন্ধকারে, \nআমাকে বুঝতে দাও \nমানুষ কেন আলোর \nপ্রত্যাশা করে!

আসোয়াদ লোদি

জীবন ও যন্ত্রণার মরুচরে আমি প্রপাতের ধারা ।

আসোয়াদ লোদি › বিস্তারিত পোস্টঃ

অবরুদ্ধ আকাশ ।। পর্ব- ৩

২৭ শে মে, ২০১৪ রাত ৯:১২



১ পর্বের লিঙ্ক- Click This Link
২ পর্বের লিঙ্ক- Click This Link

২য় পর্বের পরের অংশ

সেগুন বাগিচায় মেহনতি জনতা পার্টির অফিসের সামনে এসে সজল রিক্সা থেকে নামল। সে যতবার পার্টি অফিসে আসে, অফিসে প্রবেশ করার আগে একবার মাথা কাত করে সাইনবোর্ডের দিকে তাকায়। আজো তাকাল। সাইনবোর্ডে আঁকা মুষ্টিবদ্ধ হাতুড়ির ছবিটি তাকে বেশ আকর্ষণ করে। তার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, এই হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে। কিন্তু সে একা কিবা করতে পারে। সব কাজে চাই জনগণের সম্পৃক্ততা। জনগণ জেগে না উঠলে কোনকিছুই সম্ভব নয়।

আজকের মিটিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মহসিন ভাই বললেন। সজলকে দেখে ইশায় বললেন, বসে যাও। সজল লক্ষ্য করল, নেতা-কর্মীদের চোখেমুখে চাপা আতংক। মহসিন ভাই বলতে শুরু করলেন। গতরাতে চট্টগ্রামে পোস্টারিং করতে গিয়ে আমাদের দুইজন কর্মী এরেস্ট হয়েছে। প্রথমে আমি তাদের মুক্তির জন্য স্বৈরাচার সরকারের কাছে জোরালো দাবী জানাচ্ছি। আবার নতুন করে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। শুনতে পাচ্ছি সামরিক জান্তা রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করবে। যদি এরকম কিছু হয় আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করতে হবে। কিছুতেই আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। সবাই চেষ্টা করবে গ্রেপ্তার এড়িয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যেতে। ঢাকা ভার্সিটির আজকের ঘটনা তো সবাই জান। পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়েছে। সঠিক সংখ্যাটা বলা যাচ্ছে না। পুলিশ লাশ গুম করেছে। ভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিবাদে ছাত্ররা আগামিকাল দেশব্যাপি হরতাল ডেকেছে। আমরা পার্টির পক্ষ থেকে হরতালে নৈতিক সমর্থন দিয়েছি। আমাদের রাজনীতি মেহনতি মানুষের জন্য। আওয়ামীলীগ-বিএনপি বুর্জোয়া সংগঠন। একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আমরা তাদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব। যদি রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা আসে, প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় চলে যাবে। তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করবে। তৃণমূল হচ্ছে বিপ্লবের আসল শক্তি। মহসিন বক্তৃতা বন্ধ করলেন। বোতল থেকে গেলাসে পানি ঢেলে পানি খেলেন।

সজল অফিসে টাঙ্গানো কার্ল মার্কসের ছবির দিকে একবার তাকাল। বোঝতে পারল সুজানগর তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আগামি দিনগুলোতে সুজানগর যাওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরির সম্ভাবনা সে দেখতে পাচ্ছে। এখন শুধু দুইয়ে দুইয়ে চার হওয়ার অপেক্ষায় তাকে থাকতে হবে।

মহসিন সজলের দিকে তাকালেন। সজল তোমার পোস্টারের খবর কী ?
আমি আসার পথে প্রেসে গিয়েছিলাম। ওরা বলল, কালরাতে ডেলিভারী দিতে পারবে।
ভেরিগুড ! তোমার দায়িত্ব হল প্রত্যেক জেলাতে পোস্টার পাঠানোর ব্যবস্থা করা। আর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্দেশ দেবে, যাতে থানা লেভেলে পোস্টার পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
ঠিক আছে মহসিন ভাই। সজল মাথা নাড়ল।

মহসিন এনায়েতের দিকে ফিরে বলল, ঢাকা সিটির দায়িত্ব তোমার। রাতের মধ্যে পোস্টারিং শেষ করবে। আর মিছিলের দায়িত্ব থাকল মনিরের উপর। স্বৈরাচারের পতনের দাবীতে কাল পার্টি অফিস থেকে মিছিল হবে সকাল দশটায়।

পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে সজল প্রেসক্লাবের সামনে এসে দাঁড়াল। উত্তরা যাওয়ার বাসের জন্য অপেক্ষা করছে সে। বাদল উত্তরায় থাকে। সজলের বাল্যবন্ধু। আশুলিয়াতে তার বেশ বড় খামার আছে। সজল ভাবল খামার সম্পর্কে বাদলের কাছ থেকে কিছু আইডিয়া নেবে। আর বাদলের খামারটাও দেখে আসবে।
ঢাকার টাউন সার্ভিস বাসগুলোতে সবসময় ভীড় থাকে। বসা তো দূরের কথা অনেক সময় দাঁড়ানোর জায়গাও হয়না। সজল ইতিমধ্যে দুইটা বাসে চেষ্টা করেও উঠতে পারল না। সে লক্ষ্য করল, তোপখানা রোড দিয়ে বিরাট মিছিল প্রেসক্লাবের দিকে এগিয়ে আসছে। মিছিল বাইতুল মোকাররামের কাছাকাছি পৌছতেই পুলিশ এ্যাকশন শুরু করল। টিয়ার গ্যাস, জলকামান, লাঠিচার্জ করাতে পুরো এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারে ছুটতে লাগল। অনেকে রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। সজল লক্ষ করল, একজন পুলিশ এক কিশোরকে পা দিয়ে রাস্তার উপর চেপে রেখেছে, অপর পুলিশ লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিঠাচ্ছে। টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় ধূসর বাতাসের মধ্যে জনতার আর্তনাদ ও দোকানের শাটার নামানোর শব্দ একাকার হয়ে গেল। দুয়েকটা ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও শুনতে পেল সজল। রাস্তার চলন্ত গাড়িগুলো দেখে মনে হল, প্রাণ ভয়ে এরাও নির্দিষ্ট দূরত্বে সরে যাচ্ছে। ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুটিতে অনেক গাড়ির কাঁচ ভাঙ্গা টুকরো পড়ে থাকল রাস্তার উপর। মানুষের স্যান্ডেল ও ইট পাটকেলের ছড়াছড়ি ছাড়া রাস্তায় আর কিছু নজরে আসছে না। মুহূর্তে পুরো এলাকা ফাঁকা ও থমথমে হয়ে গেল। সজল বোঝতে পারল এখন উত্তরা যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। সজল সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না এখন কি করবে।

মণিকা এসেছিল বায়তুল মোকাররম মার্কেটে। কাল তার এক বান্ধবীর বিয়ে। মণিকা দামী কিছু প্রেজেন্ট করার কথা চিন্তা করে, একটা স্বর্ণের রিং নিল। 'ওয়্যার এন্ড পিস' বইটা পড়া হয় নি, অনেকদিন ধরে ভাবছিল বইটা কিনবে, কিন্তু মনে থাকে না। আজ কিনে ফেলল। বাসায় যাওয়ার পথে প্রেস ক্লাবের সমানে সজলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মণিকা রিক্সা থামাল। ডাক দিল, সজল !

সজল বিনা বাক্য ব্যয়ে রিক্সায় মণিকার পাশে বসল। বলল, এই পরিস্থিতিতে তুমি এখানে কী করছ ? বায়তুল মোকাররম এসেছিলাম। যা একটা যুদ্ধ দেখলাম, ভাবা যায় না। আমার খুব টেনশন হয়, বিশেষ করে তোমার জন্যে। আমি তো বলতে পারি না রাজনীতি ছেড়ে দাও। রাজনীতিকে আমার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে রেখেছ।
সজল ঘাড় বাঁকা করে মণিকার দিকে তাকাল। কিছু বলল না। ইদানিং ঢাকার আকাশে কোথা থেকে যেন খন্ড খন্ড মেঘ এসে জমাট বেঁধে থাকে। সহজে সরে যেতে চায় না। বিশাল আকাশে এই ক্ষুদ্র মেঘের অবরোধে অবাক হয়ে যায় সজল। তার মাঝে মাঝে মনে হয় মণিকার মুখ যেন ঢাকার আকাশ, সেখানে পড়েছে সেই মেঘের ছায়া।
মণিকা আবার বলতে শুরু করল, একবার ভেবেছিলাম তোমার পার্টি অফিসের দিকে যাব। কিন্তু তোমাকে এত কাছাকছি পেয়ে যাব ভাবিনি। তুমি তো ভ্রাম্যমান নেতা। এক জায়গায় থাক না।

সজল মৃদুকণ্ঠে বলল, কেমন আছো ?

তার মনে হল মণিকা শুনতে পায় নি। মণিকা আড়চোখে তাকাল সজলের দিকে, কোন জবাব দিল না।
মণিকার চোখের ভাষা সজলের জানা। ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে সে এভাবেই মনের গোপন অভিমান প্রকাশ করত। অনেক সময় বোঝাই যেত না সে অভিমান করে আছে। কলাভবনের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মণিকাকে বসিয়ে রাখত সজল। তারপর এসে বলত, সরি, একটু দেরি হয়ে গেছে। তখন মণিকা এভাবে তাকাত। মুখফুটে কোন অভিযোগ কখনও করে নি মণিকা। সজলের সব অন্যায় কখনও হাসিমুখে কখনও নিরবে মেনে নিত। মাঝে মাঝে সজলের নিজেকে খুব অপরাধী মনে হত এবং ভাবত সে কোনদিন মণিকাকে কষ্ট দেবে না। কিন্তু মণিকা কষ্ট পেয়ে যায়, সজল বোঝতেও পারে না।

সজল মণিকার হাত মুঠোয় নিয়ে হাল্কা চাপ দিয়ে বলল, কোথায় যাবে ?

মণিকা আকাশের দিকে তাকাল। সেও দেখতে পায় ঢাকার আকাশে প্রচুর মেঘ, কালো কালো মেঘ পাহাড়ের মত স্থির হয়ে আছে। নিষ্প্রাণ। তার মনে যে ছায়া পড়েছে তা যেন স্থায়ী হতে শুরু করেছে। মণিকা জানেনা এই মেঘ কবে কেটে যাবে। গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,আমার কোন গন্তব্য নেই।
একদিন তুমি বলেছিলে, আমি তোমার পৃথিবী। পৃথিবীর গন্তব্য কোথায় আমি জানি না।

রিক্সা তখন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। সজল রিক্সাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল, রমনা পার্ক চল।
সে তখনও মণিকার হাত ধরে আছে। মণিকা ভাবছে সজল যেন তাকে সারাজীবন এভাবে ধরে রাখে। সজলের স্পর্শ মণিকার ভাল লাগছে। তার শিরায় শিরায় নদীর মত স্রোত বয়ে যায়। সে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল সজলের পাশে। বাতাসে মণিকার চুল বারবার মুখের উপর ছড়িয়ে পড়ছিল। কখনও সজলের গালে এসে পড়লে তার সুড়সুড়ির মত একটা অনুভূতি হচ্ছে।

রমনা পার্কে তারা লেকের পারে বকুলগাছ তলাটা বেছে নিল। এখানে বসলে লেকের পানিতে নিজেদের ছায়া দেখা যায়। সজল লেকের পানিতে ছোট একটা ঢিল ছুড়ে দিল। এখন তাদের ছায়া পানির মৃদু তরঙ্গে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে। সজল সেদিকে তাকিয়ে রইল।

মণিকা তাকিয়ে আছে সজলের দিকে। সজল কেন যে তাকে এত দুর্বল করে দিয়েছে বুঝতে পারেনা। শুধু এই মানুষটির জন্য সে এখনও পরিবারের চাপে ভেঙ্গে পড়েনি। সজল চোখের আড়াল হলেই মনে হয় কি যেন হারিয়ে ফেলেছে। মণিকা দূর আকাশের দিকে তাকায়। দেখে জমাট বাঁধা সেই কালো মেঘ আবার ফিরে এসেছে। তার মনের ভেতর শিমের বিচির মত একটা শংকা দানা বাঁধতে থাকে। মণিকা বুঝতে পারে সেই বীজ ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠবে। তারপর চোখ মেলার মত মেলে দেবে প্রথম দুটি পাতা। এরকম অনাগত উৎকণ্ঠা নিয়ে মণিকার দিন কেটে যাচ্ছে। যদি সে সজলকে হারিয়ে ফেলে তার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে সে বলল, প্রেস ক্লাবের সামনে দড়িয়েছিলে কেন ? জান না আবার ধরপাকড় শুরু হয়েছে ?
সজল তার দৃষ্টি ঘুরাল মণিকার দিকে। উত্তরা যাব চিন্তা করে বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম।
পার্টির কাজে ?
না, বাদলের ওখানে।
আমি অনেক আগে একবার গিয়েছিলাম। এরমধ্যে আর যোগাযোগ নেই। তনিমা খুব সুন্দরভাবে সংসার সাজিয়ে নিয়েছে। মনে হল ওরা খুব সুখি।

সজল বুঝতে পারে মণিকার মনের কথা। সে চাচ্ছে সজল একটা সিদ্ধান্তে আসুক। কিন্তু মুখফুটে কোনদিন বলবে না।
মণিকা আমি জানি তুমি পরিবারের চাপের মধ্যে আছ। কিন্তু আমি এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে স্থির হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগই পাচ্ছিনা। বাবা রিটায়ার্ড করেছে, আমার সুনির্দিষ্ট কোন কাজ নেই, হৃদয়ে ধারন করেছি রাজনীতি, চাই সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, মেহনতি মানুষের মুক্তি, কেবল দেখি একটি বিপ্লবের স্বপ্ন।

মণিকা হাঁটু ভাঁজ করে বুকের কাছে নিয়ে এল। দুই বাহু হাঁটুর উপর রেখে সজলের দিকে তাকাল। দেখ, স্বপ্ন আমিও দেখি। তবে তোমার মত এত বিরাট স্বপ্ন দেখি না। আমার স্বপ্ন ছোট্ট একটি ঘর, মোটা চালের ভাত, পরনে ঢাকাই শাড়ি।

সজল চুপ করে থাকে। মণিকাকে আশ্বস্ত করার মত কোন বাণী তার কাছে নেই। কিছু কিছু মুহূর্ত আছে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। এখন সজলের নিজেকে সেরকম অসহায় মনে হচ্ছে। এদিকে পার্কে লোকজনের ভিড় কমতে শুরু করেছে। রোঁদ মিলিয়ে গেছে আকাশে। অন্ধকার এসে লেকের জল থেকে মুছে দিল সজল ও মণিকার ছায়া। তারা দুইজন কালো জলের দিকে তাকিয়ে আছে তখনও।


(চলবে .........)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.