নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প - মাঝারি মাপের সুখ-দুঃখ

১২ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৪

১।
স্নায়ু এবং রক্তের চলাচল প্রায় শুন্যের কাছাকাছি নামিয়ে এনে মাজেদ তাকিয়ে আছে বেঢপ টিকটিকিটার দিকে। মাজেদ যোগসাধনার অভ্যাস নেই। সে তন্ত্রমন্ত্রও জানেনা। তবুও তার স্নায়ু এবং রক্তপ্রবাহের ওপর তাকে নিয়ন্ত্রন আনতেই হয়, কেননা, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ইঙ্গিত দেয় নড়াচড়া করলেই বিপদ আসন্ন।

লম্বায় এক বিঘতেরও বেশী সরীসৃপটি কালো পুঁতির মত কুতকুতে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এলো কোত্থেকে এই যন্ত্রণা এসময়ে, এখানে? সারাদিনের ধকল পার করে রাত দেড়টার সময় মাজেদ ঢুকেছে গোসল করতে। সারা শরীরে দলাই মলাই করে সাবান মাখার পর গোসলখানা কাম পায়খানার এই একচিলতে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা মাজেদ শিস বাজিয়ে মাত্রই গায়ে পানি ঢালার এন্তেজাম করছিল – এমন সময়ে এই মাতারি টিকটিকির আবির্ভাব। নিঃশ্বাস বন্ধ করে মাজেদ পুনরায় কানিয়ে কানিয়ে তাকায়, দেখে গোসলখানার দেয়ালের ওপরদিকে এককোনে যে ঘুলঘুলির মতন ছোট্ট জানালা – তার কাঁচ সে গোসল করতে ঢুকবার সময়ই যত্ন করে টেনে বন্ধ করে দিয়েছে। এটাই টিকটিকিটার গোসলখানার ছোট্ট পরিসরে চরকির মত পাক খাবার কারণ। বাইরের কোন গাছের ডালে ঝুল খেয়ে এই ঘুলঘুলি দিয়েই ঢুকেছিল প্রাণীটা ভেতরে, কিন্তু এখন আর বের হতে পারছে না। এদিকে সেদিকে খানিকক্ষণ বেদিশের মত দৌড়াদৌড়ি করে টিকটিকিটা এবার মাজেদের সম্মুখের দেয়াল বেয়ে উঠে আসে। মাজেদেরর ঠিক নাক বরাবর দেড় হাত দূরে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে। ফলে মাজেদের সুযোগ হয় টিকটিকির পুরো শরীরের ওপর চোখ বোলাবার।

খাঁজকাটা লেজ, বেশ মোটা এবং লম্বা। লেজের পেছনে, ওর পাছার দিকটা থেকে নিয়ে পুরোটা পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। ডিম আছে সম্ভবত ওতে। গলা থেকে নিয়ে মাথা পর্যন্ত পুরো একটা বাচ্চা ড্রাগনের সংস্করণ। ছোট কালো পুঁতির মত চোখ দুটি মাজেদের কাছে কোঁদালে চোখ মনে হয়। সরসর করে বার কয়েক সরু সুতোর মত জিভ বের করে প্রাণীটা। ওর মাড়ির মধ্যে দাঁতগুলো কেমন হবে? ছেলেবেলায় দেখা অ্যানাকোন্ডা মুভির কথা মনে পড়ে মাজেদের। সেই সাপের চোয়ালজুড়ে যেই সরু কিন্তু ভয়াবহ ধারালো এবং তীক্ষ্ণ দাঁতের মত দাঁত কি এই টিকটিকিরও আছে? শত হলেও, সেই সরীসৃপেরই তো জাত ভাই।

মাজেদের গা গুলিয়ে ওঠে। হারামজাদা টিকটিকিটা কি চাইলে এখন লাফিয়ে উঠে মাজেদের নাক কামড়ে ধরতে পারবে? আর চিন্তা করতে মন চায় না! সারা শরীরে সাবান মাখানো- এই মুহূর্তে লাফালাফি করতে গেলে পিছলে পড়ে মাজাভাঙ্গার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। মাজেদ করুণ স্বরে দু-চারবার হুসহুস শব্দ বের করে মুখ দিয়ে। আশা করে, এতে টিকটিকিটা ভয় পেয়ে পালাবে। কিন্তু টিকটিকিটা নড়ে না একচুলও। মাজেদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে টিকটিকিটার দিকে।

এইভাবে, কোন শব্দ বা শক্তির অপচয় ছাড়া মিনিট পাঁচেক কাটবার পর, , মাজেদের অসহায়ত্ব ক্রমশ বিরক্তিতে পরিণত হয়। সেই বিরক্তি থেকে ঘৃণা এবং ঘৃণা থেকে ক্রোধ সঞ্চার হতে সময় নেয় না। মাজেদ অ্যাথলেটিক দক্ষতায় তার বাম পায়ের রাবারের স্পঞ্জ খুলে ডান হাতে নেয়। লক্ষ স্থির করে। একটি মাত্র আঘাতে কদাকার টিকটিকিটাকে কুচলে দিতে হবে দেয়ালের গায়। মাজেদ খুব সাবধানে শক্ত করে জুতো ধরে রাখা তার ডানহাত উঁচু করে।

ঠিক এই মুহূর্তটায়, মাজেদ জানে না কেন, তার শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের শীতল এক স্রোত প্রবাহিত হয়। মাজেদের মনে হয়, এই বাথরুমের ছোট পরিসর ভেদ করে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে... এমন করেই... খুব বিশাল আকৃতির... কেউ বা কিছু... ওকে... কুঁচলে...

২।
“এই গুলিস্তান- বঙ্গ- গোলাপশাহ মাজার – সদরঘাট! এই গুলিস্তান- বঙ্গ- গোলাপশাহ মাজার- সদরঘাট! সিটিং সার্ভিস - সিটিং সার্ভিস!”

বাসের হেলপারের ক্রমাগত গেট চাপড়ানো আর চিৎকারে মাজেদের ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে শূন্যদৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। আশেপাশে সারিসারি যানবাহন, যানবাহন পেরিয়ে ফুটপাথ, ফুটপাথে মানুষের ভিড়, ভিড়ের মাঝে ঠায় একাকী দাঁড়িয়ে থাকা একটি ল্যাম্পপোস্ট, ল্যাম্পপোস্টের পেছনে উঁচুউঁচু দালান, দালানের গায়ে রংবেরঙের পোস্টার আর চিকা সাঁটা। বাসটি এখন দাঁড়িয়ে কোথায়? মাজেদ ঠাহর করে উঠতে পারে না। মনোযোগ দেয় দেয়ালের গায়ের রংবেরঙের পোস্টারগুলোতে।

“ইউনানি বিধান মতে সমস্ত গোপন রোগের ১০০ ভাগ হালাল চিকিৎসা” – বড়বড় করে পোস্টারের শিরোনামে লেখা। এরপর , গোপন রোগগুলো কি ধরণের হতে পারে, পুং জননেন্দ্রিয় কর্মক্ষম রাখতে যে এতশত কারসাজী আর কেরদানির প্রয়োজন হতে পারে, এই পোস্টারগুলো খুঁটিয়ে না দেখলে তা বোঝা সম্ভব হত না কখনো। পোস্টারে একজন সুঠামদেহি সুপুরুষের উদোম শরীরের ছবি সাঁটা। মাজেদ চেনে তাকে। বলিউডের লেজেন্ড সালমান খান। চোখে একটা সানগ্লাস। উঠে আসছেন তিনি সমুদ্রের মধ্য থেকে। আচ্ছা, শরীরচর্চা তো এখন বলিউডের চ্যাংড়া প্যাংড়া সব নায়কেরাও করে- তবে ইউনানি বিধান মতে গোপন রোগের চিকিৎসার পোস্টারগুলোতে সবসময় সালমান খানের ছবিই কেন দেয়া থাকে? মাজেদ সালমান খানের সাথে ইউনানি চিকিৎসার অন্তর্নিহিত সম্পর্কটা ধরার চেষ্টা করে। বিশ্বসুন্দরীদের ডেট করেছে বলে সালমানের ইউনানি ঔষধ সেবা লাগে? নাআআআহ! তবে? আচ্ছা আচ্ছা, সে বিশালমাপের তারকা হওয়া সত্যেও তার প্রেমিকারা টাকে ছেড়ে চলে যায়। আর চলে যায় বলেই তার ইউনানি চিকিৎসা দরকার! এই কারনেই পোস্টারে তার উদোম ছবি সাঁটা যে- শুধু শরীরচর্চা করলেই হবে না, করতে হবে যৌবনচর্চাও। পোস্টারের নীচে আরও লেখা –“উত্তরাবাসীদের জন্যে সুখবর! বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসালয় এবং ঔষধী সেবা এখন উত্তরাতেও!” উত্তরাবাসিদের সৌভাগ্যে মাজেদের আনন্দ হয় না। সে পুনরায় ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে।

বাস দাঁড়িয়ে আছে সিগন্যালে। একদম সামনের সারিতে। এইরকম সামনের সারিতে এসে আটকা পড়ার মানে কি? ড্রাইভার ব্যাটা তো এক নম্বরের বোকচোদ! পেছন থেকে রিকশাও কাটিয়ে চলে যাবে এই বাস, তবুও শালার হুঁশ হবে না। সুন্দর মত সেই রিকশাকেও সাইড দিয়ে নিজে সিগন্যালে আটকা পড়বে। অথবা,হতে পারে বাসে আরও বেশী প্যাসেঞ্জার তোলার এটা একটা কৌশল। মুখে বলে সিটিং সার্ভিস, কিন্তু এরই মধ্যে বাসে দাঁড়িয়ে আছে দুই প্যাসেঞ্জার। সিট নেই জেনেও হেলপার নীচে দাঁড়িয়ে আরও প্যাসেঞ্জার ঠেলে ভরার চেষ্টা করছে বাসে। এই বাসওয়ালাদের মত বড় হারামি আর হয় না। মুখে সুন্দর করে বলে সিটিং সার্ভিস, ভাড়াও নেয় সিটিং সার্ভিসেরই কিন্তু ঠেলে যাত্রী ওঠাবে সিটের ডবল। আসুক একবার কনডাক্টর এদিকে, লোকাল বাসের ভাড়া দেবে বলে মনে মনে ঠিক করে মাজেদ। এর এক পয়সাও বেশী দেবে না।

তবে বাসটা আটকা পড়লো কোথায়? মাজেদ আবার জানালা দিয়ে মাথা বের করে বোঝার চেষ্টা করে। সামনের মোড় হতে সবুজ রঙের একটা স্বকল্প বাস বেরিয়ে আসে, পেছনে পেছনে একটি ছয় নম্বর বাস। দুটো বাসই একই রকম লোকে ঠাসা। বাংলাদেশে লোকাল বাস আর কাউনটার বাসে পার্থক্য রইল না।

জায়গাটা বাংলামোটর। কিছুক্ষনের মধ্যেই সিগন্যাল ছেড়ে দিলে বাসের ইঞ্জিন গমগম করে ওঠে। এতক্ষণ ধরে প্রথম সারিতে আটকা পড়ে থাকার কষ্ট লাঘব করতেই মনে হয় বাসটি ঝটকা মেরে অন্যান্য সব বাস- প্রাইভেট কার-সিএনজি পেছনে ফেলে বেরিয়ে আসে। শেরাটন হয়ে পিজি বারডেমের রাস্তাটা মোটামুটি খালি। জানালা দিয়ে বাতাস প্রবেশ করতেই মাজেদ একটু নড়েচড়ে বসে জায়গা করে নেবার চেষ্টা করে। জানালার পাশে বসেছে শ্যামবর্ণের বিশালবপু এক লোক। নিজের সিটতো বটেই, মাজেদের সিটেরও অর্ধেক দখল করে পশ্চাৎপদেশ স্থাপন করে রেখেছে সে। ফার্মগেটে বাসে ওঠার পর মাজেদ এই সিটটা খালি দেখে পাশে এসে দাঁড়াতে লোকটা ভ্রূক্ষেপও করলো না। পরে , মাজেদ সরে বসার অনুরোধ করলে সে নিতান্ত দয়া বশবর্তী হয়েই যেন একটুখানিক জায়গা ছেড়ে দিল মাজেদকে, যেন সে কোনক্রমে বসতে পারে। চেপেচুপে বসার পর মাজেদ তাকে জানালার দিকে আরও একটু সরে বসতে অনুরোধ করতেই সে এমনভাবে কটমট করে তাকালো মাজেদের দিকে যে মাজেদ আর কথা বাড়াবার সাহস পায় নি।

এরই মধ্যে সে কিভাবে কিভাবে যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। রোজার মাস চলছে। জুনমাসের আকাশে গনগনে রোদের রাজত্ব। রাতে তার ঘুম আসে না। সেহরি খেয়ে একসাথেই ঘুমায় সে। আজও ঘুমিয়েছে সেহরি খেয়েই, কিন্তু সকাল সকাল ব্যাঙ্কে যাবার জন্যে বের হতে গিয়ে আজকের ঘুমটা আর জুত মত হয় নি। যাক, খুব বেশী সময় লাগে নি সব মিলিয়ে। বেলা দু’টা নাগাদ সদরঘাটের বাস ধরতে পেরেছে সে।

-“এই পিজি বারডেম শাহবাগ – নামবেন যারা গেটের দিকে আহেন!” - বাসের গেট থেকে হেলপারের ভেসে আসা চিৎকারে নড়েচড়ে ওঠে মাজেদের পাশে আটার বস্তার মত গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা লোকটি। মাজেদ সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দেবার চেষ্টা করতেই বোঝে যে বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। মোটা লোকটাকে উঠে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দেয়া উচিৎ ছিল। লোকটা মাজেদকে সিটের সাথে একদম পিষে দিয়ে বের হয় যায়। মাজেদ ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে দেখে, গেট পর্যন্ত যেতে লোকটা বহুজনকেই ধাক্কা-গুঁতো দেয় এবং প্রত্যেকেই লোকটাকে কিছু না কিছু গালমন্দ করলে মাজেদ দুঃখের মাঝে সান্ত্বনার প্রলেপ পায়। মাজেদ সরে এসে জানালার পাশে বসে। এরই মধ্যে আরেকজন লোক মাজেদের পাশের সিটে এসে বসতে চাইলে মাজেদ যথেষ্ট পরিমাণ ভেতরে চেপে গিয়ে লোকটাকে জায়গা করে দিয়ে মনে মনে বেশ প্রশান্তি লাভ করে। ঐ সমস্ত ইতর ছোটলোকদের মত সে নয় – যারা একবার বাসের জানালার পাশের সিটের দখল পেলে পুরো সিটটাই নিজের বাপদাদার সম্পত্তি মনে করে পাশের যাত্রীর সিটেরও অর্ধেক দখল করে বসে থাকে। এইসব ভাবতে ভাবতে বেশ মাঝারিমাপের একপশলা সুখ তার মনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

বাস শাহবাগ ছেড়ে ঢাকা ক্লাব অতিক্রম করতেই দমকা গরম বাতাস এসে ঝাপটা দেয় মাজেদের মুখে। শালার রোদটাও পড়ছে একদম মুখ বরাবর। মাজেদ জানালা বন্ধ করে না। রোদ সরাসরি এসে লাগছে লাগুক। পুড়লো না হয় খানিকটা চেহারা। চেহারা দিয়ে আর কি হবে? সে তো সিনেমায় নাম লেখাতে যাচ্ছে না। রোদের আঁচে সেদ্ধ হতে হতে বাতাসের যে ঝাপটাটুকু লাগবে মুখে – তাই তার লাভ। জ্যৈষ্ঠের দুপুরের ভাপে সেদ্ধ হওয়া গরম বাতাস বুক ভরে টেনে নেয় মাজেদ। নাক দিয়ে শব্দ করে সে নিঃশ্বাস ছাড়ে। হায়রে বাতাস! চামড়া ছোঁয়, তবে অন্তর ছুঁতে পারে না। মনে তার অন্য এক কষ্ট দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে ভেতরটা বারেবারে। ডানহাত দিয়ে পকেট থাবড়ে একবার অনুভব করে নেয় সে তার মানিব্যাগের উপস্থিতি। ওতে খুচরো কিছু টাকা ছাড়াও আছে পাঁচশো টাকার তিনটি নোট। অনেক খুশী মনে বাড়ি ফেরার কথা ছিল মাজেদের। প্ল্যান প্রোগ্রাম সব প্রস্তুতই ছিল। কিন্তু অসময়ের সমস্যা সবকিছু একদম ভণ্ডুল করে দিয়ে চলে গেল।

বাবার পেনশনের টাকা তুলবার পর গিয়েছিল সে ফার্মগেট তেজতুরি বাজারে। ওখানে একই গলিতে দুটো বাসায় ইংরেজি টিউশনি করিয়ে সে মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা পায়। এক ফ্যামিলিতে ক্লাস ফোরের একটি ছেলে, অপর ফ্যামিলিতে ক্লাস টু ও থ্রি এর দুই পিঠাপিঠি ভাই। রমজান মাসে ঈদের আগে শেষ পড়ানো ছিল আজ। হিসেবে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনও আজই পকেটে আসতো। প্রথম বাসায় পড়িয়ে দেড় হাজার টাকা নিয়ে বের হয়ে দ্বিতীয় বাসায় গিয়ে দেখে গেটে বিশাল তালা ঝোলানো। পরে দারোয়ানের কাছ থেকে শোনে, তারা পুরো পরিবার মিলে বাড়িতে চলে গ্যাছে ঈদ করতে! মাজেদ বাকহারা হয়ে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে দারোয়ানের মুখের দিকে কিছুক্ষণ। বাড়ি চলে যাবে ঈদ করতে একদম না জানিয়ে? তার বেতন না দিয়েই? একবার বলে তো যেতে পারতো! ছোট দুটো ভাই আর বাবা মাকে সামান্য উপহার দেবার যে আয়োজন সে মনেমনে করেছিল – তা আর করতো না তাহলে! ভেবেছিল, বেকার জীবনের এইতো শেষ ঈদ। নিজে কিছু না নিয়ে এবার বাবাকে একটা পাঞ্জাবী দেবে। মা শাড়ির ওপর ওড়না পড়েন, ভেবেছিল ভালো একটা নকশাদার ওড়না উপহার দেবে। ঈদের দিন বিকেলে স্কুল পড়ুয়া ছোট ভাই দুটিকে বাইরে ভালো একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে ভালোমন্দ কিছু খাওয়াবে। দেড় হাজার টাকায় এখন সে কি করে?

জানালা দিয়ে লক্ষ্যহীনভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকে মাজেদ। বাবা চাকরী করতেন একটা সরকারি ব্যাঙ্কে। মা গৃহিণী। ছোট ভাইদুটো এখনও বেশীই ছোট। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারে নি। মাজেদ কেবলমাত্র একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করলো। রেজাল্ট দেয় নি এখনও। রেজাল্ট দেয়া মাত্রই সে বিভিন্ন দিকে অ্যাপ্লাই করা শুরু করবে। চাকরী, ছোট-বড় সে যেমনই হোক, পেলেই হল কোনক্রমে একটা। না খেয়ে আছে তারা – এমন অবস্থা নয়। তবে বাবার পেনশনের টাকায় সংসার চালাতে যে মায়ের কি কষ্ট হয় – তা মাজেদের চোখ এড়ায় না। সংসারের বড় ছেলে হওয়ায় বরং আরও বুকে আরও টনটন করে বাজে দুঃখগুলো। বাড়ি থেকে নিজের খরচ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে সে বহু আগেই। এখন সে যত দ্রুত সম্ভব সংসারের আয়ে কিছু সংযোজন করতে চায়।

মানুষ আর মানুষ চারিদিকে। বাসের মধ্যে মানুষ, বাসের বাইরে মানুষ, রাস্তায় মানুষ, দোকানপাটে মানুষ, দালানঘাটে মানুষ, জলে-স্থলে-আকাশে সব জায়গায় কেবল মানুষ আর মানুষ। এত মানুষ কেন এই ঢাকা শহরে? যদি এত মানুষের ভার এই শহর বইতে না পারে? হঠাৎ মাটির নীচে দেবে যায়, সব মানুষ আর দালানকোঠা নিয়ে? বিলীন হয়ে যায় এই জনবসতিতে শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা সভ্যতার সব নিদর্শন? আজ সকালে, দশটা বাজার কিছু আগে মাজেদ যখন বাস থেকে নামলো মতিঝিলে, চারিদিক থেকে পঙ্গপালের মত কেবল মানুষ ছুটে ছুটে আসছে চাকরীর তাড়া খেয়ে। সবার মুখের গড়ন এক, শরীরের আকৃতি এক, পোশাক এক, এক ধরণের জুতো। একধরণের ফরমাল পোশাকে, কিছুটা রঙচটে যাওয়া জুতো ঘসেমেজে আকৃতিতে আনার চেষ্টায়, কাঁধে বা হাতে একটা ব্রিফকেস বা এই ধরণের একটা ব্যাগ নিয়ে ছুটে চলার মাঝে সবচেয়ে লম্বা –দীর্ঘকায় ব্যাক্তিটিকেও ঋজু-খর্বাকার লাগে। সবচেয়ে সুন্দর মুখচ্ছবির মানুষটিকেও লাগে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত। লোকসমক্ষে বলার মত একটি চাকরী, চলনসই একটি বেতনের অঙ্ক, একটু নিরাপত্তা, সাধ্যের মধ্যে একটি সংসার, প্রতি সপ্তাহে একদিনের মাছ মাংসের নিশ্চয়তা এটাই মাজেদ এবং মাজেদের আশেপাশের শত-সহস্র মানুষের পরম আরাধ্যের জীবন। দিনান্তে মাজেদ যখন আবার ভিক্টোরিয়া পার্ক বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ায়, বাড়ি ফেরে, সেই রাস্তাঘাটেও একই চেহারার মানুষের ভিড়। মাজেদের নিজেকে প্রকৃত অর্থেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একরাত্রি গল্পের সুরবালার সর্বহারা প্রেমিকের মনে হয়, যার যৌবনে গ্যারিবল্ডি হবার স্বপ্ন থাকলেও আদতে জীবন কাটাতে হয়েছিল এক ভাঙ্গাস্কুলের সেকেন্ড মাস্টার হয়ে।

-“ এই দ্যাশ গোল্লায় গ্যাছে গা! আর কোন ভবিষ্যৎ নাই এই দ্যাশের! জাহন্নাম! জাহন্নাম আছে সবাইর কপালে!” বৃদ্ধকণ্ঠের গজগজানোর আওয়াজে মাজেদের চিন্তার সুতো জট পাকিয়ে যায়। আওয়াজটা আসছে তার পাশের সিট থেকে।
-“হ্যাঁ? কিছু বললেন?”
-“না, আপনারে না। ঐ কইলাম আর কি। চাইয়া দ্যাহেন কারবারডা।” বৃদ্ধ তাদের পাশের সারির সিটের দিকে ইশারা করে। মাজেদ ঝুঁকে পড়ে দেখে একটা মেয়ে তার সাথে বসা পুরুষ সঙ্গীটির হাত জাপটে ধরে তার বুকের সাথে একদম মিশে বসে আছে। মাজেদ কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। বুড়ো লোকটা ক্রমাগত গজরাতে থাকে। মাজেদ চুপ করে বসে থাকে।

-“ আপনি যে এমন ধইঞ্চা ধরণের পুরুষ মানুষ, সেইটা আগে বুঝলে জীবনেও আপনেরে আমার এই হাত ধরতে দিতাম না!”

প্রায় একবছর আগে শোনা কাটাকাটা, হিসহিসে কণ্ঠের কথাগুলো এখনও কানের দরজায় কড়া নাড়ে যেন মাজেদের।

-“যারে ভালোবাসেন কইছেন- সেই মাইয়া চইলা যাইব আরেক ব্যাডার ঘরে, সেই ব্যাডার লগে এক খাটে শুইব, ভাবতে খারাপ লাগে না আপনার? আপনে পুরুষ না? কইলজা নাই আপনার?”

আরসিনগেইট বিক্রমপুর মিষ্টান্নভাণ্ডারের ওপরে তিনতলায় থাকতো মেয়েটি। শায়লা তার নাম। ইসলামপুরের এক কাপড়ের ব্যাবসায়ির সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পরপরই সে এক কাপড়ে এসে দাঁড়ায় মাজেদদের ভাড়াবাড়ির দরজায়। বস্তুত, তার মাজেদের ঘরেই ঘরণী হয়ে আসার কথা ছিল। দুই বছরের প্রেমের সূত্রপাত হয় ভার্সিটিতে যাবার আগে বিক্রমপুর হোটেলে সকালের নাস্তা করতে গিয়ে। শায়লা সে সময় মহানগর মহিলা কলেজের সাদা ইউনিফর্ম পরে কলেজে যেত। এইভাবে, বারবার চোখেচোখে বিনা বাক্যব্যায়ে কথাবার্তা চলবার পর সকালের নাস্তার পাশাপাশি মাজেদের বিকেলবেলাও ঐ মিষ্টির দোকানের বিপরীতে তেলেভাজার দোকানে গিয়ে রোজ দুটো কিমাপুরি আর এককাপ চা খাবার অভ্যাসও হয়ে যায়। তারপর আনুসাঙ্গিক ভাবে তিনতলার বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মোবাইল গুঁতানো। একটা সিগারেট ধরিয়ে ক্রমাগত হাই তোলা। নির্দিষ্ট সময়ে বারান্দায় শায়লার আগমন ঘটলে আবার সেই চোখে চোখে আদিম সাংকেতিক ভাষায় ভাবের আদান প্রদান। শায়লা তার বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করায় একটি সরকারি ভার্সিটির ব্যাবসায়ে প্রশাসনে অনার্স করা মাজেদের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে উপযোগিতা। মাজেদ শায়লার বাসায় প্রবেশাধিকার পায়। শিক্ষকের ভেক ধরে প্রেম চালিয়ে যেতে মাজেদের বিবেকে বাঁধা না দিলেও শায়লা যখন নিজের ঘর ছেড়ে এককাপড়ে মাজেদের দোরে এসে দাঁড়ায় তখন মাজেদের বিবেক তীক্ষ্ণভাবে বাঁধা দেয়। বিয়েশাদির মত বিশাল ব্যাপার- গুরুজনদের বদদোয়া কুড়িয়ে করা ঠিক নয় – ইত্যাদি বলে শায়লাকে নিরস্ত করে বাড়িতে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে। শায়লা যতই বলে, ওর আর ফিরবার পথ নেই, বাড়িতে যাওয়া মাত্রই নিশ্চিত বিয়ে হয়ে যাবে ওর – মাজেদের বিবেকবোধ আরও শক্ত হয়ে ওঠে। মাস্টার সেজে প্রেম করতে যে বিবেক বাদ সাধে নি, বিয়ে করার সময় আসামাত্রই সে বিবেক মাথার মধ্যে লালবাতি জ্বালিয়ে কর্কশ সাইরেন বাজানো শুরু করে। মধ্যবিত্তের বিবেক কখন যে টনটনায় আর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে- বোঝা বড় দায়!

মাজেদ দেখতে পায়, পাশের সারিতে তার পাশের সিটে যেন সে আর শায়লাই বসে আছে, আগের দিনের মত। শায়লাই তার বুকে মাথা রেখে হাত আঁকড়ে ধরে আছে। কতবার যে তারা এভাবে বাসে চেপে জাদুঘর- শিশুপার্ক- চিড়িয়াখানা- সংসদভবন- ভাসানি নভোথিয়েটার ঘুরতে গেছে, তার ঠিক নেই। পাশে বুড়ো লোকটা আবার খনখনিয়ে ওঠে – মাজেদ কিছু বলতে পারে না। কোনক্রমে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে চুপ হয়ে যায়।

মনে মনে মাজেদ হিসেব কসে– ভুলটা ছিল কোথায়। পড়াশোনা করছিল সে একটা সরকারি ভার্সিটিতে, যেখানে তার এলাকার বেশীরভাগ ছেলেপুলে এইচএসসির পরেই দিনভর বাপের গালি খেয়ে দোকানে বসে হিসেবের টালি খাতায় চোখ বুলায়, যোগ বিয়োগ করে, অথবা দিনমান স্কুলগামী মেয়েদের মাপঝোক করে আর শিস বাজায়, আর সন্ধ্যায় এলাকার স্কুলের মাঠের এক কিনারে বসে গাঁজা টানে, মাজেদ সেখানে তাদের আড্ডায় না গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করেছে। অনেক কষ্ট করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাশ করে ঢাকাস্থ সরকারি একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছে সে। কাটিয়েছে সাদাসিধে একটা জীবন। পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরী করবে, তারপর শায়লাকে বিয়ে করবে এই ছোট একটুকু স্বপ্নই তো ছিল তার। কিন্তু শায়লার বাপ তাদের এ সম্পর্কের কথা টের পাওয়া মাত্রই উঠেপড়ে লাগে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে। একে তো শায়লারা দীর্ঘদিনের স্থানীয় এ এলাকায়, তারপরে বিক্রমপুর মিষ্টান্নভাণ্ডারের মালিক শায়লার বাবা এক বিশাল ষণ্ডাগণ্ডা লোক। ছাপোস মাজেদের এজুকেশনাল সার্টিফিকেটের মূল্য তার কাছে পাঁচটাকার একটা কিমাপুরির বেশী ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই মেয়ের বিয়ে দিতে তার চোখে উপযুক্ত পাত্রের খোঁজ মিলেছিল ইসলামপুরের এক কাপড় ব্যাবসায়ির ঘরে।

বাস কনডাক্টর এগিয়ে আসছে ভাড়া কাটতে কাটতে। মাজেদের মনে পড়ে, ভাড়া দেয়া হয় নি তার। ফার্মগেট থেকে বাসে উঠেই জবর ঘুম চাপে। সিটে তেরছা হয়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার ফাঁকে সে আর ভাড়া দেবার সুযোগ পায় নি। পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ হাতড়ে বের করে ভেতরে উঁকি দেয়। আলগোছে স্পর্শ করে পাঁচশ টাকার নোট তিনটিকে। এছাড়া আছে পাঁচ ও দশটাকার নোটে আরও পঞ্চাশ টাকার মতন। দশটাকার একটা নোট বের করে হাতে নেয়। ফার্মগেট থেকে সদরঘাটের ভাড়া জনপ্রতি দশটাকা, যদিও স্টুডেন্ট ভাড়া তার অর্ধেক। কিন্তু গেল বছর, তথা মাস্টার্সে ওঠার পরপরই সে বন্ধ করে দিয়েছে স্টুডেন্ট ভাড়া দেয়া। দু’চার টাকা বাঁচাতে প্রতিদিন দুইবেলা বাস কনডাক্টরের সাথে ঝগড়াঝাটি চ্যাঁচামেচি করতে ভালো লাগে না তার। পাশের সারির সেই কাপলদের সিট হতে হাউকাউ এর আওয়াজ পেতেই মাজেদ ঝুঁকে ভালো মত তাকায় সেদিকে। ছেলেটা, অর্থাৎ মাননীয় প্রেমিকপ্রবর একদম মারমুখী হয়ে ঝগড়া চালিয়ে যাচ্ছে কনডাক্টরের সাথে। ভাড়া বিশটাকা হবার কথা দুজনের, কিন্তু ছেলেটা নিজেদের স্টুডেন্ট দাবী করে পনের টাকা দিতে চাচ্ছে। কনডাক্টর তাতে সম্মত না হয়ে আইডি কার্ড দেখতে চাচ্ছে দু’জনের। এই সূত্র ধরে ঝগড়া। প্রেমিকা আর আগের মত আহ্লাদী মুডে নেই। তার চোখেমুখে যথেষ্ট ভয়। মাজেদের প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। দু’চারটাকা বাঁচাতে গার্লফ্রেন্ডের সামনেই যারা এভাবে ঝগড়া জুড়ে দেয় – তাদের ওপর বিরক্ত না হয়ে উপায় আছে? পরে আশেপাশে কে কে এগিয়ে এসে যেন থামায় তাদের এই অনন্তকাল ধরে চলতে থাকা ঝগড়া। মাজেদের কাছে আসলে পরে কনডাক্টরকে মাজেদ পুরো দশটাকার নোটই ধরিয়ে দেয়।

সব চিৎকার চ্যাঁচামেচি সাময়িকভাবে থামলে মাজেদের আবারো ঝিমুনি আসে। মাজেদ চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে দেয়। সাথে সাথে সেই চেনা অচেনা হাজারো মানুষের মুখ এসে ভিড় করে মাজেদের সামনে। খুব জোরেশোরে মাজেদ চেষ্টা করে ঝেঁটিয়ে দৃশ্যটি মাথা থেকে সরাতে, কিন্তু সে সক্ষম হয় না। পায়ের তলায় একটু মাটির খোঁজে মাজেদ আঁকুপাঁকু করতে থাকে। একটা ভিত্তি দরকার তার – যার ওপর ভর দিয়ে সে নিজেকে অন্যদের তুলনায় আলাদা প্রমাণ করতে পারে। নিজেকে অন্যদের থেকে ভিন্ন প্রমাণ করার এ তাগিদ মাজেদের কাছে খুবই মানবিক মনে হয়। পারে না সে। বরং ভয়ার্ত মনে খেয়াল করে, যেন সেই ভিড়ের মাঝে একটি লোকের মুখের আদল ঠিক তার মত! তারপাশের লোকটিও কি তার মতই দেখতে? তারপাশের জনও! মাজেদ ঘর্মাক্ত শরীরে চোখ মেলে। হঠাৎ তীব্র গরমে একপশলা ঠাণ্ডা বাতাসের মত তার মনে পড়ে – তার ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্যবিত্ত জীবন, তার মধ্যবিত্ত আদর্শ, মধ্যবিত্ত সহনশীলতা – এ ই তার চলৎশক্তি, তার হাতিয়ার, এমন একটি গুণ – যা তাকে অন্য অনেকের তুলনায় আলাদা করে দেয়। মন যা চায় – তার অধিকাংশ ইচ্ছাই অপূর্ণ রয়ে যাবার পরেও সে ইচ্ছা পূরণের জন্যে এখনও বিপথগামী হয় নি এই তো অনেক কিছু। মধ্যবিত্ত জীবন বরং তার জন্যে একটা লেন্স হিসেবে কাজ করেছে – যে লেন্সের দ্বারা জীবনকে সে এত ঘনিষ্ঠভাবে পড়তে পেরেছে – যার পাঠোদ্ধার সমাজের অন্যকোন শ্রেনির বাসিন্দাদের পক্ষে অসম্ভব।

-“এই বছরে জিডিপির গ্রোথ কি পরিমাণ হইসে খবর রাখিস? আগের আমলের তুলনায় কারেন্ট কত কম যায় খেয়াল করছিস? দেশে সন্ত্রাসের বর্তমান অবস্থারে আগের অবস্থার সাথে মিলায়া তারপর কথা বলতে আসিস। তোদের মত লোকেদের মনের আঁশ তো খোদাতা’লাও মিটাইতে পারবে না- এই সরকার তো কোন ছার...”
সামনের কোন এক সিট হতে ভেসে আসে তর্কের আওয়াজ। প্রায় নিস্পৃহ মাজেদের কানে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্যেও ঢোকে তা ...
-“ তবুও, তুই কি বলতে চাস এই সরকারের মধ্যে করাপ্টেড লোক নাই?”
-“ তা আছে, কিন্তু বাংলাদেশের কোন সরকারে, কোন জায়গায় নাই করাপ্টেড লোক?”
-“আছে, সবখানেই আছে”
-“ সবখানেই করাপশন হয় জেনেও তুই শুধু শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করছিল এমন একটা রাজনৈতিক দল বা সেই দলের শাখাদলকে সাপোর্ট করবি?”
-“ তোদের এই এক সমস্যা। কথায় কথায় ট্যাগ লাগায়া দেস। আমি কি কোন দলের ওকালতি করছি? আমি বলছি এই দেশে রুট লেভেল থেকে পরিবর্তন আনতে হবে। এই জন্যে দরকার নূতন রাজনৈতিক দল।”
-“ রাজনৈতিক দল আবিস্কার করবা ভালো, কিন্তু নূতন আদর্শ পাবা কই? একদলের আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আরএকদলের জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর পেরিয়ে দেশের মানুষকে কনভিন্স করতে পারে এমন একটা আদর্শ তুই সাজেস্ট কর দেখি? আর আমলা লেভেলে অথবা সেনাবাহিনী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনরকম সাপোর্ট আদায় করতে পারবি? শুন, দেশপ্রেম এক জিনিস আর দেশ চালানোর মেকানিজম রপ্ত করা আরেক জিনিস।”
-“ এই আমাদের মত ইয়াং ছেলেপেলেগুলা এত নেগেটিভ ভাইব নিয়া ঘুরে বলেই এই দেশের ভাগ্য বদলায় না, বুঝলি?”

মৎস্য ভবনের সিগন্যালে দাঁড়ানো মাজেদের বাসের পাশে একটানা প্যাঁ পোঁ করতে থাকা একটি প্রাইভেট কার মাজেদের মাথাব্যাথা ধরিয়ে দেয়। হর্নের আওয়াজে ছেলেদুটোর রাজনৈতিক বিতর্কও চাপা পড়ে যায়। ভালো হয়েছে– মাজেদ ভাবে মনে মনে। কারের মধ্যে বসা পরিপাটী – কেতাদুরস্ত পোশাকে প্রায় তাদের সমবয়সী একটা ছেলে। মাজেদের মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে আসে। এই যে যারা এত কিছু বোঝে দেশ নিয়ে, যাদের এতশত জ্ঞান – তারা এই লোকাল বাসে চড়ে কেন? জ্ঞানের জাহাজ হয়েছে একএকটা – সেই জ্ঞান খাটিয়ে জীবনটা তৈরি করে নিক! প্রাইভেট কারে বসা ছেলেটার মত একটা প্রাইভেট কারে চড়ে বেড়াক পারলে। যত জ্ঞান – সব ঝাড়তে হবে এইখানে, লোকাল বাসের মধ্যে? নিজের জীবনে যারা ফেইলিওর, তারাই আসে লোকাল বাসে নিজেদের জ্ঞানের লেভেল জাস্টিফাই করতে। মাজেদকে এই ফাঁকে মাঝারিমাপের একটু অহংকার ছুঁয়ে যায় – কখনো নিজেকে অন্যদের চেয়ে বাড়িয়ে কিছু ভাবে নি, এই কাণ্ডজ্ঞানের কারনে।

সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলে, বাস ছেড়ে দেয়। মাজেদ জানালায় হাত রেখে মুখ বাড়িয়ে দেয় বাইরে। একঝলক ঠাণ্ডা বাতাসের জন্যে তার প্রাণ হুহু করে। মাথায় ঘুরতে থাকে তার চিরচেনা গন্তব্যস্থল - ভিক্টোরিয়া পার্ক বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে নেমে লক্ষ্মীবাজারের পাতলা খান লেনের এক সরুগলিতে তাদের দুই কামরার ছোট বাসা, রুমের মধ্যে বাবা-মা, কারেন্ট-পানির অসহ্য যন্ত্রণা, বছরে পারলে দু’বার বাড়িওয়ালার ভাড়া বাড়ানোর চাপাচাপি, বিকেলবেলা বাথরুমের কমোডে বিনা শব্দ করে ড্রেনেজের নোংরা পানি ভেসে ওঠা। একটা চাকরী মুক্তি দেবে এসব থেকে, ভাবতে ভাবতে মন ভালো হয়ে ওঠে ক্রমশ মাজেদের। ঠিক এমন সময় খুব জোরে পেছন থেকে মাজেদের জানালায় কেউ ধাক্কা মারে।

মাজেদ আঁতকে উঠে হাত টেনে সরিয়ে আনে। ততক্ষণে জানালার লোহার ফ্রেমের ঘসা লেগে মাজেদের কনুইয়ের বেশ কিছু অংশ ছড়ে গেছে। রক্ত পড়ছে চুঁয়ে চুঁয়ে। মাজেদ হাত সরিয়ে আনার পর জানালার বাকি যে অংশটুকু খোলা ছিল - তাও দুম করে লাগিয়ে দেয় পেছন থেকেই কেউ ঠ্যালা দিয়ে। দপ করে মাজেদের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে! উঠে দাঁড়িয়ে সে ঘুরে তাকায় পেছনে –

-“এভাবে জানালা বন্ধ করলেন কেন আপনি?” পেছনে বসে যে ধাক্কাটা দিয়েছে, তাকে দেখা গেল এই যাত্রা। মাজেদের সমবয়সী, বা তারচেয়ে একটু কম বয়স হবে।
-“সব বাতাসের লিজ কি একাই নিয়া রাখছেন? পিছনের মানুষগো আলোবাতাস লাগে না?”

মাজেদ হতভম্ব হয়ে যায় তার উত্তরে। এই ছেলেটার অসচেতনতায় জং ধরা জানালার ফ্রেমে ঘসা খেয়ে তার হাত কেটে গেছে, কিন্তু তা নিয়ে এর কোন দুঃখ নেই! বরং সে আরও পাল্টা তর্ক করছে- রাস্তার ছেলেদের যুক্তি দেখিয়ে!
-“বাপ মা ভদ্রতা শিক্ষা দেয় নাই? কমনসেন্সও কি বাসায় ফালায়া আসছেন নাকি? দেখছেন কি করছেন আপনি?” মাজেদ তার ছড়ে যাওয়া হাত তুলে দেখায়।
বাপ মা তুলে কথা বলায় ছেলেটা আরও ক্ষেপে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মাজেদের রক্তাক্ত হাত দেখে সে কথাগুলো গিলে নেয় –
-“আচ্ছা সরি ভাই। জোরে লাইগা গ্যাছে!”
-“সরি বললেই হবে শুধু? আর হাত যে কাটলো আমার, সেইটা?” – দীর্ঘক্ষনের বাসভ্রমণের পূর্ব –পর নানাবিধ অভিজ্ঞতায় মাজেদ নিজের অগোচরেই মধ্যবিত্ত আদর্শ এবং সহনশীলতার গণ্ডি অতিক্রম করে চলেছিল ক্রমশ, “দেখে তো মনে হয় পড়াশোনা করেন, এরকম ব্যাক্কেলের মত কাজ করেন ক্যামনে? শালার মানুষ পারেও আজকাল! আহাম্মকের ঘরে আহাম্মক!” নিজের সিটে ঘুরে বসতে বসতে মাজেদ গজগজ করে, এবং বলাই বাহুল্য সে শব্দ তার পেছনের সিটে পৌঁছাতে সময় লাগে না। সে সাথে সাথে মাজেদের পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে মাজেদের কলার ধরে বলে
-“ ঐ মুখ সামলাইয়া কথা বল! মুখ খারাপ করলে একদম মুখ ভাইঙ্গা দিমু হারামজাদা!”

সমস্যাটা হয়েছিল এই জায়গায় যে মাজেদের মনের মাঝারিমাপের সুখ দুঃখের জায়গাটুকু বোঝার মত মানসিক অবস্থা সেই ইউনিভার্সিটির ছাত্রের সে মুহূর্তে ছিল না। যে দুঃখের ওপর ভিত্তি করে মাজেদ দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিল তার ওপরকার অস্বচ্ছ আবরণটি ভেদ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মানুষে মানুষে ভুল বোঝাবুঝি তখনই হয় যখন আমরা চাই আমাদের মনের গহীনে চাপা পড়ে থাকা বেদনাগুলো মানুষ বুঝে – অনুধাবন করে সেই অনুপাতে আমাদের সাথে ব্যবহার করুক। কিন্তু আদতে তা আর হয় না।

মাজেদকে মুখ ভেঙ্গে দেয়ার থ্রেট দেয়া ছেলেটির পাশে বসা ছেলেটিও দুটো অতিরিক্ত বাক্য যোগ করতে ভোলে না –
-“ ফ্যাঁচফ্যাঁচ কইরা কান্দে মাইয়া মানুষের মত একটু হাত ছইড়া গেছে বইলা। আরে রান্নাঘরে মাইয়াগো হাত তো অহরহ কাটে, ওরাও তো অমন করে না। রাস্তাঘাটে বাইর হওনের বদলে শাড়ি চুড়ি পিন্দা ঘরে বইয়া থাকলেই পারো।”
এবং তার ক্রম ধরে প্রথম ছেলেটি মাজেদকে খাস বাংলায় একটা গালি দেয় যাতে মাজেদের জন্ম পরিচয় নিয়ে কঠিন ভাবে সংশয় প্রকাশ পায়।

নিজের সমবয়সী বা অপেক্ষাকৃত কম বয়সি একটা ছেলের মুখে এই ধরণের অভব্য কথা শুনে মাজেদ নিজেকে সামলাতে পারে না। রমজান মাস- তালপাকা গরম – চাকরীবিহীন নির্ঘুম টেনশনের রাত, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মত ১৫০০টাকায় ঈদ পারের দুশ্চিন্তা, স্থানে স্থানে মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, দেশলাইয়ের বাক্সের মত একটি ফ্ল্যাটে অনাদরে – অপমানে মানবেতর জীবন কাটানো, শায়লার ঘৃণা জর্জর চেহারা, বাবা-মায়ের কোটরাগত চোখ, কপালে চিন্তার ভাঁজ, ছোট দুই ভাইয়ের ভবিষ্যৎ, সকাল সন্ধ্যা রাস্তায় হাজারো মানুষের ভিড়ের মধ্যে নিজেকে একটু আলাদা করে চিহ্নিত করার আপ্রাণ চেষ্টা, বিকেল বেলা শাহী ইফতার বাজারের সামনে মানুষের পয়সার ঝনঝনানি, সেই খাবারগুলো একটু চেখে দেখার সাধ আর সাধ্যের মধ্যে কখনোই সামঞ্জস্য না হওয়া, সামনে ঈদের বাজার কিন্তু ঈদ উপলক্ষে নিজে কিছুই নূতন না নেবার চাপা বেদনা – সব মিলিয়ে মাজেদের মাথার ভেতর বিস্ফোরণ হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাজেদের মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত শুন্যে ভেসে ওঠে ঘুষি হয়ে ঐ ছেলের মুখে আছড়ে পড়ার উদ্দেশ্যে।

কিন্তু হিসেবে কিছু দুঃখজনক গড়মিল দেখা দেয়। মাজেদের সারাজীবনের লালিত ভীরু- কম্প্রোমাইজিং মানসিকতাই হোক অথবা মারপিটজনিত অনভ্যাসই হোক – মাজেদের ঘুষিটা নিশানাচ্যুত হয়। ছেলেটার নাকে বা মুখে কোথাও না লেগে আলতো করে গাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। ছেলেটার শরীরে একটা আঁচড়ও পড়ে না। মাজেদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে শক্ত ইঙ্গিত দেয় – বড় ভুল হয়ে গেছে চালে। ছেলেটা, যাকে মাজেদ ঘুষি হাঁকিয়েছে তার পাশের ছেলেটা বিদ্যুৎ গতিতে উঠে মাজেদের কলার চেপে ধরতে না ধরতেই আশেপাশের সিট থেকে আরও গোটা পাঁচ-সাত ছেলে উঠে এসে মাজেদের সিটের আসেপাশে এসে দাঁড়ায় – মাজেদকে ঘিরে ধরে। সবাই একই ভার্সিটির ছাত্র, পরিচিত। মাজেদ অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, তাদের মধ্যে একজন তার পাশের সারির সিটের সেই প্রেমিক যুবক, যাকে নিয়ে বুড়ো চাচা গজগজ করছিল, কিন্তু মাজেদ জনসমক্ষে তার প্রেমিকার সাথে ভাবভালোবাসার প্রতিবাদ করে নি। মাজেদের মনে চায় চিৎকার করে ছেলেটিকে কথাটি বলতে যে আশেপাশের সবাই যখন তাদের গালমন্দ করছিল তখন সে মনেমনে পক্ষ নিয়েছিল তাদের। কিন্তু শার্টের কলার আরেকজনের হাতে আটক থাকায় মাজেদের গলা দিয়ে অস্পষ্ট ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরোয় না। মাজেদ মাছের দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় এবং বিপদের এই স্বল্পতর সময়ের মধ্যেই আবিষ্কার করে , এই বাস, বাসের মধ্যে মানুষ এবং বাসের বাইরে তাকালে যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় এবং যা দেখা যায় না – তার সবকিছু নিয়ে যে সমাজ, তা মুখ খোলামাত্রই মধ্যবিত্তদের টুঁটি চেপে ধরে অভ্যস্ত। মাজেদ সাহায্যের আশায় আশেপাশে তাকায় – দেখে সহানুভূতি কারো চোখে নেই, আছে কেবল তালপাকা গরমে নষ্ট হয়ে পচে গলে যাওয়া মগজের কিছু মানুষের চোখে মাজেদের রক্তপাত দেখার জান্তব বাসনা। পাশের সিটের বুড়ো চাচা বিপদ আঁচ করতে পেরে ফাঁক গলিয়ে বহু আগেই গিয়ে বাসের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে মিটমিটিয়ে তাকিয়ে আছে এদিক।

প্রথম ঘুষিটা মাজেদের মুখে এসে পড়া মাত্রই মাজেদের মাথা ছিটকে গিয়ে লাগে বাসের জানালার পাশে শক্ত ষ্টীলের বডিতে। মাজেদ বুঝতে পারে- কোথাও কিছু একটা সাংঘাতিক গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তার বরাবরই সরল রৈখিক গ্রাফের জীবন এই রমজানের আগুন ঝরানো দুপুরে তার বক্সিংএর কেরদানি দেখানো সমর্থন করে না।

চারপাশ থেকে বৃষ্টির মত কিলঘুশি যখন মাজেদের চেহারা ও শরীর মোরব্বা বানিয়ে দিচ্ছিল, মাজেদ তখন ভেজা অস্পষ্ট চোখে যেন সেই পেটমোটা টিকটিকিটাকে বাসের অপর পাশের দেয়ালে দেখতে পায়। সে মনে প্রাণে আশা করে – কোথাও একটা ঘণ্টা, একটা অ্যালার্ম শীঘ্রই বেজে উঠবে। মাজেদের কানের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকা কালচে রক্তের স্রোতও যেন তার কানের সেই অ্যালার্ম শোনার উদগ্রীবতা টের পায়। বস্তুত মাজেদের মুখে – পীঠে – বুকে ক্রমাগত কিলঘুসি পড়ার ভোঁতা ঢ্যাপ ঢ্যাপ আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না।

আঘাতে আঘাতে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে যাবার আগে মাজেদ অনুভব করে – মধ্যবিত্তের দুঃস্বপ্ন ভাঙ্গার নয়!


মন্তব্য ২০ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (২০) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৫৭

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: চমৎকার বর্ননা, একেবারে জীবন্ত। ঘটনাপ্রবাহের যোগসুত্র সাবলীল, সবমিলে জমলো ভালো। শিরোনামও একেবারে পারফেক্ট হইছে।

শুভকামনা রইলো :)

১২ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:০৮

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ শতদ্রু। আপনার ব্লগে আসছি শীঘ্রই। এইফাঁকে ভালো থাকা হোক :)

২| ১২ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:১৮

জেন রসি বলেছেন: আপনার কবিতার মত গল্প পড়েও চমকিত হলাম।

অসাধারন হয়েছে।

১২ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:২৫

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ ব্লগার জেন রসি। মূলত গদ্যই লিখি। গদ্যের কোঠায় বসবাস। মাথায় প্লট আসে, প্লটের সাথে শ্রমক্লান্ত রাত কাটাই, খাতা কলমের সঙ্গমে গরগরিয়ে কত কি সব বেরিয়ে আসে। প্রক্রিয়াজাত করি। এদিক সেদিক ছাপানোর জন্যে পাঠাই। অপরদিকে কবিতা প্রেমিকা। মাঝে মাঝে তার দেখা পাই। বাকি সময় কই যে থাকে!
সুন্দর থাকুন।

৩| ১৩ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:০৮

খেয়ালি দুপুর বলেছেন: আজকের বর্তমান বাংলাদেশের খেটেখাওয়া মানুষ আর তার মধ্যবিত্ত জীবনের চরম বাস্তবতার করুণ চিত্রের কি সাবলিল উপস্থাপন! ভাল লেগেছে ভীষণ। "মধ্যবিত্তের বিবেক কখন যে টনটনায় আর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে- বোঝা বড় দায়!" একমত পোষণ করছি। নিরন্তর শুভকামনা।

১৩ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৪৯

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: গল্পটা বেশ বড় ছিল। তবুও কষ্ট করে পড়েছেন এ জন্যে ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
প্রতিনিয়ত অবস্থার সাথে অ্যাডজাস্ট করে চলা ছাড়া মধ্যবিত্তের গতি কই? তাই বিবেক জেগে থাকার চেষ্টা করলেও জোর করে কখনো কখনো ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়।
ভালো থাকবেন। কথা হবে পরবর্তী কোন লেখায়।

৪| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১০:২৫

শঙ্খচিল_শঙ্খচিল বলেছেন: "আঘাতে আঘাতে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে যাবার আগে মাজেদ অনুভব করে – মধ্যবিত্তের দুঃস্বপ্ন ভাঙ্গার নয়!"

অনেক সুন্দর আর বেশ গুছানো লেখা। খুব ভাল লেগেছে।
লিখতে থাকেন। অনেক অনেক শুভ কামনা।

১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৬

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই , গল্পটি পড়ার জন্যে , ভালো লাগার কথা জানানোর জন্যে।
আপনার জন্যেও শুভকামনা। ভালো থাকুন নিরন্তর।

৫| ১৫ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৮

আহমেদ জী এস বলেছেন: সাজিদ উল হক আবির ,



গল্পের ভেতর দিয়ে, মধ্যবিত্তের বিবেক কখন যে টনটনায় আর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে ; তা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন ।

আর শেষের লাইনে জীবনের নির্মম সত্যটিই উঠে এসেছে - মধ্যবিত্তের দুঃস্বপ্ন ভাঙ্গার নয়!

ভালো লাগলো ।

১৫ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:০৯

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: প্রথমবার এলেন আমার ব্লগে। আপনাকে স্বাগত জানাই। ধন্যবাদ, গল্পটি পড়ে আপনার ভালো লাগা জানালেন এ জন্যে।
শুভকামনা আপনার লেখালিখির প্রয়াসে।
ভালো থাকবেন।

৬| ১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৯:১৪

এস কাজী বলেছেন: খুব সুন্দর।

১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৪৫

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই।

৭| ১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৫:২৮

হাসান মাহবুব বলেছেন: চমৎকার ডিটেইলিং, দৃশ্যগুলো পরিচিত খুব। তোমার কুশলী কলমের দক্ষতায় তা যেন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম। শুভকামনা।

১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৪৫

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ হাসান ভাই। শুভকামনা।

৮| ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২০

এহসান সাবির বলেছেন: গল্পটা যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। চমৎকার।

শেষ অংশটা তো অন্য রকম হলো।


এক গুচ্ছ ভালো লাগা।

২২ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৩

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ এহসান ভাই। হ্যাঁ, শেষ অংশটা একটু বেতিক্রম। তবে গল্পের পুরোটার সাথে সাযুজ্য বজায় রেখে।
ভালো থাকবেন সবসময়। শুভকামনা।

৯| ২১ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৫৩

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
অস্তিস্ত্ববাদী গল্পের কাঠামোর বহির্বিন্যাসে নানাবিদ ঘটনার অনুসঙ্গ, অনুঘটক সাথে পদানত, পলায়নবৃত্তি, সমকক্ষতা, সহমর্মিতা, সহযোগী মনোভাব প্রবণতা, স্বপ্ন-বাস্তব-কল্পনা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, সর্বোপুরি বেঁচে থাকা ভিন্নার্থে টিকে থাকা অনেক কথামালার ঘনঘটা পাঠক মন নানাদিকে প্রবাহিত হলেও একটি লাইনেই মাজেদের সঙ্গে সহমর্মী বা অনুগামী হয় বা নির্দিষ্টকরণ হয় সেখানে বলা ক্ষেত্র কম ৷ তবে অন্তর্বিন্যাসে পরিচ্ছেদ এক ও দুইয়ে সমন্বয় নিয়ে ভাবা যায় ৷ পরিচ্ছেদ এক অনেক বেশি ব্যপ্তি রাখে লেখকের দর্শন প্রকাশে যা গভীর ও সুদূরপ্রসারী ৷

বর্ণনাশৈলী শক্তিশালী, বাসেই নানা শ্রেণী ও মনের মানুষের উপস্থিতি সংখ্যায় কম হলেও ভিন্নতা আছে ৷ শ্রেণীসংঘাত সকল স্তরেই বিদ্যমান তাইতো শায়লার বাবার দৃষ্টি উর্ধ্বমুখী যদিও শায়লা চরিত্রগতভাবে বেশ অবহেলিত কারণ হয়ত এককগত ভাবে মাজেদের প্রাধান্য পুরোটা জুড়েই আবার এটিও বৈশিষ্ট্য যে একক চরিত্র বিন্যাসে ধারণা প্রকাশের প্রচেষ্টা ছিল সর্বদা ৷ যদিও মধ্যবিত্তের শ্রেণীগত স্তর- কাল ও অর্থনৈতিক ভাবে আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল ৷ ( নিম্ন মধ্যম আয়ভিত্তিক দেশের সংজ্ঞা প্রশ্নবিদ্ধ) ৷ স্বপ্ন ও কল্পনায় বোধহয় সুক্ষ্ম রেখায় বিভেদ বিদ্যমান সর্বদা সবকালেই ৷ পড়ে পাঠক মাজেদকে স্পর্শ করবে নিশ্চয় ৷এ ধরনের গল্পে লেখকের দৃষ্টি হৃদয়স্পর্শী, অনবদ্য ছিল তা ভবিষ্যতেও মর্মস্পর্শী থাকবে প্রত্যশা রইল ৷ শুভেচ্ছা..................

২২ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৪৪

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: প্রিয় জাহাঙ্গীর ভাই, আপনার লেখনী পুরদস্তর পেশাদার সাহিত্য সমালোচকের আকার ধারণ করেছে। গল্পের বিবিধ চরিত্র ও ঘটনের ব্যবচ্ছেদেও শব্দের ব্যাবহারে শৈল্পিকতা বিচ্ছুরণ, ছন্দের দ্যোতনা অন্য সবার থেকে আপনার মন্তব্যকে আলাদা করে দেয়। বাংলা সাহিত্য এখন মানসম্মত সাহিত্য সমালোচনার অভাবে ধুঁকছে। সমালোচনার কাজটি আরেকটু প্রফেশনালি নেবার অনুরোধ রইল।

এখন, যদি গল্পের প্রসঙ্গে আসি, গল্পটি কলেবরে বেশ বড় হয়ে যাওয়ায় পরিচ্ছেদ এক বেশী দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হয় নি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের একদম শেষে মাজেদ সেই টিকটিকিটাকে আর একবার দেখতে পায় - যেটা তাকে তার স্বপ্নের সাথে একীভূত করে এবং সে আসা করে, তার বেধড়ক পিটুনিটাও আরেকটি স্বপ্ন , বরং দুঃস্বপ্ন - যা থেকে পরিত্রাণ লাভের আশা করে সে।

মাজেদ ভিন্ন অন্য চরিত্রগুলির প্রতি হয়তো সুবিচার করা সম্ভব হয় নি - গল্পের আঙ্গিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার প্রচেষ্টা তার অন্যতম কারণ, নতুবা প্রকাশকের কাছে পুনরায় উপন্যাস উপযোগী প্লটকে গল্প বানিয়ে আনার অভিযোগ শুনতে হত। তবে চেষ্টা করেছি প্রতিটি চরিত্র, গল্পে নির্দিষ্ট একটি কারণে হাজির করবার।

আমি বরাবরই কৃতজ্ঞ আপনার কাছে, আপনার বিশ্লেষণী ব্যখ্যার জন্যে, জাহাঙ্গীর ভাই। স্রষ্টার কাছে আপনার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। ভালো থাকবেন।

১০| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০৮

বৃতি বলেছেন: বাহ, খুব সুন্দর একটি গল্প পড়লাম। চমৎকার ডিটেইলিং :)

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৪০

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: পড়ার জন্যে ধন্যবাদ বৃতি আপু :) ভালো থাকবেন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.