নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প - বস্তা কাঁধে স্যুট পরিহিত লোকটি

২২ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:৫৮

লোকটিকে প্রথম আমরা দেখি সাহেরুনবাগের রড ও লোহালক্করের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে, ধূলিধূসর সড়কপথ দিয়ে হেঁটে আসতে। একবার লোকটাকে দেখার পর, তাকে বারবার না-দেখে আমাদের কোনো উপায় থাকে না। আমরা তাকে আবিষ্কার করি পুরো মহল্লাজুড়ে। গোরান টেম্পুস্ট্যান্ডে, সিপাহিবাগ বাজারে, রিয়াজবাগ মসজিদে, বাসাবো খেলার মাঠে প্রাতঃভ্রমণকারী স্বাস্থ্যসচেতন লোকেদের সাথে। সে সকালে হাঁটে, বাজারে যায়, অফিস করে, অফিস থেকে ফিরে আসে, জুমাআর মসজিদে নামাজে যায়, চায়ের দোকানে চা খায়, যেমনটা সবাই করে আর কী।

তার চুল বরাবর পরিপাটি করে আঁচড়ানো। জামা কাপড় ধোপদুরস্ত। যে সময় যেটা পরা উচিত, সে সময় সেটা গায়ে। অফিস টাইমে স্যুট, ঝাঁ চকচকে সু। নামাজের ওয়াক্তে দামি পাঞ্জাবি, পায়জামা, মেশকে আম্বর আতর। বাজারে গেলে ফুলহাতা শার্ট আর দামি প্রিন্টেড লুঙ্গি। মাঝবয়েসি পুরুষ হিসেবে তার মাথার চুলের ঘনত্ব তরুণদের মনেও ঈর্ষা জাগাবে। উচ্চতার কারণে ভিড়ের মাঝেও সে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। গায়ের রং শ্যামলা। টল-ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম পুরুষের কেতাবি উদাহরণ একদম। তবে, তার চোখদুটো একজোড়া নীড়হারা পাখি। চোখের নিচে কালি।

শারীরবৃত্তীয় কারণ বাদে, লোকটা বিশেষভাবে নজরে পড়ে তার কাঁধে সবসময় একটা বস্তা থাকে বলে। ভাঙারি টোকায় যারা, তাদের বস্তার মতো একটা বস্তা। বিশাল সে বস্তার সাইজ। নিশ্চয়ই তার ভেতরে খুব ভারি কিছু থাকে, যার ভারে তার আংশিক কুঁজো হয়ে হাঁটা লাগে প্রায় সময়ই। তার রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর মতো বৈসাদৃশ্যেপূর্ণ একটি দৃশ্য, আমরা মহল্লাবাসিরা কখনো দেখিনি। এতোটা সুপুরুষ, পোশাক পরিচ্ছদে এতটা কেতাদুরস্ত মানুষের কাঁধে সবসময় ভাঙারির বস্তা, দৃশ্যটা হজম করা মুশকিল। সমস্যা হলো, সে কথা বলে না কারো সাথে। চোখাচোখি হলে মৃদু হাসি, কুশল বিনিময়, ঐ পর্যন্তই। এরপর যতই আলাপ বাড়ানোর চেষ্টা করা হোক, সে হাসিমুখে সে প্রচেষ্টা এড়িয়ে যায়। কাজেই লোকটা কেন শরীরে স্যুট কোট সু চাপিয়ে কাঁধে এক নোংরা ভাঙারির বস্তা নিয়ে ঘোরে, সে রহস্য আর আমাদের উদ্‌ঘাটন করা হয় না।

ওহ, প্রায় সবসময়ই লোকটার সাথে থাকে ৪-৫ বছর বয়সী একটি ছেলে শিশু। বাচ্চাটা তার সাথে থাকলেও, নিজের মতো করেই আনন্দে সময় কাটায়। কখনো রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কাঠি দিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি কাটে। কুকুর বেড়াল দেখলে দৌড়ে ধরতে যায়। প্রজাপতির পেছনে ছুটতে ছুটতে হোঁচট খায়। উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে আবার হেসে ওঠে। কখনো লোকটার কাঁধে চড়ে সূর্যকে মুঠোয় পোরার চেষ্টা করতে থাকে। আমাদের মনে হয়, শিশুটা তার সন্তান।

আমাদের দৃষ্টিতে লোকটাকে দয়ালুই মনে হয়। বাজার বয়ে আনা মজদুর, রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানি- সবার সঙ্গেই সে হাসিমুখে কথা বলে। সবাই তাকে বেশ ভালো জানে ও আন্তরিক একজন মানুষ মনে করে। রাস্তার কুকুরদের খাওয়ায় সে নিয়মিত। হ্যাঁ, এটাও একটা অবাক করা ব্যাপার যে, বস্তাকাঁধে ঘোরা টোকাইদের দেখামাত্রই কুকুররা ধাওয়া করলেও এই লোকটাকে কুকুর কখনোই তাড়া করে না। লোকটার ভেতরে একটা নৃশংস সত্তাও বাস করে, এটা আমরা মহল্লাবাসিরা আবিষ্কার করি এই তো, কিছুদিন আগে। ঝাঁকের একটা কুকুর তেড়ে গিয়েছিল কী মনে করে, চায়ের দোকানের অদূরেই খেলতে থাকা তার সন্তানের দিকে। লোকটা তখন পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে লোকমা বানিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল কুকুরগুলোর দিকে। আগ্রাসী কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর সন্তানের চিৎকার কানে পৌঁছানো মাত্রই সে চকিত ঘুরে রিফ্লেক্স অ্যাকশনের ওপর একটা পাথর ছুঁড়ে মারে কুকুরটার দিকে। পাথরটা নিখুঁত নিশানায় কুকুরটার মাথায় গিয়ে আঘাত করলে আমরা প্রাথমিকভাবে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। সন্তান যখন তার দুপায়ের পেছনে আশ্রয় খুঁজছে, লোকটা তখনো থামে না। সে নিচ থেকে একটা থান ইট কুড়িয়ে বারবার সেটা ছুঁড়ে ছুঁড়ে থেতলে ভর্তা বানিয়ে দেয় কুকুরটার মাথা। আমরা পুরো ঘটনাটিকে বাৎসল্যবোধের উন্মাদনা ভেবে নিই, এবং এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করি না। মহল্লার পশুপ্রেমিদের মিটিং মিছিল শুরু হওয়ার আগেই কুত্তার মরা লাশ ছুঁড়ে ফেলে দিই ডাস্টবিনে।

একদিন লোকটার সঙ্গে আমাদের কিছুটা লৌকিকতাবিহীন পরিবেশে আলাপের সুযোগ হয়। সময় তখন সন্ধ্যা হয় হয়। সে এসে বসে আমাদের সঙ্গে, চায়ের টঙ্গে। বোঝা যায়, অফিস ফেরতা সে। বস্তাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে ধপ করে পাশে রাখে। আদা দিয়ে লাল চা অর্ডার করে।

‘নুসরাত ফতেহ আলি খাঁ সাহেবের কাওয়ালির সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হলো, তাতে প্রেমে পড়ার প্রথম দিনগুলির অনুভূতির জিকর করা হয়,’

লোকটা, এতোগুলো দিনে, এই প্রথমবারের মতো নিজ থেকে আলাপ শুরু করে। তার কথার সূত্র ধরেই আমরা ডেকসেটে বাজতে থাকা নুসরাত ফতেহ আলি খাঁ সাহেবের কাওয়ালি 'রাশকে ক্বামার'- এর রিমিক্স ভার্শনের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠি।

“‘ক্বামার’ শব্দটাকে আমরা বাংলা কোমরের সাথে মিলিয়ে ফেলি। কিন্তু কোমর, বা কটিদেশের সঙ্গে এর আসলে কোন সম্পর্ক নেই। ক্বামার অর্থ চাঁদ। আরবি শব্দ এটা। কোরআনে এই নামে একটা সূরাও আছে সম্ভবত।”

‘সবসময় দেখি লগে একটা বস্তা লয়া ঘুরেন। আপনার এই বস্তার ভিতরে কী?’

রমজান মিয়া, চা বিক্রেতা, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় আলাপে আগ্রহ না দেখিয়ে তার সহজাত প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আমাদের সবার হয়ে বস্তা সংক্রান্ত প্রশ্নটি উত্থাপন করে সে।

‘ওহ্, এর ভেতর?’ লোকটার ঠোঁটে সলজ্জ হাসি ফুটে ওঠে। এ পর্যায়ে আমাদের ভেতর বিন্দু বিন্দু শিশিরের মতো কিছু কষ্ট এসে জমা হয়, এই মৃদুভাষী ব্যক্তিটিকে খুব ব্যক্তিগত এক প্রশ্ন করে ফেলায়।

‘এর ভেতর আমার স্ত্রীর লাশ,’ লোকটা ঠোঁটের কোণে সেই লজ্জা লজ্জা হাসি ধরে রেখেই বাক্যটি সমাপ্ত করে।

‘গুড় আছে না রমজান?’ কেউ একজন প্রশ্ন করে। ‘চায়ে একটু গুড় দাও। চিনিতে ক্ষতি, গুড় তো ন্যাচারাল মিষ্টি।’

রমজান মিয়া এক চা চামচের তিনভাগের দুইভাগ গুড় নিয়ে চায়ের কাপে ঘুঁটা দেয় জোরে জোরে। একজন নাকের ডগায় পেপার ধরে পেপার পড়তে থাকে জোরে জোরে। তার কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি, আমেরিকা যতই নাক গলাতে আসুক, বাংলাদেশে নির্বাচন হবে সময়মতো।

এমন সময় লোকটার ফোন বেজে ওঠে। স্যামসাং কোম্পানির সাধারণ বাটন ফোন। লোকটা ফোনটা একনজর দেখে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। তারপর তার বস্তার মুখ খোলে। অপটু হাতের গিঁট, খুলতে খুব একটা কষ্ট হয় না তার।

বস্তার মুখ খুললে আমরা দেখি, তার ভেতরে এক অপূর্ব সুন্দর মেয়েলোক বসা। সম্ভবত ভদ্রলোকের স্ত্রীর লাশ, যেমনটা তিনি বললেন।

‘এতো হইচই কেন চারপাশে? কোথায় তুমি?’ সুন্দরী মহিলার কুশ্রী চিৎকারে আমরা হতচকিত হয়ে পড়ি। লোকটা থমকে যায়। বাচ্চা চমকে উঠে তার পা আঁকড়ে ধরে। রমজান ডেকসেটের আওয়াজ কমাতে কমাতে প্রায় বন্ধই করে দেয়।

‘তিনটা গাধা আর তুমি মিলে মোট কয়টা গাধা হয়?’ ভদ্রলোকের স্ত্রী তাকে প্রশ্ন করেন। ভদ্রলোক কোনো উত্তর দেন না। মাথা নিচু করে বসে থাকেন নীরবে। আমরা কানিয়ে কানিয়ে দেখি, ভদ্রলোক ছাড়া আমরা মোট তিনজন বসা এই চায়ের দোকানে।

‘আর তুই এতো বাইরে বাইরে ঘুরিস কেন সারাদিন?’ ভদ্রমহিলার অসম্ভব সুন্দরী মুখশ্রী রাগে আগুনের মতো গনগন করতে থাকে। সে তার পুত্রের হাত ধরে টেনে তাকে বস্তার ভেতর সাধানোর চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। পুত্র ছুটে বেরিয়ে যায় দোকান থেকে। আমরা খেয়াল করি, লোকটার হাতে একটুকরো পাথর উঠে এসেছে কীভাবে যেন। সে পাথর এইহাত থেকে ওইহাত করছে থেকে থেকে। মাথা এখনও নিচু। সরাসরি তাকাচ্ছে না তার স্ত্রীর দিকে।

‘এখন থাকুক এসব,’ লোকটা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে।

‘সারাজীবন ওই এক কথা, এখন থাকুক, এখন থাকুক,’ মহিলা গজগজ করে ওঠে চুপ হয়ে যায়।

লোকটা হাতের পাথর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবারো যত্ন করে তার বৌয়ের লাশ ঠেলে ঢুকায় বস্তার ভেতর। তারপর যত্ন করে ফুলতোলা গিঁট দেয়। ভাঙারির বস্তায় নকশী গিঁট আমাদের বিস্মিত করে কিছুটা। তারপর লোকটা বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। কাঁধে তুলে নেয় ছেলেকে, অন্যহাতে বস্তা রাস্তার ওপর ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে টেনে এগিয়ে চলে। সে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে আমরা যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

গল্পটি আজ বাংলা ট্রিবিউনের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:২২

জনারণ্যে একজন বলেছেন: গল্প ভালো লেগেছে, আবির।

বর্ণনার ডিটেইলস অসাধারণ ছিল। খুবই ছোটোখাটো দু'একটা অসামঞ্জস্যতা - কিন্তু তা ইগনোরেবল। (যেমন: ভদ্রমহিলার অসম্ভব "সুন্দরী" মুখশ্রী রাগে আগুনের মতো গনগন করতে থাকে। এখানে "সুন্দর" হলে মনেহয় বেশি মানানসই হতো)।

চমৎকার একটা ছোটগল্প আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

২| ২৪ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৫৮

কোলড বলেছেন: Your attention to detail of the character and the surrounding is great! Sad to see so few comments though.

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫০

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, প্রিয় ব্লগার। মন্তব্যের জন্য আমার আফসোস নেই। লেখা কোথাও জমিয়ে রাখা লাগে বলে রাখছি এখানে। ভালো আছেন আশা করি।

৩| ২৫ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৫

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর গল্প। গ্রেট।

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫০

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ

৪| ২৬ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:০১

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: আপনার বর্ণনা-ভঙ্গি আমার বরাবরই ভালো লাগে। এটাও তার ব্যতিক্রম নয়।

তবে এ গল্পের শেষটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। আবার পড়লে কি বুঝতে পারব?

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫১

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। টানলে পড়তে পারেন। এটা সিম্বলিক একটা গল্প।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.