নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)
ঘুম থেকে উঠে সে দেখলো, তার 'মেটামরফসিস' হয়েছে। শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে সে পরিণত হয়েছে গ্রেগর সামসায়।
পীঠে ভর দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে সে, ছাদের দিকে তাকিয়ে। অন্ধকারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তার চোখের সময় লাগলো খানিকটা। ছাদটা সাধারণ, যেরকম ছাদ সবসময় সবজায়গায় খুঁজে পাওয়া যায়। কোন একসময় ওটা সাদা, বা এরকম কোন হালকা রঙে রাঙ্গানো হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা ধুলো ময়লা এখন এটার রং নষ্ট দুধের মতো বানিয়ে ফেলেছে। কোন সাজসজ্জা, বা চোখে পড়ার মতো কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই। নেই কোন অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব, বা সংবাদ। কেবল নিজের কাঠামোগত দায়িত্ব পালনই করছে এটা ঠিকঠাক, এর বেশি আর কিছুই না।
কামরায় তার অবস্থানের বাঁ দিকে একটা বড় জানালা ছিল, কিন্তু তার পর্দা সরিয়ে লম্বালম্বিভাবে কিছু মোটা কাঠবোর্ড পেরেক মেরে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি সমান্তরাল বোর্ডের মাঝখানে এক ইঞ্চির মতো ফাঁক রাখা হয়েছে, তা কি স্বেচ্ছায় নাকি এমনি এমনি, বোঝা যাচ্ছে না। সেই ফাঁক গলে উজ্জ্বল সূর্যালোক মেঝের ওপর সমান্তরাল ছায়ারেখা তৈরি করেছে। জানালা এভাবে আটকে দেয়ার কি কারন হতে পারে? বড় ধরনের কোন ঝড়ঝঞ্ঝা বা টর্নেডো আসন্ন দেখেই কি? নাকি জানালা এভাবে আটকে দেয়া, যাতে কেউ এদিক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ না করতে পারে? নাকি, ভেতর থেকে কেউ (অর্থাৎ সামসা নিজেই) বাইরে না বেরুতে পারে সে জন্য?
চিত হয়ে শুয়ে থেকেই সে এবারে সারাটা কামরার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকালো। ঘরে কোন আসবাবপত্র ছিল না, শুধুমাত্র তার শুয়ে থাকার খাটিয়াটা ছাড়া। কোন আলমিরা, টেবিল, বা চেয়ার ছিল না ওখানে। দেয়ালে ছিল না কোন ছবি, ঘড়ি, বা আয়না। ছিল না কোন ল্যাম্প, বা অন্য কোন আলোর উৎস। কাঠের তৈরি মেঝেতে ছিল না কোন পাপোশ বা কার্পেট। চারপাশের দেয়াল একধরনের জটিল কারুকার্য অঙ্কিত দেয়াল আচ্ছাদনিতে মোড়ানো ছিল, কিন্তু বয়সের কারনেই অঙ্কিত কারুকার্যগুলো এতোটা আবছা হয়ে গিয়েছিল তা আর দেখে আলাদা করে বোঝার উপায় ছিল না।
ডানদিকে, তথা জানালার উল্টোপাশের দেয়ালে একটা দরজা দেখা যাচ্ছিল। সে দরজার ধাতব হাতলের জায়গায় জায়গায় রং চটে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছিল যে এই কামরাটা একসময় শয়নকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অথচ এখন মানবজীবনের উপস্থিতি আর কোন লক্ষনই এতে বাকি নেই। বাকি আছে, কক্ষের একদম মধ্যখানে তার একাকী একটি খাট। খাটে কোন জাজিম বা তোষক নেই। নেই কোন বিছানা চাদর, কোন বালিশ। কেবল অতি পুরাতন একটি মাদুর বেছানো।
সামসার কোন ধারনা ছিল না যে সে কোথায় আছে, অথবা তার কি করা উচিৎ। তার স্রেফ এতোটুকুই জানা ছিল যে সে গ্রেগর সামসা নামে একজন মানুষে পরিণত হয়েছে। সে এই তথ্যটুকুই বা কিভাবে জানলো? যখন সে ঘুমিয়েছিল, তখন হয়তো কেউ তাকে চুপি চুপি এসে কানে কানে বলে দিয়ে গেছে। কিন্তু গ্রেগর সামসায় পরিণত হবার আগে সে কে ছিল? অথবা, সে কি ছিল?
এসমস্ত প্রশ্ন নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে সে খেয়াল করে, তার মস্তিষ্কের ভেতরে যেন নিকশ কালো মশাদের একটা লম্বা কলাম ঘুরপাক খাচ্ছে। সারিটা কেবল ঘন আর মোটা হয়ে চলেছ ক্রমাগত, ভ্যানভ্যান করতে করতে মশাদের সে কলাম হাজির হল তার মস্তিষ্কের নরম এক প্রকোষ্ঠে। সামসা সিদ্ধান্ত নিলো চিন্তাভাবনা বন্ধ করে দেবার। চিন্তা করে তার বর্তমান অবস্থার কূলকিনারা বের করার চেষ্টা করাটা খুব কঠিন একটা কাজ হবে।
যা হোক, তার শরীর নাড়াচাড়া করা শেখা দরকার। বাকি জীবন তো আর এভাবে চিত হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেয়া যাবে না। এছাড়াও, শুয়ে থাকার এই ভঙ্গীটা খুব অনিরাপদও বটে। যদি কেউ আক্রমণ চালায়, উদাহরণতঃ শিকারি পাখিরা, তবে তার আর বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। একদম শুরুতে সে নিজের হাতের আঙ্গুল নাড়ানোর চেষ্টা করলো। দু' হাতে, সবমিলিয়ে লম্বা লম্বা, কিম্ভূতদর্শন দশটা আঙ্গুল ছিল। প্রতিটা আঙ্গুলে ছিল আবার কতিপয় গিঁট, ওগুলোর উপস্থিতির কারনেই আঙ্গুলের নাড়াচাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হচ্ছিল। মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো, সে তার শরীরে কোন অনুভূতিই টের পাচ্ছিল না, যেন তাকে চুবিয়ে রাখা হয়েছিল কোন ভারী - আঠালো তরলে, যার ফলে সে তার শরীরের প্রান্তসীমায় কোন শক্তি সঞ্চার করতে পারছিল না।
অবশেষে, বারবার চেষ্টা করা এবং ব্যারথ হবার পর, চোখ বন্ধ করে, সমস্ত মনোযোগ এক বিন্দুতে এনে অবশেষে সে তার আঙ্গুলের নড়াচড়া কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হল। অল্প অল্প করে সে শিখছিল, কিভাবে সবগুলো আঙ্গুলের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় রেখে তাদের নাড়ানো যায়। তার আঙ্গুলগুলো চলনসই হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার শরীরে যে একটা ভোঁতা অনুভূতিশূন্যতা কাজ করছিল, তা চলে গেলো। তার বদলে জোয়ারে ভেসে আসা এক অন্ধকার এবং অলুক্ষুনে জাহাজের মতো অসহনীয় ব্যাথা ঢেউয়ের তোড়ে আছড়ে পড়তে লাগলো তার শরীর জুড়ে।
সামসার কিছুটা সময় লাগলো এটা বুঝতে যে, ব্যাথাটার উৎস ছিল মূলত ক্ষুধা। এরকম মারদাঙ্গা ক্ষুধার অভিজ্ঞতা ছিল তার জন্য একেবারেই নতুন, বা এরকম অভিজ্ঞতার কোন স্মৃতি তার স্মরণে নেই। যেন গত একসপ্তাহ যাবত তার পেটে দানাপানি কিছু পড়ে নি। যেন তার শরীরের কেন্দ্রস্থলে এক অন্তঃহীন শূন্য গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে। তার শরীরের হাড়গোড় মটমটিয়ে উঠলো, মাংসপেশীতে টান পড়লো, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বেঁকে উঠলো থেমে থেমে।
অসহনীয় এই কষ্টের তাড়নায় সামসা কনুইয়ে ভর দিয়ে একটু একটু করে উঠে বসলো। এই করতে গিয়ে তার মেরুদণ্ডে কিছু ভয়াবহরকমের কড়মড় আওয়াজ তৈরি হল। হায় কপাল, সামসা ভাবল, কতক্ষণ হয় আমি এভাবে শুয়ে আছি? প্রতিবারের নড়াচড়ায় তার শরীর প্রতিবাদ করে উঠলো। কিন্তু সে হাল ছেড়ে দিলো না, ক্রমাগত শক্তি প্রয়োগ করে অবশেষে সক্ষম হল উঠে বসতে।
সামসার নগ্ন শরীরের আকৃতি তার মধ্যে প্রবল হতাশার জন্ম দিলো। কি দুর্ভাগ্যজনক এক গড়ন তার! আত্মরক্ষার কোন উপায় প্রকৃতি এই শরীরে জুড়ে দেয় নি। মসৃণ সাদা চামড়া (তার উপরে এখানে সেখানে একমুঠো করে লোম ছড়ানো ছিটানো) -র ওপর দিয়ে নীল রঙের শিরা উপশিরা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে; খুবই নরম, প্রতিরক্ষার আস্তর বিহীন একটা পেট; অবিশ্বাস্যরকমের আকৃতির একটি জননাঙ্গ; মাত্র একজোড়া (!) করে হাত আর পা; চাইলেই টুক করে মটকে দেয়া যায় এমন একটি ঘাড়; আগামাথাছাড়া বিশাল একটি মাথা, তার ওপরে আবার ফুরফুরে কিছু চুল; সামুদ্রিক ঝিনুকের মতো দেখতে একজোড়া কিম্ভূতকিমাকার কান ঠেলে বেরিয়ে এসেছে দুপাশ দিয়ে। এই অপরিচিত জীবটাই কি সে? এই ধরনের খুঁতে ভরপুর একটা শরীর, যা এক আঘাতে খতম করে দেয়া সম্ভব (নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে শরীরের ওপর কোন আস্তর নেই, আক্রমণ শানানোর জন্য শরীরে আলাদা কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই) - এ নিয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা যায়? বরং সে কেন মাছে পরিণত হল না? অথবা সূর্যমুখী ফুলে? মাছ, অথবা সূর্যমুখী ফুলে পরিণত হওয়াটাই ছিল মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য মেটামরফসিস, বা পরিবর্তন। এই গ্রেগর সামসা নামক উদ্ভট এক প্রাণীতে পরিণত হওয়ার চেয়েও তা হত অনেক বেশি অর্থবহ। এছাড়া বিষয়টা নিয়ে আর কোনভাবে চিন্তা করা যাচ্ছে না।
পাথরের মতো থির হয়ে সে তার পা দুটো আস্তে আস্তে খাটিয়ার প্রান্তসীমা পার করে মাটিতে স্পর্শ করায়। কাঠের মেঝের শীতলতায় আঁতকে উঠে সে খাবি খায় মুহূর্তের জন্য। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ার মতো বেশ কয়েকটি উপলক্ষ তৈরি করতে করতে বেঁচে গিয়ে অবশেষে সে সক্ষম হয় দু' পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে। খাটিয়ার একটা পাশ একহাতে খিমচে ধরে সে দাঁড়িয়ে থাকে শরীরের নানা জায়গায় আঘাত আর ব্যাথার চিহ্ন নিয়ে। মাথাটাকে তার মনে হয় সামঞ্জস্যতাবিহীনভাবে ভারী, জিনিসটা কাঁধের ওপর সোজা করে ধরে রাখতেই তার জান বেরিয়ে যাচ্ছিল। বগলের তল থেকে ঘাম ঝরে পড়ে ভাসিয়ে দিচ্ছিল পুরো শরীর, যৌনাঙ্গ কুঁচকে উঠেছিল ব্যাথায়। তাকে বেশ কয়েকবার বড় বড় করে শ্বাস নেয়া লাগে শরীরের খিঁচ খেয়ে থাকা পেশীগুলোকে স্বাভাবিক করার জন্য।
দু'পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো শেখার পর এবারে তার শেখা লাগে পায়ে ভর দিয়ে হাঁটা। এক পা, এক পা করে সামনে এগোনোর প্রক্রিয়াটা তার কাছে অত্যাচার লাগে, প্রতিবার শরীর নাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীর ঝনঝনিয়ে ওঠে ব্যাথায়। যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গীতেই বিবেচনা করা হোক না কেন, এইভাবে ডান পা বাম পা বারবার নড়াচড়া করে হেঁটে সামনে এগুনোর যে পন্থা - এটা দুনিয়ার সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়মকে লঙ্ঘন করে তৈরি করা। তার উপরে, তার চোখের দৃষ্টিসীমা থেকে ভূভাগের দূরত্ব দেখে সে আরও একবার আঁতকে উঠেছিল। তার পশ্চাৎপদেশ এবং হাঁটুর জোড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনা শিখতেও তার সময় লাগে। আরও সময় লাগে তার সামগ্রিক নড়াচড়ার মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানে। প্রতিবার একটা পা সামনে ফেলা মাত্রই তার হাঁটু ভয়ে ঠকঠকিয়ে কেঁপে ওঠে। তার কেঁপে উঠে দু'হাত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেয়াল ধরে তাল সামলাতে হয়।
কিন্তু সে এটা বুঝতে পেরেছিল যে, এই রুমে তারপক্ষে সারাজীবন থাকা সম্ভব নয়। সে যদি কিছুক্ষণের মাঝেই খাওয়ার মতো কিছু খুঁজে বের করতে না পারে তবে হয় তার নিজের শরীরের মাংস কামড়ে খেয়ে ফেলতে হবে, অথবা, সে হয়তো মারাই যাবে।
সে দরজার সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করলো কিছুক্ষণ, দেয়ালে হালকা থাবা মেরে দেখল। এতোটুকু পথ পরিভ্রমণেই যেন ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেছে তার, যদিও সময় পরিমাপের জন্য তার কাছে শরীরের ব্যাথার ক্রমিক বৃদ্ধি ছাড়া আর কোন পরিমাপক ছিল না। তার নড়াচড়া ছিল খুবই অস্বস্তিকর, হাঁটার গতি ছিল শামুকের মতো। কোন কিছুর ওপর ভর না দিয়ে সামনে এগোনো সম্ভব হচ্ছিল না মোটেও। রাস্তায় এসে নামলে মানুষ তাকে বিকলাঙ্গ ভাববে, এই ছিল তার আশা। এই অস্বস্তিকর অবস্থার পরেও, প্রতি পদক্ষেপের মাধ্যমে সে টের পাচ্ছিল, ধীরে ধীরে সে শিখছে তার পায়ের গিঁট এবং পেশীগুলোর কর্মপন্থা।
সে দরোজার হাতল ধরে টান দিলো। কোন নড়াচড়া নেই। এবারে সে দরজা ধাক্কা দিলো, তাতেও একই ফলাফল। এবার সে দরজার হাতলটা একবার ডানে ঘুরিয়ে তারপর হ্যাঁচকা টান দিতেই সেটা ক্যাঁচ করে শব্দ তৈরি করে খুলে গেলো। এটা তালা দেয়া ছিল না। সে ফাঁকা দিয়ে মাথা বের করে ইতিউতি চাইলো এদিকসেদিক। সামনের করিডোর ছিল একদম জনশূন্য। সমুদ্রের তলদেশের মতো নীরব ছিল জায়গাটা। প্রথমে হলঘরে তার বাম পা'টা রেখে পুরো শরীর দুলিয়ে সে ভাসিয়ে দিলো দরোজার ঐ পাশে। একহাতে দরোজার ফ্রেম আঁকড়ে ধরে রেখে এবারে সে তার ডান পা'টাও বাইরে নিয়ে এসে সশরীরে এসে দাঁড়ালো করিডোরে। একহাতে দেয়াল ধরে, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল সে করিডোর দিয়ে।
হলওয়েতে সব মিলিয়ে চারটা দরোজা ছিল, সে যে দরোজাটা ব্যবহার করেছে, সেটা সহ। প্রতিটাই দেখতে একরকম, কালো রঙের কাঠ দ্বারা নির্মিত। এদের পেছনে কে আছে, বা কি আছে? সামসার ইচ্ছে হল দরজা খুলে দেখার। তাহলে হয়তো সে যে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছে, তার একটা সুরাহা হবে। অথবা, নিদেনপক্ষে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। যাই হোক, সে একটা একটা করে প্রতিটা দরোজা পার হয়ে গেলো, পারতপক্ষে কোন আওয়াজ তৈরি করা ছাড়াই। তার উদরপূর্তি করার বাসনা সবরকমের কৌতূহলের ওপর বিজয়ী হল। যেকোনোভাবেই হোক না কেন, খুব দ্রুত তাকে পেটে উপযুক্ত কিছু ঢোকাতে হবে।
"উপযুক্ত কিছু" - খুঁজে পাওয়ার একটা হদিসও তৈরি হয়ে গেলো শীঘ্রই।
ঘ্রাণ নিতে নিতে এগুতে হবে, সে চিন্তা করলো। অদূরেই কোথা থেকে যেন রান্না করা খাবারের সুবাস ভেসে আসছিল, বায়ুকনার সঙ্গে মিলে। তার নাকের ভেতর অবস্থিত ঘ্রাণেন্দ্রিয়র সংগ্রহকৃত তথ্য মস্তিষ্কে সঞ্চারিত হওয়া মাত্রই সেখানে এতো স্পষ্ট একটা কামনা তৈরি হল, এতো উগ্র একটা তাড়না সৃষ্টি হল ক্ষুধার যে মনে হচ্ছিল কোন একজন প্রশিক্ষিত জল্লাদ তার পেটের নাড়িভুঁড়ি চেপে ধরে মুচড়ে দিচ্ছে। তার পুরো মুখ লালায় ভরে গেলো।
অবশ্য খাবারের সুঘ্রাণ যেখান থেকে ভেসে আসছে, সেখানে পৌঁছাতে হলে তাকে সতেরোটা খাড়া খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হবে। এমনিতেই সোজাসাপটা মেঝেতে হাঁটতেই তার খবর বের হয়ে যাচ্ছিল, এখন ঐ সিঁড়ি বেয়ে নামাটা তার জন্য দুঃস্বপ্ন রূপে আবির্ভূত হল। দু'হাতে শক্ত করে সিঁড়ির হাতল চেপে ধরে সে ধীরে ধীরে নামা শুরু করলো। তার হাড় জিরজিরে হাঁটু এমনভাবে খটখট করছিল যে তার ওজনের চাপে সে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলে। যখন সে ঘুরেফিরে নিজেকে আবার সোজা করে দাঁড় করালো, ততক্ষণে তার পুরো শরীরের মাংসপেশী আর হাড়গোড় ব্যাথায় কুঁচকে উঠেছে।
আর এভাবে নীচে নামার সময়ে সামসা মনে মনে ভাবছিলই বা কি? মাছ, আর সূর্যমুখী ফুলের কথা - বেশীরভাগ সময়। বরং যদি আমি একটা মাছ অথবা সূর্যমুখী ফুলে পরিণত হতাম, তবে শান্তিমতো জীবনটা কাটাতে পারতাম, এরকম কষ্ট করে উঠানামা করা ছাড়া - এটাই ভাবছিল সে। এরকম একটা বিপদজনক এবং অপ্রাকৃতিক কাজ আমাকে কেন করতেই হবে? সম্পূর্ণ অর্থহীন - এ কাজের কোন প্রাসঙ্গিকতা বা যৌক্তিকতা নেই।
সতেরো ধাপ নীচে নেমে এসে সামসা শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে নিজেকে আবারো টেনে হিঁচড়ে সোজা করে দাঁড় করালো, তারপর হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে চলল খাবারের ঘ্রাণ যেখান থেকে আসছে সেদিকে। উঁচু ছাদের প্রবেশিকা হলঘর পেরিয়ে সে পৌঁছে গেলো রান্নাঘরের খোলা দরোজার সামনে। গোল ডিম্বাকৃতির একটা টেবিলের ওপর খাবারগুলো সাজিয়ে রাখা ছিল। সাথে পাঁচটা চেয়ারও রাখা ছিল, যদিও কোন মানুষ ছিল না। খাবারগুলোর ওপরে গরমগরম সাদা ধোঁয়া উঠছিল ক্রমাগত। টেবিলের একদম মাঝখানটায় কাঁচের ফুলদানিতে একডজন লিলি ফুল রাখা ছিল। ন্যাপকিন, কাঁটাচামচ সহ সব মিলিয়ে চারটা প্লেট রাখা ছিল টেবিলের ওপর, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তাদের স্পর্শ করে নি কেউ। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে যেন একদল মানুষ কয়েকমুহূর্ত আগে এখানে একসঙ্গে সকালের নাশতা করতে বসেছিল, কিন্তু হঠাৎ করে আবির্ভূত হওয়া একটা ঘটনায় তাদের এই জায়গা ছেড়ে ছুটে পালাতে বাধ্য করেছে।
কি হয়েছিল এখানে? সবাই কোথায় চলে গেছে? অথবা, তাদের কি কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে? তারা কি সকালের নাস্তা শেষ করতে ফিরে আসবে আবার?
কিন্তু সামসার হাতে আসলে এসমস্ত বিষয় নিয়ে ভেবে নষ্ট করবার মতো সময় হাতে ছিল না। সবচে কাছের চেয়ারটাতে প্রায় ধুপ করে বসে পড়ে হাতের কাছে যে খাবারই পাওয়া যায় - সেটাই খালি হাতে তুলে নিয়ে গাপুসগুপুস করে খাওয়া শুরু করলো, ছুরি - কাঁটাচামচ আর ন্যাপকিনের কথা ভুলে। কোন রকমের জ্যাম, জেলি বা মাখনের ব্যবহার ছাড়াই সে খালি রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে ঢোকাতে লাগলো, এক এক কামড়ে চর্বিতে ভাজা আস্ত একেকটা সসেজ মুখে পুরলো, আধাসেদ্ধ ডিম দারুন দ্রুত গতিতে মুখে চালান করে দিলো তাদের ওপরের চামড়া ভালো করে ছাড়ানো ছাড়াই। নলা পাকিয়ে মুখে চালান করে দিলো তখনও গরম থাকা মাখন দিয়ে করা আলু ভর্তা, যাকে ইংরেজিতে বলে ম্যাশড পটেটো। নিজের আঙ্গুলে টপাটপ পিকলস তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো মুখের ভেতর। সবকিছু যত্ন করে চিবিয়ে খেয়ে পরে সামনে রাখা এক পানির জগ থেকে মুখ ভর্তি করে পানি নিয়ে কুলকুচো করে সবকিছু চালান করে দিলো পেটে। খাবারদাবারের স্বাদ কোন বিষয় ছিল না তার কাছে। বিস্বাদ হোক বা সুস্বাদু, ঝাল হোক বা টকঃ সে তফাৎ করতে পারছিল না। পেটের ভেতরে যে সর্বগ্রাসী আন্তঃব্রহ্মাণ্ড শূন্যগহ্বরের উদয় হয়েছে, তার চাহিদা মেটানোই ছিল তার কাছে সে মুহূর্তে সবচে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সে প্রবল মনোযোগ দিয়ে খাবার খেতে লাগলো, যেন খাবার খেয়ে শেষ করবার জন্য তাকে সময় বেঁধে দিয়েছে কেউ। খাওয়ার মাঝে সে এতোটাই ডুবে গিয়েছিল যে আঙ্গুল চাটতে চাটতে নিজের অজান্তেই আঙ্গুলে দশাসই একটা কামড় বসিয়ে দিলো। ঘরময় রক্ত ছড়িয়ে পড়লো কামড়ে কাটা আঙ্গুলের জায়গা থেকে। এই করতে করতে কখন যে একখানা থালা মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেলো, সে টেরও পেলো না।
খাওয়া শেষ করে সামসা যতক্ষণে গা এলিয়ে দিয়ে বসে একটু দম নেবার ফুসরত পেলো, ততক্ষণে আর খাবার বলতে আর কিছুই বাকি নেই, ডায়নিং টেবিলের অবস্থাও বিধ্বস্ত একদম। সবকিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছিল যেন একদল ঝগড়াটে কাক কোন খোলা জানালা দিয়ে উড়ে এসে বসেছিল এই ডায়নিং টেবিলে, তারপর ঠুকরে ঠুকরে খেয়েছে সবকিছু, এরপর উড়ে চলে গেছে আবার। পুরো টেবিলে সামসার হাতের স্পর্শ থেকে বেঁচে গেলো কেবল কাঁচের ফুলদানীতে রাখা লিলি ফুলগুলো; খাবারের অভাব যদি থাকতো, তবে সামসা হয়তো সে ফুলগুলোও খেয়ে ফেলত। এতোটাই ক্ষুধার্ত ছিল সে।
সে স্থানুর মতো চেয়ারে বসে রইলো দীর্ঘ সময় ধরে। টেবিলের ওপর আলগোছে হাত দুটো রেখে দিয়ে সে আধবোজা চোখে লিলি ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো একটানা, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিবেগ স্তিমিত করে এনে। এইফাঁকে তার গোগ্রাসে গিলতে থাকা খাবারগুলো পেটের ভেতর পরিপাকযন্ত্রে পরিপাককৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো যে যার জায়গায়। জোয়ারের ঢেউয়ের মতো তার শরীরজুড়ে বেশি খাওয়ার একটা প্রভাব সঞ্চারিত হল।
এরপর সে একটা ধাতব পাত্র থেকে কফি ঢেলে নিলো সিরামিকের কাপে। এর তীক্ষ্ণ ঘ্রাণ তাকে ফিরিয়ে দিলো কিসের যেন স্মৃতি। সেই স্মৃতি একবারে সব এলো না; ধাপে ধাপে, একটু একটু করে এলো। খুব অদ্ভুত ছিল সে প্রক্রিয়া, যেন সে ভবিষ্যতে বসে বর্তমান সময়ের স্মৃতি হাতড়ে ফিরছে। যেন সময় দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, যার ফলে স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা একটা বদ্ধ চক্রে আবর্তিত হতে শুরু করেছে একে অপরের পিছে। কফিতে যথেষ্ট পরিমানে ক্রিম ঢেলে আঙ্গুল দিয়ে নেড়ে সে ঢকঢক করে পান করে নিলো সেটা। যদিও কফিটা মোটামুটি ঠাণ্ডাই ছিল, তবে পুরোপুরি নয়, কিছুটা উষ্ণতা তখনও বাকি ছিল ওতে। গিলে কণ্ঠনালী হয়ে পেটে চালান করে দেয়ার আগে সে মুখে খানিকক্ষণ ধরে রাখল তরলটা। কাজটা তাকে বেশ প্রশান্ত করে তুলল।
এরপর হঠাৎ করেই তার ঠাণ্ডা লাগা শুরু হল। ক্ষুধার তীব্রতা এতক্ষণে তার অন্যান্য সব স্নায়বিক অনুভূতিগুলোকে বিকল করে রেখেছিল। ক্ষুধা নিবারণের পর ত্বকের ওপর সকালবেলার শীতলতার প্রভাব তাকে কাঁপিয়ে তুলল ভেতর থেকে। ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভে গেছে। ঘরের ভেতরে একটা হিটারও কাজ করছে না। সর্বোপরি তার শরীরে সুতো পরিমাণ কাপড়ও ছিল না, এমনকি তার পাও ছিল খালি।
সে টের পেলো, এযাত্রা তাকে পড়বার জন্য কিছু কাপড়চোপড় খুঁজে বের করতে হবে। নগ্ন শরীরে তার প্রচণ্ড শীত লাগছিল। তাছাড়া শরীরে কাপড়ের অভাব তার মধ্যে এই চেতনাও তৈরি করে রেখেছিল যে - যেকোনো মুহূর্তে কেউ চলে আসতে পারে। হয়তো এখনি দরোজা খটখটাবে কেউ। অথবা, যারা সকালের নাস্তা করতে বসেছিল, তারাই হয়তো ফিরে আসবে। তারা সামসাকে এই অবস্থায় এখানে আবিষ্কার করে কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে কে জানে?
সে এসবই বুঝল। এই বোঝাপড়া অর্জনের জন্য তার যে খুব মাথা খাটিয়ে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থা অবলম্বন করা লেগেছে, তা নয়। সে এমনি এমনিই কিভাবে যেন বুঝে গেলো এ সব। সামসার কোন ধারনা ছিল না যে তার এ জ্ঞানের সূত্র কি। সম্ভবত এটা ছিল সে চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকা স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু একটা ব্যাপার।
সে চেয়ার হতে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের হলঘরে গিয়ে হাজির হল। হাঁটতে এখনো অস্বস্তি হলেও এখন সে অন্তত কোন কিছু আঁকড়ে ধরা ছাড়াই দু' পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারছিল। সামনেই এক লোহার তৈরি ছাতির মতো ছড়ানো একটা স্ট্যান্ড ছিল, যাতে হাঁটার লাঠি ঝোলানো ছিল বেশকিছু। সে ওক কাঠের তৈরি কালো রঙের একটা লাঠি টেনে বের করে নিলো তার হাঁটার কাজে সহায়তার জন্য; লাঠিটার হাতল মুঠোর মাঝে আঁকড়ে ধরা মাত্রই সেটা তার মধ্যে এক প্রশান্তি ছড়িয়ে তাকে আত্মবিশ্বাস দিলো। তাছাড়া, যদি পাখিরা আক্রমণ করে, তবে তাদের সঙ্গে লড়বার জন্য তার হাতে এখন একটা অস্ত্রও আছে। সে জানালার কাছে গিয়ে লেসের পর্দার ফাঁক দিয়ে ওপারে তাকাল।
বাড়ির সামনেই একটা রাস্তা। রাস্তাটা খুব বড় নয়। খুব বেশি মানুষও ছিল না সেখানে। কিন্তু সে খেয়াল করলো যে, যারাই রাস্তাটা পার হচ্ছে হেঁটে - তাদের সকলের শরীরেই অনেক পোশাক ছিল। সে পোশাকগুলো ছিল আবার বিভিন্ন ঢক পদ আর রঙের। বেশীরভাগই ছিল পুরুষ, কিন্তু সময়ে সময়ে দু' একজন নারীও দেখা যাচ্ছিল। পুরুষ আর নারীদের পোশাক ছিল ভিন্ন। তাদের পা আঁকড়ে ধরে ছিল চামড়ার জুতো। কেউ কেউ আবার উজ্জ্বল ঝকঝকে পলিশ করা বুটজুতো পরে ছিল পায়ে। পাথুরে রাস্তায় তাদের বুটজুতোর খটখট আওয়াজ সামসার কানে এই এপার্টমেন্টের ভেতরে বসেই ধরা দিচ্ছিল। নরনারীদের অনেকের মাথায় আবার হ্যাটও ছিল। দু' পায়ে হেঁটে বেড়াতে তাদের বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হচ্ছিল না, আর তাদের সবারই যৌনাঙ্গ ছিল আবৃত। সামসা বাইরের হেঁটে বেড়ানো নরনারীদের শারীরিক আকৃতির সঙ্গে নিজের শারীরিক আকৃতির তুলনা করলো, হলঘরে রাখা প্রমাণ সাইজের কাঁচের আয়নায় নিজের শরীরের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে। আয়নায় যার প্রতিবিম্ব দেখা গেলো সে ছিল এক জুবুথুবু ভঙ্গুর চেহারার জীব। তার পেটের ওপর ঝোল পড়ে একাকার হয়ে ছিল। আর তুলোর মতো দেখতে রুটির টুকরো টাকরা জড়িয়ে ছিল তার নাভির নীচে যৌনকেশের সঙ্গে। সে হাত দিয়ে নিজের শরীর পরিষ্কার করে নিলো।
হ্যাঁ, আমাকে শরীর ঢাকবার জন্য কিছু পোশাকাদি খুঁজে বের করা দরকার - ভাবল সে পুনরায়।
আবারো সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল একবার পাখির খোঁজে। কিন্তু কোন পাখি ছিল না তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে।
বাড়িটার নীচের তলায় ছিল একটা হলওয়ে, ডায়নিং রুম, রান্নাঘর আর বসবার ঘর। কিন্তু এসমস্ত রুমের একটাতেও পড়বার মতো কোন কাপড় ছিল না। এতে করে বোঝা গেলো জামাকাপড় বদলানোর কাজ এই তলায় করা হয় না। অন্য কোনখানে, সম্ভবত দ্বিতীয়তলার কোন কামরায় তার একবার গিয়ে দেখা দরকার।
সামসা সিঁড়িঘরে ফিরে এসে এবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। নীচে নামা থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা কত সহজ - এটা আবিষ্কার করে সে বিস্মিত হয়ে গেলো। সিঁড়ির হাতল এক হাতে আঁকড়ে ধরে সে সতেরোটি ধাপ পার করে ফেলল আগের চে অনেক দ্রুতগতিতে, এবং কোনরকম ব্যাথা বা ভীতি ছাড়াই। কয়েকবার অবশ্য তার থেমে দাঁড়িয়ে দম নেয়া লেগেছে।
বলতে গেলে এটা তার সৌভাগ্যই ছিল যে, দ্বিতীয়তলার কোন কক্ষেই তালা লাগানো ছিল না। তার করনীয় বলতে ছিল কেবল হাতল ঘুরিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয়া, এভাবে প্রতিটি দরজাই খুলে গেলো। সে হিমশীতল কামরা, যাতে সে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল খালি পায়ে, সেটা বাদে সব মিলিয়ে আরও চারটা কক্ষ ছিল ঐ তলায়। প্রতিটি কক্ষই খুব যত্ন করে সাজিয়েগুছিয়ে রাখা। প্রতিটাতেই পরিষ্কার বিছানার চাদর সহ বিছানা ছিল, ছিল কাপড়চোপড় রাখবার দেরাজ, লিখবার টেবিল, ছাদ কিংবা দেয়ালের সঙ্গে টাঙ্গানো ল্যাম্প, মেঝেতে নকশাদার কার্পেট। সবকিছুই ছিল একদম ঝকঝকে তকতকে। বুকশেলফে রাখা বইগুলো একদম সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ছিল পাশাপাশি, দেয়ালে ঝুলছিল তেল রঙে আঁকা নিসর্গ চিত্র। প্রতিটি কামরায় কাঁচের ফুলদানি হরেকবর্ণের রঙিন ফুলে ভরা ছিল। কাঠের তক্তা দিয়ে আটকানো ছিল না আর কোন জানালা। জানালাগুলোয় ছিল লেসের পর্দা, সূর্য আশীর্বাদজ্ঞাপনের মতো করেই আলো বিলিয়ে যাচ্ছিল তার ওপর দিয়ে। প্রতিটি বিছানাতেই কারো শুয়ে থাকার ছাপ ছিল বিদ্যমান। বালিশে মানুষের মাথার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
সামসা তার শরীরের আকৃতির একটি ড্রেসিং গাউন খুঁজে পেলো সবচে বড় কক্ষটার কাপড় রাখার আলমিরাতে। দেখে মনে হল, এর ভেতরে শরীর আঁটিয়ে দেয়া যাবে কোনভাবে। অন্যান্য পোশাকের ব্যাপারে তার কোন ধ্যানধারণা ছিল না, কিভাবে তাদের পড়া যায় - কোনভাবেই বুঝতে পারছিল না সে। খুবই জটিল ছিল তাদের গঠনঃ অনেক বেশি বোতাম, এছাড়াও কোনটা যে সামনের দিক আর কোনটা পেছনের - সেটাও সে আলাদা করতে পারছিল না। বুঝতে পারছিল না যে কোনটা ভেতরে পড়তে হবে, আর কোনটা বাইরে। সেদিক থেকে ড্রেসিং গাউনটা ছিল বেশ সহজ, ব্যবহারিক, এবং অপ্রয়োজনীয় অলংকরন মুক্ত। এধরনের পোশাকই তার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এ মুহূর্তে। হালকা, নরম, গাড় নীল রঙের পোশাকটার স্পর্শ তার ত্বকে আরামদায়ক লাগছিল। সে এরপর এমনকি একরঙা একজোড়া চপ্পল পর্যন্ত খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিল।
সে তার নগ্ন শরীরের ওপর ড্রেসিং গাউনটা চাপিয়ে দিয়ে নানারকম কসরত করবার পর সক্ষম হল কোমরের ওপর তার ফিতে বাঁধার কাজটা সম্পন্ন করতে। গাউন শরীরে, চপ্পল পায়ে দিয়ে সে এবার আবারো একবার আয়নায় নিজেকে দেখল আপাদমস্তক। নগ্ন শরীরে ঘুরে ফিরে বেড়ানোর চে' এভাবে থাকাটা নিঃসন্দেহে অনেক ভালো। আরও নিখুঁতভাবে কাপড় পরিধান করার জন্য তাকে আরও নিবিড়ভাবে কাজটা পর্যবেক্ষণ করা লাগবে, সে অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার আগ পর্যন্ত এই গাউনটাই তার সমস্যার সমাধান। যতটা উষ্ণতা তার এই মুহূর্তে প্রয়োজন, গাউনটা অতোটা উষ্ণ নয়, তবে সে বাড়ির ভেতরে যতক্ষণ আছে, এই গাউনটা দিয়ে শীত ঠেকানোর কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে। সবচে বড় কথা, তার এই নরম শরীরের ওপর দুষ্ট পাখিদের আক্রমণ নিয়ে তার আর ভয় পাওয়া লাগবে না।
যখন ডোর বেল বেজে উঠলো, সামসা তখন বাড়ির সবচে বড় কক্ষটায় (এবং সবচে বড় বিছানায় শুয়ে) ঘুমে ঢুলছিল। পালকের চাদরের নীচে শুয়ে থাকার কারনে এক আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে ছিল তার শরীর জুড়ে, যেন সে ঘুমিয়ে ছিল একটা ডিমের ভেতর। তারপর হুট করে সে স্বপ্ন টুটে গেলো। স্বপ্নটা তার পুরোপুরি মনে ছিল না, কিন্তু সেটা ছিল সুন্দর এবং আনন্দদায়ক। ঘরময় প্রতিধ্বনিত হতে থাকা ডোর বেল তাকে ঝাঁকি দিয়ে ফিরিয়ে আনল শীতল বাস্তবতায়।
সে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে উঠে বসলো বিছানাতে, গাউনের ফিতে বাঁধল কষে, পায়ে নীল রঙের চপ্পল জোড়া গলিয়ে হাঁটবার লাঠিটা এক হাতের মুঠোয় নিয়ে অন্য হাতে সিঁড়ির রেলিং ধরে টুকটুক করে নেমে এলো নীচে। প্রথমবারের তুলনায় এবারের সিঁড়ি বাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল বেশ সহজ, সাবলিল। তারপরেও পা ফসকে পড়ে যাওয়ার ভীতি তার ভেতরে ভেতরে কাজ করছিল। কাজেই অন্যমনস্ক হয়ে দুমদাম নামার চেষ্টা করলো না সে। বরং প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে কড়া নজর রেখে এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো, যখন কিনা কলিং বেল বেজেই চলছিল পুরোটা সময়। দরজার ওপাশে যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেল বাজাচ্ছিল, সে নিশ্চিতভাবে খুব অধৈর্য এবং একগুঁয়ে ধরনের মানুষ।
বাম হাতে হাঁটার লাঠিটা আঁকড়ে ধরে সামসা দরোজার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরোজার হাতল ডানে ঘুরিয়ে টান দেয়া মাত্র দরজা খুলে গেলো হাঁ করে।
ছোটখাটো এক মহিলা দাঁড়িয়েছিল দরজার ওপাশে। খুবই ক্ষীণকায় এক মহিলা। এই উচ্চতা নিয়ে সে কলিংবেলের বাটন কিভাবে নাগাল পেলো সেটাই এক রহস্য। অবশ্য খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে থাকার পর বোঝা গেলো, সমস্যাটা উচ্চতা সংক্রান্ত নয়। তার পীঠের দিকটা উবু হয়ে কুঁজ সৃষ্টি করেছিল একটা প্রমাণ সাইজের। এই কারনেই তাকে খাটো এবং ক্ষীণকায় লাগছিল, যদিও তার শারীরিক কাঠামো ছিল যে কোন সাধারণ মানুষের মতোই। একটা রবার ব্যান্ড দিয়ে তার চুল আটকানো ছিল, যাতে এলো চুল তার মুখের ওপরে এসে না পড়ে। বাদামী বর্ণের চুলে তার মাথা বোঝাই হয়ে ছিল। তার পরনে ছিল উলের সুতো ওঠা পুরাতন একটি জ্যাকেট, এবং হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা একটি ঢিলেঢালা স্কার্ট। তার ঘাড়জুড়ে প্যাঁচানো ছিল একটি সুতি ওড়না। কোন টুপি ছিল না মাথায়। ফিতে জড়ানো উঁচু জুতো ছিল তার পায়ে, এবং বিশ বছরের কিছু বেশি ছিল তার বয়স, সম্ভবত। এর বাইরে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল মেয়েটির, চোখে পড়ার মতো। যেমন, তার চোখদুটো ছিল বেশ বড় বড়, নাক ছোট, ঠোঁটজোড়া শীর্ণ চাঁদের মতো একদিকে খানিকটা বাঁকানো। তার ঘন ভ্রূযুগল কপাল জুড়ে সোজা দুটো সরলরেখা তৈরি করেছিল, যার কারনে মনে হচ্ছিল - সে পুরো দুনিয়াদারীর দিকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
"এটা কি সামসাদের বাড়ি?" ঘাড় লম্বা করে সামসার দিকে তাকিয়ে মহিলা প্রশ্ন করে। এরপর সে হুট করে তার পুরো শরীরই কীভাবে যেন আঁকাবাঁকা করে তোলে, ভয়াবহ ভুমিকম্পের সময় ভূভাগ যেভাবে ভেতরে ভেতরে আঁকাবাঁকা হয়ে যায় - অনেকটা সেভাবে।
প্রথম প্রথম সামসা বলবার মতো কোন কথা খুঁজে পায় না, কিন্তু খানিকক্ষণ পর সে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। "হ্যাঁ," উত্তর দেয় সে। যেহেতু তার নাম গ্রেগর সামসা, কাজেই এটা তারই বাড়ি হবার কথা। যাই হোক, আপাতত হ্যাঁ বলবার মধ্যে কোন ক্ষতি দেখছে না সে।
তবুও কোন কারনে মহিলার কাছে তার উত্তর খুব একটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হল না। সে খানিকটা ভ্রূ কুঁচকেই দাঁড়িয়ে রইলো। হয়তো সামসার কণ্ঠেই অনিশ্চয়তার আভাস পেয়ে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।
"তাহলে এটা আসলেই সামসাদের বাড়ি?" সে ধারালো কণ্ঠে তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে, যেন বাড়ির গেটের এক অভিজ্ঞ দারোয়ান সে বাড়িতে বেড়াতে আসা জুবুথুবু এক ব্যক্তিকে খপ করে ধরেছে।
"আমি গ্রেগর সামসা," সামসা কণ্ঠকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে উত্তর দেয়। অন্তত নিজের নামের ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই।
"আশা করছি আপনি ঠিক বলছেন," পায়ের কাছে রাখা একটি কাপড়ের ব্যাগ আঁকড়ে ধরতে ধরতে মহিলা বলে। ব্যাগটার রং ছিল কালো, আর সেটা দেখতে প্রচণ্ড ভারী লাগছিল। জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া, কুঁচকানো ব্যাগটার মালিকানা যে বেশ কয়েকবার বদল হয়েছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। "তো, চলুন, শুরু করা যাক।"
সে সামসার তরফ থেকে কোন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই গটগটিয়ে ঢুকে গেলো বাড়ির ভেতর। সামসা দরোজা বন্ধ করে। সে ভেতরে দাঁড়িয়ে একবার সামসাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে। মনে হল, যেন সামসার গাউন আর পায়ের চপ্পল তার মধ্যে সন্দেহের সঞ্চার করেছে।
"আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম বোধ হয়," মহিলা শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করে।
"না, ঠিক আছে একদম," সামসা উত্তর দেয়। মহিলার অন্ধকার হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে সামসা বুঝতে পারে, তাদের এই সাক্ষাতের জন্য তার পরনের পোশাক খুবই বেমাক্কা হয়েছে। "আমার পোশাকের জন্য আমি দুঃখিত," সে বলে। "কিছু কারনে আসলে ..."
মহিলাটি তার এসব ব্যাখ্যা এড়িয়ে যায়। "তো, এখন?" সে ঠোঁট কামড়ে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।
"তো, এখন?" তার প্রশ্ন সামসার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়।
"তো, সেই দরজাটা কোথায়, যার হাতল নষ্ট হয়ে গিয়েছে?" মহিলা প্রশ্ন করে।
"দরজার হাতল?"
"হ্যাঁ, যে হাতলটা ভাঙ্গা," মহিলাটি বলল। শুরু থেকেই তার কণ্ঠে বিরক্তির সুর ছিল স্পষ্ট। "আপনি আমাকে এসে এটা সারাই করে দিতে বলেছিলেন।"
"ওহ, সেই ভাঙ্গা হাতলের দরজা!" সামসা বলে।
সামসা তার মস্তিষ্ক আঁতিপাঁতি করে হাতড়ে ভাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সে যখনি গভীরভাবে একটা জিনিস নিয়ে ভাবার চেষ্টা করে, তার মস্তিষ্কের ভেতর সেই কালো মশারা আবার সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
"এরকম নির্দিষ্ট কোন দরজার হাতলের লক নিয়ে সমস্যা কথা আমি শুনি নি আসলে," সে বলে। "তবে আমার ধারনা, হয়তো দোতালার কোন এক দরজায় এই সমস্যা থাকলেও থাকতে পারে।"
মহিলা জ্বলন্ত চোখে তাকাল সামসার দিকে। "আপনার ধারনা?" ভ্রূ কুঁচকে, কণ্ঠ বরফশীতল করে সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। "দোতালার 'কোন এক' দরোজায়?"
সামসার মুখ রক্তিম বর্ণ ধারন করে। দরজার হাতলের তালার ব্যাপারে তার জ্ঞানশূন্যতা তাকে চরম লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। সে কয়েকবার গলাখাঁকড়ি দিয়ে কণ্ঠ পরিষ্কার করার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা দিয়ে কোন কথা বেরোয় না।
"মিঃ সামসা, আপনার বাবা মা কেউ আছে বাড়িতে? মনে হয় আমার তাদের সঙ্গে কথা বললে কাজটা সহজ হবে।"
"খুচরো কোন এক কাজে বোধয় তারা বাইরে গিয়েছে," সামসা বলে।
"খুচরো কাজে?" সে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে। "এই মহা গণ্ডগোলের মাঝে খুচরো কাজে বাইরে গেছে তারা?"
"আমার আসলে কোন ধারনা নেই। আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়িতে কেউ নেই," সামসা আবারো বলে।
"কি একটা অবস্থা," মহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে। "আমাদের তরফ থেকে আপনার বাড়ির লোকেদের জানানো হয়েছিল যে আজকের দিনে এই সময়ে লোক পাঠানো হবে আপনাদের বাসায়।"
"আমি খুবই দুঃখিত।"
মহিলাটি কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর, খুব ধীরে, তার ভ্রূকুটি সরে গিয়ে তাতে কৌতূহল জায়গা করে নিলো। সে তাকিয়ে রইলো সামসার হাতের লাঠিটার দিকে। "পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন নাকি, গ্রেগর সামসা?"
"খানিকটা," সামসা বানিয়ে বলল।
আবার হঠাৎ করেই মহিলাটি তার সারা শরীর মুচড়ে উঠলো। সামসার কোন ধারনা ছিল না যে মহিলার হঠাৎ করে শরীর এভাবে আঁকিয়েবাঁকিয়ে ফেলার অর্থ, অথবা লাভক্ষতি কি। তবুও সে উক্ত মহিলার শরীরের এই জটিল নড়াচড়া দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠলো।
"যাই হোক, কাজের কথায় ফিরে আসি," মহিলা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গীতে বলে। "দোতালার দরজাগুলো তবে দেখি একে একে। আমি ঐ সেতু আর ভয়াবহ গণ্ডগোল পার হয়ে এখানে এসেছি। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি, বলতে গেলে। কাজেই, 'ওহ, বাড়িতে কেউ নেই? তাহলে আজ থাক, পরে আবার আসবো,' - এই বলে চলে যাওয়ার কোন মানে নেই, তাই না?"
ভয়াবহ গন্ডগোল? সামসা বুঝতে পারছিল না সে কোন গণ্ডগোলের কথা বলছে। কি সমস্যা হচ্ছে রাস্তায়? কৌতূহল হলেও সে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করলো না মহিলাকে। নিজের অজ্ঞতা এভাবে প্রচার করে বেড়ানোটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
কুঁজো পীঠেই মহিলাটি ডানহাতের এক হ্যাঁচকা টানে ভারী কালো ব্যাগটি তুলে নিয়ে কোনমতে উঠে গেলো সিঁড়ি বেয়ে, যেমন করে বুকে ভর দিয়ে কীটপতঙ্গ হাঁটে। একহাতে রেলিং আঁকড়ে ধরে সামসাও তার পিছে পিছে উঠে পড়লো সিঁড়ি বেয়ে। মহিলার ঠেলে বেরিয়ে আসা কুঁজের প্রতি সামসা বেশ সহানুভূতি বোধ করছিল - এটাও সামসাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল অতীতের এক স্মৃতি।
মহিলাটি সিঁড়ির একদম উপরে দাঁড়িয়ে হলওয়েটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল একবার। "তো," বলল সে, "এই চার দরজার যেকোনো এক দরজার হাতলে 'সমস্যা থাকলেও থাকতে পারে' তাই কি ?"
সামসার মুখ পুনরায় রক্তিম বর্ণ ধারন করলো। "হ্যাঁ", বলল সে। "এগুলোরই কোন একটা। এই লম্বা করিডোরের শেষ মাথায় বামে যে কক্ষটা আছে, তার দরোজার সমস্যা এটা, খুব সম্ভবত।" সে বলল আমতা আমতা করে। এটা ছিল সেই কক্ষটি, সকালবেলা যেখানে সে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল।
"খুব সম্ভবত?" মহিলা নিভু নিভু করে জ্বলতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের মতো নিষ্প্রাণ সুরে বলল। "খুব সম্ভবত ওটা?" সে সামসার দিকে ফিরে তার চেহারা নিরীক্ষণ করতে লাগলো।
"হ্যাঁ, ওটা, বা অন্য আরেকটা।" সামসা বলল।
মহিলা সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। "গ্রেগর সামসা," শুকনো কণ্ঠে বলল সে, "আপনার সঙ্গে কথা বলে দারুন আনন্দ লাগছে আমার। এতো সমৃদ্ধ আপনার শব্দ ভাণ্ডার, আর সবসময়ই আপনি একদম ঠিক পয়েন্টে কথা বলেন।" তারপর তার বাচনভঙ্গী বদলে গেলো হুট করে। "যাই হোক, সমস্যা নেই। চলুন করিডোরের শেষ মাথার বামদিকের ঘরের দরোজাটা সবার আগে পরীক্ষা করে দেখা যাক।"
মহিলাটি হেঁটে পৌঁছুলো ঐ দরজার সামনে। সে হাতল ডানে বামে ঘুরিয়ে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো ঘরের। কক্ষটা আগের মতোই লাগছিল দেখতেঃ নোংরা মাদুরে আবৃত খটখটে একাকি একটি খাট। এই মাদুরেই ঘুম ভেঙ্গে উঠে সে আজ সকালে নিজেকে গ্রেগর সামসা হিসেবে আবিষ্কার করে। কোন স্বপ্ন ছিল না বিষয়টা। মেঝে সেই একই রকম শূন্য এবং শীতল। জানালায় তক্তা লাগানো। মহিলাটি এসবকিছু দেখল বটে, কিন্তু তার আচার আচরনে কোন বিস্ময় দেখা গেলো না। তার ভাবভঙ্গীতে মনে হল যেন এমন কক্ষ শহরের যেকোনো বাসায়ই খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
সে বসে পড়ে তার কালো ব্যাগটা থেকে একটা সাদা ফ্লানেলের কাপড় বের করে মেঝেতে বিছিয়ে দিলো। তারপর সে কয়েকটা যন্ত্র বের করে পাশাপাশি খুব যত্ন করে সাজিয়ে রাখল সেই কাপড়ের উপর। যেন কোন জেরাকারী গোয়েন্দা পুলিশ অভিযুক্ত আসামীর সামনে তাকে টর্চার করবার যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রাখছে তার সামনে।
মাঝারি আকৃতির একটি তার হাতে তুলে নিয়ে সে সেটা হাতলের তালার মাঝে ঢুকিয়ে দিলো, এবং তার অভিজ্ঞ হাতে নানাদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মোচড় দিতে লাগলো। প্রবল মনোযোগে তার চোখ সরু হয়ে এলো, তার কান দুটো খাড়া হয়ে ছিল সামান্যতম আওয়াজের অপেক্ষায়। এরপর সে আরেকটু সরু তার বেছে নিয়ে তালার ভেতরে ঢুকিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটার পুনরাবৃত্তি করলো। তার চেহারা গম্ভীর হয়ে উঠলো, তার ঠোঁটদুটো বেঁকে গিয়ে এক নিষ্ঠুর আঙ্গিক ধারন করলো, অনেকটা চায়নিজ তরবারির মতো। তারপর হাতে একটা বড় ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে স্থির চোখে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো হাতলের তালাটাকে।
"এই তালার চাবি আছে আপনার কাছে?" সে সামসাকে প্রশ্ন করে।
"আমি জানি না এর চাবি কোথায় আছে," সামসা সৎ উত্তরটাই দিলো।
"আহ, গ্রেগর সামসা, কখনো কখনো আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হয় - মরে যাওয়াই এর চে ভালো," সে বলে।
তারপর সে মহিলা সামসাকে মোটামুটি উপেক্ষা করেই নিজের কাজ করে চলল। একটা স্ক্রু ড্রাইভার তুলে নিয়ে সে তালাযুক্ত হাতলটাকে দরোজা থেকে খুলেই ফেলল একদম। তার হাতের কাজ ছিল খুব সুস্থির, এবং সাবধান। আবার মাঝেমাঝেই কাজ থামিয়ে সে তার শরীর সেই আগের মতো অদ্ভুতভাবে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে মোচড় মেরে নিচ্ছিল।
মহিলার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে তার শরীরকে এই অদ্ভুতভাবে মোচড়াতে দেখে সামসার নিজের শরীরে এক ভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তার পুনরায় গরম লাগা শুরু হয়, নাসারন্ধ্র ঘেমে ওঠে। মুখ এতোটা শুকনো হয়ে যায় যে তার ঢোক গিলতেও কষ্ট হয়। কানের ছিদ্র চুলকাতে শুরু করে। তার যৌনাঙ্গ, যেটা এতক্ষণ জুবুথুবু হয়ে ঝুলে ছিল, সেটা কেন যেন হঠাৎ করে শক্ত আর বড় হয়ে উঠতে শুরু করে। এটা উত্থিত হতে হতে একপর্যায়ে তার পরনের গাউন ঠেলে সেটা উঁচু হয়ে উঠলো। যদিও সবমিলিয়ে ব্যাপারটা আসলে কি ঘটলো - এ নিয়ে তার কোন ধারনা ছিল না।
তালাটা খুলে নিয়ে সে মহিলা ততক্ষণে হেঁটে হেঁটে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তক্তার ফাঁক দিয়ে যে সূর্যালোক প্রবেশ করছিল, তাতে তালাটা পরখ করে দেখতে। সে পুনরায় তার দিয়ে তার ভেতরে খানিক নাড়াচাড়া করে জোরে জোরে কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ভেতরে কোন শব্দ হয় কিনা। তার চেহারা ছিল আগের মতোই গম্ভীর, ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। শেষমেশ সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামসার দিকে ফিরল।
"ভেতরটা নষ্ট হয়ে গেছে," মহিলা বলল। "এটাই সেই খারাপ তালা, যেমনটা আপনি আন্দাজ করেছিলেন।"
"জেনে ভালো লাগলো।" সামসা উত্তর দিলো।
"এটা জেনে তো ভালো লাগার কিছু নেই," মহিলা আবারো বলে। "এই তালা এখানে বসে ঠিক করা আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। এটা বিশেষ একধরনের লক। এটা আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে আমার বাবা, বা বড়ভাইদের কাউকে দেখাতে হবে। তারা হয়তো এটা ঠিক করতে সক্ষম হবেন। আমি এখনো শিক্ষানবিশ। তালার সাধারণ সমস্যাগুলোই কেবল ঠিক করতে পারি।"
"বুঝলাম," সামসা বলে। তাহলে এই তরুণীর বাবা আছে, ভাইও আছে বেশকয়েকটা। তালাচাবি সারাই করা তাদের পারিবারিক বৃত্তি।
"আসলে তাদেরই একজনের আসার কথা ছিল আজকে, তবে সড়কে ঐ গণ্ডগোলের জন্য তারা পুরুষমানুষরা না বেরিয়ে আমাকে পাঠালেন নিরাপদ ভেবে। শহরের রাস্তায় রাস্তায় সামরিক বাহিনীর চেকপোস্ট বসানো।" সে হাতের তালাটার দিকে তাকিয়ে বলে, "কিন্তু এই তালাটা এভাবে বিগড়ালো কিভাবে? অদ্ভুত। নিশ্চয়ই এর ভেতরে কেউ কিছু ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া দিয়েছে জোরে। এছাড়া আর তো কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না।"
আবারো তার পুরো শরীর মুচড়ে উঠলো, তার হাত দুটো এমনভাবে ঘুরপাক খাচ্ছিল যেন সে একজন সাঁতারু, পানির মাঝে সাঁতার কাটার নতুন নতুন টেকনিক প্র্যাকটিস করছে। এই করতে করতে সে এমন এক অঙ্গভঙ্গী আবিষ্কার করে ফেলেছে, যা দেখতে ছিল খুবই বিস্ময়কর, কিন্তু আনন্দদায়ক।
সামসা সাহস করে বলে উঠলো, "একটা প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে?"
"একটা প্রশ্ন?" মহিলা সন্দিঘ্ন চোখে তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করলো। "কি প্রশ্ন করবেন কে জানে, যাক, বলুন।"
"থেকে থেকে আপনার শরীর ওভাবে মুচড়ে উঠছে কেন?"
সে সামসার দিকে মুখ সামান্য হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। "আমার শরীর মুচড়ে উঠছে?" সে চিন্তার মাঝে ডুবে গেলো কিছু সময়ের জন্য। "মানে, এভাবে?" এরপর সে নিজে থেকে সেই শরীর মোচড়ানোর পুরো ভঙ্গীটা অনুকরণ করে দেখাল।
"আমার ব্রেসিয়ার ঠিক মতো এঁটে বসছে না, তাই।" সে শুষ্ক কণ্ঠে বলে, "এটাই কারন।"
"ব্রেসিয়ার?" সামসাও খুব নিরশ কণ্ঠে প্রশ্নটা করে। শব্দটার মানে তার স্মৃতি ভাণ্ডারে জমা নেই।
"হ্যাঁ, ব্রেসিয়ার। আপনি জানেন এটার মানে কি, তাই না?" সে বলে। "নাকি কুঁজো মহিলা হয়ে আমি ব্রেসিয়ার পরেছি - এটা আপনার কাছে অবাক লাগছে? আপনার কি এই ধারনা যে এটা আমরা ভাব দেখানোর জন্য পরি, আমাদের আসলে এটার প্রয়োজন নেই?"
"কুঁজো?" সামসা আবারো বলে। আবারো একটা শব্দ যার অর্থ তার অভ্যন্তরীণ অজ্ঞতার অসীম শূন্যতার মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছিল। মহিলাটি কি নিয়ে কথা বলছে এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ধারনা নেই। তবুও, তার মনে হল যে কিছু বলা উচিৎ।
"না, না, এমনটা ভাবছি না আমি।" সে আমতা আমতা করে বলে।
"ভালো করে শুনুন, আমাদের মতো কুঁজো মহিলাদেরও দুটো করে স্তন থাকে, দুনিয়ার অন্যান্য সব মেয়েদের মতোই। আর ঠিক সে কারনেই আমাদের ব্রেসিয়ার পরা লাগে, সাপোর্টের জন্য। আমরা গরুদের মতো আমাদের দুধ ঝুলিয়ে হেঁটে বেড়াতে পারি না।"
"অবশ্যই, তা আপনি ঠিকই বলেছেন।" অজ্ঞতার অসীম শুন্যতায় ডুবন্ত অবস্থাতেই সামসা তার কথায় তাল মেলায়।
"কিন্তু আমাদের জন্য আলাদা করে ব্রেসিয়ার ডিজাইন করা হয় না। ঢিলে হয়ে যায়। আমাদের শরীরের কাঠামো সাধারণ মেয়েদের থেকে ভিন্ন, তাই না? কাজেই প্রায়ই আমাদের শরীর আঁকিয়েবাঁকিয়ে জিনিসটা বারবার জায়গামতো বসানো লাগে। কুঁজো হবার ঝামেলার পরিমাণ আপনার হিসাবের বাইরে। এই কারনেই কি আপনি পেছন থেকে বারবার ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখছিলেন? এটা আপনাকে উত্তেজিত করে তোলে?"
"না, একদমই না। আমি কেবল কৌতূহল বোধ করছিলাম আপনি কেন ওরকম করছিলেন তাই নিয়ে।"
সামসা দুইয়ে দুইয়ে চার মেলায়। ব্রেসিয়ার হচ্ছে একধরনের পোশাক, যা তাদের স্তনকে জায়গামতো ধরে রাখে। আর কুঁজো বলতে বোঝায় এই নারীর দেহাবয়বের মানুষদের। দুনিয়াতে এখনো কতো কিছু শেখা বাকি তার!
"আপনি আমাকে নিয়ে রসিকতা করছেন না আশা করি?" মহিলা প্রশ্ন করে।
"আমি রসিকতার করছি না আপনাকে নিয়ে।"
মহিলা তার ঘাড় ঘুরিয়ে সোজাসাপটাভাবে তাকায় সামসার দিকে। সে বুঝতে পারছিল যে সামসা মিথ্যে বলছে না - সামসার কণ্ঠে তার প্রতি কোন বিদ্রূপ বা বিদ্বেষ নেই। কেবল তার মাথায় খানিকটা গণ্ডগোল আছে, এই যা। ত্রিশ বছরের মতো বয়স। ফালতু কথাবার্তার পাশাপাশি তাকে খানিকটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধীও লাগে। কিন্তু তার পরিবারটা বেশ ভালো, এবং তার আচার আচরণও বেশ ভদ্রস্থ। দেখতে শুনতে চলনসই হলেও টিংটিঙে শুকনো, কান দুটো ঠেলে বেরিয়ে আছে মাথার দুপাশ থেকে, আর গায়ের রংটা একদম ফ্যাকাসে।
ঠিক সে মুহূর্তে তার চোখে পড়লো গাউনের নীচ থেকে উঁচু হয়ে থাকা সামসার যৌনাঙ্গ।
"এসব কি দেখছি আমি?" সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। "ওটা কি উঁচু হয়ে আছে আপনার?"
সামসা নীচে তাকিয়ে তার গাউনের উঁচু হয়ে থাকা অংশটা দেখল। তার অঙ্গটা আসলেই বেশ ফুলে আছে। মহিলার কণ্ঠ থেকে সে আন্দাজ করতে পারে, কাজটা শোভন হয় নি তার দিক থেকে।
"এইবার বুঝতে পেরেছি," মহিলা চেঁচিয়ে বলে। "আপনি নিশ্চয়ই এতক্ষণ মনে মনে ভাবছিলেন যে একটা কুঁজোকে লাগাতে কেমন লাগবে, তাই না?"
"লাগাতে, বলতে?" আরও একটা শব্দ যেটার কোন লেজমাথা খুঁজে পাচ্ছিল না সামসা।
"যেহেতু আমরা কুঁজোরা ঝুঁকেই থাকি সবসময়, কাজেই আমাদের পেছন থেকে ধরে জিনিসটা স্রেফ ঢুকিয়ে দিলেই হল, তাই ভাবছিলেন তো এতক্ষণ?" মহিলাটি বলল। "ভালো করে শুনে রাখুন, আপনার মতো লুইচ্চা লাফাঙ্গা সারাক্ষণ আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে, যারা মনে করে চাওয়া মাত্রই তারা আমাদের কাছ থেকে সবকিছু পেয়ে যাবে, কারন আমরা কুঁজো। নিজের চিন্তা ভাবনা বদলান বেকুব! আমরা অতো সোজা না।"
"দেখুন, আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।" সামসা বলে। "আমি যদি আপনাকে কোনভাবে অসম্মান করে থাকি, তবে আমি সত্যি সত্যিই ক্ষমাপ্রার্থী। মাফ চাইছি আপনার কাছে। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি কোন ক্ষতি করতে চাই নি আপনার। আমি অসুস্থ খানিকটা, আর অনেককিছুই আমি বুঝতে পারছি না।"
"ঠিক আছে, এবার বোধয় আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা।" মহিলা আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। "আপনি বোধয় সবকিছু বুঝতেই একটু সময় নেন, খানিকটা প্রতিবন্ধী টাইপ, তাই তো? তবে আপনার সসেজটা তো দেখছি সেই সাইজের! ওটা দিয়েই সব মাত করে দেন বোধয়?"
"আমি দুঃখিত," সামসা আবারো বলে।
"বাদ দেন," মহিলা উত্তর দেয়। "আমার চার চারটা অকম্মার ঢেঁকি ভাই আছে বাসায়। আর আমি যখন ছোট, তখন থেকেই ওরা সবকিছু দেখিয়ে বেড়িয়েছে আমাকে। এটাকে তারা দারুন একটা রসিকতার বিষয় হিসেবে মনে করতো। ছোটলোকের দল। কাজেই আমি আসলেই বুঝি কে কি উদ্দেশ্য করে কোন কথাটা বলছে।"
সে আবারো ঝুঁকে বসে পড়ে কাপড়ের ওপর বিছিয়ে রাখা যন্ত্রগুলো সব একে একে তুলে রাখল ব্যাগের ভেতর। তারপর সেই তালাটা কাপড়ে পেঁচিয়ে যত্ন করে রেখে দিলো ব্যাগে।
"আমি তালাটা আমার সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি," সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে। "আপনার বাবা মাকে জানাবেন। আমরা হয় এটা সারাই করে দেবো, বা আরেকটা তালা এনে লাগিয়ে দেবো। যদি নতুন একটা তালা লাগানো লাগে, তবে আমাদের খানিকটা সময় লাগবে অতিরিক্ত। এটাও তাদের বুঝিয়ে বলতে ভুলবেন না, ঠিক আছে? মনে থাকবে তো?"
"মনে থাকবে," সামসা বলে।
সে ধীরপায়ে হেঁটে সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নেমে আসে। সামসাও নামে তার পিছু পিছু। তাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখতে সম্পূর্ণ বিপরীত আঙ্গিকের দুজন ব্যক্তি বলে মনে হয়। মহিলাটা সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে যেন চার হাতপায়ে একদম হামাগুড়ি দেয়। অপরদিকে সামসা পেছন দিকে ঝুঁকে খানিকটা অপ্রকৃতস্থের মতো নীচে নামে। এসবকিছুর পরেও তাদের নীচে নামার গতি ছিল প্রায় একই রকম। সামসা মনে প্রাণে চেষ্টা করছিল তার উত্থিত লিঙ্গকে নামিয়ে ফেলার, কিন্তু কোন এক কারনে জিনিসটা আগের অবস্থায় ফিরতে রাজি হচ্ছিল না একদমই। পেছন থেকে সে মহিলার অঙ্গসঞ্চালন, নেমে যাওয়ার দৃশ্য দেখে সামসার হৃদপিণ্ডে ঢাকের বাড়ি পড়তে থাকে ধুপধুপ। শরীরের শিরা উপশিরায় গরম রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়। নীচের জিনিসটাও একদম ঘাড়ত্যাড়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
"যেমনটা আগেই বলেছি, আমার বাবা বা আমার ভাইদের মধ্যে কারো আজকে আসার কথা ছিল," মহিলা সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন। "কিন্তু শহরের সড়কগুলো সৈন্য আর ট্যাঙ্কে ভরপুর। প্রতিটা সেতুর এপাশে ওপাশে পুলিশের চেকপোস্ট। সবাইকেই থামিয়ে তল্লাশি করছে তারা। এইকারনে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কেউ বাইরে বেরুচ্ছে না। একবার তারা কাউকে আটক করে নিলে আর কখন ছাড়বে - তা কেউ বলতে পারে না। এ জন্যই আমার আসা। সেই প্রাগ থেকে, একাকী। 'একটা কুঁজো মেয়েকে আর কে পুঁছবে' - এই বলে তারা আমাকে ঠেলে বের করে দিয়েছিল।"
"ট্যাঙ্ক?" সামসা বিড়বিড় করে বলে।
"হ্যাঁ, অনেকগুলো। বড়বড় গোলা, আর মেশিনগান সহ। আপনার ট্যাঙ্কের নলও বেশ আকর্ষণীয়।" সে সামসার গাউনের নীচে উঁচু হয়ে থাকা লিঙ্গের দিকে ইশারা করে বলে। "কিন্তু রাস্তার ঐ ট্যাঙ্কের নলগুলো আরও বড়, আরও শক্ত, আরও খুনে। আশা করি আপনার পরিবারের সবাই নিরাপদে ফিরে আসবে বাড়িতে। আপনি সত্যি সত্যিই জানেন না তারা কোথায় গেছে, তাই কি?"
সামসা উপরে নীচে মাথা নাড়ায়। সে আসলেই জানে না।
সামসা এবার তার মনের সবটুকু সাহস একত্র করে বলে, "আমরা কি আবারো দেখা করতে পারি?"
কুঁজো মহিলা বিস্মিত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সামসার দিকে ফিরে বলে, "আপনি বলতে চাইছেন যে, আপনি আবারো আমার সঙ্গে দেখা করতে চান?"
"হ্যাঁ, আমি আরও একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।"
"তখনও আপনার ট্যাঙ্কের নল ওভাবে তাক করা থাকবে?"
সামসা পুনরায় তার উত্থিত লিঙ্গের দিকে তাকায়। "কিভাবে ব্যাখ্যা করবো বুঝতে পারছি না। সত্যি বলতে এটার সঙ্গে আমার মনের ভেতরে যে অনুভূতি জন্মেছে - তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। আমার মনে হয় এটা কোন একধরনের হৃদরোগ।"
"বাহ বাহ," সে খুশী হয়ে বলে ওঠে। "হৃদরোগ! এতো সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গী। প্রেম নিবেদনের এহেন বক্তব্য আগে শুনি নি কখনো।"
"এটা সম্পূর্ণই আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।"
"এবং আপনার দেখা করার যে বিষয়টা, লাগানোর সঙ্গে এর কোন সম্বন্ধ নেই তো?"
"লাগানো টাগানো নিয়ে আমার কোন চিন্তাভাবনা নেই। সত্যি বলছি।"
"দাঁড়ান দাঁড়ান। বুঝে নেই ব্যাপারটা। আপনি বলতে চাইছেন, আপনার জিনিস যখন ওভাবে দাঁড়িয়ে যায় - তার সঙ্গে আপনার মস্তিষ্কের কোন সংযোগ থাকে না, এর পুরোটাই হৃদয়ঘটিত ব্যাপার?"
সামসা আবারো উপর - নীচে মাথা নাড়ায়।
"ঈশ্বরের নামে শপথ করছেন?" মহিলা প্রশ্ন করে।
"ঈশ্বর," আরও একটা শব্দ যেটা সামসা আগে কখনো শোনে নি। সে চুপ করে থাকে।
মহিলা চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ সামসার দিকে তাকিয়ে আবারো শরীর মুচড়ে তার ব্রেসিয়ার জায়গা মতো নিয়ে আসে। "বাদ দিন। ঈশ্বর কিছুদিন আগে প্রাগ ত্যাগ করে চলে গেছেন। আসুন আমরাও তাকে ভুলে যাই।"
"তাহলে আমাদের আবারো দেখা হচ্ছে?" সামসা প্রশ্ন করে।
মহিলা পুনরায় ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। এবার তার দৃষ্টিতে এক নতুন ভাব পরিলক্ষিত হয়। তার দুচোখ যেন স্থির হয়ে আছে অনেক দূরে, ধোঁয়াশায় ঘেরা কোন নিসর্গ চিত্রে। "আপনি আসলেই আবারো আমার সঙ্গে দেখা করতে চান?"
সামসা মাথা নাড়ে।
"দেখা করে আমরা কি করবো?"
"আমরা বসে বসে কথা বলতে পারি।"
"কি নিয়ে?" মহিলা প্রশ্ন করে।
"অনেককিছুই তো আছে,"
"শুধু কথা?"
"অনেক কিছু জানার আছে আমার আপনার কাছ থেকে," সামসা বলে।
"কি নিয়ে?"
"এই পৃথিবীর ব্যাপারে। আপনার ব্যাপারে। আমার ব্যাপারে।"
মহিলা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে, "তাহলে সত্যিসত্যিই বিষয়টা আমার ভেতরে আপনার ঐ দাঁড়িয়ে থাকা জিনিসটা ঢুকিয়ে দেয়া সংক্রান্ত নয়?"
"না, একদমই না।" সামসা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে উত্তর দেয়। "আমার মনে হয় আপনার সঙ্গে কথা বলবার মতো আমার এক পৃথিবী জিনিস বাকি রয়ে গেছে। ট্যাঙ্ক , ধরুন তার মধ্যে একটা। তারপর ঈশ্বর। তারপর ব্রেসিয়ার। এবং তালা।"
দুইজনের ওপরেই নীরবতা এসে ভর করলো খানিকক্ষণের জন্য।
"আমি জানি না," মহিলাটি বলল অবশেষে। সে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেও তার কণ্ঠে ছিল উত্তেজনার আভাস। "আপনার জন্ম, বড় হওয়া আমার চে সুন্দর, বনেদী পরিবারে। আমার মনে হয় না আপনার বাবা মা শহরের নোংরা এলাকা নিবাসী এক কুঁজো মহিলার সঙ্গে আপনাকে দেখে ব্যাপারটাকে ইতিবাচকভাবে নেবেন। যদি সে ছেলে কিছুটা বেকুব, কিংবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধি হয়, তবুও। তারচে বড় কথা, আমাদের শহর এখন সৈন্য আর ট্যাঙ্কে ভরপুর। কে জানে ভবিষ্যতে কার কপালে কি লেখা আছে।"
সামসার পক্ষে এটা মেনে নিতে কষ্ট হল না যে, সে আসলেই জানে না তার ভবিষ্যতে কি লেখা আছে। সে সবকিছু নিয়েই অন্ধকারে ডুবে আছে; ভবিষ্যৎ নিয়ে তো বটেই, এমনকি তার বর্তমান এবং অতীত নিয়েও। ঠিক কি, আর বেঠিকই বা কি? নতুন পোশাক পরাটাও তো তার কাছে এক ধাঁধাঁর মতো।
"সে যাই হোক, আমি কিছুদিনের মধ্যেই আবারো ফিরে আসবো," তরুণী কুঁজো মহিলাটা বলে। "যদি আমরা এই তালাটা সারাই করতে পারি, তবে এটা নিয়ে আসবো। আর যদি না পারি, তবে আপনার কাছে এসে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো। আমাদের পারিশ্রমিক কিন্তু আপনাকে উভয় ক্ষেত্রেই দেয়া লাগবে। আপনি যদি সেদিনও বাড়িতে থাকেন, তবে আপনার সঙ্গে আবারো দেখা হবে। তবে যে লম্বা আড্ডার আশায় আপনি আছেন, তার সুযোগ হবে কিনা আমি বলতে পারি না। আরেকটা কথা, আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম, তবে আমি আমার বাপ মায়ের সামনে আমার ঐ উঁচু জিনিসটা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম না। বাস্তবের দুনিয়ায় আপনি ঐ জিনিস এভাবে প্রদর্শন করে বেড়ালে কারো কাছ থেকে তারিফ শুনতে পাবেন না।"
সামসা মাথা নাড়ে, যদিও সে পুরোপুরি পরিষ্কার ছিল না যে, কিভাবে জিনিসটা একবার দাঁড়িয়ে পড়লে পরে লোকচক্ষুর আড়ালে তা লুকিয়ে রাখা যায়।
"কি অবাক করা ব্যাপারে, তাই না?" মহিলা ম্রিয়মাণ স্বরে বলে। "চারপাশের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের, এরমধ্যেই কেউ কেউ তাদের বাড়ির দরজার নষ্ট তালা নিয়ে মাথা ঘামায়, আবার কেউ কেউ সেটা সারাই করতেও চলে আসে ... তবে হয়তো এটাই হওয়া উচিৎ। একটা পৃথিবী যখন ধ্বংস হবার জন্য উন্মুখ, তখন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে, সৎভাবে আমাদের যার যার কাঁধে থাকা ছোট ছোট দায়িত্বগুলো ঠিকঠাক মতো পালন করেই হয়তো আমরা মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারি।"
মহিলাটি সামসার চেহারার দিকে তাকাল। সে তার একটা ভ্রূ উঁচু করে বলল, "গোয়েন্দাগিরিতে আমার কোন আগ্রহ নেই, কিন্তু আমাকে দয়া করে বলবেন, দোতালার ঐ কক্ষটিতে কি চলছিল? এমন একটা কক্ষ, যাতে কেবল একটা খাটিয়া ছাড়া আর কিছুই নেই - ওটাকে আটকে রাখার জন্য এতোবড় তালা আপনার বাবা মায়ের কি দরকার? আর সে তালা নষ্ট হয়ে গেলেই বা তারা কেন সেটা ঠিক করার জন্য এতোটা উতলা হয়ে উঠলেন? ঐ রুমের জানালার ওপর এমন তক্তা মারা ছিল কেন? কাউকে কি ওর ভেতর আটকে রাখা হত?"
সামসা মাথা নাড়ে। যদি ঐ কামরায় কাউকে আটকে রাখা হয়ে থাকে, তবে ঐ আটক ব্যক্তিটি ছিল সে নিজে। কিন্তু কেন তাকে আটকে রাখা হয়েছিল? এ বিষয়ে তার কোন ধারনা নেই।
"আমার মনে হয় না এ নিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করার কোন অর্থ আছে," মহিলা বলে। "যাক, এখন যেতে হবে আমাকে। দেরি হয়ে গেলে বাসার মানুষজন দুশ্চিন্তা করবে। দোয়া করবেন, যেন আমি নিরাপদে শহরের ঐ প্রান্তে পৌঁছাতে পারি। যেন সৈন্যদের লোলুপ দৃষ্টি আমার মতো এক কুঁজো মেয়ের ওপর না পড়ে। যেন তাদের কেউ অতোটা লাফাঙ্গা প্রকৃতির না হয়। এমনিতেই তারা প্রতিনিয়ত আমাদের সমষ্টিগতভাবে চুদছে।"
"আমি দোয়া করবো," সামসা বলে। যদিও তার লাফাঙ্গা, বা দোয়া - এসব শব্দের অর্থের ব্যাপারেও কোন ধারনা ছিল না।
মহিলাটি তার কালো ব্যাগটা তুলে নেয়, তারপর পুনরায় ঘাড় গুঁজে হাঁটা শুরু করে সদর দরজার দিকে।
"আমাদের কি আবার দেখা হবে?" সামসা শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করে।
"যদি আপনি কাউকে নিয়ে মনে মনে খুব বেশি চিন্তা করেন, ভাবেন, তবে দৃঢ় সম্ভাবনা থাকে যে তার সঙ্গে আপনার আবারো দেখা হবে।" দরজায় দাঁড়িয়ে মহিলা উত্তর দেয়। এবারে তার কণ্ঠস্বর ছিল প্রকৃতই উষ্ণতা আর হৃদ্যতা মাখা।
"পাখিদের থেকে মাথা বাঁচিয়ে," সামসা তাকে সতর্ক করে দেয়। সে মহিলা আরও একবার ঘুরে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। তারপর হাঁটতে থাকে সড়ক পথ ধরে।
পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে সামসা সে কুঁজো মহিলার পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখে। তার হাঁটার ভঙ্গী অদ্ভুত, কিন্তু গতি অনেক বেশি। সামসার কাছে তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গী অসাধারণ লাগে। শুকনো বালুতে ভরা রাস্তার ওপর পানি ছিটিয়ে বেড়ায় যে বড় ট্রাকগুলো, মহিলার হাঁটা তাকে সেই উষর বালুকাবেলায় প্রাণসঞ্চারী বাহনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তার কাছে মনে হয়, সাধারণ মানুষ দু' পায়ে ভর দিয়ে যেভাবে হাঁটে, তার চে অনেক প্রাকৃতিক, অনেক বাস্তব ঐ কুঁজো মহিলার হাঁটার ভঙ্গী।
মহিলা দূরে মিলিয়ে যেতে না যেতেই সামসা খেয়াল করে, তার যৌনাঙ্গ নেতিয়ে পড়ে আবার আগের মতো ছোট হয়ে গেছে। সেই সুবিশাল উত্থিত অঙ্গ তার শক্তি আর জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছে কখন যেন। এখন তার যৌনাঙ্গ, তার দু'পায়ের ফাঁকে এক নিরীহ ফলের মতো ঝুলছিল, খুবই প্রশান্ত, অসহায়। তার লিঙ্গের ওপর যে দুটো শক্ত গোলোকাকৃতির অঙ্গ, তারাও ফিরে গিয়েছিল নিজ নিজ স্বাভাবিক অবস্থানে। গাউনের ফিতা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে সে ডায়নিং টেবিলে ফিরে যায়, এবং মগে যে কফিটুকু পড়ে ছিল, তাতে চুমুক দেয়।
যে মানুষগুলো এখানে থাকতো, এবং কোথাও চলে গেছে, সামসা জানে না যে তারা কারা, কিন্তু সে আন্দাজ করে, তারা হয়তো তার পরিবারই ছিল। হয়তো হঠাৎ করেই কিছু একটা হয়েছে, এবং তারা উধাও হয়ে গেছে। হয়তো তারা আর কখনোই ফিরবে না। "একটা পৃথিবী যখন ধ্বংস হবার জন্য উন্মুখ" - মানে কি এ কথার? গ্রেগর সামসার কোন ধারনা ছিল না। বিদেশী সৈন্য, চেকপোস্ট, ট্যাঙ্ক - সবকিছুই ছিল রহস্যের চাদরে মোড়ানো।
তবে যে ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিত ছিল, তা হচ্ছে এই যে - ঐ কুঁজো মেয়েটাকে সে আবার দেখতে চায়। তার সঙ্গে মুখোমুখি বসে প্রাণের আঁশ মিটিয়ে কথা বলতে চায়। রহস্যে ঘেরা এই দুনিয়ার পর্দা উন্মোচন করতে চায় তাকে সঙ্গে নিয়ে। সম্ভাব্য প্রতিটি কৌণিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে ঐ মেয়ের এঁকেবেঁকে নিজের ব্রেসিয়ার ঠিক করা দেখতে চায়। যদি সম্ভব হয়, তবে তার শরীরের ওপর সে একটু হাত বুলিয়ে দেখতে চায়। তার কোমল ত্বকের স্পর্শ পেতে চায়, তার উষ্ণতার ছোঁয়া পেতে চায় নিজের আঙ্গুলের ডগায়। দুনিয়ার তাবৎ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আর নামতে চায় তার সঙ্গে।
কেবল মনে মনে ঐ মেয়েটার কথা ভাবলেই সামসার ভেতরটা উষ্ণ হয়ে আসে। তার আর মাছ, কিংবা সূর্যমুখী ফুল, অথবা অন্য আর কোনকিছু হবার খাহেশ বাকি নেই। নিশ্চিতভাবে, এই দুই পায়ে হেঁটে বেড়ানো, বা উদ্ভট সব পোশাক পরা, অথবা কাঁটাচামচ আর ছুরি দিয়ে খাবার খাওয়া - এসবই খুব যন্ত্রণার বিষয়। তারমধ্যে সে জানে না - এমন জিনিসেরও কোন অভাব নেই দুনিয়ায়। তবুও যদি সে মাছ কিংবা সূর্যমুখী ফুল হয়ে জন্মাত, তবে এই মেয়েটার প্রতি তার যে আবেগ অনুভূত হয়েছে, সে স্বাদ নেয়া হতো না তার কখনো। এমনটাই মনে হয় সামসার।
সামসা দীর্ঘসময় ঐ জায়গাতেই বসে থাকে, চোখ বন্ধ করে। তারপর, সে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, তার হাঁটার কালো লাঠিটা হাতে নেয়, সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় পায়ে পায়ে। তাকে দ্বিতীয় তলায় গিয়ে সঠিকভাবে পোশাক পরা শিখতে হবে। এই মুহূর্তের জন্য, আপাতত এটাই তার লক্ষ্য।
একটা আস্ত পৃথিবী বসে আছে, তার পোশাক পরা শেখার অপেক্ষায়।
(হারুকি মুরাকামির গল্পগ্রন্থ মেন উইদাউট ওমেন এর পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউজ ইউকে সংস্করনে টেড গোসেনকৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমার বঙ্গানুবাদে। )
©somewhere in net ltd.