নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিজের সম্পর্কে লেখার মত এমন স্পেশাল কিছু এখনও অর্জন করতে পারি নি। ভালো থাকুন সবাই,আর ভালো রাখুন চারপাশের সবাইকে।

আদিল ইবনে সোলায়মান

আদিল ইবনে সোলায়মান › বিস্তারিত পোস্টঃ

"মা আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি, তোমাকে আর ঝিয়ের কাজ করতে দেব না"

২৭ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ৯:০২

ঢাকা বিশ্ব‌বিদ্যালয়
বছর সতেরোর ছেলেটি খুব জোরে জোরে হাটছে, দ্রুত শব্দ করে ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। স্বপ্ন দেখছি না তো ?পরক্ষনেই ভাবলো, না আমি ঘুমাই নি! আমি তো ঢাকার রাজপথে হাটছি, হুমমম রাজপথ। সামনে প্রায় ৩০০ গজ দূরেই বিখ্যাত শাহবাগ মোড় দেখা যাচ্ছে, স্বপ্ন নয় সত্যি! পাঁচবার ডিন অফিসের নোটিশ বোর্ড দেখেছে, শুধু নিজে নয় অন্য প্রার্থী দিয়ে রোল নম্বরটি সঠিক কিনা যাচাই করেছে। না কোন ভুল হয়নি তো। ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা ও বোর্ডে টানানো ফল মিলে গেছে, কোন সন্দেহ নেই।না, এ যে আর স্বপ্ন নয় সত্যি, নিগূঢ় সত্যি! মোবারকের স্বপ্ন সত্য।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক মোবারকের জন্য খুলে গেছে। তাকে হাতছানি দিয়ে বলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমাকে স্বাগতম। মাকে তাড়াতাড়ি খবরটা দিতে হবে। এখন ঘড়িতে সময় দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মাকে যে খবরটি দেয়া খুব প্রয়োজন। ক্ষুধা লেগেছে, খুব সকালে মেস থেকে বের হওয়ায় নাস্তা করা হয়নি। হাজারীবাগ থেকে হাকিম চত্ত্বর পর্যন্ত হেটে আসতে হয়েছে, অযথা পয়সা খরচ করা যাবেনা। অবশ্য খরচই বা করবে কি করে? অযথা খরচ করার মতো পয়সা তার হাতে নেই। পকেটে হাত দিয়ে দেখে মাত্র ৫০ টাকা পকেটে আছে। গাজীপুরের কোনাবাড়ী পর্যন্ত লোকাল বাস ভাড়া ৪০ টাকা। দেরি করা যাবে না, তাহলে মাকে গিয়ে তার বাসায় মানে বস্তিতে পাওয়া যাবে না। গার্মেন্টস এর মেসে রান্না চড়াতে মা চলে যাবে দুপর ২টা ৩০ মিনিটে। রাতের খাবার রান্না করতে। দেরি হলে অনেক শ্রমিক রাতে এসে বিরক্ত হন। সুতরাং তাকে তার আগেই কোনাবাড়ী পৌছতে হবে। আরো জোরে পা চালাতে হবে। শাহবাগ থেকে গাজীপুরের একটি বাসে চেপে ওঠে মোবারক।

প্রচন্ড গরম আর ক্ষুধা-তৃঞ্চা একটু ঝামেলা করছে, তবে শরীরের শক্তি যেন আজ দ্বিগুণ হয়েছে। মাকে আজ খবরটা দিতে হবে, হাজারো স্মৃতি আজ তাকে তাড়া করছে। হঠাৎ মনে হলো এই সংবাদটি বাবাকেও দেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু কিভাবে? বাবার কথাতো তেমন মনে নেই। শুধু মনে আছে ছোটবেলা বাবা খুব আদর করতেন। সারাদিন অন্যের জমিতে কামলা খাটতেন, সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরতেন। গামছার কোনায় ২টা লেবেন্সুস থাকত একটি মোবারকের অন্যটি তার ছোট ভাইয়ের জন্য। তখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। বাবার পিঠে ২ বছরের ছোট ভাই উঠে ঘোড়ায় চড়ত। মোবারক পাশে থেকে খেয়াল রাখতো যাতে পড়ে না যায়। ২০০২ সালে একদিন সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে যায়। বাবার কাপুনি দিয়ে জ্বর হয়। জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না করে বাবা, মা দিশেহারা হয়ে চিৎকার করে। মোবারক ও তার ছোট ভাই খুব ভয় পায়। রাতে পাশের গ্রাম থেকে অনেক কষ্টে মা একজন কবিরাজ নিয়ে আসে। মোবারকের আর কিছু মনে নেই।মনে থাকবেই বা কি করে! তখন মোবারকের বয়সই বা কত? এই সাড়ে চার কিংবা পাঁচ!

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে বাবাকে বাইরে কাপড় দিয়ে ঢেকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আশেপাশের সবাই এসে বাবার মুখখানি একবার করে দেখেছে আর আফসোস করে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা ঝাকুনি খেয়ে মোবারকের চেতনা ফিরে আসে, বাস তো বেশিদুর এগুয়নি, সবে মাত্র কাওরানবাজার সিগনাল। ছোট ভাইটির খোজ নিতে হবে। ২০০৭ সালে তাকে সে নিজে নিয়ে এসে দুঃস্থ শিশু প্রশিক্ষন ও পূর্নবাসন কেন্দ্র গাজীপুর এ ভর্তি করার জন্য মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসে। তখন সে সেই প্রতিষ্ঠানের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। মনে আছে বড় স্যারকে অনুরোধ করলে তিনি সহজেই রাজি হয়ে যান। তিনি ভাইকে প্রতিষ্ঠানে আবাসিক ছাত্র হিসাবে ভর্তি করে নেন। তার পর থেকে ২ ভাই একসাথে থাকা ঘুম, খেলাধুলা, পড়াশুনা।

২০১৬ সালে কোনাবাড়ী একটি বেসরকারি কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে দুঃস্থ শিশু প্রশিক্ষন ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের বদৌলতে। কোনাবাড়ীতে ২০০৩ সাল হতে ২০১৬ পর্যন্ত আবাসিক ছাত্র হিসাবে বিনামূল্যে থাকা খাওয়া, ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ বহন করে এই প্রতিষ্ঠানটি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা কতটা যে কষ্ট করেছে তা আজো মনে আছে। বাবা মারা যাওয়ার ২ দিন পর থেকে বাড়িতে আর খাবার নাই। অবুঝ ভাইটি ক্ষুধায় চিৎকার করছিল। মাকে কতবার যে ভাত দিতে বলেছে কিন্ত মা কোন কথা বলে না, শুধু শাড়ির কোনা মুখে দিয়ে নিশব্দে কাঁদে। ভাইকে দেখে রাখতে বলে একটি থালা হাতে পাশের বাড়ি থেকে খাবার আনতে যায়।

মোবারক খুশি হয় মা খাবার নিয়ে আসবে, ভাইকে চুপ করতে বলে। অনেকক্ষণ পর মা খালি হাতে ফেরত আসে, মোবারক তার ভাইকে ঘুমিয়ে যেতে বলে। ঘুম থেকে উঠলেই খাবার আসবে বলে জানায়। সেদিন অনেক কষ্টে করে দুই ভাই ক্ষুধার্ত পেট নিয়েই ঘুমিয়ে পেড়ে। সকালে মা তাদের নিয়ে নানাবাড়ি রওনা দেয়। অনেকদূর হেটে বহু কষ্টে নানাবাড়ি পৌছায়। নানা বেঁচে নেই। তিন মামার অভাবের সংসার। তবু তারা তাদের খেতে দেয়। কিন্তু রাতে ঘুমানোর জায়গা নেই। তবুও অনেক কষ্টে মামাদের বাড়িতে সপ্তাহ দুইয়ের মতো থাকার পর একজনের পরামর্শে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে অবুঝ দুই শিশুসহ অজানার উদ্দেশ্যে মা তাদের নিয়ে চলে আসেন। গাজীপুরে প্রথমদিকে মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো। মোবারক সারাদিন ভাইকে নিয়ে বস্তিতে সময় কাটাতো। দুপুরবেলা মা তাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসত আর দুইভাই মিলে তা খেতো। কখনো মাকে তাদের সাথে খেতে দেখেনি। তারা খেয়ে বেশি হলে মা খেতো। তাদের এই অবস্থা দে‌খে একজন পরামর্শ দিল মোবারককে দুঃস্থ শিশু প্রশিক্ষন ও পূনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করার জন্য এবং তাদের সহযোগিতায় মোবারক উক্ত প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ লাভ করে।

নতুন জীবন শুরু হয়ে যায় মোবারকের। গাড়ি থেকে নেমে মাগো মা বলে চিৎকা‌র দিয়ে মোবারক ঘ‌রে প্র‌বেশ ক‌রে মা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে ব‌লে, আমি ঢাকা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ে চান্স পে‌য়ে‌ছি মা। তোমা‌কে আর কষ্ট ক‌রে ঝিয়ের কাজ কর‌তে হ‌বে না। তোমার দোয়া কবুল হ‌য়ে‌ছে। এই ব‌লে মোবারক অঝোর ধারায় কাঁদ‌তে থা‌কে। মা তা‌কে সান্ত্বনা দেয়। ব‌লে, খোকা আমার কে ব‌লে‌ছে আমি কষ্ট ক‌রে‌ছি, আমি দোয়া ক‌রি তুই মানু‌ষের ম‌তো মানুষ হ‌বি। তাহ‌লে ম‌রেও আমি শা‌ন্তি পাব। মোবারক ব‌লে জানো মা আমির গত ৩ বছর রা‌তে ঘুমহীন। যখনই ঘুমাতেন যাই তখনই তোমার কথা ম‌নে হতো। সকালের খাবার তৈ‌রি কর‌তে তুমি রাত ২টা হ‌তে মে‌সে রান্নার কাজ কর‌তে চ‌লে যাও সারা রাত তুমি না ঘুমি‌য়ে কাজ কর ব‌লে ডুক‌রে কেঁদে উঠে। আমার তখন আর ঘুম আসে না মা। সারারাত পড়ার চেষ্টা করতাম। আজ তার ফল পে‌য়ে‌ছি মা। আমি আর তোমা‌কে কষ্ট কর‌তে দেবনা মা। পৃ‌থিবীর সর্ব‌শ্রেষ্ঠ মা হিসা‌বে তোমা‌কে প্রতিষ্ঠিত করব।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.