নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু সিদ

আবু সিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরীক্ষা

১৩ ই জুন, ২০১৪ রাত ১১:০২





ষোল বছরের আহমাদ পড়তে পড়তে দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারটা দেখে আরেকবার। আজ পনের তারিখ। আঠার তারিখ থেকে তার মাধ্যমিক শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। আঠার তারিখ এবং অন্য যে তারিখগুলোতে তার পরীক্ষা সেগুলোকে সে ক্যালেন্ডারে নীল কালিতে দাগ দিয়ে রেখেছে। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আদৌ সে পরীক্ষার কথা ভাবছে না। তার ভাবনা তাদের বাসাবদল সম্পর্কে। আসছে বিশ তারিখে তারা তাদের নতুন ফ্ল্যাটে উঠবে। বাবা বলেছেন, বাসাটা সুন্দর, বড়সড়। তাছাড়া নিজেদের তো! নতুন যে ফ্ল্যাটে তারা যাবে সেখানকার ঘরদোর ড্রয়িং রুম ডাইনিং বসার আসন সবই অতি আধুনিক। মা-বাবা দুজনের ইচ্ছা তাই আসছে বিশ তারিখেই নতুন ফ্ল্যাটে ওঠা। তারা আহমাদের পরীক্ষার কথা ভেবেও এই সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন। কারণ বাসাটা খুব কাছে আর বিশ তারিখে আহমাদের কোনো পরীক্ষা নেই ।

আহমাদ আজ আনমনা। সে ভাবছে তার ছোট ভাইয়ের কথা। বয়স তার দুই বছর। দু দিন আগে তারা দুজন তার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে যখন দাঁড়িয়েছিল ঘটনাটা ঘটেছিল তখন। ব্যালকনিতে খেলতে খেলতে একসময় তার ছোটো ভাই এক দৌড় দিয়ে মা-র কাছে গেল, আবার ছুটে এল নাচতে নাচতে এবং আবার গেল। যখন সে এভাবে আপন মনে খেলছিল তখন আহমাদ তার হাত দিয়ে গ্রিলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ সে অনুভব করল, তার পিঠের কাছে একটা গ্রিল যেন খুলে গেল। সে পিছন ফিরে পরীক্ষা করে দেখল যে একটা নয় দুটো। গ্রিলের দুটো পাত ফ্রেমের থেকে আলগা হয়ে প্রায় খুলে পড়েছে। অবস্থাটা অনুধাবন করার সঙ্গে সে কল্পনায় তার ছোট ভাইকে চারতলার গ্রিল ভেঙে নিচের কর্কশ কংক্রিটে আছড়ে পড়তে দেখল। ‘ইস!’ আফসোস হলো তার।

কিন্তু আমরা যাবার পর যারা আসবে তাদেরও যদি এরকম একটা ছোট বাচ্চা থাকে তাহলে তারও তো এরকম হতে পারে! প্রথমে ওরা তো এই দুরবস্থার কথা জানতেও পারবে না Ñ দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ? সে তার বাবাকে বিষয়টা জানাবার কথা ভাবল। কিন্তু বাবার স্বভাব বিলক্ষণ জানা আছে তার। সে কল্পনায় দেখল : তার এই জাতীয় কথায় বাবা বিরক্ত হলেন। বললেন, তুমি একটা উজবুক অথবা সজারু। তুমি সম্ভবত কোনো ভীত বাদুড়ের হৃৎপি- নিয়ে বেঁচে আছো। আমরা তো চলেই যাচ্ছি। আমরা তাহলে গ্রিলটা ঠিক করব কেন? ‘বাবা! ওদেরও তো এরকম ছোট একটা বাচ্চা থাকতে পারে। ওরা বাসার সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই যদি বাচ্চাটা গ্রিল ভেঙে নিচে পড়ে যায়!’

তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষের নির্বোধ সন্তান। ওদের বাচ্চা গ্রিল ভেঙে পড়লে তাতে আমাদের কী করার আছে? তুমি তোমার পরীক্ষার চিন্তা করো। পরীক্ষার রেজাল্টটাই আসল কথা!

নিজের মনে অন্য আরও অনেক রকম কল্পনার পর সে বাবাকে কিছুই জানাল না, শুধু ছোট ভাইকে নজরে রাখল। গত দশ তারিখ থেকে আজ পনের তারিখ পর্যন্ত তার মাথার ওপর তবু কী যেন বোঝা, কোনো অপরাধ যেন চেপে বসে আছে! কাল শেষ রাতে সে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল যে, এক অচেনা শিশু আকাশের সীমানা ভেঙে পড়ে থেঁতলে গেল কংক্রিটের চেয়ে কঠিন এই পৃথিবীতে! তার ঘুম ভেঙে গেল। সেই তখন থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত ভেবে ভেবে সে ঠিক করল, ভাঙা গ্রিলের ভগ্নপ্রায় পাত দুটো ঠিক করতেই হবে।

বাবা এখন অফিসে। মা ছোট ভাইটাকে নিয়ে গিয়েছে স্কুলে। আহমাদ সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাল। সে ঘরে তালা লাগিয়ে সোজা একট গ্রিল মেরামতের দোকানে গিয়ে হাজির। তার সব কথা শুনে দোকানদার বললেন, ষাট টাকা লাগবে। দরাদরি আর দরকষাকষির পৃথিবীতে সে স্রেফ আগন্তুক। সে তাই ত্রিশ টাকার কাজের জন্য ষাট টাকার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। তার কাছে একটাও পয়সা নেই। সে কখনও কোনো টাকা জমায়নি, অথবা ভুল করেও বাবার পকেট বা মায়ের পার্টসে হাত দেয়নি। যদি কখনও তার কাছে কিছু পয়সা আসত তাহলে সে দরিদ্র কাউকে দেখামাত্র দিয়ে দিতো। কেবল দরিদ্র মানুষদের জন্য যে তার বুকভরা ব্যথা এরকমটা নয়। সে ব্যথিত কুকুর, অসুখে ভোগা বিড়াল আর শীতে কাঁপতে থাকা গরুগুলোর কথাও ভাবে। একবার রাস্তায় একসিডেন্ট করা এক বিড়ালের কষ্ট দূর করতে সে ওষুধের দোকানে গিয়েছিল বিষ কিনতে। তার ধারণা হয়েছিল, তাতে বিড়ালটিকে আর কষ্ট পোহাতে হবে না। অবশ্য বয়স কম হবার কারণে কোথাও সে বিষ কিনতে পায়নি।

দোকান থেকে ফেরার পথে সে যতগুলো সম্ভাবনার জায়গা দেখল সর্বত্রই বলল, একটা কাজ হবে কি? ষোল ঘণ্টায় ষাট টাকা হলেও আমি রাজি। সে রাজি হলো কিন্তু দোকানদার আর মালিকরা কেউ রাজি হলেন না। তারা বললেন, পথ দেখো বাপু।

পথ দেখে যেতে যেতে সে একটা লরি বোঝাই হতে দেখল। ভারী মালামাল বোঝাই হচ্ছে তাতে। সে সুযোগ পেয়ে তারই ভিতর নিজেকে সেঁটে ফেলল। চার ঘণ্টা পেশিশক্তি দিয়ে পেল বিশ টাকা। ‘বি-ই-শ টাকা’, নিজেকে বলল সে। আজ সকালে তার সমস্ত শরীর ব্যথা। কিন্তু কোনো পথ নেই, ভিন্ন কোনো অবলম্বন নেই। সে একইভাবে পথে বেরোল এবং অনুসন্ধান করল একটা কাজের। আজকে সে তার পুরনো কাপড় পরে ঠেলাগাড়ির পিছন পিছন ছুটে পেল পনের টাকার সোনালি মুদ্রা। সতের তারিখে তার পরীক্ষার আগের দিনে, যখন তার শরীরের কলকব্জাসহ অন্ত্র-যকৃৎ-হৃৎপি- সব ব্যথায় পরিপূর্ণ, সে উপার্জন করল কোনোক্রমে দশ টাকা। সেটি উপার্জন করে সর্বসমেত পয়তাল্লিশটি টাকা নিয়ে হাজির এখন সে সেই দোকানে। বলল, বাকি টাকা আগামি মাসের বিশ তারিখের মধ্যে দিয়ে দেব Ñ যদি আপনি এই সাহায্যটুকু আমায় করেন! তার বিনয়ে দোকানদারের আফসোস হলো, মানুষ কত ভালোও হয়! সে পয়তাল্লিশ টাকায় রাজি হলো এবং তার এক সহকারীকে পাঠাল আহমাদের সঙ্গে।

আহমাদ! একনিষ্ঠ ও বিপর্যস্ত আহমাদ, প্রথমে দুটো পরীক্ষায় খুব কম লিখতে পারল। তার হাতের তালু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ব্যথায় প্রায় অবশ। সে কেবল কোনো রকমে পরীক্ষা দিলো, এবং একে একে সব কটা দিলো।

পরীক্ষার ফল বের হলে সে সবার নিন্দা আর উপহাসের পাত্র হলো। শিক্ষকেরা বললেন, ফার্স্ট বয় এবার বাস্ট হয়ে গেল। সহপাঠীরা ভেঙচি দিলো, ও তো মাকাল ফল - দূর থেকেই কেবল সুন্দর।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.