![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ সকাল থেকে প্রবল বৃষ্টি। শহরের পয়:নিষ্কাশন এমনিতে খারাপ, তার ওপর বিল ঝিল ভরাট করে মানুষ সব বাড়িঘর তুলেছে। এখন একটু বৃষ্টিতে পথ-ঘাট ডুবে যায়। ঘরের ভিতরে পানি চলে আসে। গরীব বস্তিতে থাকে যেসব মানুষ তাদের টিকে থাকা এক প্রকার যুদ্ধে পরিণত হয়। ঘরের এটা সেটা সরাতে, দৌড় ঝাপ করতে তাদের বেলা বয়ে যায়। দিনমজুরীর টাকায় সংসার চলে যাদের তাদের অনেকে আবার কাজ পায়না। আবার যাদের ঘরবাড়ি নেই, রাস্তার ফুটপাথে যাদের আশ্রয় তাদের অবস্থা আরও খারাপ। রাস্তায় জমে যাওয়া পানিতে ফুটপাথ ডুবে গেলে জীবনের সব অর্জন উপার্জন নিয়ে তাদের ছুটতে হয় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। কোথাও কিছু না মিললে গাছের তলায় তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মনে আশা, পানি কখন নেমে যাবে ফুটপাথ থেকে! এর মধ্যে এক কোটির বেশি মানুষ বেচে আছে এই শহরে। আরও কত জন্মাচ্ছে মরছে আর বাচার জন্য গ্রাম থেকে ছুটে ছুটে এখানে আসছে!
শহরের শতকরা চল্লিশভাগের মতো লোক এরকম অনিশ্চিত ঘর বাড়িতে বেচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকাল তাই তাদের প্রায় সবার কাছে অপ্রিয়। এত কিছুর মধ্যে আজ বৃষ্টির আনন্দে দুলে উঠল শায়ার এর মন। সে থাকে একটা দরিদ্র বস্তিতে। সেখানে ছোট ছোট খুপরি ঘরে শত শত মানুষ জীবন যাপন করে যাচ্ছে। তার আনন্দে লাফিয়ে ওঠার কারণ তার কারখানায় পানি ঢুকেছে- অর্থাৎ, আজকে আর তার কাজ করতে হবেনা। এটা ঠিক যে এতে সে কিছু আয়ও করতে পারবেনা কিন্তু তার বউ এর সাথে ঘুরে বেড়াবার একটা চিন্তা কিছুদিন ধরে তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে তাই যখন কারখানায় গিয়ে দেখল মেঝে পানিতে ছয়লাব সে একপ্রকার আনন্দিত হলো। পরে আশঙ্কাও জাগল, এখন যদি এই পানি সব পরিষ্কার করতে হয়! কিন্তু পানি পরিষ্কার করতে হলোনা, কাল রাতে আটা ময়দা চিনি লবন কিছুই আনা হয়নি এখানে কাজেই রুটি তৈরির কাজ কী বিস্কুট বানানো আজ আর লাগবেনা। কারখানার মালিক ভোর বেলায় এ দৃশ্য দেখে আনন্দে আটখানা। ভাগ্যিস! কাল রাতে এসব আনা হয়নি! না হলে সব যে পানিতে নষ্ট হত!
এরপর শায়ারকে আর কারখানার আশেপাশেও দেখা গেলনা। সে এক ছুটে তার ঘরের দরজায় হাজির। বউকে সেখানে না দেখে সে ‘মারি’ ‘মারি’ বলে চিৎকার করল কিন্তু মরিয়ম কোথাও থেকে এগিয়ে এলনা। এই ফাকে শায়ার তাদের চাচের বেড়ার সাথে আটকানো ছোট্ট আয়নাটাতে নিজের মুখ আর নাকের পাশের তিলটা ভালোভাবে দেখে নিলো, ‘না, চলবে।’ পরক্ষনে সে ঘরের থেকে বের হয়ে তার প্রতিবেশির কাছে জানল যে মরিয়ম বাজারে গেছে।
যেন সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোন কুকুর কেবল গন্ধ শুকে শুকে তার মারি-কে খুজে পাবে! কোন দিকে না তাকিয়ে এমনিভাবে জোরে হেটে সে বাজারে পৌছল। চারদিকে বৃষ্টি কাদা হালকা বাতাস। বাজার আজ মন্দা। বৃষ্টির উৎপাতে মানুষের আসা যাওয়া কম। পাইকারী বিক্রেতারা অনেক কম দামে তাদের শাক পটল করলা শসা আর কুমড়া ছেড়ে দিচ্ছে। সেখানে দাড়িয়ে এদিকে ওদিক হাটল সায়ার, বউ তার কোথাও নেই। যদি মাছির মতো মাথার চারদিকে চোখ থাকত আমার! সে আফসোস করল।
বউকে বাজারে খুঁজে না পেয়ে সায়ার সেই একই পথে ছুটতে ছুটতে ঘরে ফিরে এল। ঘরের কাঠের দরজা খোলা। বাজার থেকে আনা সব্জি মেঝের ওপর রেখে মরিয়ম আপন মনে ছোট্ট আয়নায় তাকিয়ে আছে। ঘরে ঢোকার আগেই সায়ার ব্যস্ত হয়ে উঠল। রেডি হও! এখনই বেরতে হবে। সায়ারের এমন হঠাৎ আগমনে সে অবাক। ‘কাজ না কইরা ফিরে আইলা যে?’ -‘আরে আজকা বেড়ামু’ সায়ার বলল। মরিয়ম শাকসব্জিগুলো কি করবে তা ভাবারও সময় পেলানা, সায়ার তাকে আবারও বলল, এরকম বৃষ্টি ভেজা দিন! এ তো হাতছাড়া করা যায় না- যাও যাও! আজকা বাইরে খামু।
মরিয়ম মোটেও তার স্বামীর মতো রোমান্টিক নয়। সে পোশাক বদলাতে বদলাতে খরচের হিসাব করতে শুরু করল। বাইরে ঘোরা ফেরা আর একটু কিছু খেলেও সে তো দেড়শ দুশো টাকা! তার থেকে পঞ্চাশ টাকা খরচ করে বাসায় ভালো কিছু খেলেই হয়! বাকি একশ টাকা তো জমানো যেত! সায়ার মরিয়মের মতো পুঁজিবাদী নয়। সে তার বউ এর এ কথা এক হাসিতে নিভিয়ে দিলো। সে দ্রুত তার যেনতেন প্যান্টটা পরে নিলো আর তার পর বউকে বগলদাবা করে টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে পথে নেমে এল। পিছন থেকে বস্তির কে যেন বলল, এ যে লাইলী মজনু! তারা সেদিকে কান দিলোনা। তাদের ছোট্ট অগোছাল ঘর পিছনে ফেলে তারা বৃষ্টিতে পরিছন্ন রাস্তায় এসে উঠল। চারদিকে খোলা পৃথিবী আর উদার আকাশ।
ফুটপাথ ধরে তারা হাঁটছে। রাস্তা কোথাও পানির তলে ডুবে আছে, কোথাও বা ইটখোয়া উঠে কাদায় একাকার। এর মধ্যে দিয়ে, গাড়িঘোড়া বাসট্টাক চলছে। জোরে হর্ন বাজিয়ে কোন কোন গাড়ি মানুষের গায়ে কাদা জল ছিটিয়ে ছুটছে। রিক্সাগুলো তাদের আপন তালে যেন বৃষ্টির ছন্দে চলছে। চারধারের পথচারী ভেজা কাক বা কুকুর সব কিছু চমৎকার লাগছে তাদের। মরিয়ম বড় হয়েছিল গ্রামে, স্বভাবত সে হাটতে পারত অনেক পথ। কিন্তু বৃষ্টি আর ভেজা রাস্তা তার গতি কমিয়ে দিয়েছে অনেক। সে বাদাম বা ঝালমুড়ি খাওয়ার কথা বলবে বলে কিছুক্ষণ ধরে ভাবছে। তার বলার আগে সায়ার এক দোকানের ছাউনীর নিচে একজন বাদামওয়ালাকে দেখে এখানে থামল। বাদামের ঠোঙা হাতে মরিয়ম বলল, আমারে কই নিয়া যাবা? ‘নিউমার্কেট’ বলল সায়ার। তার ইচ্ছা যত কম দামেরই হোক তার বউকে সে আজ নিউমার্কেট থেকে কিছু না কিছু কিনে দেবে।
একটা খলি রিকশা সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে সায়ার সেটাকে থামাল। ‘রিক্সা ক্যান? হাটতেই ভালো’- মরিয়মের এমন কথা সে কানে তুলল না। ময়িরমের মাথায় এখনও টাকা জমানোর চিন্তা। রিক্সার ভাড়া শুনে মরিয়ম এবার বলেই ফেলল, গরীরের সংসার - তুমি তো ভালোই বোঝ - একটু হিসাব করে না জমালে চলে! সায়ার এরকম কথায় দমে যাবার পাত্র নয়। রিক্সায় উঠে তার ‘মারি’র হাত ধরে সে উত্তর দিলো, টাকা তো কতই জমাইতে পারবা। কিন্তু এই বয়স আর সময় কি জমায়া রাখতে পারবা ? আজ খুব ভাল্লাগতাচে¬¬¬¬¬¬¬¬, সে আন্দিত মনে বলল।
কতদিন ধইরা ভাবতাচি তোমারে নিয়া একদিন সারাদিন ঘুরুম- তা আজকা সময় পাওয়া গেল। রিক্সা থেকে নেমে তারা আবার হাটতে শুরু করল। কোন রকমে টিপ টিপ বৃষ্টিতে ভিজে আর একটা ছেড়া ছাতা মাথায় ধরে হাটতে হাটতে তারা নিউমার্কেটের দিকে চলছে। চলতে চলতে হঠাৎ সায়ার একটা চুম দিল তার বোর গালে। বৃষ্টিতে রাস্তায় মানুষজন কম তবু মরিয়ম লজ্জায় শিউরে উঠল। তার জীবনে আগে কখনও এত মানুষের সামনে এমন কিছু ঘটেনি! স্বামীকে সে একটু প্রেমমিশ্রিত তিরস্কার করল, বেহায়া পোলা! এত মানুষৈর মধ্যে লজ্জাশরম কিছু নাই তোমার ! সে চারদিকে ভালো করে তাকাল, কেউ আবার দেখে ফেলেনি তো ?
কিছু দূর হেটে তারা সুন্দর একটা খাবারের দোকান দেখতে পেল। দোকানটা চমৎকার কাচে ঘেরা। বাইরে তার একজন দারোয়ান। বাহির থেকে ভিতরের মানুষদের চমৎকার পোশাক ও জীবনের জৌলুস দেখা যাচ্ছে। শায়ার এমন চমৎকার দোকানের ভিতরে কখনো ঢোকেনি। আজ সময় আছে আর ‘মারি’ও আছে তার সাথে। সে বেশি কিছু চিন্তা না করে দোকানটার ভিতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় দারোয়ান তাকে থামাল। তাদের কাপড় চোপড়ের দিকে উপহাস ভরে তাকাল। দূরে থাক বস্তি কোথাকার! দেখি কয় টাকা তোর পকেটে ? লেখাপড়া কিছু জানিস ? দারোয়ান তাকে কাচের ওপর ইংরেজিতে ছোট করে লেখা খাদ্য তালিকায় দাম দেখাল। শায়ার এবং মরিয়ম কেবল বাংলা পড়তে পারে। তারা সে- দামের কিছু বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কিসের কত দাম যদি একটু বলেন। দারোয়ান তার জন্য বিশ টাকা দাবী করল।
মরিয়ম সায়ারের হাত ধরে টানল। কিছু দূরে একটা ভ্যানের ওপর খিচুড়ি বিক্রি হচ্ছে দেখে সেদিকে চলতে শুরু করল। আহা দেখিনা কি বলে, শায়ারের কথা মোটেও কানে তুলল না সে। এখানে ভেজা রাস্তার ধারে জনকয় রিক্সাচালক দাড়িয়ে বা ফুটপাথে বসে তৃপ্ত মনে খেয়ে চলেছে। সায়ারের ইচ্ছা সুন্দর কোন দোকানে বসে তারা দুজন পাশাপাশি বসে খাবে আজ। এখানে তাই সে বসল না। বৌর হাত ধরে তার সাথে প্রেমালাপ করতে করতে সে একটা চাইনিজ রেস্তোরার সামনে এসে গেল।
বৃষ্টি এতক্ষণে থেমে গেছে। সায়ার তার মাথা মুছে নিয়েছে মারি’র শারির আচল দিয়ে। এক হাতে সেই পুরনো ও ভাঙা ছাতা অন্য হাতে বৌর হাত ধরে সে চাইনিজ দোকানটার সামনে দাড়িয়ে। এর সামনের দারোয়ান ও ভিতরে ঢোকার দরজা দেখে চাইনিজ খাবার খাওয়ার আশা সে ত্যাগ করল। তবু আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে চাইছে সে। দারোয়ানের কাছে গিয়ে খাবারের দাম দর জিজ্ঞেস করল সে, এ জাগায় খেতে কিরকম খরচ? দারোয়ান তার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে একটা ইঁদুর আর এখান থেকে খাবার চুরি করে খেতে এসেছে তারা! সে এদের মতো ছোটলোকের সাথে কথা পর্যন্ত বললনা। সায়ার তার বৌর দিকে তাকিয়ে বলল, বিশ টাকা দিলে এমন কি ক্ষতি হতো ? আমরা কি আর প্রতিদিন এরকম আইতে পারি ? তার অভিমান হলো। কি আর এত খরচ হতো ? সে তার পকেটে লুকানো পাঁচশ টাকার নোটটা বের করে মরিয়মকে দেখাল। মরিয়ম মুখে তার দুষ্টুমিভরা হাসি নিয়ে বলর, দেখি আসল না নকল? সায়ার সেই নোটটা তার চোখের সামনে আনল, মরিয়ম সেটা কেড়া নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল। এখন দুজনের চোখে হাসি। তারা আরেকবার পরিষ্কার ঝকঝকে কাচে ঘেরা খাবার দোকান খুঁজতে শুরু করল।
©somewhere in net ltd.