![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বেশ কিছ ুদূর হেটে ওরা এসে পৌছল বড়সড় একটা রাস্তার ধারে। এই রাস্তা থেকে কতগুলো সরু ও ছোট রাস্তা ভিতরের দিকে চলে গেছে। ভিতরে বেশ খেলামেলা জায়গা। বড় উচু বিল্ডিং আর তার মধ্যে তরুণতরুনীরা বসে গল্প করছে, বই হাতে এদিক সেদিক আসা যাওয়া তাদের। ওরা কাচের দোকানের বাইরে আগের মতো দারোয়ান দেখতে পেল। সায়ার তাকে জিজ্ঞেস করল, বাংলায় খাবারের তালিকা নেই ? দারোয়ান হচ্ছে অল্প বয়সের এক ছোকড়া। এদেরকে দেখে সে খুব মজা পেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, কি খাবে হট ডগ না বিফ বার্গার? ‘ডগ মানে যে কুকুর সেটা সায়ারের মনে পড়ল। সে ভাবল আছে হয়ত কি- ‘ভালো কিছু নেই?’ দারোয়ান তাকে বলল মুরগী ভাজা আর আলুভাজা নিতে পার। তারপর সে তড়িঘড়ি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভিতরে চলে গেল।
বর্ষায় আজ দোকানটায় বেশি ভিড় নেই। দারোয়ান তড়িঘড়ি একটা সুন্দর প্যাকেটে তাদের খাবার এনে দিল আর একশ’ টাকা ফেরতও দিল পাচশ’ টাকার সেই নোটটা থেকে। খাবার দেয়ার সময় দারোয়ান খাবারের নামটা জানিয়ে দিলো তাদেও, ফ্রাইড চিকেন ও ফ্রেঞ্জ ফ্রাই। মরিয়ম খারারটা না জানি কী তা বুঝতে না পেরে বলে ফেলল, কেন মুরগী ভাজা আর আলু ভাজা ? তারা তড়িঘড়ি করে প্যাকেটটা খুলে দেখে নিল যে না ঠিক আছে। তারা খারারের ইংরেজি নাম মনে রাখার কোন চেষ্টা না করে সামনের খোলা মাঠটার দিকে এগিয়ে গেল।
এতক্ষণ হেটে তারা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখন বসার জায়গা পেলে বিশ্রামের জায়গা মেলে তাদের, আর খাওয়াটাও শেষ হয়। মাঠের কাছে এসে তারা ভেজামাঠ দেখে হতাশ হলো। তাইলে উপায়? তারা সামনে বাংলায় লেখা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা লেখাটা পড়তে পারল। যাই হোক সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তারা আরও কিছুটা পথ হাটার পর একটা সুন্দর সাদা বিল্ডিং দেখতে পাচ্ছে। সাদা এই বাড়ির সামনে খোলামেলা সুন্দর মাঠ। মাঠের ভিতর চমৎকার লোহার বেঞ্চ। এখানে ঢোকার দরজাটাও খোলা। মানুষের আসা যাওয়া দেখতে দেখতে তারাও ঢুকে পড়ল ভিতরে। মাঠটার যে বেঞ্জগুলো খালি তার একটাতে বসে তারা স্বস্তি পেল। একটানা এতক্ষণ হেটে তারা এখন যেন একেবারে বাতাসহীন চুপসে যাওয়া বেলুন।
এখানে বসে তারা গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করল। আলুভাজা এবং মুরগী ভাজা তারা আগেও খেয়েছে কিন্তু এ যেন অন্য স্বাদ একেবারে। তারা মুরগীর মাংস এমনকি হাড়ের অংশও চিবিয়ে যাচ্ছে। তাদের যাওয়া দেখে কেউ কেউ তাদের দিকে তাকাল। সেসব খেয়াল তাদের নেই যে কারা দেখছে আর কী ভাবছে। আশপাশের কোন কিছুকে পরোয়া না করে তারা মুরগীর মাংস ও হাড়ের শেষ কনাটার স্বাদও নিলো। এমন সময় কোথা থেকে এক বাবরী চুলওয়ালা এসে হাজির। হাতে তার গজারী লাঠি, ঠোটে হুইসেল আর পরনে খাকী পোশাক। খেকি কুত্তার মতো হাউ হাউ করতে করতে সে এই দুজন নিরীহ গরীব মানুষের ওপর এসে পড়ল। ফকিরনীর জাত! হান্দাইচোস ক্যামনে এইহানে ? ওই চা- বেচা ছেড়াগুলারে দেখচোস? সে ফ্লাস্কে করে চা বিক্রি করা ছেলেগুলোকে দেখিয়ে তাদের ব্যঙ্গ করল। গরীব মানুষ দু’জন এতে খুব অবাক হলো। তারা এটাকে মাঠ ভেবে ছিল। ‘হউক ইনিভার্সিটি ! তাই বলে তারা ঢুকতেও পারবেনা ! তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ আছে কিনা সেটা ভাবারও সময় তারা পেলনা। ‘পরিষ্কার কর। জায়গাডা নোঙরা বানাইচে একদম !’ তাদের ফেলা খাবারের ঠোঙা তারা হাতে তুলে নিল। তাদের চোখে পড়ল চারপাশের ঘাসে ছোট ফুলবনে পথে ছড়ানো ছিটানো অনেক ঠোঙা কাগজের টুকরো, পানির বোতল এ সব এখনও পড়ে আছে আগের মতই। শায়ারের হাটার ইচ্ছা একদম নেই আর। মরিয়ম কিছুদূর সামনে আরেকটা গাছপালা ঘেরা জায়গা দেখে বলল, চলো ওই খানটায় যাই। অনেকেই তো বসছে - আমরা না হয় ঘাসে বসলাম। শায়ারের রিক্সায় উঠতে ইচ্ছা হলো। চলনা, হাইটাই যাই- ওইহানে বসুমনি একঘন্টা। শায়ারকে সে একপ্রকার টানতে টানতে হাজির এখন পাশের ছোট উদ্যানটায়।
উদ্যানটা ছোট খাট। তার মাঝখানে একটা পুকুর। পুকুরটায় গুচ্ছ গুচ্ছ শাপলা চোখ মেলে চেয়ে আছে যেন জলজ- তারা। পুকুরের চারধারে সব বৃক্ষ যেমন কদম, কৃঞ্জচূড়া, জারুল আর বড় এক শতবর্ষী মহুয়া। মহুয়া গাছটার চারধার শ্বেতপাথরে বাধানো। ওরা বৃক্ষগুলোর তল দিয়ে হেটে বসল পুকুরের ধারে। এখানকার ঘাস এখনও ভেজা, সূর্যের আলো পড়েনি তাই রয়ে গেছে এখনও সকালের বৃষ্টিগুলো। পাখিদের কেউ কেউ ডাকছে যদিও সেদিকে খেয়াল করতে পারলনা শায়ার, সে টুপ করে তার বৌর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। মরিয়মের কোল যেন ফুটন্ত তেল আর শায়ারের মাথা যেন কোন মাছের মাথা- মরিয়ম তেল ফুটতে থাকা কড়াই এর মতো তেড়েফুড়ে উঠল, এহনও তোমার বেহায়াপনা ! শায়ার মরিয়মকে চারদিকটা দেখাল। এখানে সেখানে জোড়ায় বসে আদমের বংশ ধরেরা, বংশের ধারা তারা রাখবে বহমান। পৃথিবী যতদিন থাকবে থাকবে আদম সন্তান।
হঠাৎ কী খেয়াল চাপল শায়ারের মাথায় সে একলাফে একটা কাঠালচাপার গাছে উঠে পড়ল। কত গুলো ফুলও পাড়ল সে। এবার নিচে নেমে তার বৌর খোপায় গুজে দিয়ে এক পলকে তাকিয়ে থাকল। চারদিকের পৃথিবী প্রেমে মশগুল। এরই মাঝে হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো এক মানবরূপী কানা খাটাস ! এসেই সে হম্বিতম্বি শুরু করলঃ ফুল পাড়ছিস ক্যা? গাছ তোর বাপে লাগাইছে ? শায়ার বা মরিয়ম কেউ বুঝতে পারছেনা যে কয়েকটা ফুল পাড়ায় তাদের কী অপরাধ হলো। আজ না হয় কাল ওই ফুল আপনিই খসে পড়ত গাছ থেকে। আর বাপের কথা আসছে কেন ? এই পৃথিবী চন্দ্র সূর্য বাতাস আকাশ জল স্থল পশু পাখি গাছ পালা এসব কার বাপের লাগানো ? প্রকৃতি ও জীবনের ওপর তার অধিকার সে জন্মগত ভাবেই পেয়েছে। এই উদ্ভট লোকটা এ বিষয়ে কথা বলার কে ? তাদের অধিকার নষ্ট করবার অধিকার সে কোথায় পেল? শায়ারের এতসব ভাবনার ভিতর বেহায়া লোকটা তার হাতের লাঠি দিয়ে শায়ারের পাছায় দুটো বাড়ি কষে দিল। হা কইরা দেখতাচোস কি ? আমারে আগে দ্যাহোশ নাই ! পিরীত করবার আইচোস দে ট্যাকা দে ! সে দস্যুর মতো শায়ারের পকেটে হাত চালিয়ে পঞ্চাশ টাকার নোটটা তুলে নিলো। মরিয়ম বলল, আমরা কুনো অকামে আসি নাই- আমরা স্বামী স্ত্রী ! লোকটা এ কথায় তার দু’চোখ ঘুরিয়ে চিৎকার শুরু করল, রাইত হইলেই বিশ টাকা নিয়া গাছের তলে শুইবা আর অহন ভালো মারাইতাচো !
এবার সে সবদিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল যে না, কেউ দেখেনি তার টাকা নেয়াটা। সহসা সে হেসে উঠল এবার। শায়ারের কাধে হাত রেখে বলল, আরে বস। টাকা যহন নিচি তোর আর কোন ভয় নাই। পীরিত আমিও কত করছি, রাত বিরাতেও করি - তয় মজা কর। উদ্যানের অন্যদিকে সে ছুটল এবার ... এভাবেই তার আর উপার্জন, জীবন যাপন। মরিয়ম এখানে থেকে এখনই উঠে যেতে চায় কিন্তু শায়ার নাছোড়বান্দা। আরে বস তো ! সব ঠিক এহন - সে মরিয়মের সাথে গল্প করা শুরু করে দিলো। মরিয়ম তার স্বামীর চাপাচাপিতে উঠলনা বটে কিন্তু এখানে সে আর মনও বসাতে পারছেনা। ঠোট তার কথা বলছে কিন্তু মন তার ছোট্ট বেলার দিনে ফিরে যাচ্ছে। সে যখন একটা ছোট্ট মেয়ে হয়ে স্কুলে যেত তখন কি দুনিয়াটা এমন ছিল? বিয়ের পর এই শহরেও তো সে কত ঘরের বাইরে এসেছে কিন্তু এরকম মানুষদের পাল্লায় সে আর পড়েনি। বাজার তো সে প্রতিদিনই করে। এমনকি স্বামীর কারখানারও যায় তাই বলে টাকা আদায়ের এ কৌশল তার খুব অচেনা লাগল। চুরি ডাকাতি ছিনতাই এসবের সাথে সে পরিচিত কিন্তু এমনভাবে টাকা নিয়ে লোকটা এখনও কিছুদূরে তারই চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
শায়ার বৌর মন খারাপ বুঝতে পেরে পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া এক বাদামওয়ালাকে ডাকল, এই বাদাম দিয়া যাও। অন্য সময় হলে মরিয়ম হয়ত আপত্তি জানাত, টাকা খরচ করতে দিত না। কিন্তু এখন সে নির্বিকার। শায়ার পাঁচ টাকার বাদাম কিনল। তোমারে যা সুন্দর লাগতাচে না’ শায়ার কানে কানে বলল, একদম বিয়ের দিনের মতো ! মরিয়ম কিছুটা যেন লজ্জা পেল। শায়ার কথায় ওস্তাদ। বৌর মন সারাতে তার জুড়ি নেই। মাত্র মিনিট দশেকের মধ্যে সে মরিয়মের চোখে আনন্দ আর মুখে হাসি ফিরিয়ে আনল। মরিয়ম এতটা অভিভূত হলো যে কয়েক লাইন গানও গাইল সে-
প্রতিদিন পায় কতজন
কতজনের হৃদয়
ধাপ্পাবাজির এই দুনিয়ায়,
হারিয়ে না যায়
রেখেছি তাই পরানে গেথে
তুমি আমার অক্ষয়,
অবিনশ্বর প্রণয়!
এতক্ষণে দিনটাকে স্বার্থক মনে হচ্ছে শায়ারের। তার বুকভরা আবেগ জেগে উঠছে। সে মরিয়মের খোপায় একটা চুমো একে দিলো। মরিয়মের আফসোস হলো, ঘরের ছোট আয়নাটা যদি সাথে থাকত নিজেকে কেমন লাগছে দেখে নিত একবার! যাই হোক, তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে ছেড়া ছাতাটা ছাড়া আর কিছু সাথে নিতে পারেনি সে। স্বামীর মুখে তার রূপের প্রশংসা আর গুনকীর্তণ তাকে এখন একটা যেন নতুন দিন এনে দিলো। সে আবারও আগের মতো সরব হয়ে উঠল, খরবদারি চালাল। বলল, তোমার সে নিউমার্কেট আর কতদূর?
অনেক শুয়ে বসে হেটে চলে তারা এখন উদ্যান ছেড়ে বেরল। শায়ারের মনে আশা, বৃষ্টি যদি থেমে যেত! দিগন্তব্যাপী একটা রঙধনু দেখার ইচ্ছাও মনে জেগেছে তার। কিন্তু নাহ! আকাশের মুখ আবার গোমড়া! ফোটা ফোটা বৃষ্টি আবারও শুরু হলো।
আধ-ছেড়া ছাতা মাথায় তুলে মরিয়ম ও শায়ার আবার হাটা ধরল। ফুটপাথ ধরে হাটতে হাটতে এবার তারা অজস্র ছোট ছোট দোকানের সামনে এসে পড়ল। এখানে বইখাতা আর কাগজ কলমের দোকান। বইখাতা বা কাগজ কলম এখন কোন কাজে আসবেনা তাদেও, তারা তবু এসব দোকানের দিকে অগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে। কল্পনায় শায়ার দেখতে পাচ্ছে তারা পড়ছে ফেলে আসা বিশ্ববিদ্যালয় টাতে। বেশ এখানে কাগজ কলম কিনতে কিনতে তাদের পরিচয়... আস্তে আস্তে বেশ ভাব-ভালোবাসাও হলো !
অই মিয়া, দেইখা চলতে পারেননা? একজন লোক ধমক দিলো শায়ারকে। তার পা রাস্তার ওপর ছোট একটা গর্তে পড়ে নোঙরা পানি ছাড়ল মানুষটার প্যান্টে ও পায়। কী করবে বুঝতে না পেরে সে মুখ কাচুমাচু করে বলল, ছোরি, ভুল হইচে ভাই ! বৌর হাত ধরে সে চলেছে-
হঠাৎ মুখের সামনে এখন তার একটা ছোট খাট দোতলা দোকান। দোকানের নাম মিষ্টার স্টুডিও। পাঁচ মিনিটে তোলা ছবি ওয়াশ করা হয়। আজকের দিনটাকে অবিস্মরনীয় করে রাখার কোন সুযোগ শায়ার হারাতে চায়না। যে অপ্রশস্ত সিড়ি বেয়ে মরিয়মের হাত ধরে টানতে টানতে দোতলায় উঠে এল। রাস্তায় থাকতে সে দেয়ালে টাঙানো ছোটখাট কাপড় পরা নায়িকাদের অর্ধেক বুক এবং নগ্ন পা দেখতে পেয়েছিল। এখন খুব কাছ থেকে দেখে তার রক্তের মধ্যে কামনার কিছু বদ্বুুদ জেগে উঠল। ‘লজ্জা শরমও নাই মাইয়াগুলার’- মরিয়ম ছি ছি করল। ও মা, হিন্দি ছবিতে দেখছো না ! শায়ারের কথায় মরিয়ম কয়েকজন অচেনা মানুষের সামনে লজ্জায় পড়ে যায়- দেখি না হয়, তাই বইলা সবার কইতে হইব ? মনে মনে ভাবে সে।
আমাগোর একটা সুন্দর ছবি তুইলা দ্যান-পাঁচ মিনিটের মদ্যে না’? তার স্বামী দরদাম না করায় মরিয়ম জিজ্ঞেস করল, খরচ কত পড়ব? কথাটা শায়ারের সম্মানে লাগল।সে হঠাৎ দমকা ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ল, তোমার খালি খরচ নিয়া চিন্তা ! একদিন একটু আনন্দও করতে পারুম না? মরিয়মের মুখ মলিন হয়ে এল এতে। অপরিচিত মানুষ দু’জনের সামনে নিজেকে সে অসম্মানিত ভাবল। এক ছুটে সে নিচের রাস্তায় নেমে এল। মাথার ভিতরে ঝড় থামল তার। এখন অনুতাপ তার কলিজায় মোচড় দিলো। সেও এক ছুটে নিচে নেমে এল। আকাশে বৃষ্টির ফোটা বিরামহীন, সেই বৃষ্টির সাথে এখন মরিয়মের অশ্র“- বৃষ্টিকে যোগ হতে দেখছে শায়ার। অনেক কথা দিয়ে সে তার বৌকে মানাতে চেষ্টা করল কিন্তু কোন কাজ হলোনা। মরিয়ম একাকী শহরের পানিজমা কাদা ওঠা অচেনা রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করল।
©somewhere in net ltd.