নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু সিদ

আবু সিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

যাদুর আয়না (উপন্যাস) - ৩য় র্পব

২০ শে জুন, ২০১৪ সকাল ১০:২২

সন্ধ্যা জুড়ে বসেছে পুরোপুরি পৃথিবীর পরে। অন্ধকার এখন সারাটা আকাশ। দোকান গুলোয় আলো জ্বলে উঠছে একে একে। তারা ফুটপাথে দাড়িয়ে বেশি ’ধইন্যা পাত্তা দিয়া’ ফুচকা বানাবার অর্ডার দিলো।



ফুচকা খেয়ে ছবি তোলানোর দোকানে ঢুকতে যাবে এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। ছবি তোলা তাদের আরও কিছুক্ষণ পিছাল। দোকানদার বলল, ভাই আরেকটু ঘুইরা আসেন - এক ঘন্টার মধ্যে কারেন্ট আইসা যাইব।



শায়ার তার বউকে খুশী ও সুখী করতে চায়। এখন তাই তার ভাবনা হলো আশে পাশে কোন চুড়ি বা গয়না-গাটির দোকান আছে কিনা তা খুজে দেখার। সে ‘মিষ্টার স্টুডিও’র মালিককে জিজ্ঞস করল, ভাই, আশেপাশে কোন চুড়ি- টুড়ির দোকান আছে? ‘ সামনে যাইয়া একটু বামে গেলে পাইবেন।’ রাস্তায় আজ মানুষের ভিড় একেবারে নেই। শায়ার তবু তার বউকে অমূল্য কোন সম্পদের মতো আগলাতে আগলাতে চুড়ির হাটে চলল।



চুড়ির হাটে শায়ার তার বৌর এসিসটেন্ট হয়ে গেল। সে যে দোকানে যায় শায়ার তাকে অনুসরন করে, যেটা কিনতে চায় সেটা কিনে দেয়। চুড়ি টিপ লিপষ্টিক নেল-পালিশ সব তারা কিনল। কেনা শেষে প্রায় আড়াইশ’টাকার মতো খরচ হওয়ায় মরিয়ম ইতস্তত করল যে তার স্বামী এতে কী ভাবছে। শায়ার তাকে আশ্বস্ত করল, তোমারে খুশী দেখার জন্যেই তো আইচি। দুজনে ঘুরচি, খাইচি, এখন কেনাকাটা করতাচি, ভাল্লাগতাচে - এইডাই তো আসল। যখন বুড়ি হইয়া যাবা, যখন আর ছুটাছুটি কইরা পৃথিবীডারে দ্যাকবার পারবানা তখন এইগুলা মনে পড়লে ভাল্লাগবো।



‘মিস্টার স্টুডিও’-র মালিক তার দোকান বন্ধ করতে যাবে এমন সময় তারা ফিরল। আজ সারাদিন বৃষ্টি। মানুষের আনাগোনা কম। আর এরাও ফিরছেনা দেখে সে ভেবেছিল, মনে হয় আর আসবেনা। তার ভাবনার ভুল ভাঙিয়ে শ্রাবণ দিনের এ দম্পতি উঠে এলো স্টুডিওতে। শায়ার বলল, খুব সুন্দর কইরা তুইলেন। একটা দুজনার, আরেকটা ওর একার।

আমার একার ছবি দিয়া কি হইব ?

আমার মানিব্যাগের মদ্যে রাইখা দিমু।

তার পুরনো মানিব্যাগটা পকেট থেকে বের করে সে মরিয়মকে দেখাল। তাইলে ওর ও একটা একার ছবি তুইলেন। এটা যে তার সাজ-গোজ করার বাক্সে সাজিয়ে রাখবে সে- কথা আপাতত প্রকাশ করলনা সে।



তোলানো ছবির প্রিন্ট নিয়ে ওরা রাস্তায় নেমে এল। চারদিক বড় বেশি জনমানুষহীন। কিছুক্ষণ আগে এ পথে যাওয়ার সময় ওরা একে অন্যের মাঝে এত বেশি মগ্ন ছিল যে এসব খেয়াল করেনি। এখন রাস্তার চারদিকের দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ হয়ে গেছে। মরিয়ম বলল, চলো, আজকা যাই। নিউমার্কেট মনে হয় বন্ধ হইয়া গেছে! কাদা আর পানিময় রাস্তা, ডাস্টবিন থেকে ছিটকে পড়া ময়লা আবর্জনা, ফুটপাথে রাত কাটানো মানুষজন, মাতাপিতাহীন শিশু-কিশোর-কিশোরী আর বেওয়ারিশ কুকুরেরা এখন এই রাতের রাস্তার অধিকারী। সাধারন ক্রেতা কিংবা পথচারীদের সংখ্যায় কম দেখেও শায়ার বলল, আসছি যখন একটু দেইখা যাই! অবশেষে তারা তাদের প্রধান গন্তব্য নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছে এখন।



নিউমার্কেটের ভিতরে ঢোকার অনেকগুলো গেট। যে গেটটা তারা প্রথম দেখছে সেটি বন্ধ। ‘আগেই কইছিলাম, এই বিষ্টি বাদলার দিনে কি আর এত রাইতে দোকান খোলা থাকব !’ আরও কয়টা গেট আচে। চল মেন গেট পর্যন্ত তো যায়। যেতে যেতে আরও একটা গেট তারা দেখতে পেল। গেটের ভিতর, অর্থাৎ, নিউমার্কেটের ভিতরে প্রায় এক হাটু জল জমে আছে। বৃষ্টি শুধু আজ সারাদিন নয়, গত কয়েক দিন ধরেই কম বেশি হচ্ছে। তবে আজকের বিরমহীন বৃষ্টির কারনে শহরের অনেক জায়গা চলে গেছে পানির তলে।



তারা নিউমার্কেটের মেইন গেটে এসে দেখছে এটাও বন্ধ। রাস্তা থেকে মার্কেটের ভিতরের পানি দেখা যাচ্ছে। তবে এখানে বেশ কিছু মানুষজন এক জায়গায় জড়ো হয়ে গল্প করছে, আড্ডা জমাচ্ছে। এদের কাপড় চোপড় চেহারা সুরত দেখে বোঝা যায় যে এই পুঁজিবাদী দুনিয়ার এরা নিছক খেটে খাওয়া মানুষ। অভুক্ত অর্ধভুক্ত জীবন এদের। কিন্তু মজলিশটা বেশ সরগরম। ধনপতিরা, সার্টিফিকেট ও ক্ষমতাধারীরা এখন তাদের আরামদায়ক ঘরে বসে খাচ্ছে বা আয়েশ করছে। এদের রাতের ঘুমনোর জায়গাগুলো পানির নিচে চলে গেছে। এখন এরা নিছক পানি সরে যাওয়ার অপেক্ষা না করে গান আর হাসি তামাশার শুরু করেছে। অল্প বয়সী আট-দশ বছরের বালিকা থেকে শুরু করে সত্তর পার করা বুড়োও আছে এখানে।



শায়ার আর মরিয়ম আড্ডাটার কেন্দ্র স্থলে এসে দেখতে পেল এক বিরাট আয়না। তার সামনে মানুষগুলো সব অঙ্গভঙ্গি করছে, উকি ঝুঁকি দিচ্ছে। আয়নাটা ঠিক মেইন গেটের ওপাশে নিউমার্কেটের ভিতরে। কিন্তু গেটটা সরু সরু লোহার রড দিয়ে তৈরি বলে এপাশে দাড়িয়েই সবাই তাদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে।



আয়নাটা প্রায় দশফুট উচু আর ছয়ফুট চওড়া। এটা কোথা থেকে যে এখানে এসেছে তা নিয়ে এদের কারও কৌতুহল নেই। এরা আয়নাটার সামনে গিয়ে তাকাচ্ছে, হাসছে হাত তালি দিচ্ছে আর আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। মরিয়ম শায়ারের হাত ধরে আয়নাটার সামনে এসে তাজ্জব বনে গেল। তাকে আয়নাটায় একজন রানীর মতো লাগছে। তার পাশে শায়ারকে মনে হচ্ছে রাজকুমার। তারা ঠিকমতো নিজেদের প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখে ওঠার আগে চারদিকে হাততালি বেজে উঠল। সত্তর পার করা বুড়ো লোকটা বসা অবস্থা থেকে উঠে দাড়াল। কাশতে কাশতে বলল, ভায়া তোমরা আজকা ফাস্ট হইচো। এই মাগার বেত্তমিজ আয়নার রয়োচ্য জানবার পারি নাই, কিন্তুক এই হানে স¹লরে ছুন্দর লাগতাচে। বুড়ো এসে তাদের পাশে দাঁড়াল। আয়নার ফুটে উঠল এক সুদর্শন প্রাণবন্ত তরুনের প্রতিচ্ছবি। বুড়ো তার থেকে কিছু দূরে বসা এক যুবকের পাছায় লাত্থি কষে বলল, এই হালার পুতেরেই কেবল কাউয়ার লাহান লাগতাচে।



কোন ভূমিকা ছাড়া বুড়ো বলে চলল, রাস্তায় ফুটপাথে পানি জমচে। ঘুমাইতে তো পারুমনা, তাই ঠিক করছি আনন্দ কই রাই রাইতটা কাটাইয়া দিমু। তা জবর আনন্দ পাইতাচি। তা কি কস তোরা? আশপাশের আর সবার সমর্থন আদায় করতে সে বলল। তাইলে অহন আরেকটা নিয়ম কই, ওরা যে ফাস্ট হইলো এই জন্য তা ওগো পুরস্কার দেওন লাগে। এক চ্যাংড়া ছোড়া লাফ দিয়ে উঠে বলল, নানা, আমি ফুলের দুকান থিকা বাতিল ফুল টুকাইচি। এগুলোন দিয়া এককান মালা বানায় দিবার পারি। সবাই কি কয়? বুড়ো জানতে চাইলে এক বুড়ি বলে ওঠে, আমরা রাজি তা তোমাগে একটা গান গাইতে হইব! বুড়ি মরিয়ম শায়ারের উদ্দেশ্যে বলে।



মরিয়ম গান গায় মনের আবেগে। সবার সামনে গাওয়ার মতো দক্ষ সে নয়। তার পরও শায়ার তাকে গাওয়ার অনুরোধ করে। সেই যে কই লাইন গাইলা বাগানের মইদ্যে- তার সকালে গাওয়া গানটার কথা শায়ার মনে করিয়ে দেয়। সংকোচ আর দ্বিধা যেন তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। মরিয়ম কোন রকমে বলল, আমি আসলে গাইতে পারিনা। বয়স ষাট পেরনো বুড়ি তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। সে মরিয়মকে আশ্বাস দিয়ে বলল, কুনো অসুবিদা নাই¹া বুন। তোমার গান আমি গাইয়া দিতাচি।



বুড়ি আসলে এক বাউল সাধক। কৈশরে সে তার প্রেমিক পুরুষের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিল। সে ছিল তার এলাকার প্রভাবশালী লোকের মেয়ে আর তার সেই পছন্দের মানুষ ছিল একজন যে কোন মানুষ। গান ছাড়া তার আর কিছু ছিলনা। পরিবারের দিক থেকে মেনে নেয়ার কোন আশা নেই বলে সে মা- বাপের ঘর ছেড়েছিল তার স্বপ্নের ঘর বাঁধতে। কয়েক মাস কষ্টে কাটাবার পর তার প্রেমিক পুরুষ, গায়ক পুরুষ তাকে এক পতিতালয়ে বেচে পালাল। সেখানে সে কাটায় নয় বছর। তারপর তার এক খরিদ্দারের সহায়তার পালায় সে সেখান থেকে। বাপের ঘরে আর ফেরেনি সে, ততদিনে স্বপ্রের ঘর পুড়ে ছাই! সবকিছু ছাড়লেও গানের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা কখনো ছাড়েনি। যে-গায়ক তাকে সামান্য-জন ভেবে বাজারে বিক্রি করতে দ্বিধা করেনি তাকে আজও সে মনে রেখেছে তার ওস্তাদ বা গানের শিক্ষক হিসাবে।



এতক্ষণে তৈরি হলো ফুলের মালা। বুড়ি মালাটা তার হাতে নিয়ে খুশী হতে পারল না; তাতে কয়েকটা বাসী গাদা আর দুটো আধপচা গোলাপ। সে সান্ত¡না দিলো নিজেকে, উপহারের মূল্য উপহারেই নিহিত, অন্য কিছু দিয়ে তার বিচার করা যায় না। কিশোরটা এতক্ষণে অধৈর্য্য হয়ে উঠল, নানী, এলায় পরায়ে দিতাচেন না ক্যা? বুড়ি মরিয়মকে বাসী পচা মালা পরালেও অপূর্ব সে অবিশ্বাস্য আয়নার ফুটে উঠল হীরা মনি জহরতের একটা মালা। সবাই তাতে হাত তালি দিলো আরেকবার। বুড়ো বলে উঠল, কিসের মালা পরাইলা বুড়ি? কিশোর ছেলেটা জোরসে বলল, হীরা মনি জহরতের মালা নানা। রাজা-রানীরাও এমন সুন্দর মালা চোহে দ্যাহে নাই।



আজ রাতটা, রাতের মানুষেরা, মেঘ সরে গিয়ে জেগে ওঠা চাঁদের ফালিটা সবই অবিশ্বাস্য স্বর্গীয় মনে হচ্ছে শায়ারের। মরিয়ম যে রাতের কথা কখনো ভাবতে পারেনি, এখানকার গরীব আর অবহেলিত মানুষেরা যে রাতের কথা কেবল গল্পে শুনেছে তা আজ তাদের সামনে তাদের সাথে। তারা প্রত্যেকে আজ এক একজন অভাবহীন দুঃখহীন সুস্থ সুন্দর ও সুখী মানুষ।

সুখী মানুষদের দলটা থেকে গায়িকা বৃদ্ধা এগিয়ে এলেন সামনে। আশ্চর্য আয়নাটাতে তার অনুপম ছবি। তার সাধনার সম্বল একতারাটা নিয়ে তিনি গাইতে শুরু করলেন-



পঙ্কে না নামলে তুমি

মাছ ধরবে কিসে,

ভালোবাসা আছে আমার

চোখের জলে মিশে।



অন্তরে হাত না রাখ যদি

তুমি কেমন কারিগর-

ইট পাথর আর মূর্তি মিলে

গড়েনা ভাস্কর।

প্রেমের সুধা প্রাণের তানে

দুলিয়ে দিলো জীবন আমার;

নিচের থেকে আরো নিচেয়

হীনের মাঝে গোপন আছে

প্রেমের পুরস্কার।

কেবল যদি ভোগবিলাসী

ইন্দ্রিয়পরায়ণ

চেওনা হতে সৃজনশীল,

গড়ার ব্রত নিয়ে জীবন

করতে যাপন করেন যেমন

নিত্য নারায়ণ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.