![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গত দুই দিন ধরে মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। এখানে দাঁড়িয়ে যদি আপনি একটা লাট্টুর মতো ঘুরপাক দেন, দেখবেন চারদিকে কিছুই চোখে পড়ছে না । শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি আর শুধু বৃষ্টি। ২০ X ২৫ ফুট একটা ছাউনির নিচে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে প্রায় জন পঞ্চাশেক মানুষ জীবনের কথা ভাবছে। চারদিক থেকে বৃষ্টির উচ্ছিষ্ট কণাগুলো এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। এই মানুষেরা গত দশ দিন ধরে এইখানে আছে। নারী পুরুষ বৃদ্ধ শিশু বৃদ্ধা বিকৃত মস্তিষ্ক তরুণ উদ্দীপ্ত তরুণীÑ সব ধরনের মানুষ এখানে রয়েছে। শেষবার ওদের সঙ্গে যেসব সাংবাদিক মানবাধিকার কর্মী কথা বলে গেছে, তারা আশ্বাস দিয়েছিল যে একটা ব্যবস্থা তারা নিশ্চয় করবে। তারপর তিন দিন হয়ে গেল আর কারো দেখা নেই। সব খাবার শেষ হয়ে গেছে ৩৬ ঘণ্টা আগে। পানীয় জলের যে শূন্য ক্যান আর বোতল ছিল সেগুলোতে এরা বৃষ্টির জল ভরে রেখেছে। বৃষ্টি বাঁচালো এবার তৃষ্ণা থেকে!
ওদের জীবন নিয়ে কে বা কারা যেন ছিনিমিনি খেলতে চায়। সাংবাদিকরা সচিত্র ও জীবন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে তাদের টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য, মানবাধিকার কর্মীরা অনেক অনেক ডলার হাতিয়ে নেয় জাতিসংঘের তহবিল থেকে, কিন্তু তারা এদের দুর্ভাগ্যের বিরোধিতা করতে পারেনা। তারা স্রেফ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে সংবাদ সংগ্রহ করে আর ছাপে। অনেক বড় ও বিখ্যাত চ্যানেলের সাংবাদিক আসে আর এসব মানুষের ওপর এমনভাবে প্রতিবেদন করে, যা দেখে মনে হয় যে মরে যাওয়াটা তাদের প্রত্যেকের জন্য দরকার। ভারতের রাজনীতিকরা প্রকাশ্যে বলেছেন, অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের আশ্রয় দিই না আমরা। আমাদের নিজেদেরই রয়েছে হাজারটা সমস্যা! ওরা যারা বাংলায় কথা বলছে তারা অবশ্যই বাংলাদেশের লোক; আর অন্যদের বিষয়ে কিছু বলার নেই আমাদের। বাংলাদেশের তরফ থেকে জানানো হয় যে, ওই বাংলাভাষীরা আসলে ভারতীয়; তারা পশ্চিমবঙ্গের লোক। আর অন্যদের বিষয়ে আমরা কিছু বলব না। জাতিসংঘ আছে, রেডক্রস আছে, মানবাধিকার কর্মীরা আছে । ওরা বুঝুক গিয়ে ওসব কারা। যখন সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে এসব বলে তো আমরা বা আপনারা কেউই দায়িত্ব এড়াতে পারি না। কিছু মানুষ অনাহারে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ধুঁকে ধুঁকে মরছে সারা পৃথিবীর সামনে আর কোটি কোটি মানুষ কিনা নির্বিকার। আগে ওদের আশ্রয় মিলুক, ওরা সুস্থ হোক পরে দেখা যাবে কে কোন দেশের নাগরিক। আগে তো বাঁচানো হোক তাদের।
এইমাত্র একটা সাদা জিপ এসে থামল এখানে। জিপটার গায়ে নীল নীল হরফে লেখা UNICEF। একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা নামল গাড়ি থেকে। তার সঙ্গে একজন তরুণ। এরা এসেছে অসুস্থদের সেবা করতে। যখন তারা সেই ছাউনির নিচে এল শরণার্থীদের প্রত্যেকে নিজের ভাষায় বলল, খাবার চাই, খাবার! তা না হলে আমরা মরে যাব। এক বৃদ্ধ ভাঙা ইংরেজিতে বলল, আমিও অংশ নিয়েছিলাম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে... আমরা এখানে কোনো না কোনো জাতির অংশ... আমরা আকাশ থেকে পড়িনি... যন্ত্রণা কেন তবে...? সে খক খক করে কাশতে থাকল। অপর একজন মানুষ, যার ইংরেজি জানা নেই, নিজের মাতৃভাষায় বলল, আমি দেখেছি মানুষের অনেক কিরিকিচি আর কুত্তামি... কী মনে করেন আপনারা, এ্যাঁ? সে চিকিৎসক মহিলাটার দিকে এগিয়ে গেল। আমরা বুঝি না কিছু! পৃথিবী আজকে বেজন্মাদের হাতে বন্দি হয়ে গেছে... আমি নিজের কানে শুনেছি নেতাদের শলাপরামর্শ : মানুষকে তুমি ঘরছাড়া করো, সে স্বভাবছাড়া হয়ে যাবে। তাকে তুমি উদ্বাস্তু করে রিলিফ খাওয়াও কিছু দিন, এরপর বাকি জীবন আর তোমাকে ভাবতে হবে না; সে ভিক্ষা করে খাবে... তোমার পায়ের তলে মাথা কুটে মরবে।
একজন তরুণ ছিল সবার পিছনে। সে তার রক্তচক্ষু নিয়ে মহিলাটির দিকে তেড়ে এল। তার গলা চেপে ধরল সে; খেলা পাইছিস? খেলা? তার ছেলেটা মরে গেছে গত রাতে। পাশের কেউ কেউ এসে তাকে ছাড়িয়ে নিলো মহিলাটির কাছ থেকে। সঙ্গী যুবক বলল, ম্যাডাম! চলে যাওয়াটাই ভালো হবে । এসব অভদ্র আর কুরুচিপূর্ণ লোক, ‘মানুষ’ নামের যোগ্য না। চলেন আমরা ফিরে যাই। এরা মরলে আমাদের কি? এরা কার কে? যতোসব উদ্ভট আর হীন মানুষ! মানুষগুলো অভুক্ত রইল, মৃতদেহগুলোর সৎকার হলো না । হাহাকার আর চিৎকার প্রতিটি হৃদয়ের অলংকার হলে রইল একটি নোম্যান্স ল্যান্ডে, একদিন ভোরের বেলা।
পরদিন থেকে বৃষ্টি রইল না আর। প্রখর রোদ আর তাপ। আর ওপরের উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে কয়েক প্যাকেট খাবার শুধু! সেই খাবার নিয়ে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। একজন মহিলা, যার মেয়েটার ডায়রিয়া হয়েছে, সে খাবার নিতে গেল না। সেই বৃদ্ধ যোদ্ধা যার যৌবনে তার ওপরওয়ালারা জাতিবিদ্বেষের বিষ ঢেলে দিয়েছিল তার কানে, সে কেমন নিস্পৃহ হয়ে রইলসামান্য সময়ের মধ্যে খাবারের প্যাকেট ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। পরের দুই দিন প্রবল রোদ, প্রবল উত্তাপ।
চারদিকে মলের দুর্গন্ধ আর কয়েকটা কবর। আবহাওয়া অস্বাস্থ্যকর একেবারে... এক ফোঁটা পানি নেই... সমস্ত উদ্বাস্তু শিবির জুড়ে ডায়রিয়া আর কলেরা । এরই মধ্যে মুখ কাপড়ে ঢেকে চলে এসেছে জনাবিশেক সাংবাদিক। এরা অধিকাংশই কিছু না কিছু খাবার আর পানীয় এনেছে, একজন কিছু সিগারেটও এনেছে। ওরা খাবার দিলো আর সাক্ষাৎকার নিলো। আশ্বাস দিলো আর বলল, ‘শীঘ্রই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ ‘সে কথা আমরাও জানি’ এক বৃদ্ধা বলল, ‘কিন্তু সেটা কি মরার ব্যবস্থা না কি বাঁচার?’
সন্ধ্যা হয়ে এলো। সাংবাদিকেরা, মানবাধিকার কর্মীরা, জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীরা সবাই ফিরে গেল। আজকে জাতিসংঘের তরফ থেকে আরও কয়েকটা তাঁবু করে দেয়া হলো। দুটো শৌচাগার তৈরি করা হলো কিন্তু পানির ব্যবস্থা আগের মতোই রইল।
রাতের বেলায় প্রদীপের প্রয়োজনীয়তা সেখানে অনুভূত হলো না। মানুষেরা গরমে এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকল। ভাবতে থাকল, এখন খাওয়া হলো না।একটু কিছু খেলাম শুধু । কালকে ভোরে নিশ্চয়ই খাবার চলে আসবে। তাদেরকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে রেডক্রস নয়তো জাতিসংঘের তরফ থেকে হেলিকপ্টারে খাবার আসবে কাল সকালবেলা।
অর্ধভুক্ত মানুষের অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশ, অনেকগুলো দিন স্নান না করে ঘেমে অস্থির। তাদের ভিতর নানাবিধ রোগের লক্ষণ ক্রমে ফুটে উঠছে। জীবনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা চলে যাচ্ছে। তারা হয়ে উঠছে স্বপ্ন, সম্ভাবনা, আশা ও বিশ্বাস হারা মানুষ। তাদের প্রত্যেকের মনোজগৎ এ মুহূর্তে একটা হতাশার বেড়াজাল ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেই সেনানি বৃদ্ধ এসব ‘কথার কথা’ ভাবনার কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছে রুক্ষ জমিনের ওপরে। হাঁটতে হাঁটতে মাটিতে লাথি দিতে দিতে সে বলছে, কিছু নরাধমের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে। তাই আমরা বাঁদরের দল, এইখানে আমড়া চুষছি। সব ভেল্কিবাজি আর কপটতা! অনেক তো দেখলাম... সব নষ্টামি... সব চক্রান্ত। বাকি মানুষকে বন্দি করে ওরা নিজেরা সব কিছু ভোগ করতে চায়। ইতর সব... অশিক্ষিত...
মাটি তো কথা বলতে শেখেনি, বাতাসও শেখেনি উত্তর দিতে; বৃদ্ধ তাই একা বকে নিজে নিজে পড়ে থাকে নোম্যান্স ল্যান্ডের শেষ মাথায়।
সকাল নটা পর্যন্ত কারও দেখা মিলল না। হেলিকপ্টার এল না, অন্য কোনো গাড়িও না। মানুষগুলো ক্ষুধায় অস্থির হয়ে পড়ল। কিছু মানুষ আর সহ্য করতে না পেরে নিজেরা পরামর্শ করল : আমরা একদিনও যদি বাঁচি, তাও সেটা কম না । এইভাবে মরার থেকে, এইভাবে কুত্তা কুত্তা খেলা করার থেকে মরণ অনেক ভালো। তাদের একদল বাংলাদেশের দিকে ছুটল আর অপর দল ছুট ভারতের দিকে। ওরা সীমানা ডিঙোবার ফুরসত পেল না । সীমান্তের বুলেট ওদের সব ক্ষুধা চিরকালের জন্য মিটিয়ে দিলো।
এখন আর্তনাদ আর হাহাকার আর মরণ আর ঘাম আর রক্ত! আর ভয় আর আতঙ্ক।
যারা তাঁবুতে তারা আতঙ্কে অটল স্থির হয়ে গেল। সবাই বাক্য ভুলে গেল। চারদিকে মৃত্যুর নির্মম নীরবতা। হঠাৎ ভোঁ ভোঁ শব্দে দেখা গেল কপ্টার একটা আকাশে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে শিলাবৃষ্টির মতো খাবার নেমে আছড়ে পড়ল মাটিতে। মানুষেরা হুড়োহুড়ি লুটোপুটি কাড়াকাড়ি আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাঁবুতে পড়ে রইল মৃতপ্রায় কিছু মানুষ। এদের মধ্যে এক বেদে মা তার বাচ্চার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । ছেলেটার জ্বর গত আট দিন ধরে। মা-টা অনেক চেষ্টা করেও উঠতে পারল না। বেজায় দুর্বল লাগছে তার। ছেলেটা তাদের ঝাঁপির মধ্যে সাপের যে একটা বাচ্চা বেঁচে আছে, তার জন্য মিনতি করছে মায়ের কাছে। বলছে, মা-য়! যাও গা না । কিছু আনো গা না ..। সাপের বাচ্চাটা মইরা যাইব মা! মহিলা তার দুর্বলতার কথা প্রকাশ করল না। কোনোমতে বলল শুধু : হারে বাজান, মানষের খবরবা মানষে রাখে না আর সাপের বাচ্চা! আস্তে আস্তে তার হাত নড়া থেমে গেল, সে মাটিতে নেতিয়ে পড়ল। ছেলেটা কিছু বুঝল না, ভাবল : মা বুজিবা ঘুম আইচে!
এইভাবে পূর্ণ বাইশটা দিন আদমের বংশধরেরা, স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীবেরা ধরণীর ওপরে তাদের জীবনযাপন করল। তারপর জাতিসংঘের সদর দপ্তরের দয়া হলো। ঘোষণা এল : মানুষ মানুষের জন্য। সব সংঘ সব প্রতিষ্ঠান কেবল মানুষের কল্যাণার্থে। আমরা এতদিন সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি তাদের অবস্থা। এখন সময় এসেছে তাদের জন্য ব্যবস্থা নেয়ার।
এই ঘোষণা জারি হওয়াকালে মাত্র চারজন বনি আদম আজরাইলের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে থাকতে পেরেছে। এই চারজনের একজন সেই বৃদ্ধ সৈনিক, দ্বিতীয় জন বেদে সেই মায়ের সন্তান, তৃতীয় জন একজন তরুণ এবং চতুর্থ জন একজন তরুণী। মহাসচিবের জারি করা বিধি মোতাবেক কোনো ফয়সালা হাজির করার আগে তাদের বাংলাদেশে আনা হয়। এখানে তারা তিনজন অপরিচ্ছন্ন কারাপ্রকোষ্ঠে দিনরাতভর মরার স্বপ্ন দেখতে থাকে। চতুর্থ জন তরুণী এবং তন্বী হওয়ায় তার জন্য মানবাধিকার কর্মীদের হৃদয় উথলে উঠে, কিন্তু মেয়েটা কেবল ছবি এঁকে দাগ কাটতে জানে। মানবাধিকার কর্মীরা এই ভাষা চীনা না জাপানি না কোরীয় তা তখনই বুঝতে পারেনা। যাই হোক মেয়েটা কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে পার পেয়ে যায়Ñ আর বাকিরা আইন যে অন্ধ সেটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে থাকে।
২| ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:১০
আবু সিদ বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৩ রা জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:২৯
প্রান্তিক জন বলেছেন: লেখেছেন দারুন, এমন এক বিষয় নিয়ে যা নিয়ে ভাবার বিবেক বোধটুকুও জীবীত নেই আমাদের।
বিহারী ক্যাম্পে যা হয়ে গেল, সেটাও এড়িয়ে যাবার বিষয় নয়।