![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(১)
আজ থেকে বছর দশেক আগে ঢাকা শহরের প্রায় ১০০ কি.মি. উত্তরে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। জায়গাটা ছিল আগাছা গুল্ম তৃণলতা এবং জানা অজানা নানান বৃক্ষ আচ্ছাদিত। জায়গাটা পুরনো সব শতাব্দী ধরে ভরে ভরে উঠছিল প্রকৃতির আপন হাতের ছোয়ায়। মানুষের ইচ্ছার কোন তোয়াক্কা না করে সেখানে বিকশিত হচ্ছিল বিভিন্ন প্রজাতির কীট পতঙ্গ সরীসৃপ পাখি বাদুড় এবং কিছু স্তন্যপায়ী প্রজাতি। সে-ধারাবাহিকতায় প্রথম ছেদ পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থাপনায়। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, সেখানে মাটি খুড়ে পাওয়া গিয়েছিল পুরনো এক সভ্যতার নিদর্শন! পুরনো কালের কিছু ইট সুরকি এবং কয়েক মুঠো মুদ্রা পাবার পরও এটাকে আমার কোন ধরণের সভ্যতার চিহ্ন বলে মনে হয়নি। হয়ত কোন ধনলিপ্সু বা সঞ্চয়-পরায়ণ মানুষ পরিত্যক্ত স্থানটিকে ব্যবহার করেছিল তার সঞ্চয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেত! আবার এমনও হতে পারে যে স্থানটি ছিল কোন ডাকাত দলের আড্ডাখানা। হয়ত মুঘল কালের কথা সেসব, হয়ত শাহ্জাহান তার পুত্র শাহ্ সুজাকে বাঙলায় পাঠাবার কালে এসব ঘটেছিল সেখানে। হয়ত এসব ঘটেছিল বীর ঈশা খাঁ বা তারও আগের কালে। যখনই তা ঘটুক, বা নাই ঘটুক, এটুকু স্পষ্ট যে এত শত উদ্ভিদ প্রাণির আকাঙ্খার মাঝে মানুষের আকাঙ্খাও সেইখানে গিয়ে উঁকি দিয়েছিল।
অতীতের সব মানবীয় আকাঙ্খা মলিন হয়ে এসেছিল কালপরম্পরায়। অন্য প্রাণ-প্রজাতির জীবনাকঙ্খা বয়ে চলেছিল অমলিন। এ ধারায় নতুনত্ব যোগ হলো বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থাপনায়। মানুষের এই আগমনে অন্যান্য জীবনের আকাঙ্খা গিয়েছে থমকে। এবং গত দশ বছরে তা প্রায় এসেছে থেমে। আজ তারা দরিদ্র ও নীপিড়িত মানুষের মতো কেবল খেয়ে দেয়ে জীবন পার করে দিতে চায়! আজ যে কোন গাছ কোন একটি আগাছা কে আশ্রয় দেবে বা প্রাণিকূলের কাউকে দেবে বসতি সে-বাসনা গেছে মরে। তবু প্রতি সকালে সূর্যের আগমনে অজ¯্র পাখি যে পাশের বিলে কোলাহলে মেতে ওঠে, গাছে গাছে জুড়ে বসে রঙীন বসন্ত তা কম নয়। যখন বন-নিধন হয়ে উঠছে সাধারণ, নদীর মৃত্যুও কোন আকস্মিক ঘটনা নয় সেখানে একটি বৃদ্ধ বিল বা জলাশয়ের টিকে থাকা, হাজারও গুল্মলতার জীবনযাপন সত্যিকার অর্থে আশাময়।
যতদিন মানুষ প্রকৃতির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠেনি, ভালোবেসেছে প্রকৃতিকে যেমন সে ভালোবাসে নিজ ভূমি, সমাজ ও আপন পরিবার পরিজনকে ততদিন প্রকৃতিও যখন তখন ফুসে ওঠেনি তার ওপর। প্রকৃতির এই ফুসে ওঠা সে সরাসরি প্রকৃতির ওপর আমাদের নির্দয় আচরনের ফল তা সহজে বোঝা যায়না। যদি একটা গাছ কাটার সাথে আমাদের পকেট থেকে লোপাট হয়ে যেত হাজার খানেক টাকা, যদি কাটা পড়ত আমাদের একটা আঙুল তাহলে কি এত বৃক্ষ নিধন হতো? আজ শীতের মিষ্টি রোদে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি সেগুন বনে চলছে হত্যা। হাজার চেষ্টায়ও রোধ করা যায়নি তা। সেখানে নতুন কিছু ভবন হবে। ‘ভবন হোক। ভবন হোক পরিত্যক্ত জমিতে যেখানে গাছপালা তেমন জন্মায়না বা ফসলও হয়না তেমন স্থানে!’ আমার এমন প্রতিবাদে ‘আজব লোক!,’ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা বলেন, ‘তা না হলে পড়ায় মনোবিজ্ঞান আর ঝোক কিনা গাছপালার দিকে? এতই যদি তুই উদ্ভিদ ভালোবাসিস তবে Botany-টা পড়তিস? যতোসব! ফাজিল লোকজন! ’
তাদের কথার উত্তর আমার জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান এবং পরিবেশ ও প্রকৃতি প্রতিরক্ষা (Environment & Nature Safety) বিভাগ থেকে জানান হয়েছে যে একটি সেগুন বন নিধন বিশ্বব্যিালয়ের সার্বিক পরিবেশের ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কি শুধুই একটি বিশ্ববিদ্যালয়? সে-কি মহাধরণী আর তার আপামর অধিবাসীদের সাথে সম্পৃক্ত নয়? একটি বন কি নিছকই একটি বন? তা কি হাজারো বৃক্ষের জীবন সম্বলিত একটি জনপদ নয়? হাজারো পাখি প্রজাপতি পতঙ্গ কীট এবং অন্য প্রাণীদের নিয়ে একটি সমৃদ্ধ আবাসভুমি নয়? আমার এসব প্রশ্নে কর্তৃপক্ষ অবহেলার হাসি হেসে এগিয়ে যায়। আমার অন্য সহকর্মীরা দরদ-ভরা কথা বলে। কেউ কেউ অস্ফুট আবেগও প্রকাশ করে, আহা! বেচারা!
বিকেলে ঘরে ফিরে দেখি আমার স্ত্রী বট, অশ্বধ এবং আরো গুটিকয় বৃক্ষের বনসাঁই এর পরিচর্যা করছে। চারতলায় আমাদের ফ্লাটটার বিস্তৃত বারান্দায় সে সারিসারি সাজিয়ে রেখেছে নানান বৃক্ষের বনসাঁই। গাছের সমস্ত আকাঙ্খাকে বন্দ্বী করে রাখা হয়েছে এতটুকু এতটুকু গুল্মের থেকেও ছোট আকারে! টবগুলো পরিচ্ছন্ন, লাল রঙে চকচক করছে। আমার স্ত্রী আমার চলাফেরা টের পেয়ে সেখান থেকে দ্রুত আসে। যতবার আমি তাকে বনসাঁই নিয়ে সময় কাটাতে দেখছি (বা বলা ভালো হতে নাতে ধরেছি) ততবার সে শুনেছেঃ এভাবে একটা বৃক্ষকে, একটা জীবনের সমস্ত আকাঙ্খাকে যারা একটি টবে বন্দ্বী করে কতনা নির্মম তারা! যার জীবনময় আকাঙ্খা শুধু বেড়ে ওঠার, বড় হবার এবং ওই আকাশ ছোবার, তাকে কেন বন্দ্বী করা। আজ আমি তাকে হাতে নাতে ধরার আগেই সে আমার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করেত যায়। আমি মোক্ষম সুযোগ পেয়ে তার অনুপস্থিতিতেই ব্যালকনিতে গিয়ে উচ্চ গলায় বলি, বৃক্ষ কেন বনসাঁই হবে? বৃক্ষ কেন বনঁসাই হবে এ জবাব কে দেবে?
রাতের খাবারের পর আমি সুখও দুঃখের তাৎপর্য নিয়ে একটা লেখা তৈরিতে ব্যস্ত । আমার স্ত্রী বনসাঁই পরিচর্যার বিষয়ে পত্রিকার কলাম পড়ছে। ‘নির্দয় হবার ট্রেনিংও দেখি নিচ্ছ আজকাল!’ তাকে আমি ব্যঙ্গ করি। আমার স্ত্রী কোন উত্তর না দিয়ে কিছু হাসি এবং আরও কিছু ছলনা মিশিয়ে আমায় জানায় যে সে মা হতে চলেছে। তার কথায় আমি সঠিক বা সম্ভাব্য সময় এবং খরচের পরিমানটা জানতে চাই। কখন সেই নবজাতক পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলতে পারবে। সে আমাকে বড় ধরনের একটা ভেংচি কাটে। অভিমানে উতালা হয়ে অভিযোগ করে, এমন খবরে সবাই খুশী হয়।লাফিয়ে ওঠে দশহাত! আর তুমি কিম্ভূতকিমাকার! প্রথমে টাকার চিন্তা! সময়ের বিষয়েও যে আমি বলেছি সে তার উল্লেখ মাত্র করেনা। ব্যঙ্গ খুনসুটি আর প্রেমে আমাদের সময় বয়ে যায়।
(২)
ঘরে বনসাই আর বাইরে বৃক্ষনিধন দেখে দেখে হতাশা লাগে আমার। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলো পেরিয়ে বনের পাশে গিয়ে বসি প্রায়। সেখানে একেবারে যেন অন্ধকার। উচু বৃক্ষের পাতার ফাক দিয়ে গলে পড়ছে আলোকের স্বর্ণধারা। সেই আলোক ধারায় একটি লতানো জীবন এক নাম না জানা বৃক্ষকে পাঁকে পাঁকে পেচিয়ে উঠেছে উর্দ্ধে। তার পাশে সবুজ পাতায় পাতায় জীবনের আশ্বাস। তার পাশে কয়েকশ বছরের পুরনো এক দাদীমা বৃক্ষ, সেই বৃক্ষের একটি শাখা এসে যেন ঠেকেছে মাটিতে । আমি বসি সেই ডালটাতে। ভাবি, যদি এমন বনের কথা সবাইকে জানানো যেত! হয়ত মানুষ অনুপ্রাণিত হতো বৃক্ষ বা বন সংরক্ষণে! পরক্ষণে আকাঙ্খা হয় আমার, হয়ত উল্টোটা হবে। হয়ত গাছ কেটে বাজারজাত করে মুনাফা করাটা মানুষের লক্ষ্য হয়ে উঠবে! সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমি আপন মনে বিভিন্ন গাছের পাতা ফুল ফল নেড়ে চেড়ে দেখি। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ কখন যেন নিসঙ্গ একটি মহীরুহের পাশে এসে দাড়িয়েছি। তার পাশে দুটো গাছ, অনেকটা যেন শিউলী বা কামিনী গাছের মতো। দুটো গাছ মিলিয়ে একটি ফুল। ফুলটা বিস্ময়কর সুন্দর। জাফরান হলুদ ও সাদা-র মিশ্রণ তাতে। আমি ফুলটা ছুতে যাব এমন সময় কোথা থেকে কে যেন বলল, হাত দিওনা! হাত দিওনা! এই একটা মাত্র সন্তান আমাদের। ওকে বাঁচিয়ে বড় করব আমরা! পৃথিবীর আর কোথাও কোন স্থানে দেশে বা প্রান্তরে আমাদের বংশের কাউকে আর পাবেনা।
গাছকে কথা বলতে শুনে আমি তো অবাক। জগদীশ বসু গাছের সাড়া ধরবার জন্য সরুতাল তরুলিপি নামের এক যন্ত্রের উদ্ভাবন করেছিলেন কিন্তু গাছের কথা ধরবার কোন যন্ত্রের কথা তো আমার জানা নেই! আর থাকলেই বা কি, আমার কাছে তো তেমন কোন যন্ত্র নেই। হয়ত এ আমার শোনার ভুল! আমি আবারও ফুলটার দিকে হাত বাড়ালাম। আবারও ভেসে এল সেই ধ্বনি, না-না-না ভুলেও হাত দিওনা। মানুষ হয়েছ যখন মূর্খ হয়োনা। মানুষ হয়েছ যখন অবিবেচক হয়োনা।
ঘরে ফিরতে আমার সন্ধ্যা হয়। সবার অপরিচিত ও উপেক্ষিত সেই বন থেকে ঘরে ফেরার পথটি কীটপতঙ্গের নিরবিচ্ছিন্ন শব্দে আনন্দিত। আমার স্ত্রী আমার জন্য ঘরের দরজা খুলেই অদৃশ্য হয়ে যায়। সে আমাকে দূরে রাখে এবং এঘর সে ঘর থেকে অনেক কথা শোনায়। একথাও সে বলে যে আমি আজকাল অন্য কোন মেয়ের সাথে প্রণয়ঘটিত কোন সম্পর্ক গড়ে তুলছি কিনা সেটা তার অনুসন্ধান করা দরকার। ‘তা না হলে কোন কাজটা করছ তুমি যার জন্য সকাল সন্ধ্যা ঘরের বাইরে থাকছ?’ সে আমাকে প্রশ্নের ফাঁদে ফেলে,‘আজ তো ইউনিভার্সিটিতে কোন ক্লাসও ছিলনা! আমি ভেজা বেড়ালের মতো মিউ মিউ করি, আসলে ন¤্রতা! তুমি তো জান যে আমি গাছ প্রকৃতি এসব খুব ভালোবাসি ......! থাক্ ! আর বোঝাতে হবেনা। গাছের কথা বলাটা আমার মনে পড়ে যায়। আরে আমি তো ভুলে গেছি, একটা গাছ আজ আমার সাথে কথা বলেছে। একথাটা তাকে অদৃশ্য অবস্থা থেকে আমার সামনে হাজির করে। সে চোখ বড় বড় করে ঠোট উল্টে যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বলে, গাছ তোমার সাথে কথা বলেছে, হ্যাঁ ? তোমাকে নিয়ে যে কী করব -- oh God!
আমি ন¤্রতার সামনে যুক্তি পেশ করি। তাকে বলি, একেবারে সত্যি ঘটনা। চলো কাল তোমাকে নিয়ে যাব। তুমিও শুনবে নিজের কানে। আমার কথায় সে আশ্বস্ত হয় কিনা বুঝতে পারিনা। তাকে কিছুটা প্রশংসা করে অবস্থাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। সে আমার প্রশংসাকে মৌসুমী বায়ুর মতো ক্ষণস্থায়ী জেনে রান্নায় মন দেয়। আমি জানালা দিয়ে দেখতে পায় চারধারে যে গোটকয় বাড়ি দাড়িয়ে আছে এই অরন্যানীর ভিতর সেসব স্থান থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো, মাথা উচু দাড়িয়ে অজ¯্র বৃক্ষ। কল কাকলিতে মুখর সন্ধ্যার পাখিরা। বাইরের ব্যালকনিতে এসে বসি আমি। ডজন খানেক বনসাই বসত করে এখানে। এঘর সেঘর ও সকল ব্যালকনি খুজে ১২৮টা বনসাই এর সন্ধান পেয়েছি আমি। মাঝে মাঝে ভাবি, একে তো ওদের করা হয়েছে বামন তার ওপর কেন রাখা হচ্ছে বৃক্ষবিহীন নির্বান্ধব এই বদ্ধ ঘরদোরে? আমার স্ত্রী বলেন, বনসাঁই করা হয়েছে এজন্য যেন তাদের ঘরের মধ্যে এনে রাখা যায়। সে বলে, সবাই আমার বৃক্ষ প্রেমের কত সুনাম করে! কেবল তোমার কাছেই আমি সন্মান পেলামনা। আমার সবকিছুতে তুমি ত্রুটি খুঁজে পাও।
ন¤্রতা, আমার স্ত্রী, একজন কলেজ-শিক্ষিকা। প্রতিদিন ভোরে সকালের খাবার তৈরি করে তার স্বামীর সাথে একত্রে বসে খায়, এখান থেকে ২০ কিমি দূরের কলেজটাতে যায় এবং বিকেলে ঘরে ফেরে। ঘরে ফিরেও সে সংসার ও ঘরের গোছগাছ ও রান্নাবান্না করে। এরপর সে তার কলেজের জন্য লেখাপড়া করে। মানুষ হিসোবে সে অধিকাংশ সময় আবেগের ওপর যুক্তিকে স্থান দেয়। আমি বুঝতে পারছিনা আগামীকাল বা পরশু সে আমার বক্তব্যটা বাস্তবের সাথে মিলিয়ে দেখতে যাবে কিনা, নাকি কখনও সেটাকে সে গুরুত্ব দেবেনা।
সকালে জেগে আমি তড়িঘড়ি বনের পথে পা বাড়াই। যেতে যেতে আমার মনে পড়ল বিদেশী কোন ম্যাগাজিনে পড়া একটা প্রবন্ধের কথা। সেখানে লেখক লিখেছেন যে একদা হিমালয়ের পাদদেশ ছিল প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা হাজার বৃক্ষের বসতভূমি। তিনি প্রথম যখন সেখানে যান (তার এই প্রবন্ধ লেখার ২০-২৫ বছর আগে) স্থানটির সেই পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করে। তিনি সেখান থেকে ফিরে এই চমৎকার পরিবেশের ওপর একটা লেখা পত্রিকায় ছাপেন। বিশ-পঁচিশ বছর পর সেখানে আবার গিয়ে তিনি খুব কষ্ট পান। সেখান থেকে ফিরে তিনি বলেন যে তিনিই হয়ত দায়ী এর জন্য। ক্ষতিটা হলো, পুরনো সেসব বৃক্ষরাজি লোপাট হয়ে গেছে। হাজার উৎসুক পর্যটক খোনে গেছেন, তাদের প্রয়োজনে তারা গাছগুলো কেটেছেন আর এখন, বলতে গেলে, কোন গাছ আর অবশিষ্ট নেই। প্রবন্ধকার আফসোস করছেন যদি তিনি প্রকৃতির ও বৃক্ষের সেই অনুপম সৌন্দর্যের কথা না লিখতেন! এসব বৃক্ষ নিধনের অপরাধ যেন তার এমনিভাবে তিনি আফসোস করছেন!
আমার স্ত্রীকে এখানে আনার পরিকল্পনা আমি আপাতত বাদ দিই; পাছে তার কাছ থেকে অন্যরা এ স্থান চিনে যায়! হয়ত তারপর তারা টাকার চিন্তায় বিরল সব গাছগুলো বিক্রি করবার ফন্দী আটবে! এটি বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু তা জ্ঞান চর্চার স্থানে পরিণত হয়নি। এটি হয়নি মানব কল্যাণের সাধনাক্ষেত্র। এটি হয়ে উঠেছে আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো আয় উপার্জন পদাধিকার ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তির স্থান। এসব কারণে আমি সাহস হারিয়ে ফেলি এবং বনের পথে আমার যাতায়াত গোপন রাখি।
সহসা আমার স্ত্রী একদিন বলে যে গাছ কেমন করে বলে এবং কি বলে তা সে নিজের চোখে দেখবে নিজের কানে শুনবে। আমি সাথে সাথে তাকে ‘না’ বলি। সে আমার উচ্চ কন্ঠ শুনে প্রথমত চমকে যায়! কিছুক্ষণ চুপ থাকে, এবং বলে, তুমিই কিন্তু বলেছিলে! ঠিক আছে, না গেলাম!
(৩)
নিজের অজান্তে কখন যে ঘর ছেড়ে বেশি বেশি বনমুখো হয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ একদিন ন¤্রতা ডাক্তারের কাছে যাবে বলে আমাকে এক মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। ব্যাপারটার কিছুই আমার জানা ছিলনা। ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকার আগে সে আমায় বলে, এমন কিছুনা! জাষ্ট একটু কথা বল। প্রতিবাদ করার কোন সময় পাওয়া গেলনা, সে আমার হাত ধরে সোজা ডাক্তারের সামনে হাজির হলো। ডাক্তারের সাথে এটা সেটা কথা বলতে বলতে ন¤্রতা বলল, তোমার ওই গাছের কথা বলার ব্যাপারটা একটু শেয়ার করতে পার। ডাক্তার সাহেব নিজে গাছপালা খুব পছন্দ করেন। গাছপালা হয়ত তার অপছন্দের না মনোযোগ দেবার মতো কোন বিষয় নয় তবু ন¤্রতার কথায় ডাক্তার মশায় উদ্ভিদ ফুলের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠলেন। বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ বলেন গাছের কথা বলার ব্যাপারটা যেন কী? আমার নিজের গ্রামের বাড়িতে বেশ কিছু নারকেল আর সুপারি গাছ আছে। ডাব খেতে আমি খুব ভালোবসি। আমি বলবার আগে আমার স্ত্রী বলল, আসলে গাছ গাছড়া এর খুব প্রিয়। কয়েক সপ্তাহ আগে বলছিল যে কোন গাছ নাকি এর সাথে কথা বলেছে! ডাক্তারের ঠোটে অর্ধেক হাসি ফুটে উঠল। পরক্ষণে তিনি হেসে উঠে বললেন, তা এরকম গাছ পেলে তো আমি তা মানুষকে দেখিয়েই যথেষ্ট পয়সা আয় করতাম ঠিক চিড়িয়াখানার মতো। সব কথার শেষে ডাক্তার বললেন, কিছুদিন কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসুন। সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক নয়তো দুবাই যান। জগতের রঙ তামাসা একটু উপভোগ করুন, এসব বন জঙ্গল আর আগাছা তো সারা জীবন দেখলেন!
কিছুক্ষণ বাদে আমরা বেরিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী বলল, এক মিনিট, একটু দাড়াও। সে একছুটে আবার ডাক্তারের রুমে গেল।
ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর আমার স্ত্রী বলল, তা চল! আমরা কোথাও একটু বেড়াতে যাই। সে মালোশিয়ায় তার বোনের বাসায় যাবার প্রস্তাব করে। সামনে শীতকালীন ছুটি। আমি এ অবস্থায় কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে না যাবার কোন কারণ দেখছি না।
(৪)
দেশের বাইরে বেশিদিন আমার থাকা হলোনা। গাছগুলোর জন্য আমার খুব খারাপ লাগছিল, এছাড়া মনে হচ্ছিল যে কেউ আবার গাছগুলোর কোন ক্ষতি করে ফেলছে না তো! দেশে ফিেের সোজা আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলাম। শীতের ছুটি এখনও শেষ হয়নি। বিকেলের হলুদ আলোয় আমি সেই বনানীতে দাঁড়িয়ে। যে ফুলটি দুটি বৃক্ষের আকাঙ্খা হয়ে দুলছিল একদা সেটি এখন একটি চারাগাছ। চারদিকে সেই অনন্ত প্রাণ যা পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাবের পর ধারাবহিক বয়ে চলেছে। সে ধারাবহিক জীবনের বয়ে চলার মাঝে নীরব এক ছন্দ বয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। অশ্রুত সেই ছন্দ সেই সুর আমায় মোহিত করে। আমি আবিষ্ট হয়ে কাটিয়ে দিই ঘন্টার পর ঘন্টা। বিকেল সন্ধ্যা হয় --- সন্ধ্যার তারার উজ্জ্বল জ্বলে ওঠে আকাশময়, ফুলের সৌরভে মেতে ওঠে বনানী। সহসা কোথায় ডেকে ওঠে একপাল শেয়াল, একটি হুতোম প্যাঁচা। আমি তেড়েফুড়ে জেগে উঠি; এতক্ষণ যেন হারিয়ে ছিলাম অনন্তের গহীনে!
ব্যস্ত ও দ্রুত আমি চলতে চলতে ধাক্কাই খাচ্ছিলাম আরকি! দেখি ন¤্রতা। দুচোখে তার অবিশ্বাসের ঘোষনা, এতক্ষণ কি করছিলে? এদিকে প্রাণ আমার উড়ে যাবার অবস্থা! আমি অনুতাপ করার ভঙ্গীতে বলি, খুব ভুল হয়ে গেছে ন¤্রতা। তুমি তো জান বনটার জন্য আমার কি নেশা! সে কোন কথা বললনা। সোজা ঘরের দিকে চলতে থাকল।
সে রাতে তার পক্ষ থেকে কোন অনুযোগ অভিমান বা রাগের নমুনা পাওয় গেলনা। দিনকয় পর সে আমাকে আরেক দফা ডাক্তারের সাথে দেখা করাল। ডাক্তার বললেন, আপনারা স্থান বদল করেন। ওই বন না বুনো হাওয়া কিসের কথা বলছেন তার থেকে দুশো মাইল দূরে থাকবেন।
এর কয়েক সপ্তাহ পর ন¤্রতা আমাদের নতুন বাসস্থানের ঠিকানা জানায় আমাকে। বলে যে সে মাননীয় চ্যান্সেলরের কাছ থেকে আমার এক বছরের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে এনেছে। এ কথায় আমি কিছুটা আহত হই। কেন? ্এবং কিভাবে তুমি তা করলে? খুব সহজ, সে বলল। আগামী এক বছরের মধ্যে একটা কাগজ কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিতে হবে। কিসের কাগজ সেট? আমি জানতে চাই। সে আমি ব্যবস্থা করব, সে বলল। আমার ‘কেন?’-র কোন জবাব দেবার অপেক্ষা না করে ন¤্রতা তার কলেজের জন্য তৈরি হতে গেল। বেরিয়ে যেতে যেতে সে বলল, আগামী কাল আমরা যাচ্ছি। তুমি তোমার অফিসিয়াল কাজকর্ম আজকের মধ্যে গুছিয়ে ফেল।
(৫)
নতুন বাসায় আমাদের চারমাস হয়ে গেলো। ন¤্রতা একদিন বলল, তোমার সেই কাগজের কথাটা মনে আছে? প্রথমত আমি মনে করতে পারিনি সে কোন কাগজের কথা বলছে। সে আমাকে মনে করিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার নেয়া এক বছরের ছুটিটার কথা। এর জন্য তোমাকে বিশেষ কিছু করতে হবেনা, সে বলল, শুধু একটা দিন ‘মনরোগ আরোগ্য নিকেতন’ - এ কিছু সময় কাটিয়ে আসবে! আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, ন¤্রতা আমায় সাহস দেয়। তার কথায় অস্বস্তি এবং অসম্মান আমায় ঘিরে ধরে একথা অমান্য করার কোন সুযোগ এখন অবশ্য আমার হতে নেই।
আমরা যেখানে বাসা নিয়েছি জায়গাটা কেমন যেন ঘিঞ্জি। অগোছাল সব বাড়িঘর দোকানপাট আর দু’একটা অফিস ও একটা খেলার মাঠ। বাড়িটার ভিতর একফালি ছোট্ট জায়গা। চারদিকে তার ছোট ছোট ইটের টুকরো ছড়ানো ছিটানো। এসবের মাঝে দাড়িয়ে বৃদ্ধ এক শিরীষ গাছ। দেহটা প্রকান্ড তার। সকাল সন্ধ্যা ও দিনভর সেখানে পাখিদের আনাগোনা ও বসবাস জায়গাটাকে প্রাণময় করে তুলেছে।
বাড়ির সামনের দোকানগুলোর জনৈক আজগর আলী এমন একটি প্রাণময় দিনে আমার সাথে হাজির হন মনরোগ আরোগ্য নিকেতনে।
আরোগ্য নিকেতনটা ছিমছাম পরিচ্ছন্ন। বেশি লোক কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। কোন মনরোগীকে আমার চোখেও পড়লনা। আজগর বলে, মনরোগী কী আর আপনি চোখে দেখতে পাবেন স্যর? নামটাইতো মনরোগ, মাইনে মনের মইদ্যে রোগ --- রোগী দেখলেও বুঝবার পারবেন না।
আমরা বসে থাকি।
আমাদের বসবার ঘন্টা দুই পর আরোগ্য নিকেতনের একজন এসে আমাদের চায়ের অর্ডার দেন। একটু বসতে হবে স্যার, তিনি বলেন, এমনিতে সব রেডি --- আপা যেভাবে বলেছিলেন। তা আমাদের এম ডি স্যার না আসা পর্যন্ত একটু যদি কষ্ট করেন। লোকটার কথায় আমার তেমন কোন অনুভূতি হয়না। এখন আমার অবারিত সময় নিজেকে মনরোগী প্রমাণ করার! হঠাৎই বলব, ন¤্রতার ওপর আমার প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা হয়! সে কি সত্যিই আমাকে বিকৃত মস্তিষ্ক মনে করছে? আমি আজগর-কে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা আজগর! তোমার কি মনে হয়? এই মনরোগ আরোগ্য নিকেতনে যারা আছে তারা পাগল না বাকী দুনিয়াটায় যারা আছে তারা পাগল? আমার কথায় আজগর কি বলবে বুঝতে পারেনা। বাইরে ঝড় ওঠে। জৈষ্ঠের ক্ষুব্ধ বায়ু তেড়ে আসে চারদিকে। সাথে বৃষ্টি ও শিলাপাত।
আমরা বসেছি টেলিভিশনের সামনে। সেখানে একটা লাইভ শো দেখানো হচ্ছে। এতক্ষণ আমি খেয়াল করিনি যে এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে। চারদিকে বৃষ্টি। কোথা থেকে মুভি ক্যামেরার ফোকাস গিয়ে পড়ল আমার এক প্রতিবেশীর মুখের ওপর। তিনি বলছেন, প্রথমত আমি বুঝতে পারিনি কি হচ্ছে। হঠাৎ দেখি আমাদের পাশের দোতালা বিল্ডিংটা ফুড়ে একটা বড় মহুয়া গাছ মাথা উচু করে দাড়িয়ে। ক্যামেরাম্যান আমরা যে বিল্ডিং এ থাকতাম তার পাশের দৃশ্য দেখাতে থাকল। আমি দেখলাম দোতালা সাদা বিল্ডিংটার চারদিকের ইট ভেঙে চুরে ফেটে পড়েছে। ছাদের একপাশটা ফেটে গেছে। সেখানে প্রকান্ড এক মহুয়ার কান্ড ও মস্তক উঁিক দিচ্ছে।
মনরোগীর কোন সনদ না নিয়ে যে গাড়িতে আমরা এসেছিলাম সেটাতে করে রওয়ানা হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। আজগর দু’একবার না না করলেও এই বাদলের সাথে সে খাপ খেয়ে গেল। আমাদের গাড়ি ছুটতে থাকল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।
আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সাংবাদিক দলটাকে আগের মতো তৎপর দেখতে পাচ্ছি। তিন ঘন্টা আগে তারা সে বাড়িটার সামনে দাড়িয়ে ছিল সেখান থেকে তাদের অনেক দুরে সরে আসতে হয়েছে। এখন তারা প্রায় সদর রাস্তার কাছে। এই তিন ঘন্টার ব্যবধানে এখানে বিরাজমান প্রতিটি বাড়ি থেকে অজ¯্র সংখ্যক বৃক্ষ মাথা উচু করে উঠেছে। আশেপাশে কোন বিল্ডিং আর দাড়িয়ে নেই। চরিদিকে কেবল ইট আর সিমেন্ট সুরকি। আমাদের গাড়ি পুলিশ আটকে দিল। আমি গাড়ি থেকে নেমে এক ছুট দিলাম আমাদের বিল্ডিংটার দিকে। পিছন পিছন কয়েকজন পুলিশ কিছুদূর ছুটে দাড়িয়ে গেলেন। সাংবাদিকেরা তখনও চিৎকার করছে, কি ভয়ঙ্কর! কি ভয়ঙ্কর! ফিরে আসুন! ফিরে আসুন!
আমাদের বিল্ডিংটা আসলে কোথাও নেই। অজ¯্র গাছ সেখানে যেন ছোট একটা বন তৈরি করে ফেলেছে। প্রায় দুশোর মতো বনসাই তেড়েফুড়ে বৃক্ষ হয়ে উঠেছে। আশপাশের সব বাড়ির সেই দশা। চ্যান্সেলর ভবনের দিকে যেতে দেখি সব পরিত্যক্ত। বনসাঁইদের এ বিপ্লবে আমি হতচকিত! চারদিকে বৃক্ষ আর বৃক্ষ। আম জাম বট অশ্বথ পাকুড় এবং আরও রকমারী সব গাছ। কে যে কত গোপনে কোন কোন গাছের জাত মারার চেষ্টা করেছিল আজ তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তবে আমার স্ত্রী যে এ দলের হোতা তা বুঝতে বাকি নেই কারো। আমি আরো এগিয়ে আমার প্রিয় বনানীতে যাই। সেখানে গিয়ে দু’চোখ আমার জলে একাকার। সেখানকার অনেক গাছ কাটা হয়ে গেছে। একটা সাইনবোর্ডও ঝুলছে ‘প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষা গবেষণাগার’ নামে। বৃক্ষ ও উদ্ভিদ প্রাণের এরূপ তেড়ে ফুড়ে ওঠার মর্ম এবার আমি সত্যিকার উপলব্ধি করি।
চারদিকে এখনও বৃষ্টি। বৃক্ষেরা সব মাথা উঁচু। তাদের আকাঙ্খা অমানবিক সব শখ সঙ্কল্প পরাজিত করে জীবনের ধর্মকে প্রকাশ করে চলেছে। সংবাদিকেরা আমায় দেখে চিৎকার করে ওঠেন, কী দেখলেন? কী দেখলেন? পুলিশেরা বললেন, জায়গাটা পরিত্যক্ত হয়ে গেল। এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গুটিয়ে নিতে হবে।
©somewhere in net ltd.