![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“ পন্ডিতেরা পড়ে পড়ে সব হলেন পাথর,
লিখে লিখে সব হলেন ইট,
প্রেমের একটা ছিটাও না পারে
তাদের মনে প্রবেশ করতে।”
[কবীর সাহেবকা সখী গ্রন্থ। বালক দাসজী সম্পাদিত। পৃঃ ১৯৯]
এই পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের সাথে আর সব মানুষের প্রাণের যোগ আছে। প্রাণের সাথে প্রাণের এই যে যোগাযোগ তা জ্ঞানের নয়, প্রেমের। আমাদের প্রত্যেকর জ্ঞানের সঞ্চয় ভিন্ন ধরণের, কিন্তু অনুভবের প্রধান স্তরগুলো অভিন্ন। এই অনুভব, যা অন্যের আনন্দে আনন্দ দেয় আমাদের --- অন্যের বেদনায় বেদনার্ত করে তোলে, এক বিষ্ময়কর শক্তি। অনুভবের এই শক্তিই মানুষকে বাধ্য করে চিকিৎসা শাস্ত্রের পত্তন ঘটাতে। যখন অতীতের একজন মানুষের সামনে আরেকজন মানুষ অপরিসীম অকথ্য বেদনায় দুমড়ে মুঁচড়ে যেতেন তখন সেই বেদনা তার শরীর ছড়িয়ে অন্যদের মনে বাসা বাঁধত। এক মানুষ তখন থেকে চেয়ে আসছে অন্য মানুষের বেদনা ঘুচাতে। আর তার একটা পূর্ণ ফসল আধুনিক চিকিৎসা কলা।
মানুষের অনুভব আর চিন্তা তাকে জ্ঞানী করেছে, কিন্তু সেই জ্ঞান অনুভবেকে আগের মতো খাঁটি থাকতে দেয়নি। একসময় তাই তার মনে হয়ঃ অন্যের কষ্ট তো অন্যের কষ্ট, আমার কি? জগত জুড়ে আমাদের জ্ঞান আমাদেরকে দাঁড় করিয়েছে এ-জাতীয় আরও বিস্ময়কর সব সত্যের সাথে। সেসব সত্যের একটা এরকম যে, ‘ প্রকৃতি জগতের এক প্রানীর সাথে অন্য প্রানীর যত ব্যবধান একজন মানুষের সাথে অন্যজন মানুষের ব্যবধান তার চেয়ে অনেক বেশি।’ পন্ডিতেরা কথাটাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে তাদের বুকের মিনারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু কোন অর্থে? সেটা কি এই অর্থে যে একজন মানুষের থেকে অন্য একজন মানুষ সব দিক থেকেই ভিন্ন? না কি এই অর্থে যে যেকোন দুজন মানুষের মাঝে চিন্তা আর আচরণগত কিছু ব্যবধান রয়েছে?
একজন মানুষের সাথে অন্য মানুষের যে ব্যবধান থাকে তা ওই মানুষ দুজনকে আলাদা করে চেনার পক্ষে সহায়ক। আর মস্ত এ জগতে মানুষের মধ্যে যে ঐক্য আছে তা পারে আমাদের এক সুরে বাঁধতে। কিন্তু আমরা আমাদেরকে প্রেম থেকে দূরে সরিয়ে কেবলই ধোঁকা দিচ্ছি। করে তুলছি নিজেদের নিষ্প্রাণ অপ্রেমিক, নিরেট জ্ঞানী!
কিন্তু প্রেম অবিচল অবিনশ্বর, তা সকল জীবনের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে বাঁধা। এই প্রেম যেকোন বোধ সম্পন্ন মানুষের প্রাণে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে অপরিসীম মহিমায়। এর জন্য জ্ঞানের বিশেষ কোন আবশ্যক নেই। আমাদের জীবনে তার নিত্য আসা যাওয়া। সে আসে জাগরণের সকল ক্ষণে হাজারো কাজের মাঝে নিদ্রার আয়োজনে। আসে সে আমাদের বুকে অনুভবের হাট থেকে।
প্রেমেই ঐক্য। প্রেমের এই ঐক্যই পারে মানুষের সাথে মানুষকে মেলাতে। চেনা জানা মানুষের সাথে, অজানা অপরিচিতের সাথে আমাদের মিলন ঘটে কেবল প্রেমে ও অনুভবে। আমরা অনেক সময় ভাবি, ও এক জাত, আমি আরেক জাত; মিলন হবে কেমনে? আবার ধর্ম যখন আমাদের এক নয় তখন মিলন ছেঁদো কথা! এক মানুষের সাথে আরেক মানুষের এসব ব্যবধান মানুষ নিজে সৃষ্টি করেছে। অজ¯্র অসঙ্গত বিভাজন সে তৈরি করে নিয়েছে ধর্মীয় জাতিগত লিঙ্গগত, এমন কি গায়ের চামড়ার রঙের হেরফেরকে পর্যন্ত অবলম্বন করে। অবশ্য অর্থনৈতিক বিভাজনটাই এখন সবার ওপরে দাড়িয়ে দানব নৃত্য করে চলেছে।
এতসব বিভাজন ও ব্যবধান কি মানুষের অনুভবহীনতার কারণে ছড়িয়ে পড়ে মানব সমাজে? সেগুলো নিশ্চিত অনুভবহীনতার ফল নয়। সে সব আমাদের একগুয়েমির ফল যাকে সচল রাখতে অজ্ঞতা পুরোহিতের ভূমিকা নেয়। আসলে আমাদের অনুভবের ¯্রােতে কুসংস্কারের একটা উঁটকো বাঁধ নির্মিত হয়ে গেছে। আমরা জীবন-নদীর অনুভবের ¯্রােতকে মানব-বিশ্বের মহাসাগরে পৌঁছে দিতে পারছিনা। এই না পারার কারণ যেমন আমাদের অজ্ঞতা তেমনি আমাদের অচিন্তা কুচিন্তা।
দীর্ঘদিন ধরে পলি জমে জমে প্রবল নদীও যেমন ক্ষীণ¯্রােতা হয়ে যায় তেমনি কুসংস্কারের পলির চাপে আমাদের জ্ঞানবোধ এবং অনুভূতি ক্ষীণধারা হয়ে গেছে। আমাদেরকে এখন ক্রমাগত এইসব চরাভুমি কেটে কেটে চিন্তার নদীকে নাব্য রাখতে হবে। তাতে একজন মানুষ প্রথমত, ‘মানুষ’ শব্দের মাঝেই তার পরিচয় খুঁজে পাবেন। তার জাতিগত বা অন্য ধরণের বোধ তখন গৌণ হয়ে পড়বে।
জাতিগত উন্মাদনা বা জাতীয়তাবাদের ধারনা গত শতকে মানব জাতির অশেষ ক্ষতি করেছে। বিশ্বযুদ্ধ দুটি শুরু হয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে । হিটলার মনে করতেন যে জার্মান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি, এবং ঈশ্বর তাকে সমস্ত পৃথিবীর নেতা নির্বাচিত করেছেন। কাজেই এই বিশ্বজগত শাসন করার অধিকার তার আছে।
বিশ শতকে এসে ধর্মীয় কুসংস্কারের ধোয়া আর তেমন আচ্ছন্ন করতে পারেনি। সেই স্থান দখল করেছে জাতীয়তাবাদের কুসংস্কার। জাতীয়তাবাদের কুয়াশা আন্তর্জাতির্কতার মহাসূর্যকে মানব চক্ষুর আড়াল করেছে। জার্মানরা শ্রেষ্ঠ না ফরাসীরা? ব্রিটিশরা অভিজাত না মার্কিনীরা? পেশী শক্তি বেশি ভারতের নাকি পাকিস্তানের? এই সব আজগুবি আর উদ্ভট উপাখ্যানে মানুষের মগজ দুষিত হয়ে গেছে। জগত বলতে তারা ¯্রফে নিজেদেরকে বুঝিয়ে থাকেন। তারা ছাড়া বাকিরা জগতের, তথা মানবতার, শত্রুতে পরিণত হন। অথচ আমরা জানি যে দৈত্যকূলেও প্রহ্রাদের জন্ম হয়। অর্থাৎ, সবখানেই সত্যপরায়ণ ভালোমানুষেরা থাকেন।
এসব কথা যখন আমরা ভাবছি বা বলছি তখন পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভূত শক্তি অর্জন করেছে যদিও মানুষ মানুষের যথার্থ বন্ধু হতে পারেনি আজও! এর কারণ মানুষের প্রেমহীনতা। প্রেম ছাড়া জ্ঞান অন্ধ আর জ্ঞান ছাড়া প্রেম বিকলাক্সগ। যদি তেমন প্রেমের অনুভবে দুলে উঠতে পারতাম আমরা তাহলে এ্যটম বোমার কথা ভাবতেও হতোনা। তাহলে কি মানুষ একেবারে প্রেমহীন? ঘরে ঘরে মায়েরা কি তাদের সন্তানদের ফেলে পালাচ্ছেন? সমস্ত জগতের পথে পথে কি সবাই ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন একে অন্যকে হত্যা করতে?
প্রেম আছে। তবে সেই প্রেমের অনুভবের সাথে জ্ঞানের অনুভবের সম্মিলন হয়নি। কেবল অনুভবহীনতাই পারে হাজারো কুঁড়ে ঘরের বস্তিতে একটি রাজ প্রাসাদকে টিকিয়ে রাখতে। রাজপ্রাসাদের মানুষেরা যদি যথাযথ অনুভূতি প্রবণ হন তবে কুড়ে ঘরের দৈন্য দুঃখ তাদেরও বুকে বাজে। কিন্তু হাজার হাজার রাজপ্রাসাদ লক্ষকোটি কুঁড়ে ঘরকে কুঁড়ে ঘরের প্রাণ যুগিয়ে চলেছে। কতক্ষণ তা চলবে? যতক্ষণ ‘আমি বড় বটে---- অন্যেরা ছোট’ এই বোধ আমাদের জীবনের অবলম্বন হয়ে থাকবে। মানব মনের আত্মপুজোর এই অমানবিক শক্তির মোহ প্রতিনিয়তই মানবিকতার কন্ঠে ফাঁস লগিয়ে চলেছে।
অসংখ্য মানুষ অজ¯্র বার বলেছেন যে এক মানুষের সাথে অন্য মানুষের কোন ভেদ নেই। আজও ব্স্তবতায় কথাটার চর্চা হয়নি। আমাদের জীবনে কোন কথার যথাযথ চর্চা বা প্রয়োগ তখনই ঘটে যখন আমরা কথাটাকে অনুভবে পাই। অনুভবের সত্য এইভাবে আমাদের জীবনের প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, ‘আমি বড় বটে---অন্যেরা ছোট’ এই অনুভব ততক্ষণ থাকে যতক্ষণ আমরা অন্যের অনুভবকে নিজের করে না-পাই।
অন্যের অনুভবকে নিজের করতে পারাটা মানবিক হবার মূল কথা। যদি মানবিকতার অবিকাশ একইভাবে চিরবিকশিত থাকে তবে মানুষ্যত্বের চর্চা শুরু হবেনা আমাদের ভিতর। আর যতদিন তা না হবে ততোদিন এ-বিশ্বলোকের সবার প্রাণের সাথে সবার প্রাণের যে যোগাযোগ তা পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হবেনা। আমরা আমাদের প্রাণের সাথে আর সব প্রাণের যোগ ঘটাতে চাই। আমরা চাই অনুভবের বন্ধন, বন্ধনের মুক্তি - বিচ্ছিন্নতার শিকলে জীবনের বন্দ্বীত্ব নয়।
২| ১০ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ২:৩২
আহসানের ব্লগ বলেছেন: +
৩| ১০ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ৮:১৪
আবু সিদ বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৯ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৩
আহসানের ব্লগ বলেছেন: ভালো লাগলো ভাইয়া।