![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
[চিরকাল ধরে ফুটে যাচ্ছিলে তুমি, আমি না এলেও ফুটতে।]
জন্ম থেকে এক চোখ নেই তার, চেহারাটা কুৎসিত, এক পা বিকল। ভাইবোন আত্মীয়স্বজন কেউ নেই তার। অবশ্য আত্মীয়স্বজনের বিষয়ে কথাটা অমন করে বলা যাবে না। আত্মীয়স্বজনেরা আছে কিন্তু তারা তাকে দেখা দেয় না এবং সেও দেখা করে না। ধনী বলতে যা বোঝায় তা সে নয়। শহরের এক কোনায় তার পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত পুরাতন বাড়িটাতে সে থাকে। বাড়ির মধ্যে কতগুলো ফুলের গাছ আর ফলবান বৃক্ষ। রোজ সকালে সে ওই বাগানটার চর্চা করে, পরিচর্যা করে ঘরের উঠোনের আর নিজের দাড়ির। দাড়িটা সে রাখতই নাÑ কিন্তু রাখলে মুখের কুৎসিতভাবটা কিছুটা কমে যায়; চেহারার বিপর্যস্তভাবটা প্রথমটায় ঠিকমতো বুুঝে উঠতে খানিকটা সময় লাগে।
একজন চাকর আছে তার; বুড়ো, বিপর্যস্ত। সে-ই কাজ করেÑ এবং কাজ সে ভালোই করে। রান্নাবান্না আর পোশাক-পরিচ্ছদ সে পরিষ্কার করে। অসুস্থ হলে মনিবের সেবা করে। কদাচিৎ কখনও কোনো অতিথি এসে পড়লে তার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে। আর তার মনিব যখন মাছ ধরতে পঁচা লেকের ধারটাতে বসে, সে-ও বসে যায় তার সঙ্গে এবং কোনো কথা ছাড়াই কয়েক ঘণ্টা কাটায়।
মাঝে মাঝে ওরা দুজনে বেড়াতে যায়। কাছে বা দূরে যেখানে যায় ওরা দুজনেই যায় Ñ অনেকটা বন্ধুর মতো, অনেকটা প্রচণ্ড শত্র“কে নজরে রাখার মতো। এছাড়া ওদের বাড়ি থেকে একটু দূরে ওরা ছবি তোলার যে স্টুডিওটা চালায় সেখানেও ওরা প্রতি রাতে যায়। আসলে স্টুডিওটা চালায় অন্য এক লোক; সে-ই সব করে কিন্তু মালিক তার চাকরটি (বা বন্ধু)-কে নিয়ে দেখা দেয় প্রতিদিন এবং প্রতিদিনই। এই যে বৈশাখের জ্বলন্ত উত্তাপ গেল, কালবৈশাখীর জ্যৈষ্ঠ পেরোল তবু তারা ঠিক যেত। এমনকি দোকান চালানো লোকটা যেদিন সকালে দোকানের চাবি নিতে আসে না সেদিন সন্ধ্যায়ও তারা যায় Ñ এটা অনেকটা নিয়মমাফিক, ঠিক আহার বা নিদ্রার মতো।
১
চল্লিশ পেরোনো বয়স তার। চেহারাটা যত না বদ্খদ তার চেয়েও বেশি বিষণœ। তার চাকরটা তাকে অবশ্য প্রায়ই সুন্দর বলে উল্লেখ করে এবং এও বলে যে, তার মতো মানুষ হয় না। কিন্তু সেসব যে ফাঁকা বুলি তা তারা দুজনেই জানে। অবশ্য এসবের পরও নারীসঙ্গের জন্য মনটা তার কেমন করে কিন্তু তা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে তার ভয় হয়। তার যৌবনে সে প্রতিবেশী এক মেয়েকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিল; মেয়েটা প্রায়শ তাদের বাড়িতে ফুল নিতে আসত এবং তাকে দেখে হাসত। কিন্তু ‘তোমাকে করুণা করা যায়, ভালোবাসা যায় না’ বলেছিলো মেয়েটি। এরপর কাউকে সে আর এমন কথা বলেনি। অবশ্য মা-বাবা বেঁচে থাকতে তার বিয়ের চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু কিছুতেই এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া গেল না যে এরকম কুরূপী স্বামী পছন্দ করে!
শেষে মা মরে গেলেন আর সেই সঙ্গে যেন আত্মীয়স্বজনরাও মরে গেল অথবা তাকে ভুলে গেল। সে কারণে তার মনে তেমন কোনো দুঃখ নেই Ñ অবজ্ঞা-উপেক্ষা এসব সে জন্ম থেকেই মেনে নিয়েছে।
এত নিঃসঙ্গতা ও দুঃখের পরও অন্য সব শরীরের মতো তার শরীরেও নারীর চাহিদা প্রবল। অবশ্য বিয়ের আশা সে ছেড়েই দিলো। মানুষেরা যেখানে মসজিদে তার পাশে বসতে চাই না, বরং সে গিয়ে বসলে উঠে যায়, সেখানে একজন কুরূপা মেয়েও যে তার পাশে বসবে এমন আশা সে করে না। তার মনে পড়ে লোকেরা তাকে দেখে বলে, কী বিশ্রী! যেমন দেখতে, তেমনি শরীরের গন্ধ!
বিয়ের আশা শেষ হলে সে ভেবেছিল, যেসব দরিদ্র মেয়ে পতিতা হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় তাদের সঙ্গ হয়তো সে পেতে পারে। তার বৃদ্ধ চাকর (প্রথমে সে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ ছিল না) তখন বেশ সহজে এক-একজন তরুণীকে পাকড়াও করে আনত এক এক রাতে। কিন্তু রাতের আঁধার যত গভীরই হোক, তরুণীরা তাকে দেখে ঠিক ভয় পেয়ে যেত।
এভাবে বেশ কিছুদিন কাটল তার, তারপর সে সেসব আশাও ত্যাগ করল। এখন তার নিয়মমাফিক জীবন, যেন একটা বোঝাÑ সেটাকে বহন করে মরণ গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারলেই তার মুক্তি!
২
তবু মানুষের শরীর, মানবমন খুব বিস্ময়কর। সেই বিস্ময় তার মধ্যে জাগল আবার আজ অনেক দিন পর। সে তার চাকরকে ডাকল। বলল, আমার একটা মেয়ে চাই। চাকরটা বলল, আমি তো চেষ্টার কম করি না। ‘দেখো’ সে বলল, ‘তুমি আগে থেকেই সব বলোÑ আমার চেহারার অবস্থা এইসবÑ তবে টাকার কথা ভাবতে হবে নাÑ আর পারলে এও বলো যে এ বাড়িটাও আমি তাকে দিয়ে দেব।’ তার কথায় বৃদ্ধ কোনো উত্তর দিলো না, শুধু মাথা নেড়ে চলে গেল।
জৈবিক চাহিদা তার চিন্তায় খুব প্রখর হয়ে কাজ করল। তাকে ভাবাল, তাকে ভুলিয়ে দিলো তার আত্মহত্যা করতে চাওয়ার সেই দিনগুলো। সে দ্রুত দ্রুত দোকান থেকে ফিরল, ঘড়ি দেখল Ñ রাত দশটা। তার মনে হলো, হয়তো কাউকেই পাওয়া যাবে না। তবু সে মনে আশা রাখল, তার প্রিয় গদিআঁটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল আর পুরনো সেটটাতে গান চালিয়ে দিলো :
আমায় তুমি ঠেল না দূরে
তুচ্ছ করে,
অবহেলার প্রান্ত হতে উঠিয়ে আন
নিজের কর
নিজের করÑ
নিজের করে
৩
বৃদ্ধ মানুষটা যখন ফিরে এল তখন চারদিকে আজান, কাক আর মানুষের শব্দ। সে এসে দেখল উন্মুক্ত গেট, খোলা দরজাÑ
মনিবটা তার বাইরের বারান্দায় শুয়ে আছে।
ভিতরে ঢুকে আনন্দের সঙ্গে চিৎকর করল সে, একজনকে পাওয়া গেছে! তার উল্লাসে মনিবের ঘুম ভেঙে গেল। সে বোজা-চোখ ধীরে ধীরে খুলল, যেন অন্ধ চোখ অপারেশনের পর প্রথম কিছু দেখবে। সে দেখল বারান্দার নিচে একটা মেয়ে দাঁড়ানো। কুৎসিত নয়, অপরূপা নয়Ñ তবে যুবতী, তবে বেশ।
সকালের নাশতার পর তার মন একটা ফুর্তির আবেশে ভরে গেল, তবে রাতের সেই জৈব-যন্ত্রণাটা আর রইল না। সে চাকরটাকে বাজারে যাবার কথা বলল। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল কী তার পছন্দ, তার জন্য কিছু আনতে হবে কি-না। মেয়েটা বলল, কিছু না। বৃদ্ধ চাকর বাজারে চলে গেল।
এরপর সে মেয়েটাকে বলল, তুমি জানো নিশ্চয়ই তোমাকে কেন আনা হয়েছে। মেয়েটা একটু ঘুরিয়ে জবাব দিলো, আমি জানি আমি কী করি। সে জানতে চাইল যে তার ভয় করছে কি-না। ‘আপনি সুন্দর’ হেসে জবাব দিলো সে, ‘ভয়ের কী আছে!’ এতে করে তারও হাসি পেল, তবে সেটা সে প্রকাশ করল না। মেয়েটা বলল, নিশ্চয় আপনি এখন কিছু করতে চান নাÑ নাকি চান? আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। সে আর একটুও অপেক্ষা করল না, সোজা ভিতরে ঢুকে গেল এবং বিছানায় শুয়ে পড়ল। অল্প কিছুক্ষণ বাদেই বাইরে থেকে তার নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল।
৪
অনেক দিনের পর তার বাসনা পূর্ণ হলো। বেশ ভালো লাগলো, বাঁচবার আরও একটা কারণ আবিষ্কার করতে পেরে আনন্দ হলো তার। সে রাতভর ঘুমাল এবং দিনের কিছু অংশ ঘুমিয়েই কাটাল।
বিকেল হলো। শুয়ে শুয়ে সে দিনের পত্রিকা দেখল, দুপুরের খাবার খেল এবং নিজের অজান্তেই রাতের প্রতীক্ষা করতে শুরু করল।
৫
এখন সন্ধ্যার অন্ধকার শেষ হয়েছে। বাদল ঘেরা রাত।
দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। সেও দোকান থেকে ঘরে ফিরেছে। ঘরে ফিরে কিছু খেতে মন চাইছে না তার। সে বারান্দার অন্ধকারে সেই চেয়ারটায় বসে। আকাশে তারা নেই একটাও, কেবল মেঘের আনাগোনা। সে এই মেঘের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে। চাকরটা কাছে এসে পাশে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, চা দেব? ‘না’ বলল সে। তারপর মাথাটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকল।
ঝমঝম বৃষ্টি ঝরে গেল মিনিট দশের ধরে। হঠাৎ কিছুক্ষণ থামল সেটা, তারপর আবারও পুরো উদ্যমে ঝরতে শুরু করল। দেখা গেল আকাশভরা বৃষ্টি, ঘাস ও বৃক্ষভরা বৃষ্টি, হাওয়ায় দুলে দুলে ওঠা বৃষ্টি। সেই সব বৃষ্টির দোলে সেও দুলে উঠল, চোখ মেলল। দেখল খোলা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কে একজন। নিজের মনেই বলল সে, কে? তারপর নিজেই অনুধাবন করল বৃষ্টিতে, ভেজা সে। মাথায় তার কোঁকড়ানো চুল, পোশাক এলোমেলো। কুৎসিত নয়, অপরূপা নয়Ñ তবে যুবতী, তবে বেশ।
২| ২২ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:৩৭
আবু সিদ বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১০:২৬
অতঃপর জাহিদ বলেছেন: অসাধারণ লেখা!