![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মেসের ঘর থেকে যখন সে বেরিয়ে এলÑ অথবা, বলা ভালো, যখন তাকে বের করে দেয়া হলো Ñ তখন সে কপর্দকশূন্য একটা ঘৃণ্য বেহায়া, সকল অবজ্ঞার যোগ্য। পর পর চতুর্থ দিনের মতো সে চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। আজ সে সকালের নাশতা চুরি করছিল। যার সঙ্গে সে একঘরে থাকত, সেই লোকটা একটু কোথায় যেন গিয়েছিল; আর তখনই সে লোভীর মতো গোগ্রাসে এবং বেকুবের মতো অসময়ে একটা আস্ত কলা গেলার চেষ্টা করে। পাউরুটির টুকরোটা সে দু হাতে ছিঁড়ে সেই একই মুখে ঢোকানোর অপচেষ্টা চালাতে লোকটা এসে হাজির। সে ভেবেছিল, কোনো মানুষ না দেখলেই হলো। এখানে একসঙ্গে ছয়টা ঘর। কোন ঘরে কে কী গিলল তা কে দেখল! তবে সন্দেহ নেই যে লোকটা তাকেই সন্দেত করত। ‘তা বয়েই গেল’, কলা গিলতে গিলতে সে ভাবছে। আর তখনই অকস্মাৎ ছন্দপতন। এ বাড়ির কোনো বাসিন্দাই তাকে পছন্দ করে না। তারা কেউ জানে না ছারপোকার মতো এই উজবুক লোকটা এখানে জুটল কোত্থেকে। একটা দিনও তারা তাকে ভালো চোখে দেখেনি, মানুষ বলে ভাবেনি। হয়তো ঘিঞ্জি বস্তিতে গেলে কেউ কেউ তাকে মানুষ ভাবত - এমনই তার চেহারা চালচলন আর বেশভূষা।
এ গৃহ ছেড়ে আজও সে যেত না। কত অপমানিতই তো সে হয়েছে, তাই বলে কোনো অপমানকে কখনও কি সে অপমান বলে ভেবেছে? নিতান্তই তার বিছানা-বালিশ যাকে বিছানা-বালিশের শব বললে ঠিক বলা হবে, তারা ছুড়ে ফেলেছে নর্দমায় । তা না হলে অপমানকে অপমান ভাবাটা তার স্বভাবে ছিল না। বাড়িটা ছেড়ে যেতে যেতে তার দু চোখ ভেঙে জল এল; এ বাড়িতে সে বিগত ছাব্বিশ বছর কাটিয়েছে। কিন্তু এ বাড়িতে থাকার ইচ্ছে আজ তার একেবারে শেষ হয়ে গেল। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নিজের দু গালে সে নিজেই জোরসে দুটো চড় কষে বলতে লাগল, কেনরে হারামি! কলা গেলার আর সময় ছিল না?
শুয়োর আর সজারুর মতো চরতে চরতে একসময় সে একটা অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে এসে পড়ল। কোনো এক ধনপতি বছর ত্রিশ আগে মরেছিল, তার স্মরণে তার শ্রদ্ধায় প্রতি বছর এই দিনটিতে তার নাতি-নাতনিরা কাঙালি ভোজের আয়োজন করে। অবশ্য কাঙালদের জন্য বরাদ্দ বিশেষ কিছু থাকে না, তবু যা থাকে অনাহারি আর কোনো ছিঁচকে চোরের জন্য সেটা যথেষ্ট ভালো। সময়ের সুবিধাটা পেয়ে সে গোগ্রাসে গিলল দিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে, যেন ক্ষুধার একটা দানব তাকে তাড়া করেছে নাছোড়বান্দার মতো।
খেয়েদেয়ে তার হাই উঠছে, ঘুম ঘুম লাগছে। কিন্তু চোয়ালে ও ভুঁড়িতে চর্বিজমা সাহেবরা বললেন, মৃতের মঙ্গল কামনায় দোয়া করতে এখন আমরা গোরস্তানে যাব। ভাইয়েরা, আপনারা আসেন।
বিকেলের বেলা কমে এসেছে। পিচের রাস্তার উত্তাপও এসেছে নষ্ট হয়ে। সুবিধা পেয়ে সে কবরখানার বাইরের ফুটপাতে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদে সে সেখান থেকে একটু দূরে জীবন্ত একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। তবে বেশিক্ষণ সে ঘুমাতে পারল না। রাস্তায় পাহারারত পুলিশ তার পাছায় বেত কষে তাকে জাগিয়ে তুলল। পাপের ভয় দেখিয়ে সে বেটা তাকে শাসাল, তোর সাহস কত? ঘাড়ের ওপর তোর কয়ডা মাথা যে কবরে হেলান দিয়ে ঘুমোস!
বেতের প্রকোপে মাথা তুলে উঠে পড়ল সে। কামনায় তপ্ত পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে দেখল যে সেই প্রার্থনাকারী দলটা সমাধিক্ষেত্রের ভিতরে গিয়ে তাদের প্রার্থনা জানাচ্ছে। তার আলস্য লাগছে। শেষবেলার হলুদ আলোকে সে অবজ্ঞার হাসি হেসে উপেক্ষা করল। সমাধিশালার কোনার প্রান্ত জুড়ে জেগে ওঠা ফোঁড়ার মতো চায়ের দোকানের ছায়ায় গিয়ে বসে পড়ল সে। এখন তার কোনো অনুশোচনা নেই, তিলার্ধমাত্র আফসোস নেই। একে একে প্রার্থনাকারী দলটা সন্ধ্যার অন্ধকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মোমের আলোয় আলোকিত করে তুলল বহু বছরের ঝকমকে মার্বেলখচিত সমাধিটাকে।
অন্ধকার কোনো প্রভুর মতো তার আধিপত্য মেলে দিলো শহরের ওপর। নিমকহারাম এই দুনিয়াটার চল্লিশোর্ধ ‘জারজের বাচ্চা জারজ’ সন্তানটি ভুঁড়িওয়ালা তবু মেদহীন গাছপালায় বেষ্টিত কবরখানাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল। একটা ভাঙা কবর, তার ইটের পাঁজর শ্যাওলা ধরা। সেখানে একটা বেটে বট বসত গেড়েছে। তার পাশে বসে ‘বেওয়ারিশ বেজন্মাটা’, মেসের লোকেরা তাকে এই নামে চিনত, লাগামহীন ভাবনায় মজে গেল। তার মনে পড়ল বড়সড় একটা চাচের ঘর, যেখানে বুড়ো-বুড়ি আর তাদের চার ছেলে-বউ, আর তাদের বাচ্চারা ঘুমায়। সেটা যেন নরক। সেই নরকের উত্তাপ সময়ের এই সুদীর্ঘ প্রহরা পেরিয়ে দগ্ধ করে তাকে। রাতের পরতে পরতে তার নাকে সঙ্গমের গন্ধ এসে লাগে। কে কার বাপ? অর্ধজাগরণে আর পূর্ণ চেতনায় সে ঘরের প্রত্যেক পুরুষকে দেখেছে সকল নারীতে রত! অবশ্য এ নিয়ে তার কোনো ক্ষোভ নেই। তবে তার মায়ের ওপর কখনও একাধিক জন ক্রমান্বয়ে এলে তার ঘুম যেত ছুটে।
সেই গৃহপতিতালয় থেকে সে পালাল ন’ বছর বয়সে। কখনও গেল না সেখানে ফিরে। কখনও না। তবু বারে বার ফিরে ফিরে সেই অশান্ত নরক তাকে ঘিরে ফেলে। বেওয়ারিশ কুকুরের মতো পথকে তার গৃহ বলে মনে হলো, জীবনকে মানে হলো বেজন্মার মতো করুণ, গৃহপতিতার মতো শস্তা। পথে পথে ঘুরে মানুষের ফাইফরমাশ খেটে সে জুটে গিয়েছিল তখনকার দিনের ‘নবধারা ছাত্রাবাস’-এর মালিকের সঙ্গে। মালিকের জুতো সাফ করে আর গাঁজার কল্কি সাজিয়ে সে পেয়ে গিয়েছিল একটা ঘরের অলিখিত স্বত্ব। চিরতরুণ মৃত্যুর দূত একনিষ্ঠ আজরাইল সহসা একদিন সেই মালিককে তার হিমালয়সদৃশ পা দিয়ে এমন এক লাথি মারে যে, লোকটা মদ্যপ অবস্থায় ছাত্রাবাসের ছাদ থেকে টালখাওয়া ঘুড়ির মতো মাটিতে এসে পড়ে। পরে ‘নবধারা ছাত্রাবাস’ নাগর পাল্টে হয়ে যায় ‘নবধারা বসবাস’।
‘আমি হলাম বেজন্মার বাচ্চা বেজন্মা জারজের বাচ্চা জারজ’, নিজের মনে সে ভেবে চলল। তারপর ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে মৃতদের সঙ্গে একই মাঠে ও মাটিতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম থেকে জেগে নাছোড়বান্দা ক্ষুধার দানবটাকে সে অনুভব করল। আজকের সকাল তার কাছে শূন্য বলে মনে হচ্ছে। কোথায় যাব? চুরি করার মতো যথেষ্ট জায়গা কোথায়? চোখ তার সমস্ত কবরখানা খুঁজে এক কোনায় একটা ছোট্ট কুঁড়ে খুঁজে পেল। এবার গন্তব্য তার কবরখানার দারোয়ানের ঘরে।
কবরখানার দারোয়ান এক মাতাল। রাতটা সে পার করে নেশা করে আর দিনের বেলা থাকে ঘুমিয়ে। সে যখন এমনি ঘুমে বিভোর তখন ক্ষুধার দানবের অনুগত দাস হয়ে লোকটা ঘরে ঢুকল। ঘরটার চারদিক নানান মাপের গাছের গুঁড়িতে ঠাসা। এর মধ্যে একটা চৌকিতে সে ঘুমাচ্ছে। ক্ষুধার দানবের দাস হয়ে উঠলো চুরির প্রভু। সে শূন্য ঘরটায় একটা বেঢপ ভুঁড়ি ওঠানামা দেখে ক্ষেপে গেল। অবাক হয়ে ভাবল, লোকটা খায় না? পানি রাখার একটা পাত্র পর্যন্ত নেই! শুধু শূন্য একটা মদের বোতল ঘুমন্ত শরীরের পাশে শুয়ে; সেটাও যেন চিৎ হয়ে ঘুমুচ্ছে সমানে।
পূর্ব আকাশের সূর্য শিশিরের কণাগুলোকে সব গিলে শেষ করেনি এখনও। এখনও বনের পাখিরা সব আকাশের সীমানায় ছড়িয়ে পড়েনি। ক্ষুধায় বিভ্রান্ত সে। সমাধিশালার সামনে বেড়ে ওঠা ছাপড়া হোটেলটায় গিয়ে কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে, কারও কোনো অনুমতি না নিয়ে দু হাতে ছিঁড়েফুঁড়ে সদ্য ছেঁকে তোলা গোটাকয় রুটি সে গিলে ফেলল অবলীলায়। হোটেলের মালিক, বসে আছে ক্যাশবাক্সের সাথে, তার কাছে দৃশ্যটা খুব নাটকীয় মনে হলো। সে দেখতে থাকল, একজন মাঝারি উচ্চতার শীর্ণ মানুষ মুখময় দাড়িগোঁফসমেত একটা বিকল পা নিয়ে দিনেদুপুরে গোগ্রাসে গিলছে তো গিলছেই! লোকটা এতটাই হাভাতে যে দোকানের সামনের ল্যাংড়া কুত্তাটা এবং রুটি সেঁকার নির্দয় ছোকরাটা পর্যন্ত বেমালুম দৃশ্যটা দেখছে।
পেটের নাড়ির যন্ত্রণা উবে গেল। সে দু গ্লাস পানি নিমেষে সাবাড় করল। তারপর সে সবিস্ময়ে লক্ষ করল যে, এত সব মানুষের সামনে সে একটা দৃশ্য বনে গেছে । কিন্তু সেটা ক্ষণিকের। দোকানমালিক তার সম্বিৎ ফিরে পেল, কুত্তাটা ‘ঘেউ’ করে উঠল এবং রুটিসেঁকা ছোকরাটা নিমেষেই তার চ্যাপ্টা হাত দিয়ে মুখদাড়িগোঁফে জোরসে চটাচট করে দুটো চড় কষে দিলো। সকালের সব ভোজনকারীদের জন্য বিনা পয়সায় নাটকটা দারুণ উপাদেয় হয়ে উঠল।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে বাঁধা পড়ে রইল ছাপড়া হোটেলের বাঁশের খুঁটিটার সঙ্গে। সেখানে সন্ধ্যা-আসরের সর্দার গিয়ে হাজির। রুটিসেঁকা ছোকরাটা তার ওস্তাদ সর্দারকে সেলাম জানিয়ে বলল, এই যে সেই নিমকহারামের বাচ্চাটা! তোমার ঘরে ঢুকেছিল শয়তানের ছানাটা। কবরখানার দারোয়ান তার ভুড়ি উঁচিয়ে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে সে বলল, ওরে তোকে দেখতে ঠিক ভীরু আর বুড়ো বিড়ালের মতো। নে নে মদ খা। সে ক্ষুধার্ত বন্দির ঠোঁটে মদের বোতল উপুড় করে দিলো। কিন্তু সবটুকু মদ, মদের শেষ কণাটা পর্যন্ত বেরিয়ে এল ক্ষুধার ক্রীতদাসটার গলা থেকে। তাই দেখে দ্বাররক্ষী তার রক্তাক্ত চোখ ছানাবড়া করে বলল, এত বড় দুঃসাহস! তুই চুরি করতে ঢুকিস কবরখানার মালিকের ঘরে? জানিস না তুই, আমি দরজা খুলে ঘুমাই? তার বামহাতের মুঠোয় সে ক্ষুধার্তটাকে গলা ধরে শূন্যে তুলে ধপ করে মাটিতে ফেলে দিলো।
সে যেন একটা দুঃখী কুকুর; সবাই তাকে উচ্ছিষ্ট আর উপহাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। ছাপড়া হোটেলটার মালিক বলেকয়ে দ্বাররক্ষীকে রাজি করাল। বলল, যত খারাপই হোক অভাবের তাড়নায় প্রয়োজনে পড়ে মানুষ কত কিছুই তো করে! তুমি তোমার একজন ভিক্ষুক হিসেবে ওকে নাও। ও-ও বাকিদের মতো প্রতিদিন পথে পথে ভিক্ষা করবে। যা আয় হবে তার অর্ধেকটা তোমায় দেবে। ‘কিরে? তুই কি বলিস?’ কুত্তা বনে যাওয়া মানুষের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সে বলল। দারোয়ান শর্ত জুড়ে দিলো, যদি একদিনও বসে থাকিস তোর পাছার ছালচামড়া যাও আছে তা আর থাকবে না। তা দিয়ে আমি ডুগডুগি বাজাব আর জাদু দেখাব। নামগোত্রপরিচয়-হারা বেয়াদপটা একটা পরিচয় পেল, খোঁড়া ফকির! বাস্তুহারা কুত্তাটা একটা খোঁয়াড় পেল, কবরখানা।
প্রথম দিনের ভিক্ষা শেষে ঢুলতে ঢুলতে এসে সে ঘুমিয়ে পড়েছে দারোয়ানের ঘরের মধ্যে। মাঝরাতে যখন সে ঘুমে অচেতন, সে সময় দারোয়ান মদের ঘোরে ঘুরতে ঘুরতে এসে তার কোমরে একটা লাথি কষে দিলো। ‘ওঠ কুত্তাÑ ওঠ!’ সে চিৎকার জুড়ে দিলো, ‘শুয়োর! নকশা মারার আর জায়গা পাও না? যাÑ দূর হÑ ওই কবরের মধ্যে গিয়ে শোÑ ’ ঘুমের ঘোরে সে দানব দেখার মতো আকস্মিকতায় চমকে উঠল। পিট পিট করে তাকিয়ে উঠে পড়ল, তার ভিক্ষার টাকার অর্ধেক বিছানায় রাখল। বলল, ‘বেচে থাকতে কবরে কী করে শোবো!’ মাতালের নেশা এখনও প্রগাঢ়। বেওয়ারিশ ফকিরটা তাই তাকে আর ঘাটাল না। সে প্রাচীন কবরটার বুক ফুঁড়ে জেগে ওঠা বটের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সে ঘুমিয়ে পড়লেও ‘ বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ামকগুলোর প্রত্যেকটিই জাগ্রত এবং ক্রিয়ারত। শেষরাতে তুমুল বাতাস আর বৃষ্টি শুরু হলো। তাতে ভয় পেয়ে পড়িমড়ি করে সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দারোয়ানের ঘরে ঢুকে পড়ল। দারোয়ান সবে শুয়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে সে দাড়াল। বরদাশত করতে পারল না কোনো খোঁড়া ফকিরকে। পাছায় লাথি কষে সে তাকে তাড়াল।
প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গাছের তলে তার সময় কাটাতে থাকল নিঃসঙ্গ ও নির্মম ধরণীতে, সব লোকচক্ষুর আড়ালে।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সে শয্যাশায়ী হয়ে গেল। বটের আশ্রয় ছেড়ে কোনোক্রমে সে গেল কবরখানার শবরক্ষকের কাছে। শবরক্ষক সারারাত কবরখানায় টহল দেয়। কোথাও কোনো শেয়াল বা অন্য কিছু কোনো লাশ বা শবকে যেন জাগিয়ে না তোলে, সেটা সে দেখত। শবরক্ষক তার এই দুরবস্থা দেখে তাকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে বরং দারোয়ানের কাছে নিয়ে গেল। একে তো বেশ কিছু দিন ফকিরটার কাছ থেকে সে কোনো পয়সা পায়নি, তার ওপর আজ সন্ধ্যায় তার মদ গেলা হয়নি। মেজাজটা তার এমনি খারাপ। যখন সে সব শুনল, হয়ে গেল রেগে আগুন। সে তার ঘরের মধ্যেই ফকিরটাকে ধাওয়া করল। ফকিরটা জান বাঁচাতে যতটা পারল ছুটল। পিছু নিল দারোয়ানও। ফকিরের এলোমেলো দৌড়ে সারি সারি উঁচু করে রাখা কাঠের গুঁড়িতে ধাক্কা লেগে একে একে একটা পুরো কাঠের স্তূপ দারোয়ানের ঘাড়ে পড়ল। এতক্ষণ শবরক্ষক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল মজাটা, এবার সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গালে হাত দিয়ে বসে পড়ল।
ব্যাপারটা আদালত পর্যন্ত গড়াল। সব পর্যালোচনার পর মহামান্য আদালত দারোয়ানের মৃত্যুকে একটা দুর্ঘটনা বলে রায় দিলেন। বেওয়ারিশ মানুষটা বেকসুর খালাস হয়ে গেল। কিন্তু আদালতের রায়ে সে খুশি হতে পারল না। সে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলল, ফাঁসি না হয় না দিলেন হুজুর, অন্তত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আমাকে দেন। এখন আমি কোথায় কোন চুলোয় যাব ধর্মাবতার? এই শুয়োরের বাচ্চার যাবার কোনো জায়গা নেই। দোহাই স্যার, এই বেজন্মাটাকে একটা থাকা - (খক খক করে সে কেশে উঠে মুখে উঠে আসা কফ গিলে ফেলল) একটা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা অন্তত করে দিন। এই পশুটার সঙ্গে এত নির্দয় ব্যবহার করবেন না হুজুর।
তার নিবেদন নামঞ্জুর হলো। তাকে জানান হলো যে, আদালত কেবল ন্যায় ও ন্যায্য বিচার করার ক্ষমতা রাখে। মানুষের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করাটা তার এখতিয়ারভুক্ত নয়।
ভিক্ষা না পেলেও ছাপড়া হোটেলে আজ তার খাওয়া জুটে গেল। সন্ধ্যা নাগাদ সে কবরখানার সেই বটতলায় ফিরে দেখল তার তথাকথিত ঘর-সংসার বিছানা-বালিশের কোনো অস্তিত্ব নেই। নতুন দারোয়ান তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিলো, কবরখানার মধ্যে ওসব হবে না। ‘আমি তাহলে যাব কোথায়?’ এমন প্রশ্নের জবাবে দারোয়ান বলল, ‘তার আমি কি জানি?’ আমি নিয়মবর্হিভূত কোনো কিছু এখানে ঘটতে দেব না। নিয়মে লেখা আছে কবরখানার হেফাজতের জন্য নিয়োজিত মানুষেরা ছাড়া আর কেউ এখানে থাকতে পারবে না। অতএব, তুমি বিদায় হও।’ ‘কিন্তু কোথায়?’ মানুষটা বলল। ‘যেখানে তোমার ইচ্ছা, দরকার হলে জাহান্নামে।’
©somewhere in net ltd.