নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু সিদ

আবু সিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

যে কারনে আমি আত্মহত্যা করছি - ২য় পর্ব

১৭ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১০:৩৫

‘ন তেন পন্ডিতো হোতি যাবতা বহু ভাসতি।
ঘেমী আবেরী অভযোগ পন্ডিতো’তি পরুচ্চতি’
[ বহুভাষণের দ্বারা কেউ পন্ডিত হয় না।
যিনি শত্র“হীন, সহিষ্ণু, ভয়মুক্ত ও উদার তিনিই পন্ডিত। ]
[ ত্রিপিটক, ধর্শস্থবর্গ শ্লোক: ২৫৮]

কিন্তু এটা কি সম্ভব যে মানুষ একই সাথে ভয়মুক্ত উদার সহিষ্ণু হবে আর শত্র“হীন ও হবে? আমার কথায় চালবাজটা খানিকক্ষণ হাসল। বলল, এজন্যেই শাস্ত্র বলেছে ‘বহুভাষণের দ্বারা কেউ পন্ডিত হয় না।’

‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর নারীর জন্য ফরজ’ আমি বললাম। অথচ কী তামাশা! বর্তমান কালে মুসলমানেরাই সবচেয়ে কম লেখাপড়া করছে। আর বাংলাদেশের কথা না হয় নাই বললাম। ‘বিয়ে করা ফরজ’, এটা আমাদের মনের কথা, কিন্তু জ্ঞান দিয়ে কি হবে?

আমার প্রশ্নবানে জর্জরিত বুড়ো তার ব্যবসার টাকা গুনতে শুরু করেছিল। হয়ত তার রক্ষিতাও ছিল গোপনে, আমার কাছে সে শুধু মহান হবার ভড়ং দেখাত।

যার যেমন ইচ্ছা সে তেমনি অভিনয় করুক। আমি কেবল সত্য বলব। যখন সত্য প্রাণঘাতী হবে তখন আমি আত্মহত্যা করব। হয়ত এজন্যে, এই ‘অর্থহীন বোকামীর কারনে’ এক সহপাঠী বলেছিল আমায়, তোমাকে মরতে হবে।

হ্যাঁ, আমাকে মরতে হবে। আত্মহত্যা করতে হবে। ও ঘড়ির কাটা তুমি কি থেমে গেলে? এতক্ষণে তোমার দ্বিতীয় পা মাত্র চৌদ্দ কদম এগোল? যখন বিলের ধারে মাছ ধরেছি কিশোর বেলায় তখন তো তুমি ছুটতে হন্যে হয়ে। আজ এত ধীর কেন? নাকি আমার সুখ তোমারও সহ্য হয় না।

‘সুখ’। ‘জীবনের জন্যে, সুখের জন্যে কত কী করতে হয় মানুষকে!’ সিগারেটের ধোয়ায় কালো-করা ঠোটের ওপর পালিশ দিতে দিতে মা বলেছিলেন আমায়। ‘এই জীবনের জন্যইতো আজ একা থাকি - ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল তোর বাপের সাথে। তোর নানা, বুড়ো বদমাশ, ষোল বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দিলো আরেক বুড়ো ভামের সাথে! যত সব ইতরামি। শুধু বড় বড় কথা! বলার সময় বলি ধর্মের কথা আর করার সময় করি নিজের ইচ্ছা মতো।’ অন্যের মতামত আর অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি আমরা আজও রপ্ত করতে পারিনি।

আমাকে যারা জীবনের কথা বলেন, বলেন’, বাঁচার জন্যে কত কী করতে হয়!’ আমি তাদের প্রশ্ন করতে চাই, বাঁচার প্রয়োজন কোথায়? জীবনের দরকারটা কিসে? বিশেষত: জীবন যখন এমন!

সবার কাছে হয়ত জীবন এক নয়। কিন্তু একের ভালো যখন অন্যে দেখতে পারে না তখন জীবন কি করতে পারে? আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে একটা কলেজে পড়াতে শুরু করি তখন আমার ভালো পড়ানোটা সহ্য হলো না অনেকের। তারা আমার পিছনে লাগল ঠিক যেমনভাবে একটা মুরগীর পিছনে লাগে অনেকগুলো শেয়াল। তারা বলল যে, প্রিন্সিপালের মেয়েকে আমি দুমড়ে মুচড়ে দড়ি ক'রে দিয়েছি - তাদের বাসায় গিয়ে তাকে পড়াবার দায়িত্ব পেয়েছিলাম আমি। তারা এমন ভাবে কথা বলে যেন প্রিন্সিপালের মেয়ে তাদের লাগানো পাটগাছ। তার রূপ-যৌবন সেই পাটগাছের সোনালী আঁশ যাকে আমার মতো এক বাঙাল হাজারটা পাকে পাঁক দিয়ে দড়িতে রূপান্তরিত করেছে।

অবশ্য এসবে কিছুই আমি তাদের বলিনি, এমনকি একটা প্রতিবাদও না। আমার শুধু মনে হয়েছিল, যদি আমি এমন একটা মন্ত্র জানতাম যেটা পড়ে ফু দিলে একটা মিথ্যে বলার সাথে ওদের মুখে একটা করে ঘা জন্মাবে তাহলে ওদের সুন্দর মুখের ভড়ং কোথায় যেত! ওদের ওই পুরোহিতের মতো বেশ, সন্তদের মতো কোমল গলা সবকিছু এতদিন পোকায় ভরে যেত।

নিজের ওপরে আমার রাগ হয়। আমি একটা নিছক কথা-বাজ লোক! নিছক চিন্তা বা কথায় এই পৃথিবী ও মানুষের জীবনে কোন বদল আসে না। যে কোন পরিবর্তন আনতে অশেষ পরিশ্রম করতে হয় মানুষকে, তবে কথা আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। কথা ও কাজ দুই-ই চুলোয় যাক। কোন শক্তিই আমার নেই দু’একটি দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা আর আত্মহত্যা করা ছাড়া। তাও আত্মহত্যায় এখনো পর্যন্ত সফল হইনি আমি!

আমার রকম সকম দেখে কলেজের সহপাঠীরা ‘শান্তিপ্রিয় বলদ’ আখ্যা দিয়েছিল আমায়। আজ অবশ্য আামার মনে হয় ‘বলদ’ শব্দটা শুধু প্রযোজ্য আমার জন্যে। তা না হলে অনন্ত জীবনের বাণী আমি ছড়িয়ে দিতে পারিনি কেন অনেকের মাঝে? কেন অন্য অনেককে অনুপ্রাণিত করতে পারিনি আমি সহ সরল জীবনের পথে? কেন আমার চারপাশের প্রত্যেকটা ভালোমানুষ চরম নির্যাতনে বসবাস করেন? কেন ডুবে আছেন তারা হতাশার আস্তাকুড়ে? ভালো কেন তিরস্কৃত সবখানে? কেনই বা মন্দের জয়গানে বিভোর সবাই?

নাহ্। এসব আর ভালো লাগছে না। সেই গাড়িওয়ালাটাকে রাস্তার দু’জন নাইট-গার্ড টেনে তুলল। তারা তার পকেট হাতড়ে, মোচড়ানো গাড়িটা খুঁজে যা-পারল হাতিয়ে নিলো। না। অবশ্যই আর না। আমি বরং কম্পিউটারের সামনে বসে প্রমীলাদের কামাতুর আঁঙ্গভঙ্গি দেখি। কী উন্নতিই না হয়েছে জগতের। চারধারে হাজারো প্রলোভনের পাতা ফাঁদ। কম্পিউটারের বসে দেশ বিদেশের জ্ঞান কী চর্চা করবে মানুষ! তার চেয়ে যৌবনের উত্তাপে মেতে ওঠ। জীবনটাকে উপভোগ কর। কিন্তু সাবধান, নর্দমায় থেকে ভোগ কর জীবনটাকে। সুস্থতার আশা পর্যন্ত করোনা। সুন্দর আর স্বাস্থ্যকর পরিরবেশ কীটের জন্য অস্বাস্থ্যকর। কীটের জন্য রয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত নালা নর্দমা আবর্জনা। আর যদি দু’একটা কীট কখনো কোনক্রমে চমৎকার সব ফ্লাটে ঢুকে পড়ে তবে তার জন্যে আছে ফিনাইল ও স্যাভলন। কোন দূষণ সহ্য করা হবে না। পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হবে। ভিক্ষুকদের আলাদা রাখতে হবে। কুঠ রোগীদের রাখতে হবে পৃথক কোন উপত্যকায়। ওরা মরুক ওদের মতো। আমাদেরকে আমাদের মতো বাঁচতে হবে।

উলঙ্গঁ মেয়েটা উঠে দাঁড়াতেই কম্পিউটারের মুখ বরাবর একটা লাথি লাগালাম আমি। কম্পিউটারের গর্ভে বসবাসকারী ওই নগ্নিকা তার গর্ভধারিনী সমেত ছিটকে পড়ল একপাশে। বসার চেয়ারটা নিয়ে ওটার বুকে আরো কয়েক ঘা বসালাম আমি। বাহ্। চমৎকার। কী শান্তি!

‘আহা, কতদিন সুর্যোদয় দেখিনা আমি’। যদি এখনই একবার সূর্যোদয় হতো! তাহলে সুর্যোদয় দেখতে যেতাম আমি সাগরের পারে। শুনেছি পতেঙ্গা সৈকত নাকি গুয়ে ভরা। নিশ্চয় সেখানে যেতামনা আমি। আমি যেতাম... আমি যেতাম নির্জন নারকেল ছায়ায় যে-ছায়া হতে গ্রহ-চন্দ্র-তারা আর বিপুলা ওই সাগর পেরিয়ে উঠে আসছে সুর্য আমার জীবনের।

না, না। জীবনের কোন প্রয়োজন নেই আমার। না। স্বপ্ন দেখব না আমি। দেখতে চাই না আর মরীচিকা। আমি চাই মৃত্যু আমার ইচ্ছায়। আমি চাই হত্যা - নিজের জন্যে, নিজের দ্বারা, নিজেকে।

একবার কি ফোন করব সিন্থিয়াকে? সে কি চিনতে পারবে আমাকে? এক সন্ধ্যায় যখন সমন্ত চিন্তা আমার টন্টন্ করছিল তার চিন্তায় তখন আমাকে ছুয়ে সে হেসেছিল। ফোনই করি একবার। ওপাশে টেলিফোন বেজে উঠল। সাত আট বার বেজে ওঠা থেমে গেল। হয়ত সিন্থিয়া ঘুমিয়েছে। তাকে আর বিরক্ত করে কাজ নেই। ফুটপাথের সেই দৃশ্যের টানটান জীবন টানছে আমায়।

বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমি। ফুটপাথের সেই পরিবারে তিনজন মানুষ ছিল, মাতা পিতা আর সন্তান। সম্ভবত পুরুষটা মারা গেছে। নাকে মুখে রক্ত মেখে মহিলা হয়ে উঠেছে যেন পেতœী। বাচ্চাটা কাঁদছে তার নিজের স্বরে। আমি শুনতে পাচ্ছি তার মায়ের মিনতি,‘ কেউ সায্য কইরেন! কেউ আইসেন।’ হয়ত সে আমাকে দেখেছে এবং আমাকেই ডাকছে! এভাবে র্নিলিপ্ত মানুষ আর নীরব দর্শক হওয়া কতটা ঠিক?’ আমি ভাবলাম। বিবস্ত্র, কিন্তু এবার পোশাক পরতে হলো। পোশাক পরে আমি নিচে নামলাম।

আমার ঘরে প্রাথমিক চিকিৎসার যা কিছু ছিল তার সব নিয়ে নিচে নেমেছি। এখন মহিলার মাথা আমার হাতের ওপর। আমি তুলো দিয়ে তার রক্ত মুছে দিলাম। সেটা স্যাভলনে ধুয়ে একটু এন্টিসেপটিক লাগিয়ে জায়গাটা বেঁধে দিলাম। তার অন্য কোথাও ক্ষত আছে কিনা জানতে চাইলাম আমি। সে ‘না’ বলল। আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের আগে তার স্বামীকে মৃত অনুভব করলাম। গাড়ি চালিয়ে ছুটছিল যে তরুন তার একটা পা একেবারে থেৎলে গেছে। আমার উচিত তারও শুশ্রুষা করা।

এক গাড়ি পুলিশ এসে থামল আমার পিছনে। একজন আমাকে দেখিয়ে বলল,‘ ছার’ এই যে এইডাই হারামি। এ্যই কাম হেই করচে।’ সেই নিমকহারামকে জুতিয়ে ঠন্ডা করে দেয়ার ইচ্ছা হলো আমার। মনে হলো, এমনি করে ওকে জুতো মারব যে ওর মুখের জিত্তগ্রাফি বদলে যাবে। চিন্তা করে দেখলাম যে অযথা কথা বলার সময় এটা নয়। আর তা ছাড়া আমাকে সে বিশ্বাস করবে কেন? আমার যুক্তি শোনারই বা কি দায় তার? যাই হোক, এক-মন শক্তি সঞ্চয় করলাম আমি। উঠেই সামনের পাঁচিল টপকে দৌড় শুরু করলাম। এমন কিছু আমি করতে পারি না এখন যাতে আমার ভোর চারটের আত্মহত্যাটা রদ হয়ে যায়। তাছাড়া আইন আর আদালতের মতো সংস্থার কাছে না যাওয়াটা বেশি শন্তিজনক।

ওরা আমার পিছু নিয়েছে কিনা তা জানার সামান্য কৌতুহলও আমার হয়নি। পিছন ফিরে একবারও তাই তাকালাম না। অন্তত বিশ মিনিট একটানা দৌড়ে ফিরলাম আমি । বড় রাস্তার ধারে পাতা একটা যাত্রী ছাউনিতে বসলাম। বসার সাথেই আমাকে আবাক করে সেখানে জেগে বসল আরেকটা মানব শরীর। প্রথমে আমি অবাক হলাম। একটু খেয়াল করে বুঝলাম যে সে একজন দেহপসারিনী। হয়ত রাতভর শরীরটা বিকিয়ে একটু বিশ্রামের আশায় সে শুয়েছে। নিজেকে আমার অপরাধী মনে হলো। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাকে বললাম, আমি দুঃখিত! আমার ভুল হয়েছে। আমার কথায় সে ভয় পেল। হয়ত সারা জীবন নারী-শরীরের ওপর পুরুষের লোভটাই সে দেখেছে এমন কোমল বাক্য তার শোনা হয়ে ওঠেনি। তাকে অপ্রস্তুত দেখে মুখটা কঠিন করে আমি বললাম, এ্যই মাগী, তোরে অ্যা’র লাগতোন্যো। এবার সে বুঝল। আমার বিপর্যস্ত লাগছে। চারদিকে শান্ত শহর, তন্দ্রার নীরবতা। আমি ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

যেতে যেতে মনে পড়ল কবরে বিলীন বুড়োটার কথা। সে আমায় বলেছিল, সাপের মাথার বিষ জমে জমে যখন অনেক হয় তখন সেই বিষের ভার সাপ সহ্য করতে পারেনা। যা পায় তাতেই ছোবল দেয়। আমার জ্ঞান, আমার বিদ্যা-বুদ্ধি-স্বভাব সবই যেন সেই বিষ। মানুষ তার ধনসম্পদ গাড়ি বাড়ি সব ত্যাগ করতে পারে, দিয়ে দিতে পারে, কিন্তু তার জ্ঞান আর স্বভাব সে কিছুতে ত্যাগ করতে পারেনা। আমার জ্ঞান আমার জন্য বিষ হয়ে উঠল, অথচ মরন ছাড়া অন্য কিছু আমার চেতনা কেড়ে নিতে পারেনা। আরও একটা পথ অবশ্য আছে, সেটা হলো পাগল হয়ে যাওয়া। কিন্তু পাগল হয়ে আমার চেয়ে খারাপ আর মূর্খদের অনুকম্পা নিয়ে বাঁচবার কোন ইচ্ছা আমার নেই। ও আত্মহত্যা, তুমি কত প্রয়োজনীয়!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.