![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ফ্লাটের রাস্তার মোড়ে পৌঁছলাম আমি। একজন ফুটপাথবাসী দাড়িয়ে এখানে। তাকে কোন প্রশ্ন করার আগেই সে বলল, সবগুলারে নিয়া গেল। কোথায়? নিজেকে প্রশ্ন করলাম আমি। তাকে বললাম, আপনার কাছে ঘড়ি আছে? ‘ঘড়ির কামডা কিসে’? সে বলল, ‘যারা সাব মানুষ, যারা বাইচা আচে তাগো ঘড়ি লাগে’। যে তার অট্্রহাসি ছড়িয়ে দিল সর্বত্র। তার হাসি আমার ফিরিয়ে নিয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দিনে।
বাইরে থেকে একজন অধ্যাপক এসেছিলেন সুনিদির্ষ্ট একটা বিষয়ের ওপর ক্লাস নিতে। ক্লাসে একটা কাগুজে সমস্যার সমাধান করতে দিলেন তিনি। ছাত্র- ছাত্রীরা যখন সেটা নিয়ে নিবিড় চিন্তায় মগ্ন তখন তিনি ফেটে পড়লেন হাসিতে ঠিক যেমন ভাবে কোন ফোলানো বেলুন সহসাই ফেটে পড়ে। তার হাসিতে আমি সুম্পষ্ট উপহাস দেখলাম। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, আসলে এগুলো কোন সমস্যাই না। আমাদের আসল সমস্যা আমাদের প্রতিদিনকার সমস্যা। কাগুজে কোন সমস্যার সমাধান না হলে তাতে তেমন কোন ক্ষতি নেই, কিন্তু প্রতিদিনের জীবনে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হই আমরা তার প্রত্যেকটিই তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীর হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখ লাখ মানব সন্তান কি নিয়ে মাথা ঘামায়? নিত্যদিনের সমস্যা কি আদৌ আমাদের চিন্তার বিষয় হতে পেরেছে? যদি তা হতো তাহলে এত এত অমীমাংসিত সমস্যা কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলত না। মানুষ বলে থাকে, শিক্ষাই আলো। অথচ পৃথিবীতে যত যুদ্ধ যত শত্রুতা যত হানাহানি সব করছে লেখাপড়া জানা লোকেরা! যদি তারা লেখাপড়া না জানত তাহলে খারাপ কাজগুলো কি এত ভালোভাবে করতে পারত? ’যত সব ফাজলামি’, জাফরিন বলত আমায়, ’মুখস্ত কর, সার্টিফিকেট নাও! ব্যাস হয়ে গেলে তুমি অনার্স, মাস্টার্স। ওরে মূর্খের দল, অনার্স মাস্টার্স দিয়ে হবে কি? তুই তো শুধু স্মৃতিচারণ করা শিখলি চিন্তা করাও যে শিখতে হয় সেটাও তো জানলি না।’
তারপর সেই প্রবীন তার বৃদ্ধ মুখটা বিষাদের কালিমায় না ভরে আরো একবার অট্রহাসিতে ফেটে পড়লেন। নিজেকে সংযত করে তিনি বললেন, আমার বরং বক্তৃতা করা উচিত ‘তথাকথিত বিদ্যালয়ও কি একটি ক্ষতিকর মরনাস্ত্র? ’এই নিয়ে। আজও কি তিনি এসব বলে বেড়ান? বললেই বা কি? যে দেশে তিনি থাকেন শুনেছি সেসব দেশ তাদের উদবৃত্ত ফসল সাগরে ফেলে দেয় তবু গরীব দেশে পাঠায় না। তাদের ভয় এতে নাকি বাজার দর পড়ে যাবে! গরীব দেশের নাকি অনেক সমস্যা! তাদের নীতিনির্ধারকেরা নাকি পকেটে ভরার মতো যথেষ্ট কিছু না পেলে দেশ বা দেশবাসীর জন্য কিছু করেন না। আমার বন্ধু আবুল বলত, তুই হয়েছিস এক হাঁদারাম! ও কাজ কেউ করে? ওসব কথা কেউ ভাবে? পাগল!
চারধারের রাস্তায় ফিরে এসেছে আগেকার নীরবতা। চারদিকে উথলে ওঠা কৃত্রিম আলো, যা অন্ধকারের চাইতেও কুৎসিত। সেই নেড়ে কুত্তাটা,যেন মানব সন্তান, ঘায়েভরা জীবন নিয়ে নর্দমার পাশে শুয়ে আছে। তার পেটটা ধীরে ধীরে উঠছে আর নামছে। আমি তার কাছে গিয়ে দেখলাম ঘুমতে পারছে না সে, সারা শরীরে তার পোকার যন্ত্রণা। আহা, কী অবস্থা তার! ওকে যদি এক বোতল বিষ কিনে দিতে পারতাম! বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে পারত সে! বেঁচে যেত অমানবিক বিশ্ব থেকে। কোথায় যেন পড়েছিলাম কবি বলছেন,
” ... পাখিরা ভালো নেই .....
যদি ওদের আত্মহত্যা শেখাতাম !
বেঁচে যেতো ওরা অমানবিক বিশ্ব থেকে;
পাখির তো পরকাল নেই।”
আমি বিষের কথা ভাবতে ভাবতে এখান থেকে দশ কদমও এগোইনি, হঠাৎ দুই জরাগ্রস্ত লোক হাতে দুটো চাকু নিয়ে আমার সামনে দাড়িয়ে। বিচ্ছিরি তাদের বেশ। হাবভাব এত বেশি কুৎসিত যেন নরক থেকে সবে ছাড়া পেয়েছে! তাদের গলার স্বরও তেমনি, জরাগ্রস্ত ওই কুত্তার চেয়েও খারাপ। সেই কুত্তামার্কা গলা নিয়ে আহস্মক দুটো খেঁকিয়ে উঠল, যা আচে বাইর কর! বোঝাই যাচ্ছে দুটোই হেরোইন-খোর। আমি কোন ভনিতা না করে একটার নাকে সজোরে ঘুষি চালালাম। ও মুখ থুবড়ে নিচে পড়ল। অন্যটা এক ছুটে পালাল আমার সামনে থেকে। আমি নিচে তাকিয়ে দেখলাম তার নাক থেকে রক্ত ঝরছে। কাজটা ঠিক হয়নি।
‘ওকে কি বাসায় নিয়ে যাব? আমার প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্সটা!’ রাস্তার ওপাশে তাকিয়ে দেখি কোন ‘বিবেকবান’ ওটার সদ্বব্যবহার করেছে। আমি ওকে টেনে তুললাম। ও অনেক কষ্টে বলল যে গত দুইদিন কিছু খায়নি। আমি বললাম, নেশা তো খেয়েছিলে, না? সে বলল যে ভাত না খেয়ে সে বাঁচতে পারবে কিন্তু হেরোইন না খেয়ে? ‘না’ এইডা পারুম না।’
‘আমার আত্মহত্যাটা!’ আমি ওকে রাস্তার ওপর বসিয়ে দিয়ে এগোলাম। সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে শুনলাম আমি সাগরের ঢেউয়ের মতো প্লাবিত নারী কন্ঠের হাসি। এক নয়, একধিক। গোনা যাবে না সে আনন্দ ধারা, অনুধাবন করতে পারবে না আমার জীবন সেই ভোগের বন্যা। ওরা অনন্ত, অগণিত। সেই হাসি মাথার বিবরে নিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ছোট খালাকে মনে পড়ল আমার। সে আমায় বলেছিল, তুই একটা বুদ্ধু। পুরুষ মানুষ; ভোগ করার জন্য রয়েছে গাড়ি বাড়ি নারী। তার কথায় সেদিন মনে হয়েছিল ইউরোপ আমেরিকায় এমন অনেক কুকুর আছে যারা চকচকে গাড়িতে ঘোরে, প্রতিদিন উৎকৃষ্ট খাবার খায়, প্রাসাদে থাকে। এছাড়া কখনো কখনো তাদের সুন্দরী কর্ত্রীর শয্যা সঙ্গীঁও হয়। তাহলে কি চৌদ্দ পুরুষ কুকুর, কুকুরের বংশধর,যার বংশধরেরাও হবে স্রেফ কুকুর আমার চেয়ে, আমাদের মতো মানুষদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ!
সে তার কামাতুর চোখে আগুন জ্বেলে বলেছিল, আমার ফ্রেন্ডদের কাউকে ভালো লাগেনা তোর? তার কথায় আমি বলেছিলাম, এসব প্রশ্ন করো না আমাকে। জীবন নিজেই একটা প্রশ্ন। হেসে উঠেছিল ছোট খালা ভেঙেপড়া কাচের মতো।
চুলোয় যাক এ সমাজ সংসার সভ্যতা। তাদের নিজের নিজের কক্ষপথে ঘুরতে থাকুক প্রতিটা সত্ত্বা। আমার পথ তাদের সবার পথের থেকে পৃথক হয়ে গেছে আজ। দেয়াল ঘড়িটা সাড়ে তিনটার ঘন্টা বাজাল। আমি ভাবলাম, টেলিভিশন ছেড়ে মানব সভ্যতার কীর্তিকলাপ দেখি শেষ বারের মতো। কিন্তু কী হবে এসব দেখে! সভ্যতা মানে তো জোচ্চুরি আর একটা ফেলনা রঙ-তামাশা। বরং ‘ডিসকভারি’ চ্যানেল দেখা যেতে পারে। হয়ত সেখানে সমুদ্রের অন্ধকার গহবরে শান্তিতে আছে লাল-নীল মাছেরা। সাগর জলের ওই গহীনে নিমজ্জমান উদ্ভিদগুলোও কী সাবলীল! অথচ সূর্যের আলোয় প্রত্যেকটা মানুষ দিনে দিনে হয়ে উঠছে কাঁকড়া! চুষে খাওয়া ছাড়া আর কিছু তারা শিখছেনা।
তাহলে যে অল্পকিছু টাকা পয়সা রইল আমার সেগুলো কার হবে? সেগুলোর মালিক হোক কাক আর শালিক। সেগুলো দিয়ে বিষ কিনে খাক ওই জর্জরিত কুকুরটা।
তাহলে যে পোশাক পরিচ্ছদ রইল পড়ে সেগুলো কার হবে? সেগুলো হোক ওই বকের যাকে দেখেছিলাম আমি নদীর ধারে শীতে কাঁপতে। মানুষের তো শীত নেই!
তাহলে এই বইপত্র সব কে নেবে? এসব নিক উইপোকারা। আহা! ওদের যে খাবারের খুব অভাব!
তাহলে আমার মরার পর অবিনশ্বর প্রেম আমার যা ছিল সুন্দরী সিনথিয়ার জন্য তা কার হবে? সে প্রেম হোক এই ধরণীর। আমরা শত শত কোটি মানুষ মিলে তার গলায় ফাঁস পরিয়ে চলেছি শত শত বছর ধরে। মানুষের অত্যাচারে হয়ত এই পৃথিবীটারও আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করছে। আহা, যদি জানতে পারতাম ধরণী-মাতার মনের কথা!
আবার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই আমি। এখন সম্পূর্ণ নগ্ন, মৃত্যুর জন্যে প্রতীক্ষমান। ছোট খালা জানতে পারলে বলত, কেন নগ্ন তুই? হয়ত আমি তাকে বলতাম, পোশাক-পরা এই ভন্ড সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করতে এ উপায়টা আমি বেছে নিয়েছি। ঘড়িতে চারটের ঘন্টা বাজল। মনে হচ্ছে ‘না’, থাক। মরে আর কী হবে - বরং চেষ্টা করি আরেক বার।
নিজের সমর্থনে মনে পড়ল আমার দু’লাইনের একটি কবিতাঃ
“ মে খাবড়াহ কহছে হৈ মৈর যায়ুঙ্গি,
মৈর ক ভি চৈন না পায়া তো কীধর যাওঙ্গি।”
[ আমি তো খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললাম মরে যাব,
এখন মরেও যদি শান্তি না পায় তাহলে কোথায় যাব।]
আমি কি সত্যি ঘাবড়ে গিয়েছি? আমার কি আবারও উচিত জীবনে ফিরে যাওয়া? যে ছবিটা আমি আঁকছিলাম, যে তৈলচিত্রটা এখনও শেষ করে উঠতে পারিনি সেটা সমাপ্ত করাই কি উচিত নয় আমার? আমি ফিরছি ঘরে।
মনের ভিতর নবজন্মের একটি কুড়ি এখনই প্রস্ফুটিত হলো। একরাশ অজানা আনন্দ আমায় ঘিরে নৃত্য করল। আমি ‘ডিসকভারি’ চ্যানেল চালু করলাম। অসমাপ্ত ছবিটা টেনে নামালাম। ঘন্টা তিন লাগবে ওটা শেষ করতে। রঙ এবং তুলি একেবারে আস্তাকুড় হয়ে আছে। রঙের প্যালেটটা দেখছি না কোথাও। বরং ডায়েরিটা খুলে পড়া যাক।
অনেকদিন পর নিজের লেখা পড়তে পড়তে যেন নিজেকে আবিষ্কার করছি নতুন করে। আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে যে ওগুলো আমার লেখা। আমি স্বপ্নও লিখে রাখতাম! বাহ্ ঐ লেখাগুলো নতুন করে সাজিয়ে আমি তো ‘স্বপ্নের খেয়া’ নামে একটা বইও ছাপতে পারি। আবিষ্কারের আনন্দ আমার রক্তে ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হলো, মাকে একটা ফোন করি। তাকেও অংশীদার করি আমার আনন্দের।
না, তাকে পাওয়া গেলনা। কেউ ধরছেনা টেলিফোন। আমি ‘স্বপ্নের খেয়া’য় চোখ বোলাতে শুরু করলাম -
©somewhere in net ltd.