নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু সিদ

আবু সিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

যে কারনে আমি আত্মহত্যা করছি - ষষ্ঠ (শেষ) পর্ব

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ৯:১৮

ঘুম ভেঙে জেগে দেখি সন্ধ্যা ও রাত কব্জা করে ফেলেছে পৃথিবীটাকে। বাইরের ব্যালকনিতে এসে দাড়াই আমি। চারদিকে চিরচেনা সেই জীবনের ¯্রােত একই ভাবে বয়ে চলেছে। গত রাতের কথা মনে পড়ছে এখন। না, স্মৃতি চারণের সময় এটা নয়। ক্ষুধার মেশিনটা গর্গর চলছে দিন-রাত। আমরা ঘুমায় বা জেগে থাকি তাতে ওর কিছু যায় আসে না। ও নিরন্তর চলছে নিজের মতো। এখন আবার নিচে নামতে হবে আমার - আত্মহত্যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে কিন্তু ক্ষুধা থেকে কারও কোন মুক্তি নেই।

খাবার হোটলেটা বাইরে থেকে বেশ মনোহর। ভিতরে তার অসস্থা রসাতল। বেশি খরিদ্দার টানতে তারা টয়লেটের সুবিধা দিচ্ছে আজকাল। তাতে ঢুকে বেরিয়ে এলাম আমি। দুর্গন্ধ আর মল-মূত্রের ছড়াছড়ি সেখানে। পানির কলটাও ভাঙা। ম্যানেজারকে কথাটা বলার সাথে সে জ্বলে উঠল শুকনো বারুদের মতো। খেকিয়ে উঠল সে, অয় মিয়া! টয়লেটে কি আতরের গন্ধ পাইবেন? বইলে বয়ের নাইলে ভাগেন। এ দোকানে মাঝে মধ্যে খেতে আসি আমি কিন্তু কখনো টয়লেটে ঢোকা হয়নি। দু’জন ওয়েটার ম্যানেজারের সামনে আমাকে দেখে পড়িমরি করে ছুটে এল। কিছু মাইন্ড কইরেন না স্যার, আজ দুপুরে পরিচিত এক কাস্টমার আইসা এক হাজার টাকার একটা জাল নোট দিয়া গেছে। ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাইয়া আমাগো বস খাইছে ধরা। আজকা তাই, বুজতেই তো পারতাছেন! বয়েন স্যার, কি খাইবেন? এখানে এখন আর বসতে ইচ্ছা করছে না আমার। আমির রাস্তায় নেমে এলাম। সামনের দিকে হাটতে শুরু করি আরেকটা খাবারের দোকানের খোজে।

ম্যানেজার লোকটাকে প্রথমে আমার খারাপ লাগলেও তার দুরবস্থা শুনে এখন একদম অন্যরকম লাগছে। দেড় কোটি মানুষের এই শহরে যেখানে পাবলিক টয়লেট আছে হাতে গোনা কয়েকটা সেখানে দুর্গন্ধযুক্ত টয়লেটও তো আর্শীবাদ!

হেটে হেটে আমি এসেছি এখন একটা চাইনিজ খাবারের দোকানে। এখানে খাবারের অর্ডার বসতে হবে কিছুক্ষণ। অর্ডার পাওয়ার পর ওরা কাজ শুরু করবে। অর্ডার দিয়ে আমি খবরের কাগজ টেনে নিই। এ-পাতা সে-পাতা ঘুরে আমার চোখ জায়গা করে নেয় একটা আত্মহত্যার খবরে। খবরটার প্রতি আমি চুম্বক-আকর্ষণ বোধ করছি। গোগ্রাসে গিলে নিই খবরটার বিষয়বস্তু। খবরটার মূলকথা এক বিবাহিত তরুনের আত্মহত্যা নিয়ে। মা আর বৌর ফ্যাচর ফ্যাচর শুনতে শুনতে লোকটা হয়রান হয়ে গিয়েছিল। কাউকেই সে খুশী করতে পারেনি। অবশেষে মুক্তি খুঁজে নিয়েছে ট্রেনের সামনে ঝাপিয়ে পড়ে।

কে যেন বলেছিল, প্রতিটি আত্মহত্যাই এক ধরনের পারিবারিক বা সামাজিক হত্যা। মানুষ মানুষকে খুন করলে আইন-আদালত তাকে ফাঁসী বা যাবজ্জীবন দন্ড দেয়। কিন্তু পরিবার বা সমাজ যদি খুনী হয় তবে তার বিরুদ্ধে কোন আইন আছে বলে আমার জানা নেই। পরিবার ও সমাজের উপদ্রব থেকে বাঁচতে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো লেখক আর মেরেলিন মনোরোর মতো সুন্দরীও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।

ভাবতে ভাবতে আমার খাবার এসে গেল। ধোঁয়া উঠতে থাকা খাবারে চামচ গলিয়ে তুলে আনলাম আমি একটা সিদ্ধ টিকটিকি। একেতে ক্ষুধা আমার চরমে তার ওপর এই অনাচার। দাড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দিলাম, কোন শুয়ার দিচে এই দোকান? ডাক হালার পুতরে। আজ ওর গুষ্টি নিপাত করে ছাড়ব। আমার চেচামেচিতে ম্যানেজার ওয়েটার এসে হাজির। খেতে থাকা মানুষ জন সব আমার দিকে তাকিয়ে। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি জোরে জোরে বললাম, কি ফাউল কামে আছেন আপনারা এইখানে? ভাতের মধ্যে টিকটিকি! কি ছাতার ফ্রাইড রাইচ বানাইচেন? টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার ওয়েটারের চোখ ছানাবড়া। পাশের টেবিলে খাচ্ছিল এক তরুন-তরুনী। ছেলেটা ওঠে এসে চিৎকার দিয়ে ওঠল। যে খাবারটা সে খাচ্ছিল সেটা ছুড়ে ফেলল। ম্যানেজারের জমার কলার ধরে সে তাকে শাসাল, ওই মাতারির পোলা! এক্কারে টেংরি খুইলা নিমু। তার সাথে থাকা মেয়েটা উঠে এসে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আহা, ছাড়ো তো। মেয়েটা ছেলেটাকে নিয়ে টানতে টানতে বাইরে বেরিয়ে গেল।

আজ আমার কপালটাই খারাপ! চাইনিজ আর খেয়ে কাজ নেই। ফুটপাথ থেকে রুটি-কলা কিনে রিক্সায় উঠে বসলাম। আমার সহকর্মী সোলেমান বলে, ওসব কপাল টপাল বাজে কথা। কেউ কি দেখেছে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা এসে মানুষের কোনো কাজ করে দিয়েছে? তোমার কাজ তোমাকে করতে হবে। এসব ধান্দাবাজদের যদি ঠিক মতো বাঁশ দেয়া যেত দেখতেন সব ঠিক। কই বাইরের দেশে তো এসব আকাম করে কেউ পার পায় না!

বাইরের দেশের কথায় আমার মনের ভিতর একটা আফসোস বোমার মতো ফেটে উঠল। সেখানে বাস করার একটা স্বপ্ন আমারও ছিল। কিন্তু সেখানে আমাদের মতো মানুষের মর্যাদা নেই! আমরা তাদের চোখে হীন মানুষ। তার থেকে আমার নোংরা টয়লেটের হোটেল বা টিকটিকি সহ ফ্রাইড রাইচ ভালো। আমরাও যদি ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলার মতো সাহসী হতে পারতাম! ওদের মতো সমাজ আমরাও তো গড়তে পারতাম! আসলে বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ম-কানুনগুলোই এমন। সেগুলে বুঝে যারা সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারবে তাদেরই ভালো হবে। কবে কোথায় যেন পড়েছিলাম, ”এই বিশ্বলোক চরাচরে যা কিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তার কোন কিছুই যুক্তির থেকে উৎকৃষ্ট নয়। নয় কোন কিছু এতটা মহিমান্বিত বা সুন্দর। যে কেউ বিশ্বলোকের যুক্তির নিয়মকে অবজ্ঞা করে সে প্রকৃতির কোপে পড়ে।” বিশ্বলোকের নিয়মগুলো যেভাবেই আসুক না কেন আসল কথা হচ্ছে সেগুলো কার্যকর। চৌদ্দ তলার ছাদ থেকে যদি আমি ঠিক মত লাফিয়ে পড়তে পারি তাহলে আত্মহত্যাটা, আশা করা যায়, সফল হবে। হতাশার পাখিরা আবার এসে ভিড়তে শুরু করেছে আমার জীবন বৃক্ষে।

দিনের দুনিয়া ও রাতের ধরণী একদম যেন আলাদা। তাদের প্রত্যেকের স্বভাবও আলাদা। যে কাজ দিনে করতে পারি তার অনেক কিছু রাতে করা যায় না। আবার রাতের অনেক কাজ দিনের বেলা যেন ঠিক মতো হয় না। আমি আমার ফ্লাটের তালা খুললাম। হঠাৎ মা-র কথা মনে হলো। কে একজন যেন বলে উঠল, তোর খোজ নেয়ার মতো সময় কারও নেই। এই ফাাউল দুনিয়ায় থেকে আর করবি কি? মর।

বিষাদ থেকে যেন মুক্তি নেই। কাল রাতের শেষে মনে হয়েছিল, অন্তত অন্যের ভালোর জন্যে বেচে থাকতে পারলে সেটাও স্বার্থক জীবন। এখন মনে হচ্ছে, অন্যের ভালো করতে যাওয়াটাও এক ধরনের জটিলতা। এখানে কেউ কারও ভালো করতে গেলেও আমরা ভাবি, মনে অন্য ধান্দা নেই তো! মনে এখন আমার আগের সেই পুরনো চিন্তা, চিরচেনা সেই হা হুতাশ। সব মিথ্যে সব ব্যর্থ। আসল সমস্যা হলো, আমি কোন কিছুর সাথেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারিনি। তার খুব দরকার ছিল।

নিজেকে অন্য অনেক কিছুর সাথে জড়াবার সময় আমি পেরিয়ে এসেছি ঢের আগে। এখন আর সে চেষ্টা না করাটাই ভালো হবে। নিজের হতাশার সাথে অন্যকে জড়াবার মাধ্যমে ভালো কি ঘটবে? বাস্তব জগতের থেকে দূরে থাকতে থাকতে আমি বাস্তবতা-অক্ষম মানুষে পরিণত হয়েছি। আমার প্রিয় সেই হতাশাবাদী কবির আরেকটি কবিতা মনে পড়ছে এখন,

কাপুরুষ

বেঁচে আছি হীন কীট
পঁচা ঘা নিকৃষ্ট পতঙ্গ;
বেঁচে আছি আমি উদ্ভট
উচ্ছিষ্ট স্তপ অশ্লীল উচ্চারণ
আবর্জনা দুর্গন্ধ!

আজ নির্মমতা মনুষ্যত্ব
আজ অন্যায় বীরত্ব;
বেঁচে আছি আমি অমানুষ
চক্ষুলজ্জাহীন জঘণ্য কাপুরুষ।

আরেকটি নির্ঘুম রাতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমি। কি করব কিছু বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে কি আর করার আছে এই পৃথিবীতে? যত সুখভোগই করি অথবা যত অসুখেই মরি পরিণতিতে পাড়ি দেয়া সেই মৃত্যু দুয়ার। শুনেছি অনেক দেশে স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকার নিয়ে আইন আছে। ওরে উড়নচন্ডী! আত্মহত্যা মহাপাপ! আমার বুড়োভাম নানা বলত। আমি তাকে বলতাম, তুমি কি প্লেটোর রিপাবলিক পড়েছ? শেষ বয়সে সে আমার সাথে আর তর্কে পেরে উঠত না।

হয়ত কথাটা প্লেটোর নয়, হয়ত ধারনাটা তিনি পেয়েছিলেন সক্রেটিসের কাছ থেকে। সেখানে বলা হচ্ছে, ভালো-মন্দ আপেক্ষিক। এমনকি মিথ্যাও হতে পারে সত্যের থেকে ভালো, চুরিও হতে পারে কল্যাণকর । সক্রেটিস যুক্তি দিচ্ছেন, ধরাযাক, আমার কোনো বন্ধু আত্মহত্যা করবে বলে একটা ছুরি এনে রেখেছে তার বালিশের নিচে। সেটা চুরি করা নিশ্চয় পাপ নয়, এটা তার জীবন বাঁচাবে। আবার, কোন বাচ্চাকে মিথ্যা বলে ওষুধ খাওয়ানোটা তাকে সত্য বলার থেকে ভালো।

বুড়োটা আমার দিকে মুখ ভারী করে তাকিয়ে ছিল। আমি বললাম, তার মানে হচ্ছে উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করছে ভালো ও মন্দ। ভূমি-ধ্বসের মতো ধ্বসে পড়েছিল সে যখন আমি বলেছিলাম, তুমি নিশ্চয় সহী বুখারী পড়েছ! সেখানে প্রথম হাদিসটাও কিন্তু এই কথা বলছে, আল্লাহ তার বান্দার কাজের পুরস্কার দেন বান্দার নিয়তের ভিত্তিতে। এরপর তার সাথে আর দেখা হয়নি আমার। একথা ঠিক, সে আমাকে সাহায্য করেছিল নানা ভাবে। তার কাছে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। তার অনেক জ্ঞান আর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও সে নিজের মেয়েদের বঞ্চিত করেছে। মেয়েদের জমিও ছেলেদের নামে লিখে দিয়ে মরেছিল বুড়ো।

মায়ের কথা, সিনথিয়ার কথা মনে পড়ছে। আত্মহত্যার ইচ্ছাটাও প্রবল আবার। এ যেন চিন্তা ও অনুভবের একটা দুষ্টচক্র। আত্মহত্যার ইচ্ছার পর আবার বাঁচার ইচ্ছা। আবার মরার ইচ্ছা আবার বাঁচার ইচ্ছা।

আমার চিন্তা আর অনুভূতি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। একই ব্যথার এই পুনরাবৃত্তির কোন মানে নেই। বাইরের ব্যালকনিতে এসে দাড়াই আমি। চারদিকে ম্লান রাত। মনে হচ্ছে সুন্দর সূর্যোদয় হচ্ছে দূরে কোথাও। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ আমি তিনতলার দুয়ার খুলে সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠছি। উঠছি তো উঠছিই! ফিরলাম না তাকালাম না কোন দিকে। সোজা চৌদ্দতলার মাথায় চড়ে বসলাম।

নিচের প্রতিটি প্রাণী এবং উদ্ভিদ, জীব ও জড় অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আর কোন চেষ্টার প্রশ্ন নেই। সারি সারি অন্ধকার উঠে আসছে বিশ্বলোকের সব কোনা থেকে। অগণিত দীর্ঘশ্বাস হৃদয় ফুঁড়ে বেরিয়ে এল আমার । আমি নিজেকে সোজা ছুড়ে দিচ্ছি পৃথিবীর ওপর - যেমন ভাবে একটা পুতুলকে ছুড়ে দিলে তার মাথাটা গিয়ে ঠোকর খায় মাটিতে - ঠিক সেই ভাবে।

আমার সামনে এখন কেবল মৃত্যুর অন্ধকার। কিন্তু আমি জানি আমি মরার পরও যারা বেঁচে থাকবে এই পৃথিবীতে তারা বাস করবে এর চেয়েও নিবিড় আর প্রগাঢ় অন্ধকারে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ৯:৩৮

খেলাঘর বলেছেন:



হাউকাউ?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.