নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু সিদ

আবু সিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মহাপ্রস্থান

১০ ই নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:২৫

পনের বছর বয়সে যখন সে রাস্তা ধরে হেঁটে যেত, যেতে যেতে তার মনে হতো, এর চেয়ে দুঃখ আর কী আছে? এত কষ্ট আছে আর কার জীবনে? তার আত্মার অন্তর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছুটে ছুটে আসত; এমনই ম্লান কেটেছিল তার কৈশোর। তার মা-বাবা দুজনেই মরে গিয়েছিল। সে উঠেছিল এক আত্মীয়ের বাসায়। যে বাড়িতে সে থালা-বাসন মাজত, ফাই-ফরমাস খাটত। মোটকথা সেখানে সে চাকরের কাজ করত। তবু যত খারাপ আচরণই তারা করুক, তার স্কুলে যাবার ব্যবস্থাটা তারা করে দিয়েছিল। হাজার হলেও তারা ছিল আপনার আত্মীয়! সেই বয়সে যদি সে বুঝত এর থেকে ঢের বেশি কষ্ট রয়েছে তার বাকি জীবনের সুদীর্ঘ সময় ধরে, তাহলে কি সে বাঁচতে পারত? তাহলে কি সে আত্মহত্যা করে নিত না? কিন্তু আর সব মানুষের মতো সেও জানত না ভবিষ্যতের কোনো কথা । তবে অতীত তার ভালোই জানা ছিল। মাতৃগর্ভ থেকে মায়ের কোলের কিছু ঘটনা বাদে অনেক ঘটনা মনে আছে তার। একবার যে সে ধুলোর ধরণীতে হেঁটে বেড়ানো একমুঠো পিপীলিকা মুখে পুরে আÑ আÑ চিৎকার করে লাফিয়ে উঠেছিল তা তার খুব মনে আছে।

সবচেয়ে মনে আছে, ভীতিকরভাবে মনে আছে তার চার-পাঁচ বছরের ঘটনাগুলো। তার বাবা তখন ছয় ফুট উচ্চতার তাগড়া জোয়ান, হৃষ্টপুষ্ট স্বাস্থ্য। ডাকাত পেটানোর সুখ্যাতি ছিল তার। সেই সুখ্যাত বাবা যখন-তখন ক্ষুদ্র অজুহাতে চিৎকার করে তাকে ধমক দিতো। তার হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠত, বুকের ভিতর পিলে যকৃৎ সব যেত চমকে! পরে যখন আরও বেশি বয়সে সে ডাক্তারের কাছে যায়, তখন ডাক্তার তাকে তার স্নায়ুবিক দৌর্বল্যের দিকে ইঙ্গিত করেন। তার অসুস্থতার ইতিহাস জানতে সেই ডাকাত পিটিয়ে সুখ্যাত পিতার দিকে দোষের বুলেটগুলোর একটা তিনি ছুড়ে দেন। তখন সুখ্যাত পিতাটি হয়তো ফেরেশতাদের সঙ্গে ঝাড়া তর্কে নেমেছে। এদিকে তার কবরের ওপর দূর্বাঘাস গজিয়ে উঠেছে আর সাপের ছানারা ডিম ফুটে বেরিয়ে যত্রতত্র ছুটে বেড়াচ্ছে। কবর থেকে তুলে কারও অপকর্মের কথা যদি দলিল-প্রমাণ সমেত তাকে বোঝানো যেত তবে সম্মানিত চিকিৎসক হয়তো তা-ই করতেন, এতটা বিরক্ত তিনি হয়েছিলেন বিখ্যাত সেই পিতার ওপর। ‘বাচ্চার সঙ্গে শোভনীয় আচরণ করা না শিখে বাচ্চার বাবা হবার অধিকার, রাষ্ট্রের উচিত, ছিনিয়ে নেয়! ’ পয়ত্রিশ বছরের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা নিয়ে আক্ষেপ করে উঠেছিলেন তিনি।

কিন্তু অন্যের আবেগ-অনুভূতি বা মনোজগৎ নিয়ে অধিকাংশ মানুষের মনে কোনো বিকার নেই। তাই রহমান যখন তার পাঠপর্ব চুকিয়ে একটা চাকরিতে ঢুকল তখন সে আরও বেশি বেশি চাকর বনে গেল। এতদিন সে অনেক আশায় সব ধরনের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছিল। ভেবেছিল, একটা কাজ যদি পাই তবে নিজের মতো করে একটু শান্তিতে থাকত পারব। ‘কিন্তু নাহ, তা আর হলো না!’ অফিসে তার কাজের জায়গায় বসে বসে সে আফসোস করে উঠল । ঠিক তখন তার ওপরওয়ালা সেখান দিয়ে যেতে যেতে তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল। তার কণ্ঠটা নিমেষে মাইক্রোফোনের মতো জোরালো হয়ে উঠল। ‘কাজ নেই, খালি খালি বসে থাকা?’ ‘স্যার, আমি তো কাজ করছি’, রহমান নিজের সমর্থনে বলল। ‘কই? আপনি তো বসে আছেন!’ সে চিৎকার করে উঠল, ‘খালি বসে বসে বেতন নেয়ার ধান্দা।’ নানা ছলছুতোয় নি¤œপদস্থদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করাটা যেন তার অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, রহমান ভাবল।

তার ভুলের কারণে কেউ তাকে বকাবকি করলে সেটাকে রহমান মেনে নেয় কিন্তু অকারণে, কেবল নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্য কেউ এরকম করলে সে খুব অসহায় অনুভব করে, তার মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সে তার চেতনার ওপর অসহ্য একটা চাপ অনুভব করে। মনে মনে সে ভাবে তখন, হায়! কী নির্মম নিষ্ঠুর সারাটা পৃথিবী! নিজেকে সে সমস্ত জগতের থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে।

কিছুদিন এরকম অসহনীয় মানসিক চাপে থাকার পর তার মনে হলো সেই বুড়ো ডাক্তারের কথা, যে বলেছিল, ‘বাচ্চার সঙ্গে শোভনীয় আচরণ করা না শিখে বাচ্চার বাবা হবার অধিকার, রাষ্ট্রের উচিত, ছিনিয়ে নেয়া!’ রহমান ভাবল, একবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখি।

পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে সে দেখল যে ডাক্তারের সেই প্রেসক্রিপশনের অর্ধেকটা ইঁদুরে খেয়ে গেছে। ‘তবু ভালো’, সে ভাবল, ‘এটাও খারাপ হবে না।’ তখন হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে সেই একই কথা তার চেতনায় ফিরে এল। আমি তো কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না; মানুষ কেন তবে আমার সঙ্গে এরকম আচরণ করে? ওহ, কী কষ্ট! দেয়ালে কয়েকবার সে মাথা ঠুকল, তারপর ডাক্তারের কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে রহমান দেখল যে তার জানা নামের কোনো ডাক্তার সেখানে নেই। এমনকি সে-নামে কোনো ক্লিনিক বা কারো চেম্বারও নেই। সে একটা দ্বন্দ্বের ভিতর পড়ে গেল। আশপাশের অনেক জায়গায় অনুসন্ধান করেও সে কোনো হদিশ পেল না। কেউ একজন তাকে বলল, আবার নতুন করে ডাক্তার দেখান ভাই। এই আরেকটু সামনে গিয়ে দেখেন একটা নতুন ক্লিনিক, সেখানে বেশ কয়েকজন ডাক্তার বসেন। রহমান কী করবে না করবে ভাবতে ভাবতে লোকটা তার হাত ধরে নতুন সেই ক্লিনিকের সামনে পৌঁছে দিলো। ‘আমি কি কখনও এত ভালো ব্যবহার আশা করতে পারি?’ নিজেকে বলল রহমান, তারপর সেই লোকটাকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে দেখল সে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। রহমান এক দৌড়ে তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ ভাই। আমি মাঝে মাঝে একটু বেখেয়াল হয়ে যাই তো কিছু মনে করবেন না।’ সে সেখানে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ খুঁজতে শুরু করল।

অনেক খুঁজেও সেখানে কোনো বিশেষজ্ঞকে পাওয়া গেল না। তবে একজন তরুণ সবেমাত্র সেখানে যোগ দিয়েছেন, তার সঙ্গে কথা হলো তার। তরুণ ডাক্তারটি মনোরোগ এবং মানুষের মনোজগৎ নিয়ে কাজ করতে চান। তরুণ এই আগন্তুককে তার খুব উপাদেয় বলে মনে হলো। পুরো দু ঘণ্টা সময় ধরে সে রহমানের রোগের ইতিহাস নোট করল। তার মনে হলো, সম্ভবত এটা খারাপ দিকে যাচ্ছে। ‘আপনি কি অন্য চাকরিতে যোগ দিতে পারেন না বা চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারেন না?’ ডাক্তার বললেন। ‘না, তা কী করে সম্ভব?’ রহমান বলল, ‘আমার বাঁচবার মতো আর কোনো অবলম্বন নেই, এছাড়া আপনি জানেন, এখন এখানে চাকরি পাওয়া কত কঠিন।’ ‘ও!’ ডাক্তার আফসোস করল। কিন্তু পরক্ষণে তার মাথায় একটা চিন্তা এলো, ‘আচ্ছা, ধরুন আমি আপনার অফিসে গেলাম’ সে বলল, ‘যদি আপনাদের পরিচালককে সব কিছু বুঝিয়ে বলি তাহলে হয় না?’ সে কথায় রহমান আস্থা রাখতে না পারলেও হেসে বলল, ‘হতে পারে!’

ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে তার একটু হতাশ হতাশ লাগল। রাস্তা ধরে সে আপন মনে হাঁটতে থাকল। তখন সন্ধ্যার বাতিগুলো তাদের চোখ মেলে তাকিয়ে বিরাজমান অন্ধকারকে অপ্রস্তুত করে দিলো। রহমান সে আলোয় হোটেল আর মানুষের আহারের দৃশ্য দেখে মনে করতে পারল, হ্যাঁ আমারও তো ক্ষুধা লেগেছিল কিছুক্ষণ আগে! সে তড়িঘড়ি একটা হোটেলে ঢুকে কিছু খেয়ে নিল।

সেখান থেকে বের হয়ে রহমান শহরের দৃশ্যাবলি দেখতে লাগল, ফুটপাতের বইয়ের দোকানগুলোতে উঁকি দিতে থাকল। সাধারণত সে অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। প্রতিদিন তাই সে অফিসে আসা-যাওয়ার বাইরে কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে পারে না। সাপ্তাহিক ছুটির দিন এলে সে ভাবে, কোথায় যাব? সব জায়গায় শত শত মানুষ! এত মানুষ তার ভালো লাগে না। আজ তাই সন্ধ্যার রাজপথ আর বইয়ের দোকান হোটেল সবকিছু তার না-জানা নতুন বলে মনে হলো।

বইয়ের দোকানে উঁকিঝুকি দিয়ে একটা কবিতার বই তার ভালো লেগে গেলো। কবিতা সে বিশেষ পড়ে না, কিন্তু প্রচ্ছদ-পিঠে ছাপা কবিতাটা তার আশ্চর্য ভালো লাগল। মনে হলো, ‘এ তো আমার নিজের জীবনের কথা!’ রাজপথে দাঁড়িয়েই কবিতাটা বার কয় পড়ল সেÑ

What a burden over my soul,
What a suffering over my soulder
No one knows... No one knows...

I’ve no wish in my days...
I’ve no desire in my hours...
In what extreme am I
No one knows.

Yet I’m someone alive.
Against all the cruel of Society
I’m all alone and lonely
Nearst to the extreme of insanity!


কবিতাটা পড়তে পড়তে আপন মনে হেঁটে যেতে যেতে আজ অন্যরকম ভালো লাগছে তার। তার মনে পড়ল যে অনেক দিন আগে কনফুসিয়াস নামের এক পণ্ডিতের কথা সে পড়েছিল। সে দারুণ একটা ভালো কথা বলেছে, কিন্তু কথাটা যেন কি? ভেবে ভেবে কথাটা সে খুঁজে পেল :
মহিমান্বিত মানুষেরা ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে চিন্তিত
আর ক্ষুদ্র মানুষেরা ভাবিত তাদের আরাম-আয়েশ নিয়ে।

‘নিশ্চয়ই এরকম আরও অনেক কথা তিনি বলেছেন’, রহমানের মনে হলো। ‘কিন্তু এ কথাটা কেন মনে হলো এখন? কবিতাটার সঙ্গে এ কথার কি কোনো মিল আছে?’, তার চিন্তা দ্রুত দ্রুত তাদের গতিপথ বদলাতে থাকল।

আবার সে অফিসের পথে নিয়মিত পা ফেলতে লাগল। যতক্ষণ সে অফিসে থাকে ততক্ষণ তার মাথার ওপর উদ্বেগ আর মানসিক নির্যাতনের বোঝা ভিড় করে। তার ভিতর সেই আশ্বাসবাণীটা এক-আধবার এসে উঁকি দিয়ে যায়। সে ভাবতে থাকে, ডাক্তার কি আর আসবে? যেহেতু তিনি ঠিকানা নিয়েছিলেন, রহমান আশা খুঁজে পায়।

এরকম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার একটি দিনে সত্যিই তরুণ সেই ডাক্তার এসে হাজির। সে তাকে নিয়ে তাদের পরিচালকের কাছে গেল। সব শুনে পরিচালক তার বৃদ্ধ মন ও মগজ নাড়িয়ে বললেন, সত্যিই ভাববার মতো ব্যাপার। এমন অমানবিকতা তো ঘটতে দেয়া যাবে না! ডাক্তার তার নিজের বক্তব্যটা আবার বললেন, প্লিজ, এরকম আচরণ যদি তার সঙ্গে আবারও করা হয় অথবা করা হতেই থাকে, আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়াক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে।

রহমানের ওপরওয়ালা বস পরিচালকের সব কথা শুনে হাসিতে সয়লাব হয়ে গেল। ‘এখনও বুঝতে পারেননি স্যার!’ সে বলে গেল, ‘একটা স্রেফ দুই নম্বরি। ওই রহমান একটা আস্ত হারামজাদা! আপনার কর্মচারীদের ইচ্ছামতো ধমক না দিলে, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করলে ওরা কাজই করবে না!’ সে তার বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করতে একটা ঢিল ছুড়ল, ‘সেই ডাক্তার অল্পবয়স্ক না স্যার?’ ‘হ্যাঁ’ পরিচালক বলল, ‘কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝলেন?’ হা হা হেসে সে বলল, এসব আমার এক তুড়ির কাজ। ও ডাক্তার না ছাই। এরকম ডাক্তার রাস্তার অলিতে গলিতে দু-দশ টাকায় কিনতে পাওয়া যায়।

এ ঘটনার পর রহমানের ওপর তার দুর্ব্যবহারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল।
এখন থেকে অফিসের নিয়মিত কাজ ছাড়াও রহমানকে তার বসের ফ্ল্যাটের বিদ্যুৎ বিল, পানি বিলের পাওনা ব্যাংকে গিয়ে পরিশোধ করে আসতে হয়। অনেক সময় তার জুতো পালিশ করার জন্য হাতের নাগালের কোনো পিয়নকে না পাঠিয়ে লোকটা রহমানকে পাঠায়। সব কাজ সে করে আর করার শেষে রহমানের কানে নির্মম ও কর্কশ সব শব্দ ছুড়ে দেয়। সেসব শব্দ রহমানের শ্রবণ-ইন্দ্রিয় পেরিয়ে বিকট হয়ে আছড়ে পড়ে তার মস্তিষ্কের পাদদেশে। এভাবে যখন সে বেদনায় মুষড়ে পড়ে তার মনে হয় মার কথা। মা যদি বেঁচে থাকত! আফসোস হয় তার। বাবার কথা মনে পড়লেই সে ভাবে, আহা! মানুষটা যদি জানত শিশুদের ওভাবে ধমক দিতে হয় না, তাহলে কি সে তা করত?

এভাবে ভাবতে ভাবতে সে অফিস থেকে বাসায় আসে, বাসা থেকে অফিসে যায়। মাঝে মাঝে সেই আত্মীয়ের বাড়িতে যেতেও ইচ্ছা করে তার। কিন্তু ইচ্ছাটা হলে সেই সঙ্গে একটা ভাবনাও হয় রহমানের, অযথা যাওয়া! হয়তো ওরা বিরক্তই হবে! সে আর ওদিকে পা বাড়ায় না।

এভাবে এরকম করে যখন তার জীবন বয়ে যাচ্ছে তখন একদিন তার ওপরওয়ালা তাকে এতটাই পীড়িত করল যে মাথাটা তার কাছে ফাঁকা ফাঁকা লাগল। দুপুরে খাবার সময় সে খেতে গেল না। আপন মনে তার কান্না এসে গেলÑ আহ! কী অনিষ্টে ভরা দুনিয়া এটা!

সে যখন এমনি করে আহত হচ্ছে, আফসোস করছে, তখন অফিসের আরেকজন তরুণ সহকর্মী তাকে বলল, ভাই, এরকম করে লাভ নেই। কুত্তাটার পাছায় সবার সামনে লাথি দেবেন, দেখবেন পরের দিন থেকে সব ঠিক। রহমান তার ওপরওয়ালাকে লাথি দেয়ার কথা বিকারেও ভাবেনি। সে অবাক হয়ে তার সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে থাকল। লোকটা তার অবাক হওয়াটা লক্ষ করল না। সে বলেই গেল, খানকিটার পাছায় লাথি দেয়া খুব সহজ, ইচ্ছা করলে আপনি বাঁশও দিতে পারেন। ধরেন, কালকে পাছায় লাথি দেবেন। আজকে গিয়ে পরিচালকের কাছে ওর বিরুদ্ধে নালিশ করে আসবেন। যা ইচ্ছা ওর বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে বলবেন। মাঝখানে পরিচালককে খুশি করার জন্য একটু প্রশংসা করবেন। ব্যাস আর কিছু না। তারপর শুধু এইটুকু বলবেন, স্যার, দেখবেন উনি আমার বিরুদ্ধে কমপ্লেন করবেন, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও করতে পারেন। তারপর কালকে অফিসে কয়েক ব্যাগ মিষ্টি এনে সবার মাঝে বিতরণ করবেন। বলবেন যে আপনার জন্মদিন। ঠিক তারপরে কুত্তাটা যখনই আপনার সঙ্গে ঘেউ ঘেউ শুরু করবে, তখনই কষবেন লাথিটা। দেখবেন আপনার কিচ্ছু হবে না।

রহমানের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই দেখে লোকটা অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ল। ‘প্লানটা মনে হয় পছন্দ করলেন না?’ সে বলল। ‘এটা একটা খারাপ কাজ’ রহমান বলল, ‘আমি আজীবন চেষ্টা করেছি নিজের ভিতর ভালো সব অভ্যাস গড়ে তোলার। এখন তো চেষ্টা করলেও আমি এটা করতে পারব না!’ লোকটা এমন কথায় হতাশ হয়ে বলল, তাহলে আপনার যা ইচ্ছা করেন। তবে আমার সঙ্গে এরকম করলে ওর পাছায় আমি এমন বাঁশ দিতাম যে এ জীবনে ও আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারত না। একটা আস্ত শুয়ার, অশ্লীল জানোয়ার।

‘এ জীবনে আর হয়তো হবে না’, ভাবতে ভাবতে রহমান তার ওপরওয়ালাকে বলেই ফেলল, স্যার! আপনি যে আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করেন এতে আমার খুব কষ্ট হয়। অনুগ্রহ করে এরকম আর করবেন না। তার কথায় লোকটা হেসে দিলো। নিপীড়ন করার পশুত্বময় আনন্দটা তার চোখে-মুখে চকচক করতে থাকল।

একদিন শেষবেলায়, অফিস ছুটির আগে আগে, রহমান তার প্রিয় সেই কবিতাটা পড়ছে মনে মনে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে সে সেটা ভাবছে। তখন সেই মানুষটা তার পরিকল্পনামাফিক রহমানের কানের কাছে মুখ নিয়ে জোরে চিৎকার দিলো। বকাবকি শুরু করল। অনর্থক কুকথা বলে রহমানের শরীর ও মনের যোগাযোগ-সেতুটাকে তীব্রভাবে আহত করল।

রহমান কিছুক্ষণ বুঝতেই পারল না কী ঘটছে। যখন বুঝতে শুরু করল তখন বুঝতে পারল যে তার মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সে তার চিন্তাগুলোকে একটার পর একটা সাজাতে পারল না। কয়েক মুহূর্ত সে চেষ্টা করল কিন্তু কোনো ধরনের কোনো ধারাবহিকতা সে তার অস্তিত্ব, কর্ম ও চিন্তার ভিতর ফিরিয়ে আনতে পারল না।

সে তার কাজের টেবিলের ওপর দু হাতে মাথা রেখে চেয়ারে বসে পড়ল। লোকটা তখনও সেই একই কথা বলতে লাগল, কি ব্যাপার? কথা কানে যাচ্ছে না? রহমান তড়িতাহতের মতো সবেগে উঠে দাঁড়াল। তারপর তার এক পায়ের জুতো খুলে চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে তার থেকে দীর্ঘ তার ওপরওয়ালার মুখে প্রবলভাবে আঘাত করল। সারা অফিস নীরবতায় ডুবে গেল।

রহমান ধীরে ধীরে তার চেয়ার থেকে নেমে জুতোটা সেই ওপরওয়ালার কাচের ঘরে ছুড়ে দিয়ে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে লালাভ চোখে হাঁটতে হাঁটতে অফিস থেকে পথে নেমে এল।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:০৫

কলমের কালি শেষ বলেছেন: গল্পটা ভালো লাগলো । ++

১০ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:১০

আবু সিদ বলেছেন: মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.