![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুই প্রান্তের দুটি পথ এখানে এসে মিলেছে। এখানকার বেশ হৈ-হট্টগোল ভরা বাসস্ট্যান্ডটা ধুলোয় ডুবেছিল সপ্তা কয় আগেও। এখন শীত এসেছে আর চারধার কেমন যেন নিজের নিজের ভিতর গুটিয়ে গেছে। এখান থেকে দক্ষিণ দিক বরাবর চলে গেছে একটা নতুন আবাসিক এলাকার পথ। এ পথে ঢুকলে যে কারও মন ভালো হয়ে যায়। পথের দু ধারে সবুজ গাছ সারি সারি। তার ভিতর পথের ধারে একটা দিঘি, ফলের বাগান আর একটা শালবন। শালবনের আগে-পরে সব বাড়ি নতুন। বাড়িগুলো রঙ করা ঝকমকে, আধুনিক স্থাপত্যকলায় অলঙ্কৃত। কেবল একটা বাড়ি, যে বাড়িটার চারধারে আছে এই শালবন, সেটি পুরাতন। এ বাড়ির জনমানুষ সম্বন্ধে তাদের প্রতিবেশীরা জানে না তেমন। তারা শুধু দুটো চাকরের পেছনে একটা বিদেশি কুকুরকে ঘুরে বেড়াতে দেখে। সেটাও সব সময় নয়, যখন চাকর দুজন কিছু কিনতে যায় তখন। এছাড়া খুব ভোরে যারা হাঁটে তারা শালবনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শোনে একটা নারীকণ্ঠ। কণ্ঠটা প্রতিদিন ভোরে একটাই গান করেÑ
তুমি আমায় জাগালে কতো
আলোর মতো
রাজপ্রাসাদে...
১
তারা কেবল এই কণ্ঠটা চেনে। কন্ঠটাকে তাদের চেনা যেন পথের ধারে ফুটে ওঠা ফুলের চেনা সুবাস। এছাড়া মধ্যরাতে খুব চকচকে একটা দামি গাড়ি এসে বাড়িটার লৌহফটক পেরিয়ে তার হৃৎপিণ্ডের কাছে পৌঁছে যায়। তখন বাড়ির ভিতর নতুন করে জাগে প্রাণ। সমস্তদিনের জীবনের থেকে এ জীবন অন্য। বাড়িতে যারা থাকে তারা সবাই আনমনে অন্যরকম হয়ে যায়। বাড়ির মালিক পঞ্চাশোর্ধ, ভয়ঙ্কর সব আচরণ শুরু করেÑ আর রাতের শেষ প্রহরে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
খুব ভোরে যে নারী তার আপন মনে জেগে ওঠে ‘রাজপ্রাসাদে’, তাকে একটা হুইল চেয়ারে করে আনা হয়। সে একজন বিকলাঙ্গ। তাকে শিকলে বন্দি করে রাখা হয় সমস্তটা সময়। কিন্তু বাড়ির প্রভুটা যখন ঘরে ফেরে তখন সেই কমনীয় মুখের শ্রাবণধোয়া মেয়েকে মুক্তি দেয় তারা। তারা তাকে বিছানায় ফেলে চলে যায়। প্রভুটা তাকে নিয়মিতভাবে ধর্ষণ করতে থাকে। রাতের শেষ প্রহর নাগাদ সে সেই একই কাজ করে। মেয়েটা রাতের কালি চোখে নিয়ে খোলা জানালার ধারে আসে তার হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে। তারপর চিৎকার করে বলে, কাকা! এইবার মুক্তি দাও!
জীবনীর এই আর্তচিৎকার কখনও কাকার কাছে গিয়ে পৌঁছয় না। কাকা চলে যায়। চারদিকে সূর্য জেগে ওঠে, মানুষেরা পথে হাঁটে, আর, সে গান করেÑ
ঘুমের থেকে জাগালে আমায়
মিথ্যা স্বপ্ন হতে...
২
জীবনী যেবার এ বাড়িতে প্রথম এসেছিল ওর বয়স ছিল ছয় বছর। ও এসেছিল ওর মা-বাবার সঙ্গে। বাড়িটা ছিল পুরনো দিনের একটা জমিদারবাড়ি। ভারতভূমি খন্ডনের ফলে বাড়ির মালিকরা সব দিল্লী চলে যান। জীবনীর বাবা বাড়িটা কেনেন তখন। তার বছর দুই পর তারা এখানে নিয়মিত বসবাস শুরু করে। এখানে থাকতে শুরু করার তিন বছরের মাথায় জীবনীর এক জ্ঞাতি কাকার সঙ্গে তার মা আমেরিকা পালিয়ে যান। জীবনীর বাবা সে বছরের শেষ নাগাদ মারা যান। তাকে মৃত পাওয়া গিয়েছিল গোসলখানায়। আইন ও আদালত কয়েক দিনের মধ্যে জানিয়ে দেয় যে বাড়িটা জীবনীর। তবে তিনি প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত কাকা হবেন তার অভিভাবক। কাকাই দেখাশোনা করবেন এই সম্পত্তির।
সেই যে তার বাবা গেলেন, তিনি কিছু বলে গেলেন না। অবশ্য মা তার উদ্দেশ্য একটা বাক্য রেখে গেলেনÑ
আমার মামণি, এই পৃথিবীর সব্বার থেকে
তোমাকে বেশি ভালোবাসি।
বাক্যটাকে জীবনী আজও সঞ্চয় করে রেখেছে। মাঝে মাঝে সেটা সে পড়ে আর হাসে। ভাবে,
ঘুমের থেকে জাগিয়ে দিলে
মিথ্যা স্বপ্ন হতে ...
৩
তার বয়স যেবার আঠারো পূর্ণ হলো কাকা বললেন, আমি তোমাকে বিয়ে করব। এতে করে সম্পত্তিটা আমার হবে আর তোমার মতো একটা চকচকে মাখনের টুকরো আমার ভোগে আসবে। ‘কিন্তু কাকা! আমি তোমার মেয়ের মতো।’ ‘চুপ কর! তুই আমার কেউ নস। তুই ওই বেজন্মা শয়তানটার মেয়ে যার সঙ্গে তোর মা পালিয়েছে। অবশ্য তুই তোর বেশ্যা মায়ের মতো অনেক ভালো ছেনালি জানিস। আর এ কারণেইÑ হাঃ হাঃÑ তোকে বিয়ে করব আমার মিষ্টি আঙুর।’ ‘আমি সব সম্পত্তি তোমার নামে লিখে দিচ্ছি; এর জন্য বিয়ে করার দরকার নেই।’ জীবনী সমস্ত বাড়িটা বাগানটা কাকার নামে লিখে দিলো।
সম্পত্তিটাকে নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন ভেবে কাকাটা কাঠবিড়ালীর মতো লাফালাফি করল কিছু দিন। তারপর একরাতে এসে বলল, ‘তোমার মতো একটা শিশিরবিন্দুকে যদি ভোগ না করতে পারি তাহলে জীবনের মানে কী?’
জীবনীর কাছে জীবনের অন্য মানে ছিল। সে প্রেমে পড়েছিল, ভালোবেসেছিল। ভেবেছিল যে একদিন এক রাতের অন্ধকারে সে এই বাড়ি ছেড়ে পালাবে। একটা ছোট ঘর হবে তার; এত অর্থবিত্ত সম্পত্তির দরকার কি? ‘দুজন মিলে সুখী হব আমরা’। কিন্তু সে সুখী হতে পারল না, পালাতে পারল না। রাজপ্রাসাদ থেকে একাধিক বুলেট ধেয়ে এল তার দিকে। তাকে বিকল করে দিয়ে জগতের সমস্ত আয়োজন পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল।
তারপরও সে কাকাকে অনুনয় করল। বলল, ‘আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব; তুমি শুধু আমার থাকা-খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দাও। আমি লোকের বাড়ি বাড়ি ঝি-গিরি করে পেটের ভাত জোগাড় করতাম যদি খোঁড়া হয়ে না যেতাম।’ কাকা তার সে কথায় রসিকতা করল, ‘কেন? তোমার নাগর? মধু খাওয়া শেষ তাই ভ্রমরের আর দেখা নেই! তা ওর-ই বা কী দোষ। এই-ই তো হচ্ছে! এটাই তো জগতের নিয়ম।’ কাকা তার হাত নাড়িয়ে চোখ পাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তাতে আর অসুবিধা কী। এখন থেকে আমি তোর নাগর; তোর মধু এখনও অনেক সরেস।’ তারপর সে জীবনীর পোশাক এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলল। তার ভিতর প্রবেশ করতে করতে বলল, ‘তুই এই কথা ভেবে কষ্ট পাসনে যে আমি তোর কাকা। আসলে তোর বাপ ছিল একটা ধ্বজভঙ্গ, নপুংসক। ও-ন্যাকা তোর বাপ হবে কি করে? আমি অবশ্য তোর মার দোষ দিইনে। ওরও তো শরীর আছে একটা, নাকি বলিস?’ ‘অবশ্য তুই একটা খাসা মাল’Ñ তার শরীর থেকে বেরোতে বেরোতে সে বলল।
জীবনী ক্রমাগত মুষড়ে পড়ল। কেবল ‘পেটের ভাত’-এর জন্য সে শিকলে বন্দি হলো, যেমন প্রতিদিন হয়ে থাকে এই পৃথিবীর লাখো মানুষ। সে কোনো বন্ধুর দেখা পেল না, কোনো আশ্রয়ের সংবাদ শুনল না। মস্ত এই পৃথিবীটা কামনার প্লাবনে ভেসে গেল। এভাবে দিনে দিনে ভেসে যেতে যেতে সে এই বাড়িতেই এক চাকরানিকে আবিষ্কার করল। সে নারীর চোখে ছিল স্বপ্নের ছোঁয়া, আশার খড়কুটো, যেটা ধরে জীবনী জীবননদীতে না ডুবে মরণ সাগরে ভেসে যেতে পারবে অবলীলায়।
জীবনী দিনরাত ভাবল। অনেক ভেবেও সে আগন্তুকপ্রায় সন্তানটির জন্য কোনো ভালো সম্ভাবনা দেখতে পেল না। সে ভেবে দেখল, সে যদি কাকাকেও বিয়ে করে তবু তার সন্তানটির ভালো হবে না। কাকার স্বভাবচরিত্র ইতিবৃত্ত হাড়ে হাড়ে জানা আছে তার। ‘তাহলে কি করতে পারি আমি? আমার জীবন তো কালোয় ঢাকা। আহা! আরও একজন মানুষ জগতের আগুনে জ্বলবে!’
‘না, তা হয় না; হতে দেয়া যায় না।’ প্রতিজ্ঞা করল সে।
৪
দিনটা শরতের। কষ্টগুলো সহ্য হচ্ছে না। জীবনকে মৃত্যুর যন্ত্রণার থেকেও ক্ষতিকর আর যন্ত্রণাদায়ক মনে হচ্ছে। জীবনী অনেক কাকুতি-মিনতি করল কিন্তু মায়া বলল, আমিও তো মানুষ; আমারও তো দয়ামায়া-ভালোবাসা আছে। জীবনী অনুনয় করল, আমার এই উপকারটা তুই কর!
আজ দিনভর মায়া একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে মদ খেল; সারাদিন এবং সন্ধ্যাভর আচ্ছন্ন হয়ে রইল। বলল সে, আমি জানি এতে আমার ঘোরতর পাপ হবেÑ জাহান্নামেও জায়গা হবে না আমার; আমি পুড়তে থাকব নরকের আগুনে। তবু বোন, তোমার ভালোর জন্যে আমি তা করব। সে জীবনীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
শেষ রাতে মায়া জেগে উঠল। চারদিকে দিনের আগমনী আভাস। সে জীবনীর ঘরে গিয়ে দেখল যে জীবনী কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে, মুখের এক পাশে তার কোঁকড়ানো চুল। তাকে দেখে মায়ার মায়া হলো। ভাবল, থাক। তার মুখে একটা চুমু খেল সে। ‘নাহ!’ নিশ্বাস ফেলল সে, তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আরেক বোতল মদ খেল।
এতক্ষণে জীবনী জেগে উঠেছে। বসে আছে সে তিনতলার খোলা বারান্দায়। মায়া এলো রক্তচক্ষু আর টলায়মান পা নিয়ে। সে জীবনীর কাছে ক্ষমা চাইল আবার। জীবনী মায়ার কথায় হেসে উঠল। বলল, ক্ষমা করার মালিক তো আল্লাহ। এতে তোর পুণ্য হবে। তুই জানিস না যে তুই আমার কত বড় উপকার করছিস! তুই একজন মানুষকে নরক থেকে মুক্তি দিচ্ছিস। ‘আমি একবার গানটা গাই, তারপর, হ্যাঁ?’
জীবনী তার বহু দিনের বন্ধু গানটা গাইল,
তুমি আমায় জাগালে কতো
আলোর মতো
রাজপ্রাসাদে।
ঘুমের থেকে জাগালে আমায়
মিথ্যা স্বপ্ন হতে;
কাটিয়ে দিলে জীবনের মোহ
মায়া বিভ্রম ভ্রান্তি যতো...
তার গাওয়া শেষ হলো না। মায়া অনুধাবন করল যে, সে যদি এখনই কাজটা না করে তাহলে হয়তো আর কখনই তা করা হবে না। জীবনী কিছু বুঝে উঠবার আগেই মায়া তাকে প্রাণপণ ধাক্কায় নিচে ফেলে দিলো।
প্রাতঃভ্রমণকারীরা এক তরুণীর রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখল দূরের থেকে। তারা কাছে এল না। চিরদিন তারা যেমন ওই প্রভাত-সঙ্গীত থেকে দূরে থেকেছিল, আজও তারা সেই সঙ্গীতের জীবনীকারের থেকে দূরে রইল। তারা এবং বাকি জগৎ কেউই জীবনীর ইতিবৃত্ত জানল না। কেবল মায়া জানল, জীবনে যে মরে ছিল মরণে সে বেঁচে গেলো।
©somewhere in net ltd.