![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই বিশ্বলোকের কোন মানুষই ত্রুটিবিচ্যুতির উর্দ্ধে নন। নিজের হাজারো গুণের সাথে বানরের ঝুলন্ত লেজের মতো তার ত্রুটিবিচ্যুতি তাকে ব্যঙ্গ করে ঝুলতে থাকে। তবে বানরের লেজ কাটলে তার বানরত্ব খর্ব না হলেও তাকে বানর বলে চিনতে কষ্ট হয়। মানুষের বেলায় তা নয়। সে তার ত্রুটিবিচ্যুতির লেজটাকে যত বেশি ছোট করে তার মনুষ্যত্ব তত বাড়ে, মানুষ বলে তাকে তত ভালো চেনা যায়। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মানুষেরা এই কথাটাকে চরম সত্য বলে গ্রহণ করে আসছেন আবহমান কাল ধরে। সবাই চান নিজের দোষ ত্রুটি কমিয়ে আনতে। তবে অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভব না হলেও আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের ত্রুটিবিচ্যুতিকে গোপন করার চেষ্টা করি, এবং অনেক ক্ষেত্রে সফল হই। কিন্তু মনের গভীর উপলব্ধিকে যেমন গোপন করা যায় না, যেমন মেঘের আড়ালে গোপন করা যায় না সূর্য-রক্তিম-রশ্মিকে তেমনি নিগূঢ় মানব স্বভাবকেও গোপন করা যায়না। তা ছড়িয়ে পড়ে।
অনেক কাল আগে বলা হতো, বাঙালী অতিথিপরায়ণ। সে-কথা ভিনদেশী পরিব্রাজক, স্বদেশী সাধু-সন্ত-ভিক্ষুক গৃহস্থ সবাই একবাক্যে স্বীকার করতেন। আজকাল সবাই স্বীকার না করলেও আশঙ্কা করছেন যে বাঙালী দুর্নীতিপরায়ণ। কথাটা পৃথিবীর সব রাজপথে তো বটেই উপরন্তু অন্ধ সব অলিগলি অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য এই কথা যখন আমরা বাঙালীরা শুনি তখন রীতিমত গর্জন শুরু করি, হ্যাঁ, এত্তো বড় কথা!
আসলে কথাটা বড় কোন কথা নয়, এটা ¯্রফে বাঙালীর সম্পর্কে বাঙালী এবং জগতবাসীর ধারণা। ধারণাটা যে মিথ্যে তা তো নয়। আমরা, বাঙালীরা, যদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আচার-বিচার-ব্যবস্থা আহার-বিহার-বিনোদন এসব লক্ষ করি তবে সত্য আর লুকিয়ে থাকতে পারবে না। আর যদি বা বাঙালী দুর্নীতিপরায়ণ হয়ও তাতেও তো আক্ষেপ করে কোন ফল নেই। বরং ধারণাটাকে বদলে দেয়া সম্ভব দারুন সব কাজ করে। কেন, বাঙালী কূলে কি জন্ম হয়নি আচার্য অতীশ দীপঙ্কর শ্রী জ্ঞান-এর? কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ বা জগদীশচন্দ্রের মতো মানুষের? হ্যাঁ, তাইতো। বটেই তো! কোন কানা মল্লিক বাঙালীকে ছোট বলে, এ্যঁ? পঙ্কে পঙ্কজ জন্মে বটে কিন্তু তাই বলে পাঁক আমাদের কারো কাম্য নয়। আমাদের কাম্য পুষ্প কানন; নিজেদের জন্য আর সমস্ত জগতের জন্য। কিন্ত নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিশ্বজগতের আয়োজনে আসা তো মুখের কথা নয়, তা কর্ম সাধনার ফল। সেই কাক্সিক্ষত ফসলে জীবন ভরাতে গেলে আমাদের জানতে হবে মহাজাগতিক জীবন থেকে কত বেশি পিছিয়ে আছি আমরা। বুঝতে হবে জগত ধারার তাল-লয়-সুর। তা না হলে অনাগত ভবিষ্যতও আমাদের ওপর দুর্নাম ছুড়ে মারবে যেমন দুর্নাম নিয়ে কয়েকশ বছর ধরে ধুঁকতে ধুঁকতে মরছে বাঙালী। জীবনের এই অভিসম্পাত থেকে কি মুক্তি নেই তবে? নিশ্চয় আছে, নিশ্চয় আছে। তবে সেই মুক্তি ঝাড়-ফুক তাবিজ-কবজ কিঙবা ওঝা-কবিরাজ দিতে পারবে না। সেই মুক্তি মিলবে আমাদের চেতনার সত্যে, কর্মের ধর্মে।
কেমন হবে সেই চেতনা? কি রূপ সেই কর্মের? ভালোভাবে তা জানতে হলে মিছে অহঙ্কারে ডুবলে চলবে না আমাদের। শূন্য ঘরকে দীনতা ভরে প্রকাশ করলেও চলবে না। তার জন্যে প্রথমে অনুসন্ধান করতে হবে আমাদের দোষ ত্রুটিকে। নিজেদের দোষের বিষয়ে যত দিন আমরা অন্ধ থাকব ততোদিন গুণের আলোচ্ছটা আমাদের জীবনে ধরা দেবে না।
কথাবার্তা ও আলাপচারিতাঃ আমাদের কথাবার্তা অত্যন্ত অসংযত ও অসংলগ্ন। এতে আমাদের উগ্র স্বভাবের রূপটি ধরা পড়ে। বোঝা যায় যে আমাদের ব্যবহৃত বাক্যের মতোই আমাদের চিন্তা সুগোছালো নয়। অন্যকে সম্মান দেখিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে কথা বলতে আমরা একপ্রকার অপরাগ। কথায় কথায় আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি। নিজেকে আমরা ‘প্রায়-দেবতা’ মনে করি আর অন্যদেরকে তার চাকর বাকর ভাবি। এটা আমাদের হীনমন্যতার সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক পরিচয়। আমরা যখন দোকানদার হয়ে দোকানে বসি তখন নিজেকে একজন স¤্রাট ভাবি, ক্রেতাদের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করি। উকিল হয়ে আদলতে কোন মামলা লড়লে নিজেকে জগতশ্রেষ্ঠ ভন্ড ভাবি। সেখানে আচ্ছা মতো বাজে কথা বলি এবং যাচ্ছেতাই ভাবে বকবক করি। শিক্ষক হয়ে কিছু শেখাতে গেলে নিজেকে একজন অ্যারিস্টটল ভিন্ন অন্য কিছু মনে হয় না। আবার যদি লোকপ্রশাসন বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের পিয়নের পদ পাই তখন নিজেকে একজন প্রধানমন্ত্রীর মতো ক্ষমতাময় মনেকরি। আর এইসব প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা হলে অন্যের আনুগত্য করতে করতে ক্রীতদাসে পরিণত হই।
ঘরেও আমরা পরিশিলীত নই। বয়স্ক মানুষ হয়ে ঘরে থাকলে নিজেকে একজন ঈশ্বর মনে হয়। সবার ওপর হুকুম চালাই, নিজের ছোট কাজটাও নিজে করতে চাই না।
উপদেশ দিতে এবং নিতে আমাদের খুব ভালো লাগে। আমরা বলি, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’, কিন্তু মিথ্যে বলতে আমরা যথেষ্ট দক্ষ। আমরা আল্লাহ ঈশ্বর ভগবানের নাম বলতে বলতে অন্যের ক্ষতি করি কিন্তু সেই নাম নিয়ে কারও ভালো করার চিন্তা আমাদের মাথায় আসে না। বরং কারও মঙ্গল দেখলে তাকে হিংসা করি, তার জন্য বরাদ্দ করি বদ-দোয়া। অন্যের ক্ষতির চিন্তা করতে করতে আমাদের দিন রাত মাস বছর পার হয়ে যায়। আমরা না পারি নিজের ভালো করতে আর না পারি অন্যের উপকারে আসতে। প্রতিদিন নিজেকে আমরা অনেক অকথা কুকথা এবং অপকর্মে বিফল করে তুলি। প্রতিরাতে ঘুমতে যাবার আগে তাই সে আক্ষেপ করি, না, কিচ্ছু হলোনা। জীবনডা মিছে।
আমরা কথাও বলি খুব বেশি। আমাদের ধারণা, বেশি কথার মধ্য দিয়ে অর্থ যশ ক্ষমতা জ্ঞান সবকিছু প্রকাশিত হয়। অবশ্য সে-কথা কোন চমৎকার সংলাপ নয়, তা শুধু অর্থহীন অপলাপ। আমাদের চিন্তার দারিদ্র আনন্দ-উৎসব ঠাট্টা-তামাশা দেখে বোঝা যায়। যে কোন আনন্দে আমরা অযথা চিৎকার চেঁচামেচি হৈ হুল্লোড় করি। রসিকতা করতে শুরু করলে আমরা গালিগালাজ করি যেন গালিগালাজ ছাড়া রসিকতা করাই যায় না।
আমাদের মধ্যে জ্ঞানগর্ভ কথার চর্চা খুব কম। বাজে আড্ডায় আমাদের ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় কিন্তু জ্ঞানের কথা বলে আমরা আলোচনা চালাতে পারি না।
আমাদের কাছে টাকা-কড়ি-অর্থ জীবনের একমাত্র মানদন্ড, তা সে যে প্রকারে উপার্জিত হোক। ছিন্ন মলিন পোশাকের যে কাউকে আমরা ‘তুই’ দিয়ে তাচ্ছিল্লভরে সম্বোধন করি। নিজের চেয়ে কম আয়ের মানুষদের আমরা হীন চোখে দেখি। আমরা সবসময় অন্যকে ধোঁকা দেয়ার সুযোগ খুঁজি। কাউকে ধোঁকা দিতে পারলে আমরা নিজের বুদ্ধি নিয়ে বড়াই করি যেন অন্যকে ঠকানোর মধ্যে মানব জীবনের মহত্ত্ব নিহিত!
নঞার্থক জীবন দৃষ্টিঃ আমরা, বাঙালীরা, জীবনকে নেতিবাচকভাবে দেখে থাকি। আমরা জীবনের থেকে মৃত্যুকে বেশি মহিমন্বিত মনে করি তাই জীবন ও জীবনের আয়োজন আমাদের নড়বড়ে। যেকোন কাজই আমরা যেনতেন ভাবে করতে চাই। আমরা জানি না যে ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ও বৃহৎ প্রত্যেকটি কাজই হয়ে উঠতে পারে মহিমান্বিত যদি আমরা তা তেমন করে করতে পারি। আমরা জীবনকে কোন মহৎ প্রাপ্তি হিসেবে আজও গ্রহণ করতে শিখিনি; তাই কোন কিছুতে ব্যর্থ হলে হতাশার কবরে শুয়ে পড়ি। সেখানে শুয়ে শুয়ে ভাবি, ‘ওই হারামজাদার দোষ। তা না হলে আমিই জিততাম। যদি কোন ‘হারামজাদা’র দেখা না মেলে তাহলে আমরা ভব,ি ‘ভাগ্যডাই খারাপ। শালা, কেন যে জন্মাইলাম!’ অথচ জন্ম কোন তুচ্ছ ঘটনা ছিল না। যে কোন জন্মই অজ¯্র স্বপ্ন-সম্ভবনার ফসল।
স্বপ্ন-সম্ভবনাকে আমরা বুকের জমিনে প্রাসাদ করে গড়ে তুলতে শিখিনি। আমরা মনেকরি, ব্যর্থতাই সাফল্যের সোপান (ঋধরষঁৎব রং ঃযব ঢ়রষষধৎ ড়ভ ংঁপপবংং) । কবে কে এমন একটা কথা নির্মাণ করেছিল আমরা সেটাকে জীবনের ধন ভেবে পুজো করে চলেছি। আসলে ব্যর্থতা কখনও সাফল্য এনে দেয় না। সাফল্য এনে দেয় নিবিড় সাধনা বা পরিশ্রম। ক্রমাগত ব্যর্থতার পরও যারা দমে যান না তারাই সফল হন। ব্যর্থতা নয়, সাধনাই সফল করে মানুষকে।
নগদ সাফল্যর ঝোঁক আমাদের এত বেশি যে কোন সাধনাতেই আমরা স্বার্থক হয়ে উঠতে পারি না। পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁস বা নকল করা আমাদের কাছে শ্রেষ্ঠ উপায়। অথচ নকল করে প্রথম হবার থেকে জ্ঞান সাধনা করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হওয়া অনেক ভালো। সাধনা আমাদের নগদ সাফল্যকে সংকুচিত করে দিলেও আখেরে তা ভালো ফল দেয়। কিন্তু আমরা ভবিষ্যতের কথা ভাবতে চাই না। ভালো চাকরী পেতে যোগ্যতাকে নয় ঘুষ-কে আমরা অবলম্বন ভাবি যদিও জানি একজন অযোগ্য কর্মী কখনও একজন যোগ্য কর্মীর সমান নয়। যিনি ঘুষ দিচ্ছেন বা নিচ্ছেন তিনি যদি ভাবতে পারতেন যে এতে ভালো যতটা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে খারাপ। সমাজকে, তথা নিজেকে, নিজের পরবর্তী বংশধরদেরকে অস্থিতিশীল ও অমঙ্গলকর পরিণতির বৃত্তে আমরা আবদ্ধ করে চলেছি, এটাই আমাদের নঞার্থকতা।
আমরা যদি জীবনের স্বার্থকতার কথা ভাবতাম তবে ঘুষ বা দুর্নীতির মুখে চপেটাঘাত করতাম। নিজের কষ্টকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে সাফল্যের সোনায়মোড়া ভাবিতব্যের কথা ভাবতাম!
বাঙালীর সম্পদঃ হুজোগ হলো কর্মহরণ, হুজোগ হলো কর্মনাশ। মিথ্যের হুজোগে যার সত্য টুটে যায় তার আর বাকি থাকেনা কিছু; না তার নিজের কিছু না ধারকরা কিছু।
হুজোগ ছাড়া নিজের বলতে আর কিছু আমাদের নেই। অবশ্য ধার করতে আমরা খুব গর্বিত। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ধার নিয়ে বুভুক্ষের মতো আমরা গিলে ফেলি। আর এই ’মহৎ’ কর্ম যেসব বাঙালী করতে পারি আমরা বাদ বাকিরা সুযোগ পেলে তার জুতোর সুখতলাও চেটে দিই। ঋণের টাকা ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারি না তবু ঋণ করেই যাই ।
এই বিশ্বলোকের কোন কিছুকে আমরা আপনার করে পাইনি। সব কিছুতে আমাদের গা ছাড়া ভাব। আমরা ভাবি যে এই কর্মলোকে আমাদের ভূমিকা নিতান্ত চোরের, ধরণী গৃহস্থালীতে আমাদের আপনার কোন অধিকার নেই! হয়ত সে কারণে আমরা কিছু অর্জন করতে চাই না। সম্ভবত ভাবি, ‘অর্জন কোরে হবে ডা কী! কোনমতে চুরি-চাট্টা করে যে কদিন বাঁচা যায়!’ কর্মের ধর্ম থেকে তাই আমরা থাকি দূরে।
কর্মের পথে যতই পিছিয়ে থকি লোভের আমাদের শেষ নেই। মনে আমাদের আজগুবি সব লোভ চগিয়ে ওঠে। চোর হয়েও তাই রাজা হবার লোভ। ভাবি, আমিও হব শ্রেষ্ঠ, বিশ্বের মাঝে মহাসম্মানিত!
কিন্তু সম্মান নয়, অসম্মান তাকে পিছু ধাওয়া করে। সে অসম্মানের কাপড়ে মুখ ঢেকে জীবন মরণ ভূবন চিনি।
ক্ষুধা-তৃষ্ণা-আহারঃ আমরা বাঙালীরা ক্ষুধায় খাই, ক্ষুধা না পেলেও খাই। আমরা যখন তখন খাই। স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট ধারনা নেই। আমরা মনেকরি বেশি বেশি গপাগপ খেলেই স্বাস্থ্য ভালো থাকে। স্বাস্থ্য বলতে আমরা শরীরের মাংসাধিক্যকে বুিঝ। যখন তখন উটকো স্বাদের জন্য আমাদের প্রাণ আইটাই করে। রসনার আমরা তীব্র পূজারী যদিও নানা ধরণের অজীর্ণ আমাদের জীবনের সম্বল। খাবারকে স্বাদযুক্ত করতে গিয়ে আমরা সেটার খাদ্যমান নষ্ট করে ফেলি। ভাতের মাড় গেলে ভাতের উপকারী অংশের অনেকটুকু নষ্ট করে আমরা গরুর মতো জাবর কাটি।‘খাওয়া’ বললে আমরা বুঝি পেট-ভরানো। তাই যা পাই তা-ই পেটের মধ্যে বেশি বেশি ঢুকাতে থাকি। সুযোগ পেলে পাকস্থলী ভরিয়ে কন্ঠনালী পূর্ণ করে আলজিব পযন্ত আমরা খাই।
ক্ষুধা বলতে আমরা কেবল ভাতের ক্ষুধা বুঝি, মনের তৃষ্ণা আমাদের নেই। একারণে আমাদের সব ধরণের উৎসবে ‘খাই খাই’ ভাব, কোথাও চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। হাতের কব্জি ডুবিয়ে পেট ভরিয়ে ভাত শাক মাংস কোপ্তা দই মিঠে মন্ডা আর ডাল খাই আমরা। একসময় আমরা রকমারী আচার-চাটনীও খেতাম। আজকাল অবশ্য কোকাকোলা পেপসি খাচ্ছি।
আমাদের কোন উৎসবে মননশীলতার চর্চা খুব কম। প্রত্যেকটা ‘আমন্ত্রণ’ ‘নিমন্ত্রণ’, ‘খাই-খাই’ চিৎকারে আক্রান্ত! কেউ কাউকে খুশী করতে চাইলে খাওয়ানোর প্রস্তাব দিই, কেউ কোথাও গিয়ে ফিরে এলে জানতে চাই ‘কি খাইলি?’একে অন্যের জন্য কিছু করতে সম্মত হ’লে বলি, কি খাওয়াবি? কথায় কথায় আমাদের খাওয়ার কথা। আফসোসও করি, খাওয়াইলেন নাতো! যেন জন্মাবধি আমরা অভুক্ত।
যতই খাই যথাযথভাবে খেতে আমরা আজও শিখিনি। বাঙালী খাদ্যতলিকায় কোন ক্ষুধাবর্ধক (অঢ়ঢ়বঃরুবৎ) নেই, স্যুপ বা খাদ্যপ্রাণ জাতীয় কোন তরল খাবার নেই। অথচ ভাতের মাড়ের সাথে পরিমিত লবণ আর মরিচ মিশিয়ে চমৎকার স্যুপ তৈরি করা যায়। কেবল ক্ষুধাবর্ধকের অনুপস্থিতি নয়, আমাদের পুরো খাদ্যতালিকাটাই অশ্রেণীকৃত। অর্থাৎ, কখন কী খেতে হবে, কোনটার পর কোনটা কেমনভাবে খেতে হবে সে-জাতীয় কোন চিন্তাভাবনা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। একটার মধ্যে আরেকটা, যখন খুশী তখন, যেভাবে খুশী সেভাবে আমরা খাই।
আমাদের রান্না যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর নয়। যে কোন ধরণের তরকারীতে কয়েকশ’ গ্রাম হলুদ দিয়ে রঙের বাহার তৈরি করি আমরা। একটার পর একটা মসলা ব্যবহার করে আমরা আমাদের রান্নার দক্ষতা প্রকাশ করি। মুঘল ইংরেজ পর্তুগীজ ফরাসীদের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু খেতে শিখেছি। আমরা সাধারণত অন্যের বদগুনগুলো শিখে থাকি। কয়েকশ বছর ধরে তাই আমরা তেলে গড়াগড়ি খাচ্ছি, কোমর সোজা করে ঘাড় উঁচু করে আর দাঁড়াতেই পারছি না।
আমাদের তৃষ্ণার জল ক্রমাগত দুষিত হয়ে উঠছে। বাঙলার সুপেয় জলধারাগুলি একের পর এক বিনিষ্টির ত্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে। নলকূপগুলো হয়ে উঠছে আর্সেনিকে বিষময়। পানীয় জল ছাড়া সে দুধ-মধু-আখের রস-খেজুর রস-ঘোল-বোরহানী-শরবত চা-কফি পান করে থাকি। আমাদের সকল পানীয় সঙ্গত ভাবেই পানিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের নদী খাল ঝিল বিল সবকিছুর পানি ক্রমাগত মরে যাচ্ছে। নদ নদীগুলোর বুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে দ্বীপ উপদ্বীপ বদ্বীপ ও মরুভূমি। বাঙলায় পানি এখন একটা লাভজনক ব্যবসা পণ্য।
এসবের পাশাপাশি আমরা ফলমূল খেতেও ভালোবাসি। দেশীয় ফল আম কাঁঠাল পেঁপের পরিবর্তে আপেল আঙ্গুরকে সে আমরা অভিজাত মনেকরি, এবং, সেগুলোকে শ্রদ্ধাভরে ভক্ষণ করি। দেশী আমলকী কিঙবা টমেটোর থেকে ভিনদেশী কমলালেবুর প্রতি আমাদের আগ্রহ বেশি। যাই হোক মুনাফাখোরদের ফর্মালিন বিষের ভয়ে আজকাল আমরা সেসব ফল খাওয়াও এক প্রকার ছেড়ে দিয়েছি।
সৌন্দর্য চেতনাঃ বাঙালীর সৌন্দর্য চেতনা শোচনীয় ভাবে দুর্লভ। ‘সুন্দর’ বললে আমর মানুষের সুশ্রী মুখাবয়বকে বুঝি। দৃষ্টিগত আর সব সৌন্দর্য, বনানীর অরণ্যের কাননের পাখির পশুর আকাশের আলোকের মেঘের আমরা বুঝি না। শ্রুতির সৌন্দর্য, আচার ব্যবহার অভিব্যক্তির সৌন্দর্য, ঘ্রাণ ও সংস্পর্শের সৌন্দর্য সম্বদ্ধে আমাদের ধারণা একপ্রকার নেই। ভালোবাসার সৌন্দর্যকে আমরা সংকীর্ণতার বশে প্রাণভরে উপলব্ধি করতে পারি না। আমরা পাখির ছানাকে আদর করি না, জল ও বায়ুর সংস্পর্শ পেয়ে অভিভূত হয়ে উঠি না। আমাদের আশেপাশে এরকম কাউকে দেখলে ভাবি, বোকার হদ্দ! বস্তিতে বসবাসরত হাজার হাজার বঞ্চিত শিশু আমাদের বুকে অনুভূতি জাগায়না। আমরা টলটলে শিশির কণার সৌন্দর্য বুঝতে চাই না, জানতে চাই না যে এক একজন মানুষ কতভাবে কতরকমের সৌন্দর্য ধারণ করতে পারে!
বনের গভীরে বাতাসের সঞ্চালন কী দারুন সুরে ভরিয়ে দেয় ভূবন, নদীর জলতরঙ্গ কী আশ্চর্য শ্রুতি-সুন্দর মাধূরী রচনা করে তা আমাদের জানা নেই। অবশ্য আজকাল অনেকে এসবের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ছে।
আমরা জানি না জ্ঞান আর সততার সৌন্দর্য, ভালোবাসা মমত্ব আর অজ¯্র প্রেমবন্ধনের সৌন্দর্য। একারণে আমরা তিলে তিলে পলে পলে অসুন্দরের জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। যেকোন সময় যেকোন সৌন্দর্যের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠি। চালাই এসিড সন্ত্রাস। অনেক সময় সুন্দরের প্রতি সহিংস আক্রমণও চালাই আমরা।
বাঙালীর প্রাণের শক্তিঃ আমরা মানব মনের পরিপূর্ণ প্রাণশক্তিকে আজও উপলব্ধি করে উঠতে পারিনি। মানব প্রাণের নিবিড় নীরব শক্তিখনি সম্পর্কে আমরা আজও অজ্ঞ। আমাদের অসংযত কামনা বাসনা লোভ লালসা হিংসা প্রতিহিংসা মিথ্যা অসততা দিয়ে আপন প্রাণের আলোককে আমরা ঢেকে রেখেছি। আজ যখন আমাদের বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকাতে হয় তখন নিজেকে ও অন্যকে দেখি অন্যের থেকে ধার করা আলোয়। জ্ঞান বিজ্ঞানে আমাদের অবদান তাই খুব সামান্য। ধার করা আলো স্পষ্ট করে কিছুই দেখাতে পারেনা, বরঙ অনেক সময় তা ধোঁয়াশার কুয়াশা তৈরি করে নতূন অস্পষ্টতার সূচনা করে। এ জাতীয় হাজারও অস্পষ্টতা আমাদের প্রাণে আজও বসত করছে।
নিজের প্রাণ-শক্তির খুব কম আজ নিজের দখলে আছে আমাদের। আমরা অজ¯্র অজ্ঞতার ক্রীতদাস আজ, অবশ্য সেজন্য আমাদের কোন রকম অনুশোচনা নেই।
আমাদের তীব্র স্বপ্ন-প্রবণতা রয়েছে অথচ সেসব স্বপ্নের অধিকাংশ রুগ্ন। লাখো লাখো রুগ্ন আর অসুস্থ স্বপ্নে আমাদের মন মেধা মগজ অবশ হয়ে আছে। আমরা স্বপ্ন দেখি চোরাকারবার লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ লুট হত্যা ধ্বংস পরমুখাপেক্ষিতার। নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন, মঙ্গল সত্য সুন্দরের স্বপ্ন আমাদের কম। হয়ত সে কারণে কথায় কথায় বলিঃ মরতে পারলে বাঁচি!
মরণে মুক্তি নেই, মুক্তি জীবনে। জীবনে যার মুক্তি আসে না মরণেও তার মুক্তি মেলে না। জীবনের মুক্তি কোথায় তবে? জীবনের মুক্তি জীবনীশক্তিতে। সেই শক্তি আমাদের সমবেত শক্তি, সেই শক্তি যুগ যুগান্ত ধরে প্রতীক্ষিত আমাদের কর্মের মাঝে প্রকাশিত হবে বলে।
২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪১
আবু সিদ বলেছেন: ধন্যবাদ বিন্দু। ’আমাদের দেশে কবে সেই ছেলে হবে .. ’। মেয়েদের কথা বললেন না যে!
২| ২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৪
আবু শাকিল বলেছেন: ভাল বলেছেন
২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪২
আবু সিদ বলেছেন: ধন্যবাদ শাকিল ভাই। শুভ কামনা।
৩| ২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৬
আহমেদ জী এস বলেছেন: আবু সিদ ,
বেশ সুন্দর একটি বিষয়ের অবতারনা করেছেন । আত্ম সমালোচনা ।
যথেষ্ট কঠিন একটি কাজ । এর জন্যে নুন্যতম যে প্রজ্ঞার অধিকারী হতে হয় , সে প্রজ্ঞা কি আছে আমাদের ? আমাদের চারপাশের দেখা থেকেই তো আমরা শিখি । এই শেখা কি আমাদের চেতনায় দাগ কাটে ? কাটেনা ।
কাটেনা যে তা আপনার লেখার বিষয় বস্তুই বলে দিচ্ছে ।
নীতি কথা পড়ানো যায়, শেখানো যায় কিন্তু নীতিবোধ জাগানো যায়না । বিদ্যা মানুষকে জ্ঞান দান করে চরিত্র দান করেনা । এর জন্যে প্রয়োজন "বোধ" এর ।
নিজ মাটি আর সংস্কৃতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ, নির্মল জীবন জিজ্ঞাসা , নির্মোহ ,নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী আর সর্বোপরি বিবেকবোধ না থাকলে বাঙালীর সম্পর্কে বাঙালী এবং জগতবাসীর ধারনা থেকে মুক্তি মিলবেনা ।
আপনার কথা মতো সেই মুক্তি মিলবে শুধু আমাদের চেতনার সত্যে, কর্মের ধর্মে।
২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৪
আবু সিদ বলেছেন: প্রিয় আহমেদ জী, অনেক ধন্যবাদ । আপনার সুচিন্তিত মন্তব্য অনেক ভালো লাগলো।
৪| ২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৩
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: চমৎকার একটি লেখা +++++
আমরা সমালোচনা নিতে পারি না । নিজেদের সবসময় শ্রেষ্ঠ ভাবি । আমুক আমাদের তমুক বলেছে ! এতো বড় হিম্মত ! গর্জে উঠি !
এ সম্পর্কে লিখলে অনেক কিছুই লেখা যায় । আপনার পোষ্টের চেয়ে বড় বড় মন্তব্য হয়ে যাবে ।
শুধু এটুকু বলি - নিজে একজন ভালো মানুষ হবার চেষ্টা করি । এ জাতিকে শুধরানো সম্ভব না ।
না , মনে করবেন না আমি হতাশার কথা বলেছি । আমি দেশকে অনেক ভালোবাসি । কিন্তু যা সত্য তা অন্ধ বিশ্বাসে কিংবা দম্ভে অস্বীকার করবো না ।
ভালো থাকবেন
২১ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:০৫
আবু সিদ বলেছেন: ধন্যবাদ অপূর্ণ। চমৎকার মন্তব্য করেছেন। ভালো থাকবেন আপনিও।
৫| ২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:০১
ঢাকা জার্নাল বলেছেন: আত্মসমালোচনা কঠিন। কারণ তা করতে হলে নিজেকে পুরিশুদ্ধ রাখার মানসিকতা থাকতে হয়। নিজের দোষ বেশি হলে, আত্মসমালোচনা যায়না।
২১ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:০৬
আবু সিদ বলেছেন: সঠিক কথা, সহমত। ধন্যবাদ আপনাকে।
৬| ২১ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:২৪
এহসান সাবির বলেছেন: ভালো লিখেছেন।
২১ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:০৭
আবু সিদ বলেছেন: ধন্যবাদ এহসান। শুভ কামনা
৭| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩৩
কলমের কালি শেষ বলেছেন: সবাই নিজ উদ্যোগে ভালো মানুষ হলেই জাতির পরিবর্তন সম্ভব । সুন্দর পোষ্ট ।
২৩ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:২১
আবু সিদ বলেছেন: সহমত। ধন্যবাদ আপনাকে।
©somewhere in net ltd.
১|
২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৩০
অন্ধবিন্দু বলেছেন:
আবু সিদ,
বাঙালী করলেই দোষ ! মানতে না-পারি। হাহ হা হা...
অর্থ-সমৃদ্ধ আলাপ। তবে কথা ওখানেই এসে থামে-
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?
লিখাটিতে কৃতজ্ঞতা জানানো দায়িত্ব মনে করলুম।