![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবন মানুষের মহত্ত্বম প্রাপ্তি। কিন্তু এই প্রাপ্তিও অনেকের কাছে কেবল দুর্ভোগ ও লাঞ্চনা। একই মানব শরীর নিয়ে যাপন করলেও এ জীবন কারো কাছে উপভোগের আর কারও কাছে দুর্ভোগের। উপভোগের জীবন তাদের যারা জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পরিপুরনের পর নিজের ইচ্ছানুসারে কিছু করতে পারেন। অন্যদিকে, জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর পরিপুরন যারা দিন-রাত পরিশ্রম করেও করতে পারেন না তাদের জীবন দুর্ভোগের।
মৌলিক চাহিদার পরিপুরন যেমন জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে প্রয়োজন তেমনি মানব জীবনকে সুন্দর ও সার্বজনীন করতে মৌলিক শিক্ষার প্রয়োজন। আমাদের জীবনে এমন কিছু শিক্ষা আছে যেগুলো জীবনের তো বটে উপরন্তু তা মানব জীবনের অর্থ, তাৎপর্য ও মহত্ব শেখায় - এ জাতীয় শিক্ষাকে আমরা মৌলিক শিক্ষা হিসাবে অভিহিত করতে পারি। আবার এমন অনেক শিক্ষা রয়েছে যেগুলো আমাদের জীবনের অর্থ বা তাৎপর্য শেখায় না বটে তবে তা মানব জীবনকে অপেক্ষাকৃত সহজ, সুন্দর ও সাবলীল করে - এ ধরনের শিক্ষাকে আমরা বলতে পারি সাহায্যকারী শিক্ষা। মৌলিক ও সাহায্যকারী শিক্ষা ব্যতিত নন্দন চর্চার শিক্ষাও মানব জাতির এক অনন্য উদ্ভাবন। এই তিন ধরনের শিক্ষাকে চিত্র ৭.১ এর মাধ্যমে দেখানো যেতে পারে -
মৌলিক চাহিদার পরিপুরন যেমন সব মানুষের প্রয়োজন ঠিক তেমনি মৌলিক শিক্ষাও সবার জন্য আবশ্যক। মৌলিক শিক্ষা ব্যতিত সাহায্যকারী শিক্ষা তার পরিপূর্ণ অবদান রাখতে পারে না। যেমন, একজন বুভুক্ষু মানুষের মনে গোলাপ বা রজনীগন্ধা কি বিশেষ কোনো অনুভূতি এনে দিতে পারে? কিন্তু সেই একই মানুষ যদি তার মৌলিক চাহিদা পরিপুরনের পর গোলাপ বা হা¯œাহেনার সৌরভ নিতে পারেন তবে তা তার জন্য চমৎকার উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
ক. মৌলিক শিক্ষা
আদিম কালে যখন মানুষ ছিলো সংখ্যায় কম তখন অরণ্য, চারণভূমি আর অনন্ত প্রান্তর কৃষিক্ষেত্র পড়ে ছিলো পৃথিবীময়। পরে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এসব জায়গার দখল ও আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষ ও লড়াই হয়ে ওঠে সাধারন ঘটনা। মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আমাদের প্রিয় পৃথিবী আজ হাজার-কোটি মানুষের পৃথিবীতে পরিণত হচ্ছে। আদিম কাল থেকে আজ, এই সুদীর্ঘ সময়ে আমরা সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও মনুষ্যত্বের চর্চায় যখন ব্যর্থ হয়েছি তখন বিনাশ সমস্ত মানব জাতিকে ব্যঙ্গ করেছে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে আমরা আজ জানি যে সব মানুষ প্রয়োজন ও অনুভবে সমান। একই প্রকৃতির সন্তান তারা। জন্মগতভাবেই তাই সহজ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করার অধিকার সব মানুষের রয়েছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ও মানুষও এ বিষয়ে একমত। এই ব্যাপক ও সার্বজনীন মানব-মতৈক্যের পর দুঃখজনকভাবে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ আজ তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। আফ্রিকা বা এশিয়ায় অগণিত মানুষ পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের পশুদের থেকেও বঞ্চিত জীবন যাপন করছে। কারন, আমরা যারা অপেক্ষাকৃত সুবিধার মধ্যে আছি তারা এবং যারা সুবিধা-বঞ্চিত তারাও মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।
এখন প্রশ্ন হলো, মৌলিক শিক্ষা কি?
মৌলিক শিক্ষা হলো সেই শিক্ষা যা একজন মানুষকে -
জীবন যাপন ও জীবিকার্জনে সাহায্য করে
শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখে
পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা ও অন্য মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে
প্রকৃতির সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করে।
খ. সাহায্যকারী শিক্ষা
সাহায্যকারী শিক্ষা হলো সেই জাতীয় শিক্ষা যা জীবনকে অপেক্ষাকৃত সহজ সুন্দর ও সাবলীল করে। অন্যভাবে বললে, মৌলিক শিক্ষা হলো মানুষের পোশাক আর সাহায্যকারী শিক্ষা তার অলংকার। অথবা, এ-ও বলা যায় যে মৌলিক শিক্ষা মানুষের পদ-যুগল আর সাহায্যকারী শিক্ষা তার সাইকেল। পা-বিহীন একজন মানুষ যেমন তিন চাকার সাইকেল হাতে ঘুরিয়ে চালান তেমনি মৌলিক শিক্ষা নেই এমন মানুষ জীবনের পথে পরিপূর্ণ মানব-শক্তি নিয়ে চলতে পারেন না। রাজপথে তিন চাকার সাইকেল কম থাকলেও মানব জীবনের পথে তিন চাকার সাইকেলের অগণিত সমাবেশ।
আমাদের দেশে অফিস আদালত দোকান-পাট রাস্তাঘাট খেলার মাঠ শিল্প কারখানায় যে শিক্ষার প্রয়োগ হয় তা সাহায্যকারী শিক্ষা। অর্থাৎ, স্কুল কলেজে সরু পাতলা বা পেটমোটা যেসব বই আমরা পড়ি বা শিখি তা প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাহায্যকারী শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। যাই হোক, স্কুল কলেজ বা এ-জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মৌলিক শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে। জাপানের স্কুলগুলো সে প্রক্রিয়া বেশ আগেই শুরু করেছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রতিদিনের জীবনে আমরা যেসব গণিত বা পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ ঘটাই এগুলো কি তবে মৌলিক শিক্ষার অংশ নয়? প্রতিদিনের জীবনে যেসব জ্ঞান আমাদের প্রত্যেককে ব্যবহার করতে হয় তা অবশ্যই মৌলিক শিক্ষার অংশ, তবে অক্ষরজ্ঞানহীন কোনো মানুষ তার ছোট-বড় হিসাবের জন্য যে গণিত ব্যবহার করেন বা একজন ঘাটের মাঝি নৌকা চালতে গিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের যে তত্ত্ব প্রয়োগ করেন তা তারা পৃথক কিছু শিখে করেন না। তারা তাদের প্রয়োজনের তাগিদে প্রকৃতির সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। হয়ত তারা জানেন না যে পদার্থ বিজ্ঞান বা গণিত নামে আলাদা কোনো শাস্ত্র আছে। অবশ্য, মানব সমাজে আজ যত ধরনের সাহায্যকারী বিদ্যা বা শিক্ষা রয়েছে তার সব বিকশিত হয়েছে মৌলিক শিক্ষা থেকে। যেমন, প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা আকাশের তারার গতিপথের হিসাব রাখত বছর হিসাবের জন্য, আর বছরের হিসাব রাখত তারা ভালোভাবে চাষ বাস করার জন্য - আর এভাবে বিকশিত হলো জ্যোর্তিবিদ্যা। ফসল বা গবাদিপশুর হিসাব নিকাশ আর তার বিলি বন্টনের সুবিধার জন্য ইংরেজি সাল গণনার প্রায় ছয় হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে উদ্ভুত হলো পাটীগণিত।
গ. নন্দন চর্চা
হাজার হাজার বছর ধরে মৌলিক ও সাহায্যকারী শিক্ষার পাশাপাশি আরও এক ধরনের শিক্ষা আমাদের মানব জীবনকে আলোকিত করে চলেছে। এই শিক্ষা নন্দন চর্চার শিক্ষা। কেউ কেউ এটাকে মানব-চিত্ত বিনোদনের একটা উৎস হিসাবেও বিবেচনা করে থাকেন। ইংরেজি সাল গণনা শুরুর কমপক্ষে ২০ হাজার বছর আগে পাখির হাড়ের তৈরি বাঁশীর ব্যবহার শিখেছিল মানুষ। প্রায় একই সময়ে মেয়েরা শিখেছিল আইভরি অলংকারে সাজতে। আর প্রাচীন চিত্রাঙ্কনের যেসব নমুনা বর্তমান কালের হাতে এসে পৌঁছেছে তা ৪০ হাজার বছরের পুরনো। অর্থাৎ, টিকে থাকলে বা বেঁচে থাকলে মানব-মন সব সময় নন্দন চর্চার প্রকাশ ঘটিয়েছে। নন্দন চর্চা আমাদের ভাত কাপড় বা বিলাস ব্যসনের ব্যবস্থা করে না কিন্তু তা আমাদের চিত্তকে অনন্তের অনুভূতি দেয়। তা আমাদেরকে অপরিসীম জীবনের পথে অনুপ্রাণিত করে।
প্রত্যেক মানুষ তার সমস্ত জীবনে না হলেও জীবনের বিশেষ কোনো সময়ে নন্দন চর্চা করে থাকেন। আবার এমন হতে পারে যে কোনো বিশেষ ব্যক্তি কখনো নন্দন চর্চা করেন নি কিন্তু নন্দন চর্চার প্রতি আগ্রহ অনুভব করেন। এমন হতে পারে যে ধান কাটার সময় কৃষক যখন গান গান বা কোনো পাখি আপন মনে শিষ দেয় তখন সেই সুরের তান তার হৃদয় দুলিয়ে দেয়।
সাধারনভাবে আমরা মনেকরি যে সঙ্গীত নৃত্য নাট্য কাব্য চিত্রকলা ভাস্কর্য স্থাপত্য চলচিত্র কেবল এসবের মধ্যে নন্দন চর্চার বিকাশ ঘটে থাকে। কিন্তু খেয়াল করলে আমরা দেখতে পারি যে মানুষের সব কর্মের মাঝে নন্দনের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। যেমন, একজন মানুষ যখন রান্না করেন তখন রান্নার পদ্ধতি প্রকরণ স্বাদ, এমনকি পরিবেশনের মধ্যেও নন্দনের সমাবেশ ঘটাতে পারেন। সাধারন ভাবে নন্দন হলো সৌন্দর্যের শিল্প এবং বিশেষভাবে নন্দন হলো শিল্পের সৌন্দর্য। আর তাই নন্দন চর্চার বোধ আমাদের ভিতর একবার গড়ে উঠলে তার প্রকাশ ঘটানো সম্ভব জীবনের ছোট বড় অনেক কাজে।
©somewhere in net ltd.