নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইউরোট্রিপ ২০২৩
ইউরোপ বেড়াতে যাবার সবচেয়ে আরামদায়ক পথ হল ট্রেন। সবচেয়ে সস্তা উপায় ফ্লাইট, আর সবচেয়ে স্বাধীন পন্থা ড্রাইভিং। স্বাধীন বলছি এজন্য, যাবার পথে যেখানে ইচ্ছা থামা যায়, ছোটখাট পছন্দের জায়গা ঘুরে দেখা যায়। বহু বছর ধরে গাড়ি চালাই, কিন্তু কখনো রং সাইডে গাড়ি চালাতে যাই নি। রং সাইড বলছি কারণ ব্রিটেনে গাড়ি চলে বাংলাদেশের মত রাস্তার বাঁ দিক ধরে। স্টিয়ারিং থাকে গাড়ির ডান হাতে। একই নিয়ম আয়ারল্যান্ড এবং আইরিশ রিপাবলিকেও। অন্যদিকে গোটা ইউরোপে গাড়ি চলে রাস্তার ডান দিক ধরে যেটাকে আমি বলি রং সাইডে চলে কারণ আমরা বাঁ দিক ধরে গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত। সত্যি কথা বলতে সারা দুনিয়ায় মাত্র ৩০% দেশে গাড়ি বাঁ দিক ধরে চলে, বাকী ৭০% চলে রাস্তার ডান দিক ধরে এবং গাড়ীগুলোর স্টিয়ারিং বাঁ দিকে। সে যাই হোক, আমি নিজেকে মনে করিয়ে দেবার জন্য গাড়ির ড্যাশবোর্ডে নোটিশ লাগিয়েছি, "এইখানে গাড়ী উল্টা দিকে চলে, Overtaking on the left"
প্রাথমিক প্রস্তুতি:
ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেট ব্রিটেন একটি দ্বীপ রাষ্ট্র, এখান থেকে ইউরোপে যেতে হলে সাগর পাড়ি দিতে হয়। আমাদের জন্য সবচেয়ে কাছের পথ আটলান্টিকের ইংলিশ চ্যানেল। পারাপারের জন্য ফেরি আছে, আর আছে টানেল ট্রেন। ফেরি পার হতে দুই ঘণ্টা আর টানেল ট্রেনে পার হতে লাগে আধ ঘণ্টা। সাগর উত্তাল না হলে ফেরি হতে পারে আনন্দদায়ক, ডেকের উপর বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে সাগর দেখা, বাইরের দুনিয়াদারি দেখা, ফেরির ভেতর শপিং, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি মজাদার অভিজ্ঞতার লোভ এক পাশে রেখে টানেলের ভেতর দিয়ে ট্রেনে চেপে পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মূল কারণ ট্রেন নিয়ে আমার এবং আমার ছেলের আগ্রহ এবং ফেরি। ইংলিশ চ্যানেলের নিচে দিয়ে সুড়ঙ্গ (টানেল) চলে গেছে, সেখানে সব গাড়ীগুলোকে ট্রেনে করে টানেল পার করে দেয়। তাই আগে থেকে অনলাইনে ইউরোটানেল লে-শট্ল ট্রেনে গাড়ি পারাপার (আসা/যাওয়া) বুকিং করে নিয়েছি।
ব্রিটেন থেকে ব্রিটেন গাড়ি নিয়ে ইউরোপ যেতে হলে কিছু প্রাথমিক প্রস্তুতি বাধ্যতামূলক। যেমন বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স যা কিনা ইউরোপিয়ান (ই.ইউ) দেশগুলোতেও বৈধ। আপনার গাড়ির গাড়ির ই.ইউ কভার করে কি না। ইনস্যুরেন্স ব্রেকডাউন কভার আছে কি না। আপনার/আপনাদের হেল্থ ইনস্যুরেন্স কভার আছে কি না ইত্যাদি। আপনার ইনস্যুরেন্স ইউরো ট্রাভেলের জন্য রেডি করতে হবে যেমন বাধ্যতামূলকভাবে গাড়িতে হ্যাজার্ড ট্রায়াংগল রাখতে হবে, যত যন প্যাসেঞ্জার ততগুলো গাড়িতে ইমারজেন্সি ভেস্ট থাকতে হবে, গাড়ির পেছনে UK স্টিকার লাগাতে হবে, হেডলাইট বিম কনভার্টার স্টিকার লাগাতে হবে। এছাড়া আরো কিছু সাবধানতা যেমন ছোট একটা ফার্স্ট এইড কীট, স্পেয়ার বাল্বস ইত্যাদি। এছাড়া সময় থাকতে গাড়ির মডেল ভেদে ক্লিন এয়ার স্টিকার কিনে লাগিয়ে নেওয়া উচিত, কারণ আমরা জানিনা কোন এলাকায় কোন ধরনের পরিবেশবান্ধব গাড়ি চলতে পারবে। সবচেয়ে ভালো হয় অনলাইনে সব খোঁজ খবর নিয়ে তারপর সেই মোতাবেক ফেরিগুলো নেওয়া।
যাত্রা:
ইংলিশ চ্যানেলের ফেরিগুলো ডোভার থেকে ছাড়ে। লে-শাট্ল ট্রেন ছাড়ে ফোক্ষ্টোন থেকে। আমার বাসা থেকে ডোভার বা ফোক্স্টোন যেতে সব মিলিয়ে দেড় ঘণ্টার বেশী লাগার কথা না। যেহেতু শুক্রবার দুপুরের পর যাচ্ছি সেজন্য দুপুর দুইটার আগেই রওয়ানা হলাম কিন্তু বাসার বাইরে থেকে এমন এক জঘন্য জ্যামে পড়লাম সেখানে প্রায় দুই ঘণ্টার আটকে ছিলাম। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই ঘণ্টা পরে ফোক্ষ্টোন টানেল ট্রেন স্টেশনে পৌঁছাই তবে কোন সমস্যা হয় নি। সবকিছু অটোমেটিক, গাড়ি নির্ধারিত গেটে থামতেই স্ক্রিনে সংয়ক্রিয়ভাবে আমার নাম, গাড়ির রেজিঃ, সব মিলে কয়জন প্যাসেঞ্জার ইত্যাদি ইত্যাদি তথ্য স্ক্রিনে এলে আমি 'ওকে' টাচ করতে গাড়ির বোর্ডিং পাস প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসে, সেটাকে ড্যাশবোর্ডে রেখে নির্ধারিত গেটের দিকে ব্যাংকস্ম্যানদের ইশারায় এগিয়ে যাই। তারপর অপেক্ষমাণ অন্যান্য গাড়ির মিছিলে শামিল হয়ে সারিবদ্ধভাবে এগোতে থাকে। তারপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যা দেখার জন্য আমি, আমার ছেলে, মেয়ে, বৌ সবাই অধীর আগ্রহে ছিলাম। সামনে নীচের দিকে মাহেন্দ্রক্ষণ দুপাশে দাঁড়ানো দুটো ট্রেন। আমরা উঠলাম ডানের ট্রেনে। অবাক হয়ে দেখলাম আমার গাড়ি ২য় তলায় উঠছে। অনেক খানি এগিয়ে গেলে ফ্রেঞ্চ লেডি হেল্পার সিগন্যাল দিয়ে গাড়ি জায়গামতো দাঁড় করালো, প্রত্যেকটা বগির সামনে-পেছনের বড় গেট লক করে দেওয়া হয়, আবার বের হওয়ার সময় খুলে দেওয়া হয়। লেডি হেল্পার গাড়ি পার্ক কিংবা পার্কি ব্রেক এংগেজ করতে বলে টয়লেটের লোকেশন জানিয়ে দিলো। সত্যি অবাক কাণ্ড, গাড়ীবাহী দ্বিতল ট্রেন! এই ট্রেন হু হু করে উড়ে যাবে সাগর তলের টানেল হয়ে ওপারে, ফ্রান্সে। দারুণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। টয়লেটের কথা শুনে আমার ছেলে রাফসান হিসি করার জন্য উঠেপড়ে লাগলে, দুনিয়ার সকল এক্সপেরিয়েন্স দরকার তার। বাপের মত অসভ্য হয়েছে।
ট্রেনে ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজি ভাষায় ঘোষণা দেওয়া হল, গাড়ির উইন্ডো অর্ধেক নামিয়ে রাখতে যাতে সেইফটি এ্যানাউন্সমেন্ট শোনা যায়, চমৎকার এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা। হাঁটাহাঁটি করতে চাইলে করা যাবে, টয়লেটের লোকেশন বলে দেওয়া হচ্ছে। মাত্র আধ ঘণ্টায় চ্যানেল পার হয়ে অন্য পারে গিয়ে ফ্রান্সের কালাই (Calais), ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে আমার সাত সিটের ভলভো ট্রাকের সামনের বাম চাক্বা ফাউন্ডেশনের সাথে ঘষা খেলো। আর যায় কই, বউয়ের কড়া কাড়া ধম, ফরাসি রূপসি সিগন্যাল (ওম্যান) এর দিকে নাকি বেহায়ার মত তাকিয়েছিলাম তাই এটা হয়েছে। এরপর বার বার মনে করিয়ে দিলো, "এ্যাই, এখানে কিন্তু ডান দিকে গাড়ি চলে।" আমার প্রথম গন্তব্য প্যারিস নয়। বেলজিয়ামের গাড়ি। এফ এম চ্যানেলে ফ্রেঞ্চ লোকাল স্টেশন ধরে ফরাসি পপ গান শুনতে শুনতে আর ভয়ে ভয়ে হাইওয়ে ধরে যেতে শুরু করলাম। ইউ.কে'র মত এখানে মাইলের হিসাব নেই, এখানে সব কিলোমিটার। তাতে কিছু যায় আসেনা, আমার জিপিএস সব অটোমেটিক কারেক্ট করে নেয়। অবাক বিষয় হল, সামান্য টেরও পেলাম না, মনে অজান্তেই কি সুন্দর রাস্তার ডান দিক ধরে এগিয়ে যাচ্ছি।
ডানকার্ক:
ব্রাসেলস্ যাবার সরাসরি হাইওয়ে বাদ দিয়ে অন্য হাইওয়ে ধরে ঘুরপথে প্রথমে রওনা হলাম ডানকার্কের দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের জার্মান নাৎসি বাহিনী ডেনমার্ক, বেলজিয়াম দখল করে পরে ফ্রান্সের বুলোন(Boulogne) দখল করে এবং কালাই ঘিরে ফেলে। পার্শ্ববর্তী ডানকার্কে তখন প্রচুর ব্রিটিশ সৈনিক ফ্রান্সকে সহায়তা দেবার জন্য ডানকার্কে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলো। কিন্তু হিটলার বাহিনীর প্রবল আক্রমণের সামনে সমানে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছিল। জার্মান অফেন্সিফ এমন মাত্রায় চলে গিয়েছিলো যে ব্রিটিশরা তাদের সৈনিকদের ফেরত পাঠাতে থাকে। প্রায় তিন লাখ তিরিশ হাজার সেনা ইংল্যাণ্ডে ফিরে যেতে পারলেও চল্লিশ হাজার সৈনিক ডানকার্কে আটকা পড়ে। তাদের ভাগ্যে কি হয়েছিলো ইতিহাসই ভালো জানে। এই ডানকার্ক নিয়ে একটা মুভি দেখেছিলাম, সেটা দেখে খুব ইচ্ছে হল ডানকার্কের ঐতিহাসিক গণকবর দেখতে যাবো। আল্লাহ্ আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। প্রচুর ক্রশ চিহ্নের গণকবর। বিশাল গ্রেভইয়ার্ডের সামনে বড় বড় ইউনিয়ন জ্যাক (ব্রিটিশ পতাকার নাম) দেখে আমার ছেলে মেয়ে চিৎকার করে বলে, "Look! it's our flag in France!" বুকটা হু হু করে উঠলো। এত বছর হল ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়েছি জীবন জীবিকার প্রয়োজনে, আমি বা আমার স্ত্রী কখনও মনের ভুলেও ভাবিনা আমরা ব্রিটিশ। আমরা বাংলাদেশি। বিশেষ করে আমাকে এখনও কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, "Where are you from?" আমি বলি, "Feni." ওরা বলে "Feni? Feni where?" তখন আবার বলি ফেনী, "বাংলাদেশ। I am from Bangladesh." বলতে ভালো লাগ, বুক ভরে যায় গর্বে।
ব্রিটিশ সেনাদের ফিরিয়ে নেবার প্রোগ্রামের নাম ছিল অপারেশন ডায়নামো। একটা মিউজিয়াম ছিলো কিন্তু ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে নয়টা বেজে গেলেও তখনও বিকেল। গ্রীষ্মকালে ইউরোপের দিন হয় বিশাল লম্বা, সেদিন সূর্য্যাস্তের সময় ছিলে ৯:৪৫, আমার লোকাল ম্যাকডোনাল্ডস্-এ গিয়ে টয়লেট সারলাম। পৃথিবীর সকল ম্যাকডোনাল্ডস্ পাবলিক টয়লেট। ব্যবহার করতে গেলে কিছু কিনতে হবে এমন বাধ্য বাধকতা নেই। তাছাড়া ওখানে হালাল কিছু নেই, গাড়ি ভর্তি দুনিয়ার খাবার। নো চিন্তা। ডানকার্কে মন ভরে সব দেখে সরাসরি ব্রাসেলসের পথে। ডানকার্কের পর থেকে বেলজিয়ামের শুরু। হাইওয়ে দিয়ে বর্ডার পার হলাম, ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড ছাড়া আর কিছু নেই। বৌ কে বললাম একটা ছবি তুলে রাখো, বৌ কহিলো, "আচ্ছা।" ১৩০ কি.মি বেগে বর্ডার পার হলাম, তখনও সূর্য্য ডোবেনি।
ভেবেছিলাম বেলজিয়ামের বুর্জ্ (Burges) আর ঘঁন্ট (Ghent) ঘুরে দেখে ব্রাসেলস্ যাবো। রাত হয়ে যাওয়ায় আর গেলাম না। কলেজ বান্ধবী জেসমিনের বাসায় যখন পৌঁছি তখন রাত সাড়ে এগারোটা। সাড়ে সাত ঘণ্টার জার্নি, যার বেশিরভাগ রং সাইডে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে সামান্য টেরও পেলাম না। এই তো সেবার যখন আম্মাকে নিয়ে আমেরিকা গিয়েছিলাম, সবাই চাবি দিয়ে বলছিলো গাড়ি ইউজ করতে, আমি করিনি। ভেবেছিলাম উল্টা দিকে চালাতে গিয়ে কি না কি করে ফেলবো। আসলে এই অস্বস্তি একেবারেই অর্থহীন, রাস্তায় নামলে সব ঠিক হয়ে যায়। জেসমিনকে দেখে পথের ক্লান্তি দুর হয়ে গেলো। শেষ দেখা হয়েছিলো ২০১২ সালে লন্ডনে। আমার মেয়ের জন্ম হলে জেসমিন দেখতে এসেছিল হাসপাতালে। এতদিন পর আমার দশ বছরের মেয়েকে সামনাসামনি দেখে আনন্দিত এবং অবাক। ছেলে দুটো বড় হয়ে গেছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সবাই বড় হয়ে গেছে কিন্তু আন্তরিকতা কমেনি এতটুকু।
©somewhere in net ltd.