নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ না।

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধারাবাহিক: শ্যামলা রংয়ের মেয়েটি - শেষ পর্ব

০৩ রা নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৩:৪৮

পিতলের ঘটিহাতে উর্মিমালা জল নেবার ছলে আমার বাড়ীর পাশে নীচের কলতলায় আসতো। এলাকার সব বাড়ীতেই জলের ব্যাবস্থা আছে, ওরা বলে ‘শাপ্লাই জল’। খাবার জল বলতে পুরো মহল্লার জন্য এই চাপাকল। আমাদের কারো কলতলায় যেতে হত না, দুঃশাসন সবার জন্য মিনারেল ওয়াটারের ‘ডিব্বা’ কিনে রাখতো। আমি থাকতাম দোতলার জানালাওয়ালা ঘরটিতে। সে আসতো আমাদের গড়িয়ার বাঘাযতীন শ্রীকলনী যখন গভীর ভাতঘুমে। পুরো এলাকা নীরব। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা। তখন সে আসতো, নীচে থেকে আস্তে করে মিষ্টি কিনকিনে স্বরে মালা আমায় ডাকতো,

“সাগোরদা! সাগোরদা” আমিও জানালার কাছে গিয়ে বলতাম,
“আইছো নি? খাড়াও, আইয়ের।” তারপর আমরা বেরিয়ে পড়তাম। যাবার আগে বলতাম বাসায় বদনা রেখে আসার জন্য।
“বদনা বলো ক্যানো সবসময়? এটা ঘটি!”
“ঘটি বইলতে লইজ্জা করে।”
“লইজ্জা… মানে লজ্জ্বা করে? ক্যানো?”
“এইটা একটা বর্ণবাদী শব্দ, রেসিস্ট।”
“রেইসিস্ট? ক্যানো, রেইসিস্ট ক্যানো?”
“বাংলাদেশে আমরা কইলকাতার মানুষকে ঘটি বলি।” অপরাধীর মত মুখ করে বললাম।
“আরে ধ্যাৎ, ঘটি মোটেও রেইসিস্ট ওয়ার্ড না। এটা আমাদের কলকাতার মানুষদের মধ্যে দুটো সাব-গ্রুপ। ঘটি আর বাঙ্গাল। ওসব বাদ দাও, আর তুমি প্লীজ কোইলকাতা বোলো না, কলকাতা বলবে। ওকে?”

ভাতঘুমের সময় রিকশা বা অটো কিছু পাওয়া যায় না। অগত্যা আমরা হেঁটই অনেকখানি যেতাম। সেই রামগড় লেক নয়তো বৈষ্ণবঘাটা জোড়ামন্দিরের পাশে পদ্মশ্রী লেকের ধারে। মাঝে মাঝে ট্যাক্সী নিয়ে ময়দানে চলে যেতাম। আবার হাওড়া ব্রীজের ধারে।

অনেক গল্প করতাম আমরা। মালার সব আগ্রহ বাংলাদেশকে নিয়ে। বাংলাদেশের আকাশ কেমন, বাতাস কেমন, মানুষজন, পরিবেশ কেমন, দূর্গাপুজোর সময় কি হয়। আমি বলতাম,
“আবহাওয়া, ফরিবেশ, নদী নালা সব হুবহু তোমাদের কইলকাতার মতন। কতা হইলোযেন, আমরা লাইন ধরি ফানি থুক্কু জল আনিনা। সবাইর ঘরে ঘরে চাপাকল আছে। নিজস্ব চাপাকল, এজমালি না। আর দুর্গাপুজা? হে হে, আমাদের ফেণীতে যত বড় করি দূর্গাপুজা হয়, তোমাদের কলিকাতার মানুষ এত সুপারহিট দূর্গাপুজা জীবনে দেইখছে কিনা সন্দেহ।”

কলকাতার দূর্গাপুজা আমি দেখিনি। সত্যি কথা বলতে, ফেণী শহরের বাইরে আর কোথাও দূর্গাপুজা আমি দেখেনি। তাতে কি? আমাদের ফেণীর সবকিছু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ।

ও বলতো, “সাগোর দা, আমি কিন্তু অনেক কথা বলি, কিন্তু যখন তোমার সাথে থাকবো আমি মিউট। তুমি শ্যূধু কথা বলবে, আমি শ্যূনবো। তোমার কথাগুলো এত্তো ডিফেরেন্ট, এত্তো কিউট, খুব ভালো লাগে, শ্যূধু শ্যূনতে ইচ্চে হয়!”

মনে হচ্ছিলো মালা একটু বাড়িয়ে বলছে। আমি বললাম,
“টনটনায় নি?”
“টনটনায়? হোয়াট ডু ইউ মিন সাগোর দা?”
“মানে কোনো খান দিয়া ব্যাথা-ব্যাদনা করে নি কোনো?”
“না না, ব্যাথা করবে কেন?” মালা ব্যাস্ত হয়ে পড়ে, “তোমার এই সুন্দর ভাষার জন্যেই তোমায় এতো ভালোবাসি। এত্তো সুইট, এত্তো সেক্সী ভয়েস! উফফ আই লাভ ইউ সাগোরদা!”
ওরে আল্লাহ্‌ রে! কত সহজে বলে ফেললো, “ভালোবাসি”।

মনে মনে ভাবি, “রং এক্কেরে বাই বাই হড়ের।”

দুপুরের একটু পর থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি আর চলতো। একবার লম্বা হাঁটা দিয়ে বিশ্ববাংলা উদ্যানে গিয়ে উঠলাম। ওখানে চমৎকার একটা লেক আছে। আছে সেতু, ফোয়ারা আর বসার জায়গা। একবার গল্প করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে রাত হয়ে গেলো, মাথার উপর ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। এজন্যেই আজ উর্মীমালা বেশ প্রগলভ। শুনেছি পূর্ণিমার সময় নদীর জোয়ারে পানির পরিমান বেড়ে যায়, একে বলে ভরা কটাল। মানুষের শরীরেও নাকি কিছু হয়, জোয়ার আসে। এই সুযোগ হেলায় ফেলা যাবে না। দেখে শুনে এমন একটা বেঞ্চে বসলাম যেখানে ল্যাম্প পোষ্টের আলো ম্লান এবং লোকজন খুব একটা যায় না। কাঁধে হাত রাখলে মালা নিজে থেকে আরেকটু কাছে এলো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “থ্যাংক ইউ ফুন্নিমা!”
ঝট করে সোজা হয়ে বসে আমার মুখের দিকে তাকালো, অবাক, “পূর্ণিমার চাঁদ কে থ্যাংক ইউ দিলে? ক্যানো?”
মনে মনে বললাম, সদা সত্যি বলিবে, অনেষ্টি ইজ দ্য বেষ্ট পলিসি, “ফুন্নিমার সময় দেহেও জোয়ার আসে। এই যে, তুঁই কি সোন্দর কাছে আইসলা, কেন আইলা? কারন, ফুন্নিমার কারনে আমার এই দেহের ফ্রতি তোমর দেহ ফ্রবল আকর্ষণ বোধ কইত্তেছে।”
মুখ ভেংচে মালা বলে, “বলেছিলাম তোমার কথা শ্যূনতে ভালো লাগে। এখন জঘন্য লাগচে, এ্যাতো ক্ষ্যাত ক্যানো তুমি?”
“এইচ্চা করিওনা। পিলিজ, কাছে আইও। তোঁয়ারে কিছু ফ্রশ্ন জিংগেশ কইত্তে চাই। ফ্রশ্নগুলারে দয়া করি কু চিন্তা মনে করিওনা। কৌতুহল। পিলিজ লাগে, কাছে আইও মালামণি!”
“কি প্রশ্ন?” মালা এখনও সরে বসে আছে। আমি সরে গিয়ে এক হাতে আবার জড়িয়ে নিলাম ওকে।
“তোমার আগরে ফ্রেমের কিচ্ছা বইলবা, পিলিজ! বইলবা না?”

হেলানওয়ালা বেঞ্চে আমার মাথায় বুক রেখে মালা তার অতীত ভালোবাসার গল্প শোনাচ্ছে, সিরিয়াল প্রেম…

“তোমার আগে আলতাফ, তার আগে ভালোবাসতুম এক শিখ ছেলেকে, ও পাঞ্জাবী ভাষায় কথা বলতো। আমি বুঝতুম না তাই ইংরেজীতে বাৎ-চিৎ চলতো।”
“বাত্ বুইঝলাম, চীত্ ও হইছিলা নি হেতের লগে?” খানিকটা আহত কন্ঠে জানতে চাইলাম। সে বললো,
“না না সাগোর দা! ওটা কথার কথা। তুমিও না!…. ওই শিখ ছেলেটের আগে ভালোবাসতুম এক মারাঠীকে, মুম্বাইয়ের। পিওর উর্দুতে কথা বলতো। ওর সাথে আমার তেমন অসুবিধা হোতো না।”
“উর্দু আর হিন্দী ভাষায় আঁরও খুব একটা সমইস্যা হয় না। আঁর মাতৃভাষার লগে ‘হায়’ লাগাই দিলেই কাম চলে। তার আগে কার লগে ফ্রেম কইচ্ছ?”
“তারও আগে যাকে ভালোবাসতুম, সে ছিলো সাউথের। ওর ভাষার বিন্দুবিসর্গও বুঝতুম না। তাই সব সময় ইংরেজীতেই বাৎ-চিত্ চালাতে হোতোগো সাগোরদা!”
“আবার চীত্?” বলতেই আমার দিকে এমনভাবে তাকালো, যেন ছেঁচবে। তাড়াতাড়ি বললাম, “আইচ্ছা আইচ্ছা, হেতের ভাষা এক শব্দও বুইঝতানা মানে কিয়া? উদাহরণ দ’ চাই?” ঊর্মি বললো,
“একটা খালি দুধের টিনের ভেতর একটা বা দুটো পাথর ঢুকিয়ে খুব জোরে নাড়লে কেমন শব্দ হয় বলতে পারো?” বললাম,
“দুধের ডাব্বাত্তে হাত্তর ডুকাই গুডুর গুডুর কইত্তাম আঁই? আঁ-কে কি হাগলা কুকুরে কাম্বিয়েছে?” একটু শুদ্ধ বলারও চেষ্টা করেছি।
“ইউরেকা! সগোর দা!! তুমি ঠিইক ধরেচো। ওর ভাষাই ছিলো এরকম, গুডুর গুডুর, ভুডুর ভুডুর, ইন্ডা মিন্ডা, আন্ডেলে পান্ডেলে, একদম ওরকম। ওরা যে সাউথ ইন্ডিয়ান সাগোর দা!”
“হেতের আগে কার লগে ফ্রেম কইচ্ছ?” একেকজনের কথা বলে আর প্রতিবার আমার বুকের উপর ওর মাথার ওজন বাড়ে। আমার কি হিংসে হচ্ছে? হিইইইংসে?
“ওহ্ তার আগে? দাড়াও মনে করে নিই।” হঠাৎ বুক থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। বুকের ভার কমাতে আরাম লাগছে, বড় একটা নিশ্বাস নিলাম। “হুমম মনে পড়েচে, ও ছিলো মিডল্-ইষ্টার্ন। ও যখন কথা বলতো ইংলিশ আর এ্যারাবিক মিশিয়ে। আমি পুরোপুরি না বুঝলেও কাজ চলে যেতো”
মনে মনে খুশী হলাম, পবিত্র আরব ভূমির প্রেমিক মানে হালাল প্রেমিক। তাই মনে একটু আবেগ চলে এসেছিলো। “আইও, আবার বুকে মাতা থোও, তারফরে বল”। মালা আবার বুকে মাথা রাখলো। ওর বুক আমার বুক স্পর্শ করেছে। উফ্‌ফ্‌ থ্যাংক ইউ পূর্নিমার চাঁদ। থ্যাংক ইউ এ্যাগেইন।
“মিডল্‌ ইষ্টের হ্যাতে কোন দেশের আছিলো? দুম্বা ল্যান্ডের নি?”
“দুম্বাল্যান্ড কোথায়”
“সৌদি আরবকে আমরা দুম্বাল্যান্ড বলি। ওখানকার দুম্বা বরকতি দুম্বা”
“কোন দেশের তা জানি নে। বাট আম শিওর হি'জ ফ্রম মিডল ইস্ট। হি ইউজড টু ওয়্যার ইসলামিক স্কার্ফ।”
“বুইঝলাম, কিন্তু হ্যাতে আরবি কইতো হেইটা বুইঝলা কেমনে? হেতে ফারসী, মানে ইরানিয়ান, নাইলে সোমালিও হইতে ফাইত্তো?”
“কি যে বলোনা সাগোর দা, এ্যাসপ্লানেডের পাশে কতো বড়ো মাছ্-জিদ। আমার কালেজ ওই মাছ্-জিদের পাশেই। ওই মাছ্‌-জিদ শুধু প্রেয়ার হল নয় ওখানে দুনিয়ার সব খান থেকে ইসলামিক স্কলার রা আসে, ওদের স্পীচ হয় মাইক দিয়ে, কতো শ্যূনেছি। বুঝবোনা ক্যানো?” মনে মনে ভাবি, দুম্বাল্যান্ডের রাজপূত্রও বাদ যায় নি। তাহলে আমি কত নম্বর প্রেমিক? পঁচ, ছয়, সাত কিংবা দশ?

“কলেজরে ‘কা-ল্যাজ’, মসজিদেরে ‘মাছ্-জিদ’ বইলতেছ কিল্লাই জানু? সোন্দর করি বল। বল ‘কলেজ’, ‘মসজিদ’। হেসে ফেললো উর্মিমালা, বড় সুন্দর সে হসি।
“আমরাতো এভাবেই বলি। ওকে বলচি, ‘কওলেজ’, ‘মোসজিদ’। হয়েছে?”
“হইছে, বহুত সুন্দর হইছে। কালেজের তুন কওলেজ আরো সোন্দর।” আশ্বস্ত করে বললাম। ডাবল আশ্বস্ত করার জন্য একটা শ্লোক বানিয়ে শোনালাম,
-“তুঁই সোন্দর কওলেজ সোন্দর
সোন্দর তোঁয়ার রং
আরো বেশি সোন্দর তোঁয়ার
‘চরং – বরং’।”-


আবার হাসলো, প্রশংসা আর স্বীকৃতির মিষ্টি হাসি। দুরের ল্যাম্প পোস্টের আধমরা আলো নাকি পূর্ণিমার চাঁদের আলো জানিনা, শুধু জানি অদ্ভুত এক আলো উর্মিমালার শ্যামলা মুখে দ্যূতি ছড়াচ্ছে। উজ্জ্বল, সুন্দর। কি যে মিষ্টি মুখখানা!
“তুমি কবিতা বানালে? আমায় নিয়ে?”
“কবিতা ন’, ষোল্লক।”
“কি?”
“ষোল্লক, ষোল্লক। মানে কিচ্ছা গাইলাম তোঁয়াকে নিয়ে।”

আমার কথা বুঝলো কিনা জানিনা তবে তার দুচোখ ভিজে গেছে আবেগে আর আনন্দে। আবার আমার বুকে ওর মাথা। গভীর কালো নরম চুলগুলো, সামনের দিকে গলা পর্যন্ত, পেছনদিকে কাঁধ আর পিঠ ছাড়িয়ে প্রায় কোমর পর্যন্ত লম্বা। হাত বুলোতে ভালো লাগছে। কোনটা বেশী ভালো লাগছে… সিল্কী চুল, না নরম শরীর? যেখানে হাত যায় সেখানেই ভালো লাগে। মনে মনে বললাম, “ও আল্লাহ্ । কি হচ্ছে এসব?”

সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় নয়টা বেজে গিয়েছিলো। ভদ্রতা করে রাতের খাবার কোন ভালো রেষ্ট্যুরেন্টে খেতে বলেছিলাম, মানা করেছে।

* * * * * * * * * * * * * * * * * * *

পরদিন থেকে শুরু করে একেবারে শেষদিন পর্যন্ত কলেজে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত ছিলাম। কোর্স শেষের দিকে, তাই কঠিন হচ্ছে দিনে দিনে। বন্ধের দিনগুলোতেও লাইব্রেরী ওয়ার্ক করেছি। পরীক্ষা যেদিন শেষ পারলে সেদিনই দেশে চলে আসি। সামনে দূর্গাপুজো, কলকাতা ভয়াবহ ব্যাস্ত। দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তবে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অবাঙালিরাও ভিন্ন ভিন্ন নামে এ উৎসব পালন করে। পাঁচদিন ব্যাপী বিশাল এই পুজো অনুষ্ঠান শুধু কলকাতা নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পালন করা হয়ে থাকে। এটা বাঙ্গালিদের হিন্দুদের প্রানের উৎসব। চারিদিকে সাজ সাজ রব আর শপিংয়ের তোড়জোড়। প্রতিদিন ভীড় বাড়ছে কলকাতায়। পুজোর আগে আমাকে অবশ্যই দেশে ফিরতে হবে তা না হলে পূজো শেষ হওয়া অব্দি কলকাতায় থাকতে হবে। তখন আবার অনেক বেশী দেরী হয়ে যাবে।

কোর্সওয়ার্ক, পরীক্ষা, পরীক্ষা শেষে সার্টিফিকেট আদায়, পুজোর ডামাডোল আর আমার ফেরার প্রস্তুতি এতোসব ব্যাস্ততার মাঝে কিভাবে জানি মন থেকে হারিয়ে গেলো উর্মিমালা। দেখা করাতো দুরে থাক, ওকে নিয়ে ভাবার বিন্দুমাত্র সময় পাইনি। সার্টিফিকেট হাতে পাবার পর এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করছিলোনা। বাক্স-পেঁটরা গুছিয়ে ট্যাক্সী নিয়ে সেদিনই অনেক রাতে সোজা বেনাপোল রওনা হলাম। হরিদাসপুর বর্ডার, ইমিগ্রেশন কাস্টমস এসব পার হয়ে যখন বাসে করে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন প্রায় সকাল আটটা। একটু আগে অনেকখানি বৃষ্টি হয়েছে। নাকে আসছে আমার বাংলাদেশের বর্ষার মিষ্টি বাতাসের গন্ধ। বাসে ছাড়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে …
“সাগোর দা, সাগোর দা, শোনো! এ্যাই সাগোর দা! মা গো! এ্যাত্তো ঘুম? ওঠো, ওঠো!” ঘুমের ঘোরে টের পাই এটা উর্মিমালা। চোখ খুলে দেখি সেই প্রথমদিন দেখা খয়েরী রংয়ের জামা পরা, সেই ওড়না দিয়ে ঘোমটা। কিন্তু বৌ সেজে আছে কেন? কপালে লাল টিপ আর তার দুপাশে ছোট ছোট সাদা ক্রীম স্পট সারা মুখে হয়ে থুতনিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। শ্যামলা মিষ্টি মুখখানা, কি যে সুন্দর লাগছে! ওমা, উর্মিমালা আমার বৌ যে। উপুড় হয়ে বুকের উপর সেঁটে আছে রূপসী বধু আমার। কিন্তু মাথার ঘোমটাটা হঠাৎ বদলে গিয়ে লাল ক্যাপ হয়ে গেলো কেন?

বড়সড় একটা নৌকার মধ্যে আমরা, বাসের সীটের মত সীট। আশেপাশে অনেক যাত্রী। জানালার দিয়ে বাইরের গাছপালা দেখা যাচ্ছে। চোখে মুখে ফ্রশ বাতাসের ঝাপটা লাগছে। নৌকা মাটির উপর দিযে চলছে নাকি? হতেও পারে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের দেশেও এখন হোভারক্রাফট চলে। আমাদের কি বিয়ে হয়ে গেছে? আজ কি আমাদের বাসর রাত? বাইরে দিনের আলো কেন? এটা তাহলে বাসর দিন। ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

“সাগোর দা, সাগোর দা!…… হ্যালো, হ্যালো। এই যে মিষ্টার… হ্যালো…”

আবার তাকালাম। একি, উর্মিমালা এটা কি ড্রেস পরেছে? আর্মি ইউনিফরমের মত। মাথার লাল ক্যাপ টা আগের মত। তবে মুখমন্ডল বেশ ফর্সা। কিন্তু উর্মিমালার নাকের তলায় গোঁফ কেন?

“হ্যালো মিষ্টার হ্যালো! এই যে সাহেব, আমরা বর্ডার গার্ডস। আপনার ব্যাগ চেক করবো।” ঘুম ভেঙ্গেছে মাত্র। সম্বিত ফিরে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে এলাম,
“অবশ্যই, অবশ্যই।”
ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বললাম। পথে কোথাও চেক হচ্ছে। বর্ডার ক্রস করার পর মাঝে মাঝে নাকি এরকম চেকিং হয়। বিজিবি জওয়ানের ফর্সা মুখে গোঁফ না থাকলে মেয়ে বলে ভ্রম হত।

মধুমতী নদীর উপর কামারখালী ব্রিজ পর হয়ে বাস এখন পূর্ণ গতিতে ঢাকার দিকে যাচ্ছে। আকাশ মেঘলা তবে বাইরে উজ্জ্বল দিনের আলো। সকাল দশটার মত বাজে। ঢাকা পৌঁছতে বেলা প্রায় চারটা বেজে যাবে।

বাঘাযতীন শ্রীকলোনীতে তখন বাজবে বেলা সাড়ে তিনটে। সবাই গভীর ভাতঘুমে। পুরো এলাকা নীরব। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা। শ্যামলা রংয়ের মেয়েটি নীচে কলতলার পাশে দাঁড়িয়ে, দোতলার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে মিষ্টি কিনকিনে স্বরে হয়তো ডাকবে,

“সাগোরদা! সাগোরদা!”

কেউ হয়তো শুনবে, কিছু বুঝবে না। পর্দা সরিয়ে নীচে তাকাবেনা। মেয়েটি আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করবে, হয়তো বা।

তারপর ফিরে যাবে, শ্যামলা রংয়ের মেয়েটি।

- সমাপ্ত -

পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
বি: দ্র: চার পর্বের এই ধারাবাহিক আমি উৎসর্গ করেছি সম্মানিত, প্রিয় সামু ব্লগার মিরোরডডল কে। উনার উৎসাহ না পেলে কখনোই এটা এখানে দেওয়া হত না।
* পুরো ঘটনা কাল্পনিক। কোনো ভাবেই বাস্তবের কিংবা বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে স্থান, কাল, পত্র/পাত্রী কোনো কিছুর মিল নেই। অগ্রহনযোগ্য/irrelevant কমেন্ট সরিয়ে ফেলা হবে।

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:৩৬

মিরোরডডল বলেছেন:




ফেণীতে যত বড় করি দূর্গাপুজা হয়,

আসলেই কি তাই, নাকি ফেনীর প্রতি ভালোবাসা থেকে বলা?

“রং এক্কেরে বাই বাই হড়ের।”

এখানে রং বলতে কি ঢং বোঝায়?

মনে মনে বললাম, সদা সত্যি বলিবে, অনেষ্টি ইজ দ্য বেষ্ট পলিসি, “ফুন্নিমার সময় দেহেও জোয়ার আসে। এই যে, তুঁই কি সোন্দর কাছে আইসলা, কেন আইলা? কারন, ফুন্নিমার কারনে আমার এই দেহের ফ্রতি তোমর দেহ ফ্রবল আকর্ষণ বোধ কইত্তেছে।”

:)

আমার মাথায় বুক রেখে

কথাটা কি ঠিক আছে? উল্টো হয়েছে মনে হয়।

০৩ রা নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:০৫

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: গ্রেটার নোয়াখাইল্লাগের বিরাট এক ব্যারাম আছে, হামবড়া/হাম ইম্পর্ট্যান্ট ব্যারাম।
এইটা মনে হয় ওই ব্যারামের সিম্পটম
=p~ =p~ =p~

২| ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:১১

মিরোরডডল বলেছেন:




“বাত্ বুইঝলাম, চীত্ ও হইছিলা নি হেতের লগে?”

“আবার চীত্?”

আঁ-কে কি হাগলা কুকুরে কাম্বিয়েছে?”

মনে মনে খুশী হলাম, পবিত্র আরব ভূমির প্রেমিক মানে হালাল প্রেমিক।


মজার ছিলো :)

পাঁচ পর্ব পর্যন্ত হবে ভেবেছিলাম।
হঠাৎ করেই যেনো শেষ হয়ে গেলো!

যাক, এই তাহলে সেই উত্তরাধিকার সুত্রে প্রেমিকা :)

থ্যাংকস হায়দার।

০৩ রা নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:২৬

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: You are more than welcome, thank you for being with me.
আপনার উৎসাহ না পেলে কিছুতেই আমি এই ধারাবাহিক সামুতে দিতাম না।

সমসাময়িক দুনিয়ায় সময়ের অনেক দাম। ঢাউস ঢাউস লেখা পড়ার টাইমা নাই পাবলিকের। অল্প কথায় যতখানি দেওয়া যায় তত মঙ্গল। এক সময় ব্লগিংকে বলা হত সাহিত্য কিবং কাব্যচর্চার মাধ্যম, এখন এটা মাল্টি ফাংশনাল মাধ্যম। সময়বান্ধব আইটেম না হলে চলবে না। সময়ের অনেক দাম।

শেষ পর্বে এডিট করে নীচের লাইন লিখে দিয়েছি। আশা করছি ক্ষমাঘেন্না করে দেবেন।

“বি: দ্র: চার পর্বের এই ধারাবাহিক আমি উৎসর্গ করেছি সম্মানিত, প্রিয় সামু ব্লগার মিরোরডডল কে। উনার উৎসাহ না পেলে কখনোই এটা এখানে দেওয়া হত না।”

৩| ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৪৮

মিরোরডডল বলেছেন:




সময় খুব মূল্যবান, কথা সত্যি।
আমার নিজেরও খুব বড় পোষ্ট পড়া হয়না, কিন্তু আগেও যেটা বলেছিলাম।
হায়দারের লেখার স্টাইলের কারণে পোষ্ট বড় হলেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে।
বোর হবার কোন চান্স নেই।

“বি: দ্র: চার পর্বের এই ধারাবাহিক আমি উৎসর্গ করেছি সম্মানিত, প্রিয় সামু ব্লগার মিরোরডডল কে। উনার উৎসাহ না পেলে কখনোই এটা এখানে দেওয়া হত না।”

এই লেখাটা শুরু হয়েছিলো হিইইইংসে দিয়ে, আর এখন শেষ হচ্ছে লইজ্জা! লইজ্জা! দিয়ে।
আমিতো খুবই লজ্জা পেয়েছি :)

many thanks, feeling honored.

আগামীতে আরও অনেক মজাদার লেখা পাবো এই প্রত্যাশা থাকলো।


০৭ ই নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:০৯

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: চেষ্টা করবো ইনশা আল্লাহ্‌

৪| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:৩৪

রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম।

০৬ ই নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:০১

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: ধন্যাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি কষ্ট করে লম্বা লেখা পড়ার জন্য।

৫| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:৫১

রাজীব নুর বলেছেন: আমি ভেবেছিলাম এটা অনেক বড় ধারাবাহিক হবে।

০৬ ই নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:০৩

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: না ভাই এটুকুই। :)
ধন্যবাদ।

৬| ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:১১

শেরজা তপন বলেছেন: একি কি ভেবেছিলাম আর কি হল- সে হল না হয় দশ নম্বর প্রেমিক তাই বলে এত নিষ্ঠুর মানুষ হয়!!!
ভাষার তালগোলে অনেক ব্লগার এই হারিয়ে ফেলবে- কিন্তু সেইরকম মাস্টারপিস লেখা হয়েছে

০৬ ই নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:০৪

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: মনে হচ্ছে বেশ ক'দিন পর আপনকে দেখলাম। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

৭| ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ৯:৩৯

করুণাধারা বলেছেন: সাগোরদা দেখছি দারুন চালাক! যখন ক্লাস ছিল না কেউ ছিলনা তখন ছিল মালা, আর নিজের ব্যস্ততা শুরু হতেই মালা গন!

কাহিনী যদি কল্পিতই হবে তবে ভালোভাবে বিদায় নিতে অসুবিধা তো কিছু ছিল না!

০৭ ই নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:০৬

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা, কষ্ট করে আমার লম্বা লেখা পড়ার জন্য।

ইয়ে মানে বলচিলাম কি। এর মাঝে আরেকজায়গায় ইয়ে হয়ে গেছিলো। একদম সত্যিকারের ভালোবাসা। অন্তহীন উথালপাথাল ভালোবাসা, সেজন্য গুচিয়ে লিইখতে পারচি না। চেষ্টা চলচে, দেকি পারি কি না!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.