![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(এই লেখাটি দুর্বল হৃদয়ের ব্যক্তিগণ দয়া করে এড়িয়ে যাবেন)
জন্মানোর কথা ছিল ছোট্ট ফুটফুটে নিস্পাপ এক শিশুর। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশীদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো একসময়। অস্ফুষ্ট বেদনার্ত স্বরে কেউ একজন বলে উঠলো ‘হিবাকুশি’। আনন্দের পরিবর্তে তীব্র কষ্ট-বেদনা আর ঘৃণার অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো সবার চোখেমুখে। কারণ জন্ম নিল এক বিকলাঙ্গ শিশু।
জাপানি ‘হিবাকুশি’ শব্দ আমাদের কাছে পরিচিত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপানেও শব্দটার খুব বেশি পরিচিতি ছিল না। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পরে এই শব্দটাই ছিল লোকজনের মুখে মুখে। ‘হিবাকুশি’ শব্দের বাংলা অর্থ হলো বিকলাঙ্গ মানুষ। জাপানে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটতো ১৯৫০, ৬০ এমনকি ৭০ এর দশকেও। শুধু বিকলাঙ্গ শিশুই নয়, মাঝে মধ্যে জন্ম নিত মৃত শিশুও।কেন এমন হতো? এই শিশুদের অপরাধ ছিল এই যে এদের পূর্বসূরিরা ছিল হিরোশিমা ও নাগাসাকির অধিবাসী।
১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট ও ৯ই আগস্ট মানব ইতিহাসের দুটি কলঙ্কজনক দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জাপানের দুইটি নগরীতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটান হয় আর সেই সাথে প্রায় ৬ লক্ষাদিক লোকের নগরীকে মৃত্যুপুরীতে রূপান্তর করা হয়। সেই দিন কত লোকের মৃত্যু হয়েছিল বা পরবর্তীতে পারমাণবিক তেজশক্রিয়তার প্রভাবে আর কত প্রাণ ঝরে গিয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা আজো জানা যায়নি। এদের অধিকাংশই ছিলেন জীবিকার তাগিদে ঘোরা বেসামরিক মানুষ। তবে যারা বেঁচে ছিলেন তাদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি সেই দিনগুলোর ভয়াবহতা সম্পর্কে।
একজন বেঁচে যাওয়া মানুষ সেদিনের সাধারণ মানুষের অবস্তা বর্ণনা করছেন, "মানুষের চেহারার যদি বর্ণনা দিতে যাই, আসলে তাদের সবার চামড়া পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল. .তাদের কারো মাথায় চুল ছিল না কারণ তাদের চুল পুড়ে গিয়েছিল, এবং এক নজরে আপনি তাদের দেখলে বুঝতে পারতেন না আপনি তাদেরকে সামনে বা পিছনে থেকে দেখছেন . তারা তাদের বাহু ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে ছিল এবং শুধুমাত্র তাদের হাতের চামড়া নয়, বরং তাদের মুখমন্ডল ও শরীরের চামড়াও ঝুলে গিয়েছিল.. যদি শুধুমাত্র সেরকম একজন বা দুজন থাকতো তাহলে কখনই আমার এত প্রবল অনুভূতি হত না। কিন্তু যেখানেই আমি গিয়েছিলাম সেখানেই আমি এদের দেখতে পাই। তাদের মধ্যে অনেক রাস্তার পাশেই মারা যান - আমি এখনও তাদের ছবি আমার মনে দেখতে পাই.. যেন কিছু ভূত হেঁটে যাচ্ছে।"
"আমার ক্লাসে একটি ছেলে পুড়ে গিয়েছিল; তার মাথার অর্ধেক চুলই ছিল না যেন মসৃণ কাঁচের একটি অংশ। নিচের ক্লাসের আরেকজন ছাত্রকে সবাই ডাকতো "টেম্পুরা, টেম্পুরা " নামে; সে যখন হলে যেত তখন এক হাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে দৌড়ে পেড়িয়ে যেত। আমি ভাবি হয়তো একদিন তারা বড় হবে, তখন ঠিক কি হতে পারে ? . . "("টেম্পুরা" হল জাপানি ভাষায় ডুবা তেলে ভাজা মাছ বা সবজি)
৬ আগস্টের হিরোশিমায় একজন প্রত্যক্ষদর্শী যিনি বিস্ফোরণ স্থল থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ছিলেন, সেই ভয়ংকর দিনটিতে। ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, "প্রথমে মনে হল, আকাশ থেকে যেন একটা কালো প্যারাস্যুট নেমে আসছে। পরমুহূর্তেই আকাশ যেন জ্বলে উঠল। আলোর সেই ঝিলিক যে কী রকম তা বলার সাধ্য কারও নেই। সে সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দ। বিস্ফোরণের পরমুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগলো শত শত ভবন ও হাজারো মানুষ। সে সঙ্গে আশপাশের জিনিসপত্র এদিক ওদিক পড়ে জমা হতে থাকল। চারিদিকে আলো ও অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। হামাগুড়ি দিয়ে বেরোতে হল, কালো ঘোর অন্ধকারে। কাতরাতে কাতরাতে ঝর্ণা আর নদীর দিকে ছুটছে শয়ে শয়ে লোক। সারা দেহে অসহ্য জ্বালা। চারিদিকে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। মৃতের শরীরে কাপড়-জামা প্রায় কিছুই নেই। গায়ের কাপড় জ্বলে গেছে। স্কুলের মেয়েরা কাতরাচ্ছে আর চিৎকার দিয়ে কাঁদছে মাগো বলে। ভয়ংকরভাবে পুড়ে গেছে তারা, সারা শরীরে রক্ত গড়াচ্ছে কাতরভাবে। মাকে ডাকতে ডাকতে একে একে দেহগুলো নিথর হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী অনুভব করছে মুখটা যেন শক্ত আর ফুলে যাচ্ছে, দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।"
নাগাসাকি ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে রেডিওলজি বিভাগে কর্মরত ৯ আগস্টের নাগাসাকির বিস্ফোরণের একজন প্রত্যক্ষদর্শী মহিলা জানান, "প্লেনের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিকট শব্দ, বুক সেলফগুলো হুমমুড় করে প্রত্যক্ষদর্শীর গায়ের ওপর পড়তে লাগল। যা সেই মহিলাকে অবধারিত মৃত্যু বা মারাত্মক আহত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিল। চারদিকে কালো ধোঁয়া। কোনোক্রমে উঠে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, প্রফেসর তাকাসি নাগাই-এর মুখ ও শরীর থেকে রক্তপাত হচ্ছে। হঠাৎ করে বিল্ডিংয়ের মেঝে ভেঙে গেল। দেয়ালগুলো বড় বড় করে ভাঙতে লাগল। বাইরে দেখা গেল রক্তাক্ত অবস্থায় এদিক ওদিক ছুটে পালাচ্ছে মানুষ। চারদিকে আগুন, ধোঁয়া, গাছপালা আর পোড়া বাড়ি ঘরের বীভৎস দৃশ্য। প্রচুর লোক কাতরাচ্ছে। অনেকেই নিথর হয়ে পড়ে আছে। পুড়ে কয়লার মতো কালো হয়ে গেছে। কয়েক ঘণ্টার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীর স্মরণশক্তি হারিয়ে গিয়েছিল।"
বর্তমান পরিস্থিতি
পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হিরোশিমা-নাগাসাকির আগে বা পরে কখনো হয়নি। কিন্তু এর উৎপাদন চলছে অব্যাহতভাবেই এবং সবচেয়ে বেশি মজুত আছে আমেরিকাতেই। তবে হাইড্রোজেন বোমার তুলনায় হিরোশিমা, নাগাসাকির ইউরোনিয়াম এবং প্লুটোনিয়াম পারমাণবিক বোমা নেহাতই শিশু। এই পারমাণবিক বোমার ক্ষমতা ছিল ২০ হাজার টন বা ২০ কিলোটন। আর ১৯৫৪ সালে বিকিনি দ্বীপে আমেরিকা প্রথম যে হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটাই তার শক্তি ছিল ১ কোটি ৫০ লক্ষ টন বা ১৫ মেগাটন টিএনটির সমান। হিসেব করে দেখা গেছে একটি ১০ কিলোটন পরমাণু বোমা যদি ১৮ বর্গ কিমি জুড়ে তাণ্ডব চালায়, তবে একটি ১০ মেগাটন হাইড্রোজেন বোমা লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে ৪৩৬২ বর্গ কিমি এলাকা। ১৯৬৮ সালে জানা যায় যে ‘পোলারিস’ নামে ক্ষেপনাস্ত্রের মাথায় এক মেগাটনের হাইড্রোজেন বোমা বসানো আছে। আধুনিক এক একটি ক্ষেপনাস্ত্রের কয়েকশো মাথা থাকে। এর প্রতিটির মাথায় যদি হাইড্রোজেন বোমা থাকে, তা হলে এর একটিই পৃথিবীর অস্তিত্ব, মানব অস্তিত্ব মুছে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ১৯৬০ সালে বিশ্বে পরমাণু বোমার পরিমাণ দাঁড়ায় ২০,৫০০ মেগাটন (২০ বিলিয়ন টন, বা টিএনটি ৪০ ট্রিলিয়ন টন), যা সৃষ্টি করতে পারে ১৪,০০,০০০ হিরোশিমার সমতুল্য ক্ষয়ক্ষতি। যদিও ২০০৪ সাল নাগাদ তার পরিমাণ হ্রাস করে ২০০০ মেগাটন করা হয়, যা চোখের পলকে পুনরাবৃত্তি করতে পারে ১,৪০,০০০ হিরোশিমার মত ভয়াবহ, কলঙ্কজনক ঘটনার।
©somewhere in net ltd.