![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভেঙে পড়েছিল পনির থলেটা, মায়ের পেটে দীর্ঘ ৭ মাস ধরে জমানো পানিটুকু , যেটুকুতে আশ্রয় করে বেঁচে ছিলাম আমি। বড় অসময়ে অপরিপক্ব জীবন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলাম এই দুশ বছরের ভাঙা দেয়ালের লাল ইটের ভাঙা ঘরে। হবেই তো দুশ বছর। হুম সেই ঈসাখাঁর আমলে গড়ে ওঠা পনাম সিটির বর্তমান প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঈসাখাঁর রাজত্বের এক ভগ্নাংশের ক্ষয়ে যাওয়া ঘরে আমার জন্ম হয়েছিল । আমার জন্ম হয়েছিল মায়ের জীবনের বেঁচে থাকার আশাটুকুকে ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে দিয়ে জন্মদাত্রী মাকে মৃত্যু গুহায় ফেলে দিয়ে।
তবুও দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছিলাম আমি, হাঁটতে শিখছিলাম আর ঘরের মাঝে রেখে দেয়া এটা সেটা হাতের কাছে যা পেতাম তাই ভেঙে ফেলে মায়ের হাতে বা দাদীর হাতের কিল চড় খেতে খেতেই বড় হয়ে উঠছিলাম, আমি। হুম এ আমার নতুন মা, সে এসেছিল সামিয়িক নিয়োগ পেয়ে আমার মায়ের অভাব পূরণ করতে, নিজের খালা বলে কথা । তার চেয়ে আর কে আপন হতে পারে ? তাই ভেবেছিল দাদীও, মাস পার না হতেই নাকি বাবা তাকে পার্মানেন্ট করে নিয়েছিল আমার মা হিসেবে। বেশী খারাপ ছিল না , ওই মা আমারে মারতও আবার বেলা পড়লে পেট ভইরা খানাটাও দিত, তরকারী না দিলে কি হবে এক খাবলা কচু পাতার ভর্তা দিত তাই খাইতাম পেট ভরে। অবশ্য এখন যদিও আর কচু পাতা খেতে পারি না , সেটা ভিন্ন কথা (মা একবার আমারে আধা সেদ্ধ কচু পতা খাইতে দিছিল, সে দিনের কচু পাতার কামড়ানি আমি আজো ভুলতে পারিনাই )।
বড় হয়ে উঠছিলাম আমি প্রতিটা রাত ভোর হতো আমার এক একটা সুখ স্বপ্ন কে ভেঙে দিনের আলোতে অদৃশ্য করে দিতে দিতে।দিন তার নিয়ম মানতে কিন্তু আমি দিনের মিয়ম ভাংতাম । নিয়ম ভাঙার একটা দুর্বোদ্ধ সুখ পেতাম আমি । মাঝে মাঝে কারো পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে ডাল ভেঙে পড়ে ঘরে পরে থাকতাম দু’ চার দিন । তার পর যা হবার তাই আবারো লেগে পড়তাম নিজের কাজে … চুরি করে খাবার ভেতরে কি যে একটা অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করত তা বলে বোঝানো যাবে না। এমনি এক দিন হঠাৎ করে আমার ভেতরের আমিটা ভেঙে পড়ল স্কুল থেকে ফেরার পথে। উরু থেকে পা অবধি আমার ভেতরের আমিটা ভেঙে পড়ার ব্যথা আর সেই সাথে ভয় আর ভয়ংকর লালে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়ে। রাস্তার লোক জন কেও কেও হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছিল, আর কেও কেও তাড়াতাড়ি বাড়ীতে যেতে বলছিল। তা না হলে পিঠে বাঁশের কাচা কঞ্চি ভাঙবে বলছিল। যাক এ ধাক্কায় আমার আমি ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে ঝড়ে গিয়েও শেষ হচ্ছিল না বলে দু সপ্তাহের মতো ঘর থেকে বের হতে পারলাম না । খানিকটা লজ্জায় খানিকটা সংকোচে একদিন ঘর থেকে বের হলাম , সবাই মনে হয় ভুলেই গেছে আমার ভেঙে পড়ার ব্যাপারটা। ধীরে ধীরে আবারো আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলাম। এবার যেনও আশেপাশের মা চাচীরা একটু বেশীই শাসন করতে লাগল এখন গাছে উঠতে সবার অলক্ষ্যেই উঠতে হয়। ঋতুমতী (অমন ভেংগে পড়া মেয়ের) মেয়ে নাকি গাছে চড়লে গাছের ফলন কমে যায়। যাক গাছের ফলনের মায়ায় গাছে চড়া ছেড়েই দিলাম।
মাস পাঁচ সাতেক পরে এক রাতে একটা ভয়ংকর সুখের দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেল। এরপর যাকে তাকেই সেই ভয়ংকর সুখের দুঃস্বপ্নের ঘাতক মনে হচ্ছিল আর ভয় ও হচ্ছিল। এমনই এক দিনে একজোড়া চোখে চোখ পড়াতে শরীরটা দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের ঘুম থেকে আম ভেঙে চোখ মেলে চাইলো একটা মানুষের দিকে। চোখ আটকে গেল সে চোখের ভ্রুতে, মন থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা ঘেরা অচেনা এক দ্বীপে একাকী। হুম আসলেই মনটা খুবই একাকী অথই সাগরের মাঝখানে আবিষ্কার করেছিল নিজেকে । যেনও বহুকাল ধরে একাকী অথই কোন বিশালকায় নদীতে ভাসতে ভাসতে হারয়ে গিয়েছিলাম কুল থেকে দুরে বহু দুরে।
চোখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বাড়ী ফিরলেও মন ফিরিয়ে বাড়ী ফিরতে পারিনি। মনটাকে সেখানেই রেখে চলে এসেছিলাম সেদিন। এরপর বছর কাল যাবত সে পথের পাশ দিয়ে কারণে অকারণে হেটে গিয়েছি সে (চোখ জোড়া আর পাইনি)। সে পথের পাশ দিয়ে যতবারই বিফল মনে হেটে গিয়েছি ততবারই আমার ছোট্ট বুকটার ভেতরে কিছু একটা ভেঙে চুর্ণ হয়ে গিয়েছে।
দিন কেটে যায়, দিনে দিন বেড়ে যায়, তার সাথে বেড়ে যায় ভেঙে যাওয়া সুখের যাওয়ার সংখ্যা।
জীবনে ভোর আসে সকাল একটা নতুন দিন গড়তে থাকে। দিন দিনে গড়ে ওঠে জীবনের নতুন কোন বন্ধন। তেমন করেই গড়ে ওঠে ছিল সিহাব আর আমার ভালোবাসার একটা সুন্দর ছোট্ট ঘর। সেটাও ভাঙবে বলে ঝড় আসে বহুদূর কোন অচেনা সাগর থেকে দলা পাকিয়ে। সিহাবকে বাধতে আমি সুতো বুনতে শুরু করি নিজের জঠরে। সে সুতোর খবরে সিহাব আঁতকে ওঠে। এ বন্ধনের জন্য সে মানসিক ভাবে নাকি তৈরি নেই। বাড়তে থাকে বাদানুবাদ, আচমকাই একদিন সিহাবের একটি পা উঠে আসে আমার তলপেট বরাবর। আমার ভালবাসারআমিটা ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আমি থেকে।
বহুদূর থেকে ছুটে আসা জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে আমার ভাঙা ঘরের বেড়ায়। জলস্রোতের তোড়ে ভেঙে পড়ে ঘরের বান দুয়ারের ভিটাটা। ভাঙনের আচ পেয়ে পেটটাকে আষ্টেপিষ্টে দু হাতে বেড়ী দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। ভাঙনের সাতকাহন পূর্ণ করতেই তৈরি হয়েছিল নতুন কোন এক জীবন তৈজস। ঘটনা -দুর্ঘটনায় কারণে অকারণে কেবলই ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছিল বুকের মাঝে আগলে রাখা একটা বড় আয়নার সিসা। আমি আমার প্রেম নিয়ে আস্ত একটা সিসা। ভাঙা সিসার অসংখ্য টুকরাতে অসংখ্য আমিকে দেখে অগ্নেয়গীরির গলিত লাভার মতো ভয়ার্ত অর্তনাদ আমার কণ্ঠনালি উপচে বেরিয়ে আসছিল। তবুও আমি চুপ ছিলাম সেদিন। আমার অস্তিত্বে আমার ভাঙন উপভোগ করছিলাম। সেদিনের পর ভেঙে যাওয়া নিজেকে আর জুড়ে দিতে পারিনি। তবুও কিছু একটা জুড়ে গিয়েছিল আমার স্বত্বার সাথে, যাতে করে আমি আমার অস্তিত্ব হীনতা নিয়ে দিব্যি বেচে রইলাম আজো ।
আজ একলা দুপুরে ডাইনিং টেবিলের বাসন গোছাতে গিয়ে চেখে পড়ে ঘরের দেয়ালে বাধানো একটা বড় পরিবারের আস্ত ছবি। সেখানে ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া অসংখ্য আমির মধ্যে কোন একটা আমি সেখানেও উপস্থিত আছে দেখা যায়। সে বড় ছবিটি ছবি হয়ে ওঠার সাথে সাথে ছবির মানুষগুলোর ভেতরকার কিছু একটা ভেঙে যায়। আর সেই কিছু একটা ভেঙে যাবার পর কেউ বুঝি আর কারো থাকে না। আজ মনটা বুঝতে পারে প্রবল ভাবে এই যে, ছবির মাঝে হাসি মুখে বসে থাকা মানুষগুলি কেউ কারো নয়। জমির ভাগ ষোল আনা খাদে আঠারো আনা বুঝে নিতে নিজেদের রক্তের বন্ধনটাকে ভেঙে দিয়ে আলাদা কোন এক স্বার্থান্বেষি স্বত্বায় হারিয়ে গিয়েছে । তবুও আমি কেন জানি আজো ভাঙনের সাতকাহনটাকে বুকের ভেতর একটা মুক্ত কোঠরে যত্নে ধরে রেখেছি। ভাঙা টুকরাগুলার ধারালো কোণা গুলি মাঝে মাঝেই হৃদয়ের নরম মাটিতে ক্ষত তৈরি করে। আর আমি যত্ন করে সে ক্ষতকে লালন করি প্রতিনিয়ত। মনে হয় এ ভাঙনের সাতকাহন আমারই অংশ বিশেষ ,তাই মনে হয় এ ভাঙনের সাতকাহনকে বাদ দিলে জীবনে প্রাণের কোথাও যেন একটা ঘাটতি থেকে যায়।
২| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪২
অনিন্দ নিন্দা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ বিদ্রোহী ভৃগু
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১২
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: অসাধারন!
গভীর অনুভবের কি সাবলীল প্রকাশ! অনেক ভেতরের চোখ দিয়ে দেখা এক ভাঙনের সাতকাহন...চিরন্তন!
++++
মনে হয় এ ভাঙনের সাতকাহন আমারই অংশ বিশেষ ,তাই মনে হয় এ ভাঙনের সাতকাহনকে বাদ দিলে জীবনে প্রাণের কোথাও যেন একটা ঘাটতি থেকে যায়.. ++