নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

বিএম বরকতউল্লাহ

জানতে চাই।

বিএম বরকতউল্লাহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

দাদাকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার পর

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:২১


দাদাকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আমরা খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। এই বুড়ো দাদার কারণে ক্লাসে আমাদের প্রতিদিন লজ্জা পেতে হয়। এখন না-পারি দাদার সাথে পড়ালেখায় কুলিয়ে উঠতে; না-পারি স্কুল থেকে দাদার নামটা কেটে দিতে। স্যার ক্লাসে পড়া জিজ্ঞাসা করলেই বুড়ো ছাত্রটি হরহর করে পড়া দেওয়া শুরু করে দেয়। কোনো প্রশ্ন করে তাঁকে আটকানো যায় না। আর আমরা কোথাও আটকে গেলেই স্যার কানে ধরে টেনে টেনে বলবেন, আমার বুড়ো ছাত্রটা সব পড়া পারল আর তোমরা পারলে না; সারাদিন করোটা কী তোমরা শুনি?
লজ্জা, লজ্জা আর লজ্জা। আমরা নিজের হাতে লজ্জা পাওয়ার সকল আয়োজন করে বসে আছি।
দাদার বাড়ি ভর্তি মানুষ, বাড়ি ভর্তি আনন্দ।
তাঁর অঢেল ধন-স¤পদ, অসংখ্য আতœীয়-স্বজন আর নাতি-পুতির সংখ্যাও অনেক। তাঁর বিশাল বাড়িটা সব সময় সরগরম থাকে।
দাদা বুড়ো হলেও খুব আধুনিক। তিনি দিলখোলা ও ফুর্তিবাজ মানুষ। হালকা-পাতলা শরীরের এই দাদাটিকে আমরা সবাই ভীষণ পছন্দ করি।
কিন্তু এত আনন্দ খুশির মধ্যেও দাদার মনে একটা গোপন কষ্ট আছে। সেটা হলো লেখাপড়া না-জানার কষ্ট।
আমরা যখন ঘরে ঘরে গুণগুণিয়ে বই পড়ি তখন দাদা বারান্দায় হেলান টুলে বসে আমাদের পড়া শোনেন। আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের বইয়ের অনেক পড়া দাদার মুখস্ত বলতে পারেন। তিনি মুখে মুখে অনেক অংকের সমাধানও দিয়ে দিতে পারেন। আমরা তো তাঁর মেধা দেখে রীতিমত থ হয়ে যাই। আশি বছরের বুড়ো!

দুই
আমি একদিন হেড স্যারের সাথে আলাপ করে দাদাকে ইস্কুলে ভর্তি করার কথা বললাম। স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভালোইতো, তোমাদের দাদাভাইকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দাও, আমরা একটা ভাল ছাত্র পেয়ে যাব।’

ইস্কুল থেকে ধেই ধেই করে বাড়ি এসে দাদাকে বললাম, ‘দাদা, চলো তোমাকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই। দাদা একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এই আশি বছরের বুড়োকে ইস্কুলে ভর্তি করাবে কে! আমার কি আর সেই সুযোগ আছে রে ভাই।’
আমি বললাম, ‘আছে। হেড স্যার বলেছেন তোমাকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে।’
দাদা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আরে দুষ্টুমি করে বলেছে আর কি। আমি বুড়া মানুষ না। আমাকে ভর্তি করাবে কীভাবে?’
পরের দিন জোর করেই দাদাকে নিয়ে গেলাম ইস্কুলে। হেড স্যারের কাছে নিয়ে গিয়ে ভর্তির কথা বললাম। স্যার সত্যি সত্যি দাদাকে ভর্তি করিয়ে নিলেন এবং দাদার হাতে এক সেট পাঠ্যবই দিয়ে দিলেন। দাদা ছোট্ট শিশুর মত বই হাতে নিয়ে উল্টে-পুল্টে দেখছেন। সে কি আনন্দ দাদার!

এদিকে দাদার ভর্তি হওয়ার খবরটা সবাই জেনে ফেলেছে। দাদাকে পেয়ে ইস্কুলে আনন্দ ফুর্তি শুরু হয়ে গেল। দাদা যাকে সামনে পান তাকেই বলেন, ‘স্যার আমাকে ইস্কুলে ভর্তি করে ফেলেছেন। আমি এখন ছাত্র। এই যে আমার বই। দাদা সবার মাঝে বসে হাঃ হাঃ হেঃ হেঃ করে হাসেন। আনন্দে দাদার চোখ মুখ চিকচিক করছে। দাদা বলেন, আমি তোমাদের সাথে বসে পড়ালেখা করব। সবাই খুশিতে টগবগ করছে। বুড়ো ছাত্র পেয়ে ইস্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা আনন্দ মিছিল বের করে শ্লোগান দিল-
আদা পাদা লবণ দাদা
ছাত্র হলো চিরু দাদা
চিরু দাদা পড়বে
সোনার দেশ গড়বে।

দাদা বই বগলদাবা করে সবার সাথে রীতিমত ইস্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করে দিলেন। দাদা ক্লাসে বসে মনযোগ দিয়ে স্যারের কথা শোনেন। তিনি সামনে পিছে মাথা দুলিয়ে বেদম পড়াশোনা করতে লাগলেন। কোনোদিন ইস্কুল কামাই করেন না। অল্প দিনেই ভালো ছাত্র হিসেবে দাদার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
আমরা পড়া না পারলে স্যার বলেন, ‘আমার বুড়ো ছাত্রটা সব পড়া শিখে আসতে পারে আর তোমরা পারো না কেনো, সারা দিন খালি দুষ্টুমি করে বেড়াও, না? আমরা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলাবলি করি, এই বুড়ো পড়াটা না শিখে আসলে ক্লাসে আমাদের এত শরম পেতে হতো না।
দিনে দিনে দাদার প্রতি আমাদের মনে হিংসার আগুন জ্বলে উঠল।
আমরা দাদার চেয়ে বেশি বেশি পড়ে দাদাকে পেছনে ফেলে দেওয়ার গোপন চেষ্টা শুরু করে দিলাম। কিন্তু আমরা কিছুতেই দাদার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারি না। আমরা আফসোস করে বলি, ‘এই বুড়োটাকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে ভুলই করেছি বোধ হয়। বুড়াটার একটু অসুখ-বিসুখও হয় না!’

তিন.
দাদা এবার ক্লাশ ফাইভে।
বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেল। দাদা তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে? এমন প্রশ্ন করলে দাদা মাথা ঝাকিয়ে এমন একটা ভাব দেখায় যে, পরীক্ষার ফলটা আগে বের হোক, তারপর দেখবে মজা।
দাদার ভাব দেখে আমরা রীতিমত চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম।

আজ পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন।
এবার স্যারেরা বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। মাঠে মঞ্চ তৈরি করে উপরে সামিয়ানা টানানো হয়েছে। ইস্কুলে উৎসবের পরিবেশ।
দাদা নতুন পাঞ্জাবি পায়জামা ও নতুন নাগরা জুতো পরে ইস্কুলে এলেন। মাথার সাদা চুলগুলো সিতা করে ফিটফাট হয়ে বেঞ্চে আমাদের সাথে বসে পড়লেন। দাদা অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে খুব মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। রেজাল্টের চিন্তায় যখন আমাদের পেট চিনচিন করে ব্যথা করছে তখন দাদা হাসি মুখে ডানে বামে কথা বলছেন।
স্কুল মাঠে বহু লোকের আনাগোনা। ছাত্র, ছাত্রী ছাড়াও অভিভাবক ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা এসেছেন। আমাদের শিক্ষা অফিসারও এসে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন। এর আগে কখনও এমন অনুষ্ঠান করে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি।

চার.
৫ম শ্রেণি ছাড়া বাকি সব শ্রেণির ফল ঘোষণা করা হয়েছে।
এবার মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন আমাদের হেড স্যার। তিনি পঞ্চম শ্রেণির ফল ঘোষণা করবেন।
স্যার ঘোষণা করলেন, ‘এবার পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে আমাদের সবার প্রিয় ছাত্র মো. চেরাগালি ওরফে চিরু মাতবর। হেড স্যারের মুখে এ ঘোষণা শুনেই হাততালিতে কেঁপে উঠল গোটা ইস্কুল মাঠ। সবার চোখ গিয়ে পড়ল চিরুদাদার ওপর।

তারপর আমাদের শিক্ষা অফিসার এসে দাদাভাইকে মঞ্চে ডেকে নিলেন। শিক্ষা অফিসার সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ দাদার গলায় পরিয়ে দিলেন মেডেল ও হাতে তুলে দিলেন ফুলের তোড়া। দাদা দুই হাত উপরে তুলে মঞ্চের চারপাশ ঘুরে মেডেল ও ফুলের তোড়া দেখাতে লাগলেন। ছাত্র-ছাত্রীরা দাদাকে ছোঁ মেরে মঞ্চের বাইরে নিয়ে গিয়ে শ্লোাগান দিল-
তোমার দাদা আমার দাদা
ফাইভ পাশ চিরু দাদা।
দেখতে দেখতে সারা এলাকায় আনন্দ ঢেউ খেলে গেল।
দাদার সাফল্যের খবরে এলাকার বুড়ো-বুড়িদের মনে লেখাপড়া করার গোপন আগ্রহ জেগে উঠল।



মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:৩৯

রামিসা রোজা বলেছেন:
বুড়ো দাদার আনন্দে আমরাও আনন্দিত ।
গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক বুড়োরা স্কুলে যাচ্ছে (ব্রাক)
বিষয়টি পরিবর্তনের।
সুন্দর গল্প লিখেছেন।

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪১

বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: স্বাগত।
সুন্দর বলেছেন।

২| ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১২:২৫

ওমেরা বলেছেন: শিক্ষায় নেই কোন লজ্জা নেই কোন বয়স । খুব ভালো লাগলো ।

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪২

বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: আপনি মূল কথাটাই পাড়লেন। ধন্যবাদ।

৩| ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১২:৩৮

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অনেক আগে ডানিডার বয়স্ক স্কুল চালু ছিল। মরণ পর্যন্ত শিখার শেষ নাই।

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪২

বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: আসল কথাটাই বলেছেন আপনি। শুভেচ্ছা।

৪| ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১২:৪৩

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান আহরণ কর।

চিরু দাদা সত্যি অনুস্মরনীয় কাজ করেছেন।
অনেকেই ইচ্ছা থাকলেও লজ্জ্বা জড়তায় পিছিয়ে থাকেন।

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৩

বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: চিরুদাদাকে দিয়েই ব্যাপারটা বুঝিয়েছি। আমার শুভেচ্ছা নিন।

৫| ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:১৬

রাজীব নুর বলেছেন: সহজ সরল সুন্দর গল্প।

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৩

বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: যতটা সহজ সরল ভেবেছেন ততটা না কিন্তু।
ভাল থাকবেন।

৬| ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:১৫

ইসিয়াক বলেছেন: চমৎকার

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৩

বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: স্বাগত।
ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.