নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

বিএম বরকতউল্লাহ

জানতে চাই।

বিএম বরকতউল্লাহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি কঙ্কাল ও বীর জগাইয়ের গল্প

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৭


তোলপাড় কান্ড! পুরো গ্রাম যেন তেতে উঠেছে। শান্তি নেই-স্বস্তি নেই; সবাই আছে দৌড়ের ওপর। একজনের সাথে আরেক জনের দেখা হতেই রহস্যের প্রশ্ন ‘ভাই রাতে-বিরাতে কী সব ঘটছে এসব, শুনেছেন তো? এমন আজব ঘটনা তো জীবনেও শুনিনি! এ আবার কীশের আলামত!‘ গ্রামের ছোট-বড় সবাই এক রহস্যময় ভয় ধারণ করে আছে। যতই দিন যাচেছ ততই বাড়ছে রহস্য। এ রহস্যের ঝটও খুলছে না, প্রশ্নের জবাবও মিলছে না।
চিনাদী বিলের তীরে ছোট একটা গ্রাম-দরগারবন্দ। গভীর রাতে একটি কঙ্কাল এসে ঘোরাফেরা করে এ গ্রামে। লম্বা লম্বা কদম ফেলে বাড়ি-ঘরের সম্মুখ দিয়ে নীরবে হাঁটা চলা করে কঙ্কালটি। চলার পথে একটু পর পর অদৃশ্য হয়ে গিয়ে আবার দৃশ্যমান হয়। এ রহস্যময় ভয়ংকর ঘটনায় গ্রামের মানুষের চোখে ঘুম নেই।!

সন্ধ্যার আগে যে শিশুরা প্রাণচঞ্চল থাকে, সন্ধ্যার আগমনে ওরা নীরব হয়ে যায়। জোরে কথা বলে না, কারণে-অকারণে ঝগড়া করে না। কার পাতের ডিমটা ছোট, না মাছটা বড় তা নিয়ে অভিমান করে না। যাকে যা দিবে তাই খাবে, যা বলবে তাই শুনবে। একদম চুপ! রাতে যে কংকালটি এসে শিশুটির কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করে, তখন উপায়!
রক্ত নেই, মাংস নেই, লোম নেই, চামড়া নেই; শুধু শুকনো সাদা হাড়! খাঁচার মতো বুক! মাথার ফাটা খুলি, উঁচু কপাল, খিল আঁটা বত্রিশ দাঁত। উফ্ কী ভয়ানক ব্যাপার! ভাবতেই ভয়ে বুকটা ধুক পুক করে; কলজে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। এর সামনে পড়ে মরতে যাবে কোন পাগলে!
দুই.
কংকালের ভয়ে সন্ধ্যার পরে সহজে কেউ ঘর থেকে বের হয় না। একা চলাফেরা করে না। ইঁদুর চিকার দৌড়াদৌড়ি, শুকনো পাতার মচমচ শব্দÑ এসবই মনে হয় কংকালের নীরব আনাগোনা।
কংকালের ভয়ে ঘরে ঘরে নানান সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাতের বেলার বাইরের কাজগুলো সারা হচ্ছে ঘরে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে কেউ প্রকৃতির কোলে গিয়ে বসে না। লোটা বদনা আর মাটির পাতিলা নিয়ে বসে পড়ে ঘরের কোণায়। এভাবে আর কত দিন!
গ্রামের মুরুব্বীরা এ সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে। কিন্তু কোনো সুরাহা করতে পারছে না।

তিন.
এলাকায় ওঝা-বৈদ্যের আনাগোনা বেড়ে গেল। তারা গ্লাস, লোটা, শিশির পানিতে ফুঁ দিতে দিতে কাহিল হয়ে পড়ল। শিশুদের সামনে পড়াপানির গ্লাস ধরতেই ওরা গডু গডু করে পানি খায়। সন্ধ্যার আগে মুরুব্বিরা ঘরের চারপাশে ও দরোজায় পড়াপানি ছিটিয়ে দেয়। শোবার আগে পড়াপানির ঝটকানিতে চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে যায় শিশুরা। এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। বরং অস্বাভাবিক পানি খেয়ে শিশুরা কাঁথা ভিজিয়ে ফেলে। ভোরবেলা মায়েরা আঁচলে নাক চেপে কাঁথা নিয়ে পুকুর ঘাটে যায়। তারা কাঁথা ধুয়ে রোদে ছড়িয়ে দেয়।

ঘরে-বাইরের এত যšত্রণা আর সহ্য হয় না। এর একটা বিহিত করতেই হবে। এ গ্রামে আর ঢুকতে দেয়া যাবে না কঙ্কালটাকে।

চার.
এ নিয়ে মুরুব্বিরা গ্রামের মাথা কানু মন্ডলের কাছে গেল। মন্ডল মানুষের সমস্যা আর বিপদের কাহিনি শুনলেন। বললেনÑ”একটা কঙ্কাল সারা রাত ভয় জাগিয়ে শিশ মেরে ঘুরবে, আর তোমরা বসে বসে আঙ্গুল চুষবা, তা তো হতে পারে না! রাখ, সারা রাত পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করছি। কঙ্কালটি দেখামাত্র পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে ফেলতে হবে। তারপর কি হয়, সে আমি দেখব।” -এ কথা বলে মন্ডল রাগে কাঁপতে লাগলেন।
মুরুব্বি গোছের একজন আঙ্গুল খাড়া করে বলল, ”অবস্থা কিন্তুক বেগতিক। ঘরের ভেতরে পিশাব-পায়খানা সমানতালে চলছে। আপন ঘরের মহিলারা পরের মতো আচরণ করছে। আর আমাদের কাপুরুষ বলে গাল পাড়ছে। আজ থেকেই পাহারার ব্যবস্থাটা করে ফেলতে হবে, মন্ডল।”

“কে কে পাহারা দিবা, নাম বলো। ”কানুু মন্ডলের এ আহ্বানে সবার চোখ গোল হয়ে গেল। ভয়ংকর কঙ্কালটাকে পিটিয়ে ছাতু বানাবে কে? এ নিয়ে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু হয়ে গেল। কারো নাম প্রস্তাব পাওয়া গেল না।
খানিক অপেক্ষার পর কানু মন্ডল বললেন, “তোমরা ঘরে হাগবা, পাতিলায় মুতবা কিন্তুক পাহারা দিতে পারবানা। হুহ্, বোঝা গেছে, এ কাজ তোমাদের দিয়ে হবে না। জগাই পাগলাকেই লাগবে। ওই জগাই তাড়াবে কঙ্কাল। ডাকো দেখি তাকে।” কয়েকজন জগাইকে নিয়ে আসার জন্যে হন হন করে বেরিয়ে গেল।

পাঁচ.
জগাই এ গ্রামেরই বাসিন্দা। বয়স সতের-আঠারোর কোঠায়। তার কাজ, চলাফেরা, কথা-বার্তা, জীবন-যাপন স্বাভাবিক নয়, বল্গাহীন। তার দেহ খাটো, সুঠাম। কোঁকড়ানো চুল, অসম্ভব সাহস, গায়ে বেজায় জোর। সে তিন জনের খাবার একাই সাবাড় করে দিতে পারে। সে ভয়শূণ্য, বেতাল-বেসামাল। সে কারো ধার ধারে না, জাত-পাত মানে না, কাউকে তোয়াক্কা করে চলে-বলে না। কারো ভয়ে মিথ্যা কথা কয় না। তাকে দিয়ে অনেকেই অনেক কাজ আদায় করে নেয়। ভরা ল্যাট্রিন পরিষ্কার করতে তার ডাক পড়ে। ওঝা-বৈদ্যেরা তাকে দিয়ে গভীর রাতে গোরস্থানের মাটি ও শ্মশানঘাটের ছাই আনায়। সে সমাজের বহু কাজে এগিয়ে যায়। কিন্তু সমাজ তাকে মর্যাদা দেয় না।

ছয়.
কয়েকজন গিয়ে জগাইকে নিয়ে এলো মন্ডলের সামনে। সে বলল, আমার ডাক পড়ল যে মন্ডল চাচা, ঘটনা কি?
মন্ডল বললেন, ”সহজে তো আর কেউ তোকে ডাকে না; একটা শক্ত কাজ করতে হবে। সে কাজের জন্যে তোকে ডাকা। কঙ্কালটাকে হয় শেষ করবি; নয় তো গ্রাম ছাড়া করবি। কোনটা করবি ক।“
”অসম্ভব, একাজ আমি করব না, চাচা।”
মন্ডল অবাক হয়ে বললেন, ”তোর আবার সম্ভব-অসম্ভব কি রে? এ কাজের বিনিময়ে তুই কি চাস, বল। পারব না বললে তো হবে না। জীবন মরণ সমস্যা। টাকা-পয়সা যা লাগে দিব।”

একজন আগ বাড়িয়ে বলল, ”যত চাস তত দেব, নগদ চাস নগদেই দিব। কি কন মিঞারা? সবাই জবাব দিল, ”তা আর কইতে হয় বুঝি, আগে কঙ্কালটা শেষ করে আমাদের জানটা বাঁচাক না। জগাইকে খুশি করতে সেটা আমরা দেখব।”
জগাই বলল, “টেকা-পয়সার লোভ দেখাবেন না আমাকে। আজ রাতেই খতম করে দেব কঙ্কালটাকে। বিনিময়ে শুধু একটা জিনিস দিতে হবে আমাকে।”
মন্ডল জিজ্ঞাসা করলেন, ”এবার বল তো দেখি, এর বিনিময়ে কী দিতে হবে তোকে?”
জগাই বলল-“আমাকে বীরের মর্যাদা দিতে হবে।“
জগাইয়ের দাবির কথা শুনে সবাই হা করে রইল। খানিক নীরবতার পর মন্ডল বললেন, ”ঠিক আছে। তুই আগে কঙ্কালটা খতম কর, তোকে বীরের মর্যাদাই দেয়া হবে।”
জগাই হনহন করে চলে গেল।

সাত.
সুবেহ সাদিকের আগে আগে গোরস্থান থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ ভেসে এলো। গ্রামের ঘুমন্ত মানুষের কান খাড়া হয়ে গেল। হুড়মুড়িয়ে মানুষজন বাইরে এসে বলছে, এই রে-, মনে হয় ধরে ফেলেছে। জগাই, জগাই বলে গোরস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। হঠাৎ গোরস্থানে দেখা গেল, আগুনের কুন্ডলী পাক খেয়ে উপরে উঠে দপ্ করে নিভে গেল। জগাইয়ের লাঠির আঘাতে এমনটি হলো কি না!! আতঙ্কে থমকে দাঁড়াল সবাই। জগাই চিৎকার করে বলছে, খতম, খতম। শেষ করে দিয়েছি, শেষ করে ফেলেছি। ভয় নেই, আর ভয় নেই। সবাই ঘুমাও।

চারদিক থেকে লোকজন ছুটে এলো গোরস্থানে। জগাইকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। ক্লান্ত— জগাই উপুড় হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। তার গায়ে ধস্তাধস্তির অসংখ্য ছাপ। থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। ভিড় ঠেলে এলেন কানু মন্ডল। জগাই, জগাই বলে ডাক দিতেই মাথাটা তুলে জগাই বলল, “আমি আমার কথা রেখেছি মন্ডল।“

আট.
মন্ডলের ইশারায় লোকেরা জগাইকে নিয়ে গেল স্কুলের মাঠে। কৌতূহলী লোকে ভর্তি স্কুল মাঠ। মন্ডল ভিড় ঠেলে জগাইকে নিয়ে দাঁড়ালেন। মন্ডল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন-এই জগাই আমাদের ভয়মুক্ত করল। সে অকে বড় উপকার করল। আমরা এখন চিন্তামুক্ত। তাই “জনাব জগাই ওরফে জয়নালকে গ্রামের বীরপুরুষ খেতাবে দেওয়া হলো।” এ ঘোষণা শেষ হতে না হতেই চারদিক থেকে ফুলের পাঁপড়ি উড়ে এলো জগাইয়ের উপর। জনতার মুখ থেকে আওয়াজ উঠল-বীর জগাই - দীর্ঘজীবী হোক।



মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:৫২

রাজীব নুর বলেছেন: দরগাবন্দর বলে আসলেই কি কোনো জায়গা আছে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.