নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

মফস্বল সংবাদ

০৬ ই মে, ২০১৫ সকাল ১১:১৮

প্রিয় ফেসবুক,
আশা করি তুমি ফেসবুকীয় পরিবার পরিজন নিয়া ভালই আছ। আমরাও এই লৌহ নগরের একজন ব্রাত্য সদস্য হইয়া কোনমতে দুটি খাইয়া, লইয়া দিন গুজরান করিতেছি। তুমি তো জানো, এই দেশে বাঁচিয়া থাকাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। সেই ৮০’র দশকে জন্ম লইবার পরে বিগত সাড়ে তিনটি দশকে যে কোনোক্রমে বন্যার জলে ভাসিয়া, কোনো দানব ট্রাকের তলে পড়িয়া, ছিনতাইকারীর খঞ্জরের আঘাত খাইয়া কিংবা কোনো দুটি সোনার দলের সোনার ছেলেদের টেন্ডার সন্ত্রাস চলাকালীন হতবুদ্ধি বৃদ্ধের মতো চিপায় পড়িয়া সিসা নির্মিত গুলি বক্ষে ধারন করিয়া এতকালে পটল তুলি নাই এইটাই তো চরম ভাগ্য। যাই হউক, বাচিয়া যে আছি ইহাই পূর্বপুরুষের পরম পূণ্যি বলে।
ফেসবুক, আজি তোমাকে কেন এই পত্র লিখিতেছি তা কি তুমি জানো? এত এত মানব থাকিতে, এত “জনগনের বন্ধু” থাকিতে, ওবামা, পুতিন, মুন (চান্দের কোরিয়ান ভার্সন) থাকিতে, পত্রিকার মহান সম্পাদকরা থাকিতে, সুশীল সমাজ, শত সহস্র নাগরিক কমিটি থাকিতে কেন তোমাকেই মনের কথা কহিতে বাছিয়া লইলাম? আসলে জীবনে যখন প্রকৃত সময় ছিল তখন পত্র মিতালী করিবার কিংবা পত্র লিখিবার মতো সুহৃদ সমাজ তৈরীতে মনোযোগ দিই নাই। আজি তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ভোগ করিতেছি। বন্ধু কখনো তৈরী করি নাই। না স্কুলে, না কলেজে, না প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে অধ্যয়নকালীন। তারই ফল আজ পাইতেছি। শুনিলাম তুমি নাকি বন্ধু পাতাইয়া দাও। আজকাল দেখিতে পাই ”ফেসবুক ফ্রেন্ড” নামক একধরণের মিতালীর উদ্ভব হইয়াছে। দেখিলাম না, শুনিলাম না, সে কেমন, তার বিত্তান্ত কী-কিছুই না জানিয়া ”ফেসবুক ফ্রেন্ড”। আমি মরিলে ফেসবুক ফ্রেন্ডরা আমার খাটিয়া ধরিবে তো? তাহাদের কে জানাইবে যে আমি মরিয়াছি? আমি মরিবার পরে আমার ফেসবুকীয় স্থাবর, অস্থাবর, ফটো এ্যলবাম এগুলির কী হইবে? তাহাদের উপর কি এই মরার দেশের উত্তরাধিকার আইন প্রযোজ্য হইবে?
ফেসবুক তুমি কি জুকারবার্গ সাহেবকে চেনো? ওয়ারেন বাফেট (নাকি বুফে?) কিংবা ডেল কার্নেগী? বিল গেটস, জাকির নায়েক-এইসব মহামতি ভদ্রলোকদের চেনো যারা আমাদের মতো অধমদের সদুপদেশ দানে ধন্য করিতেছেন প্রতিনিয়ত? ওয়ারেন বাফেট বাবুকে কিছু কথা কহিবার মন চাহে। মফস্বলের ধুলাকাদা মাখা বঙ্গসন্তান আমরা (আমার এক মহামহিম সহকর্মী যিনি আবার নিজে মফস্বলের লোক হইয়াও হালে নিজেকে জোর করিয়া ঢাকাইয়া বানাইতে ব্যস্ত তিনি আমাদের নাম দিয়াছেন ডোমেস্টিক)। আচ্ছা ফেসবুক, মফস্বলে জন্ম নিয়াছি বলিয়া বিধাতার অমোঘ নিয়মে কি আমরা ছোট জাত কিংবা কোনা জা্তই নয়? তুমি কি জানো অজপাড়াগাঁয়ের আমার মতো হাজার হাজার দুর্ভাগা প্রতিদিন বোচকা বুচকী লইয়া ঢাকা শহরে পদার্পন করে ভাগ্য বদলের দুরাশায়? হাটুতে থাকে কাদা, চুলে কোনো এক বলিউড নায়কের ছাট, সারারাত নির্ঘুম বাস, লঞ্চ জার্নির ক্লান্তির ছাপ চোখে। কোনো এক দুরাগত আত্মীয়ের কাছে কিংবা গলগ্রহ হইয়া কিছুকাল থাকিতে বুক পকেটে রিটায়ার্ড হেডমাস্টার বাবার একখানি পত্র তাহার এককালের স্নেহের ছাত্রের কাছে। এই ঝা চকচকে শহরের উচু উচু ইমারত দেখিয়া শুরুতে তাহার টাস্কি লাগিয়া যায়। বাসের তলে পরার উপক্রম হয়। বাস কনডাকটরও তাহার আনাড়িপনা ধরিয়া ফেলে একমুহুর্তে।
ঘাটে ঘাটে ঠোক্কর খাইয়া, দীর্ঘকাল অন্যের সন্তানদের শিক্ষাদান করিয়া (টিউশানী), মেসের ডাল নামক হাত ধোবার জল খাইয়া, ১৩ নম্বর বাসের হ্যান্ডেল ঝুলিয়া, হলের তথাকথিত বড়ভাইদের হাতে রাজনীতির অ আ ক খ গিলিয়া, সিনেপ্লেক্সের সামনে দিয়া বুভুক্ষুর মতো নায়িকাদের অর্ধনগ্ন ছবি দেখিয়া পরক্ষনেই লজ্জিত হইয়া, আপিসে আপিসে ”চাকোরী” সন্ধানে সস্তা জুতার তলা ক্ষইয়া, পে অর্ডার নামক কর্পোরেটদের উদগ্র লোভের চোথাখানির টাকা জোগাড়ে সকালের নাস্তা কোরবান করিয়া করিয়া একদিন ঈশ্বরের রুজি রুটি বন্টনকারী ফেরেস্তার দয়ার দৃষ্টি কাড়িয়া লয় এই ডোমেস্টিক জীবটি। চাকুরী নামক একটি কেরানীগীরির বন্দোবস্ত হয় অতঃপর। মহামতি বিল গেটস, শ্রদ্ধেয় ডেল মহাশয়, আমার বন্ধু পয়সার জন্য পত্রিকায় সস্তায় কন্টেন্ট রাইটারের কাজ করিত। তাহাদের মতো হাজার হাজার মফস্বলি ডোমেস্টিকের রক্তঝরা লেখায় পত্রিকার চাকচিক্য বর্ধন হইত। দু’মাস ছ’মাস পড়ে তাহারা দয়া করিয়া কিছু টাকা ধরাইয়া দিত।
শ্রদ্ধেয় সুশীল সমাজ, ফেসবুকের বরাতে এই অভাগা মফস্বলীর সালাম লইবেন। আজকে আপনারা যাহারা পত্রিকায়, কলামে, স্যাটেলাইট চ্যানেলের চকচকে ”ঠকশো”তে দেশ ও সমাজকে উদ্ধার করেন তাহারা কি জানেন মফস্বলের এই আদম সন্তানরা এই ইট কাঠ পাথরের নিষ্ঠুর নগরে টিকিয়া থাকিতে, তাহাদের বাড়িতে চাতকের ন্যায় চাহিয়া থাকা বাবা-মা’য়ের আশা পুরণ করিতে কি ভয়ানক অমানবিক হৃদয়বিদারক সংগ্রামে লিপ্ত থাকে? ডেল সাহেব, সুশীল সুশীল প্রগতিবাদী উপদেশ আমরাও জানি। খালি কহিতে পারি না। আজি আমরা এই সমাজের দশজনের একজন হইয়া, এলাকার মসজিদের “.........” সাহেব হইয়া, “.........”ক্লাবের উচ্চ চাঁদা দাতা সদস্য হইয়া, স্মার্ট ফোনের মালিক হইয়া বেশ একজন হইয়া উঠিয়াছি। কিন্তু সন ১৯৯৮ হইতে এই ১৭টি বছর স্রেফ পেটের ভাত জোগাড়ের সংগ্রাম করিতে গিয়া, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা’র জন্য ঈদের একটি শাড়ি-লুঙ্গি, ছোট ভাইটার একটা সস্তার মোবাইল, আপুটার লুটুপুটু পিচ্চিটার জন্য একটা প্লাস্টিকের পুতুল কিনিবার টাকা জোগাইবার অশ্লীল অসম উলঙ্গ যুদ্ধে লড়িতে গিয়া, ঠিক কী কী রকমভাবে রকমারী অপমান, সুশীল উপদেশ, ছাত্রের মা’য়ের নৈতিক-অনৈতিক দাবী, টিউশানীর বাসার ফ্রি এক কাপ রং চা, সস্তার জিন্স প্যান্ট, চিমসে হয়ে যাওয়া রুটি, মাঝে মাঝে কোনো দুর্লভ দিনে হলের বিশেষ খাদ্য, দোজা মার্কেটের নির্লজ্জ দামাদামির কেনা টি-শার্ট, ছারপোকার কামড়, পুলিশের রেইড, গণতন্ত্রের সংগ্রাম, ককটেল, বিনাপয়সার পথনাটক, বৈশাখের দিন মাগনা স্যালাইন-কতকিছু যে হজম করতে হয়েছে তার খোজ কি কেউ রাখে?
আমার স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির বন্ধু অথবা অবন্ধুরা,
(ফেসবুকে যেমন চাইলেই ফ্রেন্ড করা যায় তেমনি আবার তাকে অফ্রেন্ডও করা যায়, কি অদ্ভুৎ), আমরা সবাইই একই মফস্বল মাতার সন্তান। সবাই আমরা সেই টেট্রনের সস্তা প্যান্ট পড়িয়াই একদিন এই ঢাকা শহরে অচল মাল হইয়া নাজিল হইয়াছিলাম। আমরা সবাই জীবনে কখনো না কখনো মার্বেল খেলার জন্য বাবার হাতে মার খেয়েছিলাম। ডান্ডা-কুলুখ খেরার জন্য স্কুল ফাকি দিয়েছিলাম। আমাদের শেকড় একই। আজ হয়তো আমরা গাঁয়ের আক্কাইচ্ছা হইতে মিঃ আকাশ হইয়া গিয়াছি, নামিদামী কর্পোরেটে হার্ড বা সফট তরলের গ্লাস হাতে পার্টিতে সবার মধ্যমণি হইয়া কেউকেটা হইতেছি, কিন্তু আমাদের নাড়ি পোঁতা আছে সেই গাঁয়ে। আমরা সবাইই গেঁয়ো বা মফস্বইল্লা।
প্রিয় ফেসবুক, আমার গাঁয়ের বা মফস্বলের বন্ধরা অনেকেই জীবনে অনেক উন্নতি করিয়াছ শুনিতে পাই। শুনিয়া শান্তি পাই। আমাকেও খোদাতায়ালা মোটামুটি খাওয়া পড়ার সংস্থান করিয়াছেন। দু’টি মোটা ভাত আর সস্তা জামা কিনিতে পারি। অতি সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনে একটি সাধারণ গৃহলক্ষীও বিধাতা দিয়াছেন। উহাকে লইয়া দিন চলিয়া যাইতেছে। সমস্যা বলিতে শুধু মাস শেষে কিঞ্চিত উপোশ আর মাঝে মধ্যে পোলাপানের পাতলা পায়খানা হইলে মহাখালীতে বিনাপয়সার চিকিৎসা লইবার জন্য বাটিঘটি লইয়া হাসপাতাল বাস। যাহারা উন্নতির চরম শিখরে উঠিয়াছে তাহারা কুশলে থাকুক। ঈশ্বর শুনিয়াছি থাকেন ভদ্রপল্লিতে (হয়তো গুলশান, বারিধারা, বনানী, ডি....ও.....এইচ.....এস, গ্রামীন ফোন, ইউ এন ও, বিসিএস, ম্যাজিস্ট্রেট প্রভৃতি অঞ্চলে)। তা থাকুন তিনি সেথায়। বন্ধুরা তোমরাও তোমাদের ধনী ও কর্পোরেট ঈশ্বরকে নিয়া কর্পোরেট লাইফ আরো পালিশ করিয়া পালন করিতে থাকো। আমাদের লইয়া ভাবিও না। আমরা মরিব না। সেচ্ছায় মরিবার ইচ্ছাটিও বিধাতা রোধ করিয়া দিয়াছেন। শুধু মাঝে মধ্যে ফেসবুকে তোমাদের খবর দিও। তোমাদের সমৃদ্ধির উত্তোরোত্তর খবর দিয়া আমাদের যাতনা ক্লিষ্ট চিত্তকে অক্ষমতার নিঃস্ফল ইর্ষায় আরো একটু পোড়াইয়া দিও।
ইতি,
.............

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.