নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

I am Nobody.আমি কেউ না।I have no ‘body’.আমার কোনো ‘শরীর’ নেই।

বিবাগী শাকিল

আমি খুবই সাধারন ছেলে। অনাড়ম্বর জীবন যাপন পছন্দ করি। লেখক হতে চাইনা। শুধু লিখতে চাই।

বিবাগী শাকিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি লাল জামা ও আমাদের ঢাকা শহর

১৪ ই জুলাই, ২০২১ রাত ৩:৫২



কে যেন হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল, জয়নাল ধাক্কাটা সামলে নিতে পারেনি। সে কয়েকহাত সামনে গিয়ে এক মহিলার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই তার গালে কেউ যেন শক্ত লৌহদণ্ড দিয়ে তীব্র আঘাত করল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে দু-দুটো আঘাত। জয়নাল কয়েক মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে গেল। তাকে যে চড় মারা হয়েছে, এটা বুঝতেই কিছুটা সময় লেগে গেল তার। চড়টা লেগেছে বেশ। স্ত্রীলোকের হাত এতটা শক্ত হতে পারে, এটা তার জানা ছিল না।
মহিলাটি শুধু চড় মেরেই ক্ষান্ত নয়। আঙুল তুলে উচ্চস্বরে বলল, "শুওরের বাচ্চা! মেয়েমানুষ দেখলে জিভে জল চলে আসে? শরীর কিলবিল করে, হ্যাঁ?"
জয়নাল কী বলবে? ঘটনার আকস্মিকতায় সে লা-জওয়াব। একজীবনে কয়েকবার মানুষের জীবনে কিছু-কিছু মুহূর্ত আসে যখন বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়, মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ে। জয়নালের এখন সেই মুহূর্ত। সে গালে হাত দিয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে।
সামনে কুরবানির ঈদ। হাতে গুণলে মাত্র চারদিন বাকী। এই সময়টায় ঢাকা শহর উত্তাল হয়ে পড়ে। মার্কেট-মলে উপচে পড়া মানুষের ঢেউ। বড়-বড় কমপ্লেক্স আর মলগুলোতে এত ভীড় হয়না, যতটা হয় মধ্যবিত্তদের মার্কেটে। নিউমার্কেট তেমনই একটা জায়গা। এখানকার ক্রেতাদের সিংহভাগই তিনস্তরের মধ্যবিত্ত। ঈদের মৌসুমে এখানে জনতার ঢল নামে। পা রাখার মত জায়গা পাওয়া যায় না। অথচ সকলেই মার্কেটের এমাথা থেকে ওমাথা চক্কর দিতে পারে। কীভাবে সম্ভব হয় এটিই এক রহস্য।
জয়নাল সামান্য একজন ব্যাংকের দারোয়ান। থাকে হাতিরপুলে। চিলেকোঠার মত ছোট্ট একটা রুমে তার বাস। দারোয়ানগিরির অবসরে বাড়িঅলার ছাদবাগানের পরিচর্যা করে। এই সুবাদে তাকে বাসাভাড়ার সুবিধা দেয়া হয়েছে। মাসে মাত্র হাজারখানেক। তাছাড়াও দশ তারিখের আগে বাসাভাড়া দিতেই হবে, এমন কঠোর নিয়ম তার বেলায় নেই। বাড়িঅলা মানুষ ভালো। জয়নালকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখে। সপ্তাহে একদিন দাওয়াত করে খাওয়ায়। জয়নাল এখানে ভালোই আছে।
সারাদেশে ঈদের আমেজ। কুরবানির ঈদে দেশজুড়ে টাকার খেলা চলে। হাট-বাজারে সওদাগর আর খদ্দেরের ভীড়। চলছে কুরবানিপশুর রমরমা ব্যবসা। জয়নালের কুরবানি দেয়ার মত সামর্থ্য নাই। দেশের বাড়িতে মা, বউ আর তিনবছরের কন্যাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। তার ঘরের ছাউনি দিয়ে চন্দ্র-সূর্য রোজ উঁকি দিয়ে যায়, বৃষ্টির সময় চুইয়ে পড়ে পানি। চাল মেরামতের পয়সাই নাই, তার আবার কুরবানি কী? পাড়া-প্রতিবেশীর ভাগ-বাটোয়ারার মাংস দিয়েই তাদের ঈদ দিব্যি চলে যায়।
জয়নাল আজ রাতের লঞ্চে দেশের বাড়ি যাবে। বরিশালে। যেতে অবশ্য জান কাহিল হয়ে যাবে, তবু না গিয়ে উপায় কী? পরিবার ছাড়া কীসের ঈদ? ঢাকায় ঈদ হয় নাকি! এখানে রোজকার দিনের সাথে ঈদের দিনের কোনো পার্থক্য আছে? ঈদের দিন গরু জবাই দিয়েই খালাস। এরপর আর কীসের ঈদ! সেমাই-চিনি খাওয়া হয় না। এ ওর বাড়িতে আসে না। প্রতিদিনকার মত সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর চেয়ের গ্রামের ঈদ শতগুণে ভালো। প্রতি ঈদেই মনে একটা উৎসব-উৎসব ভাব আসে। ঈদগাহে সমবেত নামাজ, কোলাকুলি, ঈদমেলায় বাচ্চাদের খেলনা, সেমাই-চিনি খাওয়া, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ি ঘুরঘুর করা, ধামা-ছুরি দিয়ে মাংস কাটাকুটি- এসবেই তো ঈদ। প্রকৃত ঈদের আমেজ তো এখানেই। এসব বাদেও ফুটফুটে কন্যাপরীটাও তো আছে। কলিজার টুকরা মেয়েটাকে গ্রামে ফেলে জয়নাল শহরে ঈদ করবে কোন দুঃখে!
বাড়িতে মা আছে, বউ আছে, মেয়ে আছে। তিনটি মুখ আর পাকস্থলীর দায়িত্ব জয়নালের ঘাড়ে। তাদের যেমন পেট চালাতে হয়, তেমনি ঈদ-উৎসবেও নতুন কাপড় কিনে দিতে হয়। মা আর বউয়ের জন্য কেনাকাটা শেষ। মেয়েটার জামা বাকি আছে। চলে এলো নিউমার্কেট-- মধ্যবিত্তের বিলাসে। জয়নাল পড়েছে বিপদে। তার কাছে দুনিয়ার সকল কোলের বাচ্চাকে একসমান মনে হয়। মেয়ের জন্য মাপমতো জামা কিনতে তাকে অনেকটা আন্দাজের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। তবে সেই আন্দাজও পুরোপুরি নিঃসংশয় থাকছে না।
কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়। নিউমার্কেটে জনতার মহাসমুদ্র। কে কার পায়ে পাড়া দিয়ে যাচ্ছে, কে কাকে ধাক্কা মারছে- এতকিছুর হিসেব রাখবে কে? জনতার একমাথায় ধাক্কা লাগলে ঢেউয়ের মত করে সেটা চলে যাচ্ছে অন্যমাথায়। জয়নালকে পেছন থেকে কে ধাক্কা দিয়েছে, সেটা জানা অসম্ভব। এটা ধাক্কাধাক্কির জায়গা, এটা এখানে চলবেই। মাঝখান থেকে মহিলাটি ভুল বুঝে ফেলল। তার বোঝা উচিত ছিল- এরকম নিশ্ছিদ্র ভিড়ভাট্টার মাঝে উদ্দেশ্যমূলক বাদেও হুটোপুটিতেও ধাক্কা লাগতে পারে। মহিলার জোরচিৎকারে কাছাকাছির কয়েকজন উৎসুক জনতা জয়নালের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকজন তো মহিলার সাথে তাল মিলিয়ে তাকে গালাগাল দিতে শুরু করল। হরহামেশাই এমন হয়। নারী আর পুরুষে সংঘর্ষ হলে সব দোষ যেন পুরুষের দিকেই যায়। তাছাড়া মহিলার হয়ে কথা বললে সুনজরে আসার সুযোগও রয়েছে। যেন নারীর সুনজরে আসতে পারাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ সফলতা।
জয়নালের এইমুহুর্তে খুব অসহায় লাগছে। সে এখন নিজের নির্দোষিতার গান গাইলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। জনগণ নারীর পক্ষে আছে। জয়নাল তবু চুপ করে থাকেনি। সে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল, "জটলাটার দিকে চাইয়া দেখেন আপা। এইখানে কে কার মাথায় পাড়া দিতেছে, কার ধাক্কা কে খাইতেছে- কোনো ঠিকঠিকানা নাই। আমি আপনারে উদ্দেশ্য নিয়া ধাক্কা মারিনাই। আমারে পিছন থিকা ধাক্কা দেছে। আপা, আমার ঘরে আমি বাদে আর সব মহিলা। ওগোরে ক্যামনে সম্মান দেতে হয়, এইডা আমার চাইতে কেউ ভালো জানেনা।"
জয়নালের বলায় কিছু একটা ছিল যার কারণে মহিলাটি আর কিছু না বলল না। সম্ভবত তার চোখের দিকে তাকিয়ে তার কথার সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। উৎসুক জনতার ক্ষুদ্র একটা অংশও তার পক্ষে গাইতে শুরু করল এবার। তবে ঘটনা আর বেশিদূর এগোলো না। এখানেই এর পরিসমাপ্তি। জয়নাল আবার শিশুদের জামাকাপড়ের দোকানের খোঁজে পা বাড়াল।

সমগ্র নিউমার্কেট এক চক্কর দিতে পাক্কা দেড়ঘন্টা লাগল। এরমাঝে অনেকগুলো বেবিড্রেস দেখা হয়েছে। কিছু মনে ধরেছে, কিন্তু মাপে বড়। আবার কিছু দামে বনেনি। এখনকার বাচ্চাদের পোশাক আর বড়দের পোশাকের মূল্যের মাঝে খুব একটা ব্যবধান নেই। তারওপর ঈদের মৌসুম। সমস্ত কিছুর দাম হুহু করে বেড়ে গেছে। আকাশচুম্বী বিক্রয়মূল্য। তবু কিছু করার নেই। ছোটদের যেকোনো পণ্যের দাম দেখলে চলে না। এসবের সাথে ইমোশন জড়িত থাকে।
ঘন্টাদুয়েক ঘোরাঘুরির পর লাল টুকটুকে একটা জামা জয়নালের খুব পছন্দ হলো। তার মেয়েটার গায়ে এই জামাটা দারুণ ফুটবে। লালপরীর মত লাগবে নিশ্চয়ই। জয়নাল জামাটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। মনে-মনে এই জামাটার আবরণে তার কলিজার টুকরা মেয়েকে কল্পনা করে নিল। তার বুক জুড়ে যেন অদ্ভুত একরকম অপার্থিব সুখ ছেয়ে আছে। কিন্তু সে এখনো নিশ্চিত হতে পারছেনা জামাটা মাপমতো হবে কি না। একটু বড় হলেও সমস্যা নেই। ছোট হলেই সমস্যা। জয়নাল অপারগ হয়ে অবশেষে তার বউকে ফোন করল।
"হ্যালো।" ফোনের ওপাশ থেকে বলল জয়নালের স্ত্রী ফাতিমা।
"এ ফাতিমা, জামা তো একটা খুব মনে ধরছে। কিন্তু মাপে হইবে কিনা বোঝতে পারতেছি না। এহন কী করমু কও তো?" বেশ উদ্বিগ্ন গলায় বলল জয়নাল। লাল টুকটুকে জামাটার প্রতি তার একধরণের টান চলে এসেছে।
"ওমা! আমি এইহানতে কমু ক্যামনে! জামা দেখলে নাহয় বলতে পারতাম।"
"জামাটা আমার দ্বারে খুব ভালা লাগছে বুঝলা? এইটা হাতছাড়া করতে মন চাইতেছে না।"
"কীরকমের জামা ওইটা?"
"একছের লাল বেনারসির মতন। মাইয়াটারে এইটা পরাইলে পরীর লাহান দেখাইবে। লাল পরী।"
ফাতিমা বুঝতে পারলো ঐ লালজামাটা তার স্বামীর খুব পছন্দ হয়েছে। নাহলে তার স্বামী এতটা আবেগতাড়িত হয়ে কথা বলত না। মেয়ের প্রতি বাপের মায়া দেখে ফাতিমার মন ভরে গেল। সে বলল, "আচ্ছা। তোমার যখন এতই পছন্দ হইছে, নিয়া আসো। কপাল ভালা থাকলে মাইয়ারে হইবো। না হইলেও সমস্যা নাই। তার অনেক জামা আছে।"
বউয়ের সাথে কথা বলেও জয়নালের মনের দ্বিধা দূর হয়নি। সে জামাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানি তাকে বারবার তাড়া দিতে লাগল। হয় 'মাল' ক্রয় করতে হবে, না হয় জায়গা ছাড়তে হবে। এভাবে শুধু-শুধু ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। কাস্টমার অনেক আছে। সে না কিনলেও 'মাল' কেনার লোকের অভাব হবে না।
জয়নাল মন খারাপ করে জায়গা ছেড়ে দিয়ে একপাশে সরে গেল। তার চোখ এখনো জামাটার দিকে। আহারে- এই জামাটায় তার মেয়েটাকে কত সুন্দরই না লাগত! শুধুমাত্র মাপে হবে কিনা এই আন্দাজ করতে না পারার কারণে জামাটা হাতের কাছে পেয়েও কিনতে পারছে না। মানুষ টাকার জন্য কিনতে পারেনা। অথচ এইসময়ে তার কাছে বেশ ভালো পরিমাণ টাকা আছে।
জয়নাল হঠাৎ দেখতে পেল এক মহিলা দোকানে ঢোকামাত্রই তার পছন্দের লালজামাটি হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। মহিলার কোলে বাচ্চা। জয়নাল মহিলাটিকে একনজর দেখেই চিনতে পারল। খানিকক্ষণ আগে এই মহিলাই তাকে ভুল বুঝে থাপ্পড় মেরেছিল। মহিলার কোলের বাচ্চাটা মেয়েশিশু। ঐ ভীড়ের সময় কোলে কেউ ছিল না। সম্ভবত বাচ্চাটা অন্য কারো কাছে ছিল। মেয়েশিশুটি ঠিক জয়নালের কন্যা জুলির মত। শরীরের স্বাস্থ্য ও আকার একইরকম। ভালোমতো দেখার জন্য জয়নাল সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
মহিলাটি দোকানে ঢোকার একমিনিটের মাথায় লালজামাটি কিনে ফেলল। দোকানিকে টাকা দেয়াও হয়ে গেছে। তার মানে মহিলাটি এক্ষুনি দোকান থেকে বেরিয়ে যাবে। জয়নাল দ্রুত এগিয়ে গেল। সুযোগটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। মহিলার কোলের বাচ্চামেয়েটার মাপে জামা কিনলে তার মেয়ের গায়েও জামাটা পুরা ফিট হবে।
জয়নাল দোকানে ঢুকে মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে দোকানিকে বলল, "ভাই, আমি যেই জামাডা দেখছিলাম, ঐডা তো এই আপায় কিনে ফেলছে। আপনি আমারে হুবহু এইরকম আরেকটা জামা দেন।"
দোকানি নিরস গলায় বলল, "এই 'মাল' আর নাই। ইস্টক শেষ।"
জয়নালের মনে হলো তার কলিজায় কেউ চোখা পেরেক ঢুকিয়ে দিল। একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তার চোখে পানি চলে এলো। আপাতদৃষ্টিতে এটা নিতান্তই ছেলেমানুষে ব্যাপার। কিন্তু একজন বাবার পক্ষ থেকে দেখলে সামান্য এই তুচ্ছ ঘটনাটিও ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক।
দুঃখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জয়নাল দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছেও লাভ হচ্ছে না। অনর্গল অশ্রুজলে চোখ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় মহিলাটি তার সামনে এলো। মহিলার চোখে অবাক বিস্ময়। ঘন্টাদুয়েক আগে এই লোকটিকে সে চড় মেরেছিল। তখন কিন্তু লোকটার মুখশ্রী একটুও পাল্টায়নি। অথচ এখন তুচ্ছ একটা কারণে লোকটা কাঁদছে! ভরা বাজারে পুরুষের চোখে জল কৌতুহলেরই ব্যাপার। মহিলা উৎসুক গলায় বলল, "কী হয়েছে ভাই? আপনি কাঁদছেন কেন?"
জয়নাল চোখ মুছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি মহিলাকে বুঝিয়ে বলল। সব শুনে ভদ্রমহিলা মুখভরা হাসি দিয়ে বলল, "জামাটা অবশ্য আমারও খুব পছন্দ হয়েছে। তবে আপনি যখন এই জামার জন্য চোখের পানি ফেলেছেন, আমি এটা আর নিতে পারব না। এটা আপনিই নিন।"
জয়নাল বুঝতে পারছেনা কী বলবে। একধরণের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো তার মনে। মহিলার এই কথায় সে খুশি হবে নাকি অবাক হবে সেটাও বুঝতে পারছে না। তবে এই মুহূর্তেও সে ভদ্রতাজ্ঞান হারায়নি। সে বলল, "থাক আপা। এইটা আপনিই নিছিলেন। আপনিই নিয়া যান। এইটা হয়ত আমার মাইয়ার কপালে নাই।"
"না ভাই। আমি এই জামাটা নিয়ে গেলে মনে শান্তি পাব না। আমার টাকপয়সার খুব একটা অভাব নেই। আমার মেয়ের জন্য অঢেল জামা বাড়িতেই আছে।"
জয়নাল মহিলার কোলের বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বলল, "নাম কী বাবুর?"
"মিলি। আর আপনার মেয়ের?"
"জুলি।"
"আচ্ছা। আপনি তাহলে জামাটা নিয়ে যান।"
এই বলে মহিলা জামার ব্যাগটি বাড়িয়ে দিল। জয়নাল বলল, "আপা, আপনারে যে কী বইলা ধন্যবাদ দেব বোঝতে পারতেছি না। জামাটা আমার আসলেই মনে ধরছিল। আপনি কত দিয়া কিনছেন আমারে কন। আমি আপনারে দাম দিয়া দেই।"
"দাম দিতে হবে না। এটা আমি আপনার মেয়েকে ঈদের উপহার হিসেবে দিলাম।"
"তা ক্যামনে হয় আপা! আপনার তো তাইলে লস...."
মহিলা তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, "দাম দিতে চাইলে আমি জামা দেব না ভাই। আমার মেয়ের জন্য জামা কেনা যে কথা, আপনার মেয়ের জন্য কেনাও একই কথা। পৃথিবীর সব মানুষই সব শিশুদের বাবা-মা।"
জয়নাল আর কিছু বলতে পারল না। মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতায় সে নুইয়ে যাচ্ছে। জামার ব্যাগটা হাতে নিতেই তার মনটা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সম্ভবত এই আনন্দ পৃথিবীর সবচাইতে বড় আনন্দগুলোর একটি। যা বর্ণমালার ভাষা দিয়ে বোঝানো সম্ভব না।

ঢাকা শহর। এ শহরে বেঁচে থাকা অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। উন্নয়নের অগ্রগতিতে শহরটি ধীরেধীরে বহির্বিশ্বে ‘উন্নত শহর' এর তালিকায় নাম লেখালেও এ শহরের সবচেয়ে বড় ত্রুটি অব্যবস্থাপনার খুব একটা তারতম্য ঘটেনি। বিশৃঙ্খলা আর দুর্নীতিভরা ভুল পরিচালনায় শহরের বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ অংশ পড়ে রয়েছে হুমকির মুখে। অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, বিল্ডিং ধস, বিদুৎ বিভ্রাট, দাহ্য পদার্থের মহাবিস্ফোরণ- এসবের সবই এ শহরে বলতে গেলে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। শহরের মানুষগুলোও জানে যেকোনো সময় যেকোনোভাবে তারা এইসব দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে। তবু তাদের মাঝে নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কোনো সচেতনতা নেই। কোনো কিছু দেখতে-দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সেটা অবলীলায় গা সওয়া হয়ে যায়। সেটা নিয়ে মনের ভেতর আর ভীতির সঞ্চার হয় না। এই অদ্ভুত শহরের অদ্ভুত মানুষগুলো নিজেদের জীবন নিয়ে প্রতিনিয়ত জুয়া খেলে যাচ্ছে। এভাবেই ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে একটি দেশের রাজধানী।

ফাতিমা সেলাই মেশিনে বসে 'খটরখটর' করে যাচ্ছে। জুলির জন্য ফতুয়া সেলাই করছে। যা গরম পড়া শুরু করেছে, মেয়েটাকে গোলগাল জুব্বার মত জামা পড়ানো দায় হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা একটুকু গরম সহ্য করতে পারে না। পাতলা কাপড় দিয়ে ঢিলেঢালা ফতুয়া বানিয়ে দিলে দু'বছরের মেয়েটা এই গরম আরামসে কাটাতে পারবে।
বিকেল হয়ে এসেছে। জুলির বাপ দুপুরের পর আর ফোন করেনি। অবশ্য ফাতিমা নিজেও সেলাই নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ফোন করতে পারেনি। মানুষটা একটা লাল জামার কথা বলছিল। সেটা শেষমেশ কিনতে পেরেছে কিনা সেটাও জানা হয়নি। ফাতিমা জুলির বাপের নাম্বার উঠিয়ে ফোন করল। রিং হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। টানা তিনবার দেবার পরও ওপাশ থেকে সাড়া নেই। ফাতিমা বুঝতে পারল মানুষটা প্রচণ্ড ভীড়ের মাঝে আছে। ভীড়ের মাঝে ফোনের আওয়াজ শুনতে না পারারই কথা। ফাতিমা ফোন রেখে জুলিকে কোলে নিয়ে স্নেহাদরে মন দিল।
এমন সময় পাশের বাড়ির রহিমা ভাবী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো ফাতিমাদের উঠোনে। চিৎকার করে বলল, "ফাতিমা রে, তাত্তাড়ি আয়। দেইখা যা রে বইন।"
রহিমা ভাবীর চোখমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। ওর সারা শরীর কাঁপছে। ফাতিমা উদ্বিগ্নতার সহিত বলল, "কী হইছে ভাবী? এমুন করতেছ ক্যান?"
রহিমা ভাবী চোখের পানি ছেড়ে বিলাপের সুরে বলল, "জয়নালেরে টিভিতে দেখাইতেছে। সে তো আর জীবিত নাই। বিল্ডিং ভাইঙ্গা তার মাথার উপর পড়ছে রে।"
টিভির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফাতিমা। তার কোলে দু'বছরের ফুটফুটে জুলি। টিভিতে এখন এক মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। তাকে সাংবাদিক জিজ্ঞেস করছে, "এই লোকটিকে কি আপনি চেনেন?"
মহিলা করুণ মুখে বলল, "চিনি বলতে আজই প্রথম কথা হলো। আমি উনার নামও জানিনা। উনি তাঁর মেয়ের জন্য এই লালজামাটি পছন্দ করেছিলেন। ঘটনাক্রমে আমি এই জামাটি কিনে ফেলি। ভদ্রলোক খুব মন খারাপ করল। একপর্যায়ে কেঁদেই ফেলল। পরে আমি তাঁকে জামাটা তাঁর মেয়ের জন্য উপহার হিসেবে দিয়ে দিই। এরপর ভদ্রলোক চলে গেল। আর আমি আমার মেয়ের জামা কিনতে অন্য দোকানে চলে গেলাম। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ হলো। মার্কেটের ভেতরে দেখি মানুষ পাগলের মত ছোটাছুটি করছে। পরে জানতে পারি নীলক্ষেতের কাছে কোন একটা বিল্ডিং নাকি আচমকা ধসে পড়েছে। বিপদ কেটে যাবার পর এখানে এসে দেখি এই অবস্থা। বিল্ডিংটা ফুটপাতের একেবারে পাশেই বলে অনেক পথচারী মারা পড়েছে। তার মধ্যে এই লোকটিও আছে। যথাসম্ভব ভদ্রলোক এই লালজামাটি বুকে জাপটে ধরে হাঁটছিল। এই অবস্থায় উনি...."
মহিলা পুরো কথা আর শেষ করল না। তার গলার আওয়াজ শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে ঠিকভাবে কথা বলতে পারছেনা। গলা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। সাংবাদিকও তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। ক্যামেরাম্যান জয়নালের দিকে ক্যামেরা তাক করতেই টিভিতে জয়নালের মৃতদেহ দেখা গেল। তার শরীরের বুক পর্যন্ত ইটপাথরের দেয়াল চেপে আছে। শুধু মুখমণ্ডল অক্ষত রয়ে গেছে। চোখ দুটো খোলা। মুখে হালকা মুচকি হাসি। ক্যামেরাম্যান জুম করে জয়নালের মুখটা আরো কাছে আনলো। দেখে মনে হচ্ছে সে কোথাও শুয়ে কারো দিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসছে। শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে বলে তাকে মৃত বলে মনেই হচ্ছে না।
ফাতিমা নিথর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। সে নড়তে পারছে না। তার কোলে চেপে আছে জুলি। দু'বছরের এই মেয়েটা টিভিতে তার বাবাকে দেখে ঠিক চিনতে পারলো। জুলি টিভির দিকে হাত বাড়িয়ে বলতে লাগল, "বাবা, বাবা, বাবা...."

এঘটনার সুদীর্ঘ বাইশটি বছর পর মিলি নামের এক লাবণ্যময়ী তরুণী তার বৃদ্ধা মাকে একদিন খুব কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, "মাগো, সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আলমারির ওই লালজামাটা তুমি খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছো। এমনকি আমি যখন কোলের শিশু ছিলাম তখনও তুমি আমাকে এটা পরাওনি। কেন মা? এর পেছনে রহস্য কী?"
মিলির বৃদ্ধা মা উদাস মনে বলল, "এই জামাটা তোর বয়সী জুলি নামের একটা মেয়েকে আমি উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত জামাটা জুলি পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তাই আমি এটা কাউকে দেইনি। এই জামাটায় শুধুমাত্র জুলিরই অধিকার আছে। আর কারো না।"
মিলি কিছু না বলে অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকালো। জুলি নামের অজ্ঞাত মেয়েটি একটা অদ্ভুত কারণে তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দীর্ঘকাল ধরে। অথচ তাকে কখনো স্বচক্ষে দেখা হয়নি। মিলি আলমারি খুলে একটা ব্যাগ থেকে লালজামাটি বের করে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। এতবছর পরেও জামাটা ঝকঝকে নতুনের মত লাগছে।

(সমাপ্ত)

বিবাগী শাকিল

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই জুলাই, ২০২১ ভোর ৪:১৯

সেলিম আনোয়ার বলেছেন: সুন্দর।+

১৪ ই জুলাই, ২০২১ সকাল ৯:২৬

বিবাগী শাকিল বলেছেন: ধন্যবাদ। ❤️

২| ১৪ ই জুলাই, ২০২১ ভোর ৪:৪৫

দিগন্ত জর্জ বলেছেন: বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে লেখা সুন্দর, সাবলীল গল্প। ++

১৪ ই জুলাই, ২০২১ সকাল ৯:২৭

বিবাগী শাকিল বলেছেন: উৎশাহ পেলাম ভাইজান। ❤️

৩| ১৪ ই জুলাই, ২০২১ সকাল ৮:২২

শেরজা তপন বলেছেন: সময়ের অভাবে পুরো পড়তে পারলাম না! পরে পড়ব
যেটুক পড়লাম সেটুকেই প্লাস

১৪ ই জুলাই, ২০২১ সকাল ৯:২৮

বিবাগী শাকিল বলেছেন: অবশ্যই সময় করে তবেই পড়বেন। ইদানীং আমার সমস্যা হচ্ছে লিখতে বলেই লেখা দীর্ঘ হয়ে যায়।

৪| ১৪ ই জুলাই, ২০২১ সকাল ১০:১৮

নীল আকাশ বলেছেন: লেখার থীম খুব ভালো, কিন্তু আপনি অযথাই টেনে টেনে অনেক বড় করেছে। অনেক জায়গায় অপ্রাসঙ্গিক বাক্য টেনে এনেছেন। অতিরিক্ত লেখা হলে পাঠক পড়তে বিরক্ত হয়ে যায়।
নিয়ম মেনে লিখলে এই গল্প প্রায় অর্ধেক সাইজ হতো।

১৪ ই জুলাই, ২০২১ সকাল ১০:৩৫

বিবাগী শাকিল বলেছেন: চরিত্র নির্মাণ করতে এবং তার সামাজিক অবস্থান বোঝাতে অনেক বাড়তি কিছুই লিখতে হয়। এটা অর্ধেক করে পড়লে যে অনুভূতিটা পাওয়া যাবে, তার চেয়ে বেশি অনুভূতি হবে এই ভার্শনটাই পড়লে। কারণ প্রতিটা লাইনই মানুষের মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে।

পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। তবে আপনার অভিযোগ আমি অস্বীকার করছিনা। আমি আসলেই ছোট করে লিখতে পারিনা। লেখা সীমাবদ্ধ করে দিলে লিখে মজা পাইনা, সুবিধাও হয়না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.