![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিউবাকে নিয়ে যে তিনটে প্রশ্ন মিস লিসবেথের কাছে জানতে চাইলাম সেগুলো হল ১) কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস, ২)কিউবাতে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং ৩)পৃথিবীর সর্বোচ্চ সেতু। কিউবাতে আসার আগে টোরোন্টোর কামাল ভাই জানিয়েছিলেন যে ভারাডেরো থেকে হাভানার পথে পড়বে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সেতু। মিস লিসবেথ শেষের প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলেন। ভারাডেরো থেকে হাভানার রাস্তায় এই সেতুর উপর থামা নিষিদ্ধ, তবে তারা বাস চালিয়ে যাবেন ধীর গতিতে যাতে আমরা ছবি নিতে পারি। দুই পাহাড়ের মাঝে সংযোগকারী এই সেতু ৬০০ ফুট উচু পিলারের উপর দাঁড়িয়ে। গাছপালা, বনজংগল, নদী এবং পাহাড় মিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর এ যায়গা ভারাডেরো থেকে এক ঘন্টার দুরত্বে।
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে লিসবেথ জানালেন- ১৯৬২ সালের কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস ঘটেছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যে। তখন যুক্তরাস্ট্র কেনেডী এবং রাশিয়ায় ক্রুশ্চেভের আমল। ফিডেল ক্যাস্ট্রো সরকারকে উৎখাত করতে সি,আই,এ, প্রায় দেড় হাজার দেশত্যাগী কিউবানকে জাহাজে করে পাঠায় কিউবার দক্ষিনাঞ্চলের বে অফ পিগস(Bay of Pigs) এ। আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল্ যে কিউবায় পৌছে স্বপক্ষত্যাগীরা সরকার গঠন করলে তাদের স্বীকৃতি দিয়ে সে সরকারের অনুরোধে সামরিক সাহায্যের নামে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে পুনরায় দখল করে নেবে কিউবা।কিন্তু তাদের জাহাজে বিমান থেকে হামলা চালিয়ে এবং সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন চে'গুয়েভারা।ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য কিউবার অনুরোধে আন্তঃমহাদেশিক ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহ করতে সম্মত হয় রাশিয়া।আমেরিকার নাকের ডগার এ ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে আমেরিকার মূল ভূখন্ডে আঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারত কিউবা।আমেরিকার নৌবাহিনী তখন সারা কিউবা ঘিরে ফেলে অবরোধ করে রাখে যাতে করে রাশিয়ার কোনো জাহাজ কিউবায় পৌছাতে না পারে।অবস্থা এমন সংগীন হয়ে দাঁড়ায় যে, দু দেশ পৌছে যায় পারমানবিক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে।এটিই হল কিউবার মিসাইল সঙ্কট।এরপর ক্রুশ্চেভ এবং কেনেডীর মধ্যে চুক্তির পর অবরোধ তুলে নেয় আমেরিকা।চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া কথা দেয় যে তারা কিউবাকে ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহ করবে না এবং আমেরিকাও কিউবার ব্যাপারে নাক গলাবে না।
নোবেল জয়ী আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল তার উত্তরে লিসবেথ জানালেন যে হাভানা পৌছে আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন কারন হল, হাভানার যে হোটেলে লেখক সূদীর্ঘ বিশ বছর কাটিয়েছিলেন সেখানে পৌছালেই আমার প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর পেয়ে যাবো। একটু পরে যখন দেখতেই পাবো তখন শোনার দরকার নেই ভেবে আশ্বস্ত হলাম।মনে পড়ল অনেক দিন আগে পড়া চীনা প্রবাদ "Traveling thousands of miles is better than reading thousands of books." ।
ভারাডেরো হতে হাভানা আড়াই থেকে তিন ঘন্টার পথ। দেড় ঘন্টা পর সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতিতে বাস থামল এক স্নাক বারে। মিস লিসবেথ এ স্নাক বারের বিশেষ পানীয় "পিনা কোলাডা"র প্রশংসা করলেন খুব।আগে ভাগেই "পিনা কোলাডা" খেতে আগ্রহীদের নাম লিখে নিলেন লিসবেথ । সময়ের কিছুটা সাশ্রয়ের জন্যই এই ব্যাবস্থা।আলাদা ভাবে পিনা কোলাডার অর্ডার দিলে সময়ের অপচয় হত। স্নাক বারের এক কোনায় বাদ্যযন্ত্রীদল গান পরিবেশন করছিলেন,চমৎকার সে গান। ভেবেছিলাম রঙ্গীন কাঁচের গ্লাসে পিনা কোলাডা নিয়ে আসবেন ওয়েটার কিন্তু হাতে পেলাম একটা আনারস। আনারসের ভেতরে পরিবেশন করা এ পানীয় খেতে হয় আনারসের উপরের দিকের ছিদ্র দিয়ে ঢোকানো স্ট্র দিয়ে। ইচ্ছে অনুযায়ী কেউ কেউ আবার এতে মিশিয়ে নেন "হোয়াইট রাম"।অপূর্ব স্বাদের এ পানীয় মনে হল অমৃত।মিনিট বিশেক যাত্রা বিরতি শেষে বাস ছুটল হাভানার দিকে।
বাস ছাড়লে ট্যুরিস্ট গাইড মিস লিসবেথ ফিরে গেলেন কিউবার বাকী ইতিহাসে।উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে উপনিবেশিক স্পেনের বিরুদ্ধে কিউবাতে স্বাধীনতা সংগ্রাম দানা বেধে ওঠে। সে স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যের নামে পাঠানো আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ "USS Maine" বিস্ফোরিত হলে আমেরিকার সাথে স্পেনের যুদ্ধ বাঁধে।১৯০২ সালে নামকা ওয়াস্তে স্বাধীন হয় কিউবা।১৯০৮ সালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকার কাছে কিউবাকে হস্তান্তর করে স্পেন। এবার রক্ষক হয়ে দাড়ালো ভক্ষক। নামমাত্র স্বাধীন পুতুল সরকার ক্ষমতায় বসিয়ে পরোক্ষভাবে কিউবা শাসন করতে থাকল আমেরিকা।আমেরিকার এ দখলদারী সময়ে হাভানা হয়ে ওঠে আমেরিকানদের বিনোদনের শহর। বেশ্যাবৃত্তি, ঘুষ, জুয়া'র জন্য খ্যাতি লাভ করে হাভানা।১৯০২ সালের এক চুক্তির বরাত দিয়ে আজও কিউবার দক্ষিনের গুয়ানাতানামো উপসাগর তীরের চল্লিশ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে রেখেছে আমেরিকা যা গুয়ান্তানামো সামরিক বন্দীশালা হিসেবে পরিচিত।১৯৫৯সালের বিপ্লবের পর ইতি ঘটে আমেরিকান দখলদারীর, ঘূষ, জুয়া, বেশ্যাবৃত্তিরও পরিসমাপ্তি ঘটে।বিপ্লবী বীর চে' ফিদেল, রাউল আজও আগের মতই কিউবাতে পূজনীয়।অর্থনীতির প্রসঙ্গে টানলে সহযাত্রী মার্ক লিসবেথের কাছে কিউবার রফতানী পন্য সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তামাক, চিনি, কফি ইত্যাদির পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করলেন জনশক্তির। কিউবার শিক্ষা এবং চিকিৎসা যথেস্ট উন্নত মানের হওয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিউবার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক কাজ করেন ল্যাটিন আমেরিকা্র বিভিন্ন দেশে।কানাডা আমেরিকা এবং দক্ষিন আমেরিকা থেকে রোগীরা হাভানা আসেন চিকিৎসা নিতে। ফুটবলার মারাডোনা ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ইত্যাদি অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তিই চিকিৎসা নিয়েছেন এখানকার ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে।
হাভানা শহরের শুরুতেই চোখে পড়ল উত্তর এবং দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের পতাকা দিয়ে সাজানো স্টেডিয়াম।১৯৯১ সালের "Pan Am Games" এর আসর বসেছিলো এখানে। আমেরিকার দুই মহাদেশের সমস্ত দেশকে নিয়ে চার বছর পর পর অলিম্পিক গেমসের ঠিক এক বছর আগে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে "Pan Am Games" ১৯৫১ সাল থেকে।স্টেডিয়াম ছেড়ে মিনিট দশ পনের পর বাস ঢুকলো Havana Tunnel এ। ১৯৫২ সালে প্রায় তিন কিলো মিটার লম্বা এ টানেল নির্মান করেছিলো ফরাসীরা।হাভানা উপসাগর কিউবার স্থলভাগের মধ্যে পনের বিশ কিলোমিটার ঢুকে যাওয়ার প্রাকৃতিক কারনে হাভানা গড়ে ওঠে বন্দর এবং পোতাশ্রয় হিসেবে।এ উপসাগরের তল দিয়ে নির্মিত টানেল থেকে বেরিয়ে বাস গিয়ে ঢুকল মূল হাভানা শহরে।(চলবে)
১৯২৮ সালের ফোর্ড গাড়ী আজও চলছে ভারাডেরোর রাস্তায়।
ব্যাটারীচালিত অটোরিক্সা
হাভানার পথে।
১৯৫০ এর দশকের ডজ গাড়ী
হাভানা'র পথে।
স্নাক বার।
©somewhere in net ltd.
১|
২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৩
শ্রাবণধারা বলেছেন: আপনার লেখা এই সিরিজের সবগুলো পর্ব এই মাত্র পড়ে শেষ করলাম । অসাধারণ একটা সিরিজ । কিউবা নিয়ে এমন ভ্রমণ বৃত্তান্ত কখনো পড়ার সুযোগ হয়নি । বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, মানুষ, পরিবেশের সাথে ইতিহাসের বর্ণনা অত্যন্ত সমৃদ্ধ আর চমৎকার হয়েছে ।

কিউবা বলতেই মনে আসে সমাজতন্ত্র, বিপ্লবী চে আর ফিদল ক্যাস্ট্রো'র নাম। চে'র মোটরসাইকেল ডায়রী পড়েছিলাম বহুদিন আগে, মুভিটাও দেখেছিলাম। সেটা ছিল চে'র বিপ্লব পূর্ববর্ত্তী জীবন । আজ আর মনে নেই কলেরা আক্রান্ত যে গ্রামে গিয়ে চে' মানুষের সেবা করেছিলেন সেটা কি কিউবা নাকি দক্ষিন আমেরিকার অন্য কোন দেশ।
আপনার দেয়া ছবিগুলোও অনেক আগ্রহ নিয়ে দেখলাম । ব্লগের অন্যসব ভ্রমন পোস্টের চেয়ে বেশ আলাদা, উন্নতমানের । তবে আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে এ পোস্টের পাঠক সংখ্যা নিতান্তই কম, আর মন্তব্যের ঘর প্রায় ফাকা । আপনি যদি পোস্টের ছবি গুলো আগে দিয়ে পরে বর্ণনা দেন তবে অবশ্য অনেকেই দলে দলে আসবে ভ্রমণ বৃত্তান্ত চোখে দেখতে