নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Bangladesh my home

বীরেনদ্র

Nothing much to say about

বীরেনদ্র › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন হামিদুর এবং টুনটুনী পাখির গল্প।

১০ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৭:২৮

নতুন ঢাকায় পুরোনো বনেদী বাড়ী আজকাল সচরাচর চোখে পড়ে না। ধানমন্ডীতে সদর রাস্তার সাথে চারদিকের বড় বড় উচু অট্টালিকার ভীড়ে ছোট দোতলা এই বাড়ীটিকে মনে হয় বেমানান, বেখাপ্পা। উচু পাচিল ঘেরা জায়গার মাঝখানে ছোট্ট বাড়ী। মূল দালানকে ঘিরে চারদিকে অনেকখানি জায়গা , বাড়ীর সামনে উঠোন এবং ফুলের বাগান, পেছনে আম জাম কাঠালের গাছ ইত্যাদি। অতীতে জৌলুস ছিল এ বাড়ীর কিন্তু এখন এটি হতশ্রী। আশে পাশে আধুনিক হাল ফ্যাশনের উচু উচু দালান পাল্লা দিয়ে মাথা তুলছে প্রতিদিন, কিন্তু পরিবর্তনের কোনো ছোয়া লাগে নি এ বাড়ীটিতে । পাকিস্তান আমলে উনিশশো ষাট এর দশকে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠার সময় থেকে প্রায় একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ীটি । বাড়ীটি ইকবালদের। ইকবালের আব্বা সরকার থেকে লীজ নিয়ে এ বাড়ী বানিয়ছিলেন পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে। সে সময় ঢাকার অভিজাততম এলাকা ছিল ধানমন্ডি এবং ধনী ব্যাবসায়ী, বড় বেতনের চাকুরে, উচ্চ পদস্থ আমলা, রাজনীতিবিদ, প্রভৃতি হোমড়া চোমড়া ব্যাক্তিরা তখন বাস করতেন এখানে। ছোটবেলার দেখা সে ধানমন্ডী এখন আর নেই। স্বাধীনতার পর নতুন রাজধানী হিসেবে গুরুত্ব বাড়লো ঢাকার আর জনসংখ্যা বাড়তে থাকল হু হু করে। অপরিকল্পিতভাবে মাথা তোলা শুরু করল আকাশচুম্বী দালানগুলো একটা আরেকটার গা ঘেঁসে। বাসস্থানের সংকুলান হলো সত্যি কিন্তু ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে থাকল ফাকা যায়গা গুলো। স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বিদায় নিলো অধিকাংশ পুরোনো বনেদী আমলের দোতলা বাড়ীগুলো।
সত্তর দশকের শেষের দিকে ইকবালের আব্বা গত হলেন। ইকবাল এবং অনান্য ভাই বোনেরা একে একে পাড়ি জমালো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা অথবা আমেরিকায়। পাশাপাশি বাড়ী এবং সমবয়সী হওয়ার সুবাদে ইকবাল আমার ছেলেবেলার বন্ধু বা " ল্যাঙ্গোটিয়া কা ইয়ার" । শেষমেষ ইকবালও যখন দেশ ছাড়লো তারপর থেকে আর উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি বাড়ীটির। ইকবাল বিদেশে যাওয়ার পর বাড়ীতে নতুন ভাড়াটে হিসেবে এলেন সাজ্জাদ সাহেব। অনেকদিন পাশের বাড়ীতে থাকায় সদালাপী, ভাল মানুষ সাজ্জাদ সাহেবের সাথেও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে আমার।ইকবালদের বাসার সবচে' পরিচিত মুখ হলো দারোয়ান হামিদুর। হামিদুর এ বাড়ীর দারোয়ান কাম কেয়ারটেকার। বাড়ী পাহারা দেওয়ার পাশপাশি ভাড়া আদায়, বিদ্যুৎ্ পানির লাইনের মেরামত, বিল জমা দেওয়া ইত্যাদি সমস্ত দায়িত্বও হামিদুরের। বছরের তিনশ' পয়ষট্টি দিনের প্রায় সবদিন এমনকি ঈদের দিনেও হামিদুরকে দেখা যেত গেটের পাশে। দারোয়ানের খাকি পোষাক পরে, লাঠি হাতে ছোট্ট কাঠের টুলে বসে অথবা পায়চারী করে সতর্কভাবে বাড়ী পাহারা দিয়ে চলেছে হামিদ। হামিদের সতর্ক পাহারায় বাড়িতে কাক পক্ষী ঢোকার উপায় ছিলো না।তার ভাবসাব দেখে মনে হত নিজের বাড়ীই বুঝি পাহারা দিচ্ছে সে। পাঁচিল ঘেষা ছোট টিনের ঘরে বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকত হামিদ। আসা যাওয়ার পথে দেখা হলেই সালাম ঠুকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতো সে "ভালো আছেন স্যার?"।
মাঝে সাঝে দেশে এলে দেখা হত ইকবালের সাথে। অনেকদিন পর গত আগস্ট মাসে ইকবাল দেশে এলো।তার কাছে শুনলাম প্রপার্টি ডেভেলপার্সদের কাছে বাড়ী বিক্রি করে দিচ্ছে ওরা এবং সেই উপলক্ষেই ওর দেশে আসা। কেউই যখন থাকে না কি হবে এত বড় বাড়ী ফেলে রেখে? ইকবালেরা বাড়ী বিক্রি করে দিচ্ছে শুনে কেন জানি খারাপ লাগলো। ডেভেলপার পুরনো বাড়ী ভেঙ্গে ফেলে গড়ে তুলবে নতুন বহুতলা দালান, বিদায় নেবে গাছপালা, আলো-বাতাস। ভোর বেলার পাখীর কিচিরমিচির ডাকে প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গতো আমার। ঢাকা শহরের গাড়ী ঘোড়ার প্যাঁপুঁ আওয়াজ শুরু হওয়ার আগে পাখীর ডাককে মনে হত স্বর্গীয়।
ইকবাল চলে যাওয়ার মাস তিনেক পর একদিন সাজ্জাদ সাহেব জানালেন আগামী পরশু বাড়ী ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি কারন ডেভেলপার নোটিশ দিয়েছে বাড়ী ছাড়ার। অনেকদিনের পরিচিত মুখ সাজ্জাদ সাহেব চলে যাচ্ছেন শুনে আবারও খারাপ লাগলো আমার। সাজ্জাদ সাহেব চলে যাওয়ার দিন ঘুম ভাঙ্গলো একটু দেরী করে। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে রওয়ানা দিলাম সাজ্জাদ সাহেবকে বিদায় জানাতে। এত সকাল সকাল মালপত্র গুটিয়ে রওয়ানা দেবেন সাজ্জাদ সাহেব তা ভাবিনি। ইকবালদের বাড়ির গেটের সামনে যখন পৌছলাম মালপত্রের শেষ ট্রাকটা রাস্তার বাকে মোড় নিয়ে চলে যাচ্ছে, আর সাজ্জাদ সাহেব চলে গেছেন আরো আগে। গেট এর সামনের সে চির পরিচিত দৃশ্য আজ নেই। আধখোলা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেও কারো দেখা পেলাম না। আরো একটু এগোতেই চোখে পড়লো গাড়ী বারান্দায় গেট এর দিকে পিঠ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে হামিদুর। পায়ের শব্দে ফিরে তাকালো সে। ছলছল করছে হামিদের চোখ, এই বুঝি কেঁদে ফেলবে সে। কোনো কথা না বলে বাড়ির পেছনের গাছ গাছালির দিকে ছুটে পালালো হামিদ। হামিদের এ রকম অদ্ভুত আচরনের কারন বুঝতে না পেরে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম বাগানের দিকে। বাড়ীর পেছনের পুরোনো আম গাছ জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে চলেছে সে। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। কিছুক্ষন পর কান্না থামিয়ে হামিদ যা জানালো তা হলঃ-
এ বাড়ির মালিক ছিলেন হামিদের পূর্ব পুরুষেরা। সরকার যখন এ জমি অধিগ্রহন করে তখন বেশ কিছু টাকা পেয়েছিলেন হামিদের আব্বা। কিন্তু নগদ টাকা হাতে পেয়ে দু'হাতে খরচ করায় দু তিন বছরের মধ্যে স্বর্বশান্ত হয়ে যান তিনি। ইকবালের আব্বা দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ দেন হামিদের আব্বাকে। আব্বা মারা যাওয়ার পর হামিদ চাকরী পায় দারোয়ান হিসেবে। জড়িয়ে ধরে থাকা আম গাছ দেখিয়ে হামিদ জানালো অত্যন্তঃ সুস্বাদু এবং মিস্টি এ আম গাছ লাগিয়েছিলেন তার ঠাকুর্দা সুদুর মালদহ থেকে চারা এনে। ডেভেলপারের লোকজনের কাছ থেকে হামিদ জেনেছে যে তারা সমস্ত গাছপালা, এমনকি এ আম গাছও কেটে ফেলবে। আম গাছের ডালপালার দিকে দৃস্টি আকর্ষন করে জিজ্ঞেস করলো হামিদ " কিছু দেখতে পারছেন স্যার?" গাছের আগার দিকে তাকিয়ে তার প্রশ্নের কোনো কারন খুজে পেলাম না। সেই চিরপরিচিত আমগাছের ডালপালা, শীতের শুরুতে কিছুটা মলিন পাতাগুলো। কিছু দেখতে পেলেন স্যার?- হামিদের এ প্রশ্নের উত্তরে না সূচক মাথা নাড়লাম।"গাছে পাখী দেখতে পাচ্ছেন না? পাখীর বাসা দেখতে পাচ্ছেন না?" আমি উত্তর দিলাম " তা তো দেখতে পাচ্ছি কিন্তু এর মধ্যে নতুন কি আছে? কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে হামিদ জানালো- ছোটবেলা থেকে সে দেখে আসছে এ গাছের ডালে বসবাস করা টুনটুনি পাখীদের। পাখীরা এক ডাল থেকে উড়ে যায় অন্য ডালে, কিছিরমিচির করে গান গায়, ডিমপেড়ে তা' দেয় বাচ্চা ফোটায়, বাচ্চা পাখীদের খাবার খাওয়ায় মা টুনটুনি ইত্যাদি।আবার কাঁদতে শুরু করলো হামিদ।কান্না জড়ানো গলায় এবার জিজ্ঞেস করলো হামিদ " স্যার, এ আমগাছ কেটে ফেললে কোথায় যাবে টুনটুনি পাখীগুলো? কোথায় ডিম পাড়বে তারা?" হামিদের এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা ছিলো না, উত্তর দিতে পারিনি, আস্তে আস্তে হেটে বেরিয়ে এসেছিলাম ইকবালদের বাসা থেকে।
সৌজন্যে- কাজলদা

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৩১

শামছুল ইসলাম বলেছেন: সুন্দর গল্প ( না সত্যি কাহিনী) ।

ভাল লেগেছে।

ভাল থাকুন। সবসময়।

২| ১০ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:০৫

বিজন রয় বলেছেন: খুব ভাল লেগেছে।
সুন্দর।

৩| ১০ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:১৬

এ কে এম রেজাউল করিম বলেছেন:
প্রিয় বীরেনদ্র,
আজকে আপনার পোষ্টের এ লিখাটি পড়ে আমার বাল্য স্মৃতিগুলো আলোকিত হয়ে ধরা দিল।
১৯৭৩ জীবনে প্রথম গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছি, থাকতাম- শুক্রাবাদ, রাস্তা দিয়ে মেইন রোড (মিরপুর রোড) আসলেই রাস্তার অপাশে বংগবন্ধুর বাড়ি, ধানমন্ডির ৩২ নং রোড, হাতের বাম দিকে ধানমন্ডি লেক। ডান দিকে বংগবন্ধুর বাড়িসহ সেই পুরানো দিনের বাড়িগুলো স্মরনে সমুজ্জল। পড়তাম লাল্মাটিয়া বয়েজ হাই স্কুলে, লালমাটিয়ার সেই পুরানো দিনের বাড়ীগুলোর স্মৃতিও মনের ভেসে আসে।

পুরান দিনের স্মৃতি নিয়ে আপনার এ পোষ্টটি পড়ে খুব ভালো লাগল, সুভেচ্ছা জানবেন, এমনি আরো লিখা চাই আপনার কাছ থেকে।

৪| ১০ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:৫৯

বিপরীত বাক বলেছেন: ছোটবেলায় স্কুল পালিয়ে লেকের পাড়ে বা ধানমন্ডির বিভিন্ন রোডে ঘুরে বেড়াতাম। নীরব নির্জন এলাকা। নিরাপদ। স্কুল পালানো ছেলের ধরা খাওয়ার আশংকা কম। ক্লান্ত হলে এবাড়ীর গেট তো ওবাড়ীর সিড়িঘরে বসে থাকতাম। কখনও কখনও কোন বাড়ির দেয়ালে উঠে গাছের দু'একটা ডালপালা অথবা পাতা ছিড়ে নেয়ার চেষ্টা করতাম।

আর এখন? ধানমন্ডির ভিতর দিয়ে হাটা তো দুরের কথা, বাইক নিয়েও যখন যাই গা গুলিয়ে ওঠে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.