![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কানাডার নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে যখন হিমশিম খাচ্ছি হঠাৎ একদিন সামান্য সুসংবাদের চিঠি এল। রেভিনিউ কানাডার চিঠিতে লেখা " আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে রেভিনিউ কানাডা তোমাকে চাকুরীতে নিয়োগ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চাকুরীর শর্তাবলী অপর পৃষ্ঠায় লেখা আছে। রাজী থাকলে তিন সপ্তাহের মধ্যে জানাও। মাত্র চার মাসের চাকুরী। কানাডার অধিকাংশ চাকুরী এমনই,এই আছে তো এই নেই।বেতন বেশ ভালো হলেও কর্মস্থল হলো কানাডার ক্ষুদ্রতম প্রদেশ প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের রাজধানী শার্লোট টাউনে। যাবো কি যাবো না' র দোটানায় কিছুদিন কাটানোর পর শেষ মুহুর্তে চাকরী করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং একদিন বাক্সপ্যাটরা নিয়ে হাজির হলাম শার্লোট টাউনে।
ছোট প্রদেশের ছোট রাজধানী শহর শার্লোট টাউনে এটি আমার দ্বিতীয় পদার্পন। অল্পবিস্তর চেনা ছিল এ শহর, আর চেনা না থাকলেও খুব অসুবিধা হত না কারন সরকারী তত্বাবধানে থাকার ব্যাবস্থা ছিল চমৎকার। কিন্তু অন্যান্য পশ্চিমা শহরগুলোর মত এখানেও সমস্যা দেখা দিলো খাবার নিয়ে। ডাল ভাত না হলে আমার পেট ভরে না আর এই পান্ডব বিবর্জিত দেশে বাংলাদেশী তো দুরের কথা, ভারতীয় রেস্তোরাও নেই। ভাত খাওয়ার একমাত্র ভরসা হল বেশ কিছুটা দুরের চাইনিজ রেস্তোরাঁ।এখানে ভাত পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু ডাল নেই। মাছ পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু তাতে মাছের ঝোলের স্বাদ নেই। তবুও ম্যান্ডারিন নামের এই চাইনীজ রেস্তোরাঁ ছিল ভেতো বাংগালীর ভাত খাওয়ার একমাত্র ভরসা। সপ্তাহের কাজের দিনগুলোর অধিকাংশ দিনে ম্যান্ডারিনে যাওয়া সম্ভব হত না। তবে শনি এবং রবিবারে এ রেস্তোরাঁতে অন্নগ্রহন ছিল রুটিন ব্যাপার। এক রবিবারে দুপুরের খাবারের টেবিলে পল বেনিঞ্জারের সাথে আমার প্রথম আলাপ, তারপর পরিচয় এবং তারপর বন্ধুত্ব। পরিচয়ের কিছুদিন পর থেকে প্রতি শনি এবং রবিবার সকাল দশটায় গাড়ী নিয়ে হোটেলে হাজির হত পল এবং ছুটি নিত রাতের খাবার শেষে আমাকে হোটেলে পৌছে দিয়ে। পল বেনিঞ্জারের বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। স্লিম ফিগারের পলকে দেখে অবশ্য মনে হয় তার বয়স ষাটের নীচেই হবে। প্রত্যেক মানুষের জীবনেরই গল্প আছে। পল এর কাছ থেকে তার জীবনের যে গল্প শুনি তা হল-
ওর জন্ম ওন্টারিওর লন্ডন শহরে। মা ইটালিয়ান এবং বাবা আইরিশ। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবচে' ছোট পল। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের। ছোট বেলাতে মুখচোরা পল ছেলে অথবা মেয়ে কারো সাথে ভালোভাবে মিশতে পারতো না ফলে তার বন্ধু অথবা বান্ধবী খুব একটা ছিলো না। অনান্য ভাই বোনেরা যখন গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ব্যাস্ত পল তখন বসে থাকতো পড়ার টেবিলে অথবা টেলিভিশনের সামনে। স্কুল জীবনের শেষে এসেও যখন ছেলের গার্ল ফ্রেন্ড জুটলো না মা তাকে প্রায়ই বকাঝকা করতেন " তোকে কোনো মেয়ে পছন্দ করবে না, তোর যা স্বভাব তাতে গার্ল ফ্রেন্ডতো দুরের কথা, বৌও পাবি না তুই"। স্কুল জীবনের শেষ ধাপ ভালোভাবে পেরোনোর সময়ে তার মনে বদ্ধমুল ধারনা জন্মে যে তার দ্বারা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ডেটিং করা বা বিয়ে করা অসম্ভব। টোরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছরে অর্থাৎ তার বাইশ বছর বয়সে বিদ্রোহ করে ওঠে পলের মন। আস্তে আস্তে মদ, গাজা, মেয়ে সমস্ত কিছুতেই জড়িয়ে পড়ে এবং পরিবারের সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সে।এ ভাবে সাত বছর কাটায় সে। কাজকর্ম খুব একটা করে নি এই সময়ে এবং সোশ্যাল এসিস্ট্যান্স এর আটশো ডলার ছিল তার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। ছোটখাট অপরাধে এই সময়ে জেল খাটে বার তিনেক। শেষবার জেল থেকে বেরোনোর পর উনত্রিশ বছর বয়সে বন্ধুর পরামর্শে টোরোণ্টোর ইউনাইটেড চার্চে যাওয়া আসা শুরু করে পল বেনিঞ্জার। আমূল বদলে যায় পল। তখন থেকে সে একজন ধার্মিক ক্যাথলিক খৃস্টান। পলের ভাষ্য অনুযায়ী জেসাস তাকে মৃত্যুর হাত ফিরিয়ে এনেছেন। ছেড়ে দেওয়া পড়াশোনা আবার শুরু করে সে এবং ভালোভাবে পাশ করে ভাল চাকরীও পায়। একদিন চার্চে নোরার সাথে পরিচয় ঘটে যা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। দুই ছেলে হয় তাদের। বিয়ের নয় বছর পর ডিভোর্স দিয়ে চলে যায় নোরা। ছেলেরা মা'এর সাথে থাকলেও যোগাযোগ ছিল পল এর সাথে। সময় গড়াতে থাকে কিন্তু ভেঙ্গে যাওয়া সংসার আর জোড়া লাগে নি। ছেলেরা বড় হয়ে একজন চলে যায় ইংল্যান্ডে অন্যজন পর্তুগালে। চার বছরের কিছু বেশী্দিন আগে অবসর নিয়েছে পল । তিন হাজার ডলারের পেনশন দিয়ে ভালভাবে চলে যায় তার। এখন কানাডার এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়ায়। যখন যেখানে ভাল লাগে সেখানে তাবু ফেলে । শার্লোট টাউনে আছে বছর খানেক। মাঝে মাঝে বিদেশ ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে, এমনকি বাংলাদেশও ঘুরে গেছে তিন চারবার। বৌ বা ছেলেদের সাথে এখন তার কোনো যোগাযোগ নেই। জীবনে আর কোনোদিন মদ ছোয় নি পল তবে মেয়েদের প্রতি তার দুর্বলতা এই বয়সেও প্রচন্ড। সামান্য দু' একটা আলাপ হলেই যে কোনো মেয়েকে শায্যাসঙ্গীনি হওয়ার আমন্ত্রন জানায় সে। টিম হর্টনে কর্মরত ষোড়শী বা মেট্রোর সেলস গার্লকে প্রস্তাব দিয়ে অনেকবার হতাশ হতে দেখেছি পলকে। তার প্রস্তাব করার ধরন হল " Would you mind to have a cup of Coffee with me to-night? কফির আমন্ত্রন যে অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয় তা প্রথম জানতে পারি মন্ট্রিয়ালের এক বৌদির কাছে। এক সহকর্মী বৌদিকে কফির আমন্ত্রন জানালে বৌদি তা গ্রহন করেন। কফি খাওয়া শেষ হলে সহকর্মী আরো এগোতে চাইলে অবাক হন বৌদি । ততোধিক অবাক হয়ে বলে উ্ঠে সে সহকর্মী " একটু আগে তুমি না রাজী হলে, এখন না বলছো কেন?" অনেক মধ্যবয়সী মহিলা তো বটেই, এমনকি টিন এজার মেয়েদের সাথে রাত কাটাতে দেখেছি পলকে।এ সমস্ত অকপটে স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই তার। আমি অনেকবার পল'কে বলেছি কি দরকার এ সবের? বয়সতো কম হলো না? তার উত্তর হল "এটি আমাদের কালচার"। কেউ অসম্মতি জানালে তাতে পলের উৎসাহ কমে না। তার যুক্তি হল মেয়ে তো অসম্মতি জানাতেই পারে, এটা তার অধিকার।
শার্লোট টাউনে চার মাস দেখতে দেখতে কেটে গেলো। এর মধ্যে পলের সাথে আন্তরিকতা আরো বেড়েছে। টোরোন্টোতে ফেরার ফ্লাইট ছিলো সোমবার সকালে। রবিবারের দিন পলের তরফ থেকে ডিনার পার্টি শেষ হলো রাত এগারোটার দিকে। গাড়ীতে হোটেলে পৌছে দিয়ে সাধারনতঃ বিদায় নিত পল। আজ আমার সাথে রুমে চলে এল সে । মালপত্র গোছগাছ হয়েছে কিনা , অ্ন্যান্য সব বিল যেমন লন্ড্রীবিল, হোটেল বিল দেওয়া হয়েছে কিনা ইত্যাদি খোজ নেওয়ার পর তার নিজের কথা বলতে শুরু করলো পল।
আজ থেকে আট দশ বছর আগে কোম্পানীর ব্যবসায়িক কাজে ছয় মাস মত ঢাকাতে থাকতে হয়েছিলো পলকে। সে সময়ে ঘনিস্টভাবে মেশার সুযোগ হয় অনেকের সাথে। সবচে' বেশী ঘনিস্টতা গড়ে ওঠে মাহিন এবং তার পরিবারের সদস্যদের সাথে। বাঙ্গালীদের পারিবারিক বন্ধন ভীষনভাবে ভাল লেগে যায় তার। শার্লোট টাউনে আমাকে পেয়ে ঢাকার জীবন ফিরে পেতে চেয়েছিল সে। পল জানায় " সমস্ত মা্নুষের জীবনে একজন সঙ্গীর বা অবলম্বনের দরকার পড়ে। রোজ রাত নয়টা দশটার দিকে যখন তোমার বৌ'এর টেলিফোন আসে তখন তোমাকে ভীষন হিংসে হয়। আমি ভাবি পৃথিবীতে অন্ততঃ একজন তোমাকে অনুভব করে, তোমার জন্য চিন্তা করে কিন্তু আমার তো তেমন কেউ নেই, আমার কোনো অবলম্বন নেই। তাই তো আমি সবসময় একজন সঙ্গী খুজে ফিরি"। দেবদাস উপন্যাসের শেষ কথাগুলো বলেছিলাম পল'কে "মরনে ক্ষতি নাই, কিন্ত সে সময় যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌছে। যেন একটিও করুনার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারো এক ফোটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে। কথাগুলো ভীষন ভালো লেগেছিলো পল এর।
শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলো পল। ভাল করে ভাবতে শুরু করলাম পলের শেষ কথা গুলো। সত্যিই তো একাকীত্ব ভীষন কস্টকর, তাইতো মানুষ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একজন সঙ্গী চায়।
২| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৫:৪২
চাঁদগাজী বলেছেন:
আপনার কফির আমন্ত্রণ কেহ নিয়েছিল?
৩| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৩
গেম চেঞ্জার বলেছেন: পশ্চিমের সব উৎকর্ষ বৃথা হয়ে যায় পারিবারি প্রতিষ্টান ধ্বংস হয়ে যাবার কারণে!
৪| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৯
দৃষ্টিসীমানা বলেছেন: ভাল লাগা রইল ।
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৫:৩১
দ্যা ফয়েজ ভাই বলেছেন: ভালো লাগলো।