![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গতকাল প্রতিদিনের মত সান্ধ্যভ্রমনে বেরিয়ে বিদ্যুতদার টেলিফোন পেলাম।তখনই মনে পড়লয এদিনটি হল পনরই আগস্ট। দেরী না করে গিয়ে হাজির হলাম শোকদিবসে আয়োজিত ড্যানফোর্থের মিজান ফার্নিচারের অডিটোরিয়ামে। সাড়ে সাতটায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও স্মরনসভা শুরু হল আটটায়। টোরোন্টোর বঙ্গবন্ধু পরিষদ আয়োজিত এ শোকসভা পরিচালনা শুরু করলেন টোরোন্টর বিশিস্ট কবি দেলোয়ার হোসেন। একে একে মঞ্চে উঠে এলেন সভার সভাপতি আমিন ভাই, প্রধান অতিথি বিশিস্ট সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব হাসান ইমাম, বিশেষ অতিথি ডঃ মোজাম্মেল হোসেন খান এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত উপাচার্য্য আব্দুল ওয়াহেদ। এ আলোচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিভিন্ন দিক এবং ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করলেন বিভিন্ন বক্তা।
ডঃ মোজাম্মেল খানঃ- ১৯৭৫ সালে যুক্তরাস্ট্রে পিএইচডি করছিলেন তিনি। পনরই আগস্টের সন্ধ্যায় হোস্টেলে ফিরলে কোসিয়ের্জ মহিলা মোজাম্মেল ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন " তুমি তো বাংলাদেশের , একটু আগে খবরে দেখলাম তোমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমান সামরিক অভ্যুথানে নিহত হয়েছেন। মাথা ঘুরে উঠলো মোজাম্মেল ভাই এর ? এও কি সম্ভব? বিশ্বাস হচ্ছিলো না কথাটা। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন "ঠিক শুনেছেন তো?" মহিলা টেলিভিশন খুলে দিয়ে বললেন "ঠিক আছে ,নিজেই দেখো"। তারপর থেকে বুকের ভেতরে শোকের আগুন চেপে রেখে নিরন্তর লিখে গেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে। যেখানে গেছেন সেখানে স্বাধীনতার কথা বলেছেন, শেখ মুজিবের কথা বলেছেন। ১৯৯৩ সালে কানাডা চলে আসেন তিনি। ১৯৯৪ সালের স্বাধীনতা দিবসে ডয়েস রোডের লিজিয়ন হলে তাকে অতিথি বক্তা হিসেবে আমন্ত্রন জানালে তিনি উত্তর দেন " আমাকে আমার মত করে বলতে দিতে হবে"। উদ্যোক্তাদের সম্মতিক্রমে সে সভায় বক্তব্য দিতে উঠে শেখ মুজিবের নাম নিতেই রাজাকার আলীমের ছেলে বর্তমানে বি,এন,পি এর উপদেস্টা কমিটির সদস্য ফয়সল আলীম মাইক কেড়ে নিয়ে বলেছিল " আপনাকে শেখ মুজিবের নাম নিতে এখানে ডাকা হয় নি"। গতকালের সভায় স্বঃতস্ফুর্তভাবে লোকের অংশগ্রহন দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন " আপনাদের ছেলে মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শিক্ষা দিন, শেখ মুজিবের কথা বলুন। তারা যেন তাদের দেশকে, যে মহান নেতার কারনে আজ তারা বাঙ্গলাদেশী হিসেবে গর্ববোধ করে তারা যেন ভুলে না যায় সে মহান নেতাকে"।
কামাল ভাইঃ- ছিয়াশি বছর বয়স কামাল ভাই এর।ভালো ছবি আঁকতেন, লেখালিখি করতেন। এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, চলাফেরা করেন লাঠি ভর দিয়ে। অসুস্থ্য থাকা সত্বেও চলে এসেছেন বংগবন্ধু সম্পর্কে দু'একটা কথা বলতে। জন্মসুত্রে ভারতীয় নাগরিক হলেও ষাটের দশকে ঢাকাতেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। ছাত্রলীগ করতেন। ভাল ছবি আঁকার সুবাদে ছাত্রলীগের পোস্টার ব্যানার লিখতেন। ১৯৬৬ সালের পল্টন ময়দানে যে জনসভায় দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক ছয়দফা পেশ করেন সেই জনসভার মঞ্চের পেছনের বিশাল দৃশ্য একেছিলেন কামাল ভাই।
আখতারুজ্জামান ভাইঃ- টোরোণ্টোর বংগবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি আখতার ভাই এখানে আছেন বেশ কয়েক বছর। থাকেন কেনেডী রোড এবং এলসমেয়ার রোডের ইন্টারসেকশানে। কম্পিউটারের মাউস কিনতে গেছিলেন বাড়ীর পাশের এক দোকানে। দোকানীর চেহারা দেখে ধরে নিলেন যে তিনি আমাদের উপমহাদেশেরই কেউ হবেন। ছেলেটির নাম মুজিব। জিজ্ঞেস করলেন তাকে "তুমি কি বাংলাদেশী?" মাথা নাড়লো ছেলেটি। -তাহলে পাকিস্তানী বা ভারতীয়? এবারও মাথা নাড়লো সে। - তাহলে কোন দেশের তুমি? উত্তর দিল সে ছেলে "শ্রীলংকার"। তুমি কি মুসলমান? - "না"। তাহলে নাম মুজিব কেন? সে ছেলে জানালো " তার বাবা ছিলেন শেখ মুজিবের ভক্ত। ১৯৭৫ সালে তার জন্মের দু'দিন আগে সপরিবারে বংগবন্ধু নিহত হয়েছেন। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে যেন বড় হয়ে শেখ মুজিবের মত বড় মানুষ হয় তাই নাম রাখেন মুজিব।
ফুয়াদ ভাইঃ- ফুয়াদ ভাই এর আব্বা আওয়ামী লীগের এম,এল,এ ছিলেন। সেই সুবাদে শেখ মুজিবকে কাছে থেকে দেখেছেন। শেখ কামাল ফুয়াদ ভাই এর সহপাঠী এবং বন্ধু ছিলেন স্কুল জীবনে। তিনি জানালেন বংগবন্ধুর খুনী লেঃ কর্নেল নুর থাকেন এ শহরের এটোবিককে। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাখ্যানের পরও কানাডার আইনের সুযোগ নিয়ে এখনো টিকে আছে নুর চৌধুরী।
লুতফুন্নাহার লতাঃ- জনপ্রিয় অভিনেত্রী এবং আবৃত্তিশিল্পী লতা জানালেন তারা কত গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে মগবাজারের কমিউনিটি সেন্টারে মিটিং করছেন শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ জানাতে। তিনি আবৃত্তি করলেন তার কবিতা " যদি একশ' বছরও লাগে তবুও এ হত্যার আমি বদলা নেব"
মিন্টু ভাইঃ- টোরোন্টো থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলাদেশী পত্রিকা "দেশেবিদেশে"র সত্বাধিকারী মিন্টু ভাই তার পত্রিকার মধ্য দিয়ে সোচ্চার হন শেখ মুজিব হত্যার বিরুদ্ধে। বি,এন,পি সরকারের আমলে ডয়েস রোডের লিজিয়ন হলে শেখ মুজিবের হত্যাকারী ক্যাপ্টেন কিসমতকে গন ধোলাই দেন। ফলে জেলে যেতে হয় তাকে। বি,এনপি এর কর্মীরা স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তাকে ডিপোর্ট করার ব্যাবস্থা করে। আদালতের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত অব্যাহতি পান মিন্টু ভাই।
হাসান ইমামঃ- সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব হাসান ইমাম ছিলেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জানালেন তার অভিজ্ঞতার কথা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবসে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে রমনা পার্কের পাশের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গনভবনে।দেখা করার পর শেখ মুজিব তাকে বললেন "তুই বস। তোয়ার সাথে কথা আছে"।হাসান ইমাম বসে রইলেন একটু আড়ালে। বিদেশী কুটনীতিক এবং অন্যান্য অতিথিদের সাথে এক এক করে দেখা করে বিদায় জানাচ্ছিলেন মুজিব। অনেকক্ষন কেটে গেলেও যখন ডাক পড়ে না গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে আসছিলেন হাসান ইমাম। এমন সময় একজন পুলিস এসে ইমামকে ধরে নিয়ে গেল শেখ মুজিবের কাছে। শেখ মুজিব তাকে বললেন " তোকে না বলেছিলাম বসতে, তুই পালাচ্ছিস কেন? তুই অভিনয় করতে শুরু কর তোর মধ্যে প্রতিভা আছে। সেটাই হবে তোর দেশসেবা। হাসান ইমামের ভাষায় প্রত্যেকের হাড়ির খবর পর্যন্ত রাখতেন মুজিব। দ্বিতীয় ঘটনা হল - ১৯৭৪ সালে দেশে বন্যার ফলে দেখা দিল দূর্ভিক্ষ। চলচ্চিত্র শিল্পীরা তখন স্টেডিয়ামে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করে পাঁচ লক্ষ টাকা তুললেন। চলচ্চিত্র শিল্পীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র রহিমা খালার হাত দিয়ে সে টাকা শেখ মুজিবের হাতে তুলে দিলেন তারা। শেখ মুজিব সে টাকা গ্রহন করার সময় রহিমা খালা তাকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন " আল্লাহ তোমাকে বাচিয়ে রাখুন" । শেখ মুজিব উত্তরে বলেছিলেন"দোয়া করবেন, দেশের সমস্ত মানুষের মুখে যেন খাবার তুলে দিতে পারি। কেউ যেন না খেয়ে মারা না যায়" । এক বার প্যারিসের এক পার্কে জনৈক ফরাসী ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করছিলেন হাসান ইমাম। ভদ্রলোক বাংলাদেশে বাড়ী শুনে বলেছিলেন যারা নিজের পিতাকে খুন করতে পারে তাদের বিশ্বাস নেই। আর কথা না বলে হেটে চলে গিয়েছিলেন সে ভদ্রলোক। আরেক বার তাসখন্দের একজন সাধারন মানুষকে হাস্ন ইমাম বোঝাতে পারছিলেন না বাংলাদেশ কোথায় তখন সে বলে উঠলো "এটি শেখ মুজিবের দেশ কিনা"। ব্যাপারটা এমন যে সে বাঙ্গলাদেশ কোথায় ঠিক জানে না অথচ শেখ মুজিবকে চেনে। হাসান ইমাম ছিলেন শেষ বক্তা । এর পর সভাপতি তার ছোট বক্তব্য দিয়ে শেষ করে দিলেন এবারের পনরই আগস্টের শোকশভা।
©somewhere in net ltd.