![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মাস খানেক আগে বস্টোন ঘুরে দেখার এক পর্য্যায়ে ট্যুরিস্ট গাইড বস্টোন হারবারে নোঙ্গর করা অস্টাদশ শতাব্দীর জাহাজ তথা বস্টন টি পার্টি মিউজিয়ামের দিকে দৃস্টি আকর্ষন করেন। বস্টোন টি পার্টির ইতিহাস তুলে ধরে ট্যুরিস্ট গাইড সংক্ষেপে জানালেন যে "বস্টোন টি পার্টিতে আমেরিকানরা বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চা ধ্বংশ করে যে সংগ্রামের সুচনা করেন তা পরবর্তীতে আমেরিকাকে স্বাধীনতা এনে দেয়" । ট্যুরিস্ট গাইড আরো জানালেন যে বস্টোন টি পার্টির সমকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীন বাঙ্গলা বিহার উড়িষ্যায় এক কোটি মানুষ অনাহারে প্রান হারায় । এটি ছিল বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কর্তৃক এক নির্মম গনহত্যা যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
বস্টোন টি পার্টিঃ-
অস্টাদশ শতাব্দীতে বৃটেন এবং বৃটিশ কলোনীগুলোতে সবচে' জনপ্রিয় এবং অভিজাত পানীয় ছিল চা। গোড়ার দিকে চা যথেস্ট দামী ছিল কারন ইউরোপের প্রয়োজনীয় চা এর পুরোটাই আসত এশিয়া থেকে। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা বিহার উড়িষ্যা দখল করার পর বৃটেন এবং এর উপনিবেশগুলোতে চা'এর অন্যতম প্রধান যোগানদার ছিল এই কোম্পানী । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারত এবং চীন থেকে চা নিয়ে লন্ডনে নিলামে বিক্রী করত এবং সেখান থেকে চা রফতানী হত উত্তর আমেরিকায়। অস্টাদশ শতাব্দীর ষাট এর দশকে উত্তর আমেরিকাতে প্রতি বছর ১মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশী চা রফতানী হত লন্ডন থেকে। ১৭৬০ এর দশকে বৃটেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মূখীন হয়। এর প্রধান কারন হল উত্তর আমেরিকায় ফরাসীদের সাথে সাত বছর ব্যাপী(১৭৫৬-১৭৬৩) যুদ্ধ, এবং ভারত ও আফ্রিকাতে বৃটিশ সাম্রাজ্য বিস্তা্রের যুদ্ধ।এই অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বৃটেন তার উপনিবেশ আমেরিকা এবং অন্যান্য উপনিবেশগুলোতে চা এবং অনান্য সামগ্রীর উপর কর আরোপ করা শুরু করে; ফলে আমেরিকায় বৃটিশ চা এর দাম বেড়ে যায়। তখন হলান্ড এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে আমেরিকায় চা চোরাচালানী হতে থাকে। বৃটিশ চা'এর দাম বেশী হওয়ার কারনে চা অবিক্রীত থাকে এবং লন্ডনের গুদামে অবিক্রীত চা এর পাহাড় জমে ওঠে। ১৭৬৭ সালে বৃটেন ইন্ডেমনিটি টি এক্ট এর মাধ্যমে চা এর উপর থেকে কর প্রত্যাহার করে নেয়। ট্যাক্স প্রত্যাহারের ফলে বৃটিশ চা এর দাম চোরাচালানকৃত চায়ের সমান হয়। কিন্তু ১৭৬৭ সালের শেষের দিকে টাউনশেড রেভিনিউ এক্ট এর মাধ্যমে নতুন কর আরোপ করে বৃটেন। টাউনশেড আইনে কাঁচ,রঙ, কাগজ, ইত্যাদি অনেক পন্যের উপর করারোপ করা হয়। প্রতিবাদের মুখে ১৭৭০ সালে চা ব্যাতীত আন্যন্য সব পন্যের উপর কর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ১৭৭৩ সালের টি এক্ট এ বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে আমেরিকায় তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে চা বিক্রী করার একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়। বস্টোনের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি যেমন Samuel Adams, Paul Revere, John Hancock প্রমুখ এই টি এক্ট এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনকারীদের বলা হত "Sons of Liberty" । তারা মনে করতেন আমেরিকানদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া বৃটিশ পার্লামেন্ট কোন আইন তাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে না। অন্য দিকে বৃটিশরা মনে করত বৃটেন এবং তার কলোনীগুলো বৃটিশ পার্লামেন্টে প্রনীত আইন মেনে চলতে বাধ্য। পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে গড়াতে থাকে। ১৭৭৩ সালে ১৬ই ডিসেম্বর স্যামুয়েল এডামস এক জনসভায় ঘোষনা করেন " বৃটিশদের বিরুদ্ধে মিটিং করার দিন শেষ"।সেই দিনই রাত সাতটা থেকে নয়টার মধ্যে শতাধিক বস্টোনবাসী বৃটেন থেকে চা বয়ে আনা তিনটে জাহাজ, বিভার, ডার্টমাউথ এবং ইলিয়ানরে হামলা চালায়। হামলাকারীদের মধ্যে অনেকে মোহাক রেড ইন্ডিয়ানদের ছদ্মবেশ পরে ছিল। তারা প্রায় ছেচল্লিশ টন চা জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেয়। চা ধংশ করার এ ঘটনা বস্টোন টি পার্টি হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। এই ঘটনার মাত্র তিন বছর পর অর্থাৎ ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীনতা লাভ করে।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরঃ-
১৭৫৩ সালের পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর একে একে মীর জাফর , মীর কাশেম প্রভৃতি পুতুল নবাবকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ক্ষমতায় বসায়। ১৭৬৪ সালে তারা নবাবের কাছ থেকে বাঙ্গলা বিহার উড়িষ্যার "দেওয়ানী" অর্থাৎ ট্যাক্স আদায় করার একচ্ছত্র ক্ষমতা লাভ করে। এই ক্ষমতা লাভের পর পরই তারা জমির খাজনা পাঁচগুন বাড়িয়ে দেয়।নবাবী আমলে কৃষককে যেখানে জমির খাজনা দিতে হত উৎপাদিত ফসলের ১০%, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলে কৃষককে তাদের জমির খাজনা দিতে হত উৎপাদিত ফসলের ৫০%। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সবসময় তাদের লাভের উপরই গুরুত্ব দিত, ভারতীয়দের জীবন নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা ছিল না। যে ফসলে তাদের যত বেশী লাভ তারা কৃষকদেরকে সেই ফসল ফলাতে বাধ্য করত। উদাহরন্ স্বরুপ বলা যায় সে সময়ে কৃষকদের নীল এবং আফিম চাষে বাধ্য করার কথা। ১৭৬৯ সালে বাঙ্গলা বিহার উড়িষ্যা অঞ্চল খরা কবলিত হয়ে পড়ে। শুরু হয় দুর্ভিক্ষ এবং অনাহা্রে মৃত্যু।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনের তৎকালীন খরা কবলিত অঞ্চল ছিল আজকের দিনের বাঙ্গলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ঊড়িশ্যা, আসামের কিছু অংশ এবং ঝাড়খন্ড। খাদ্যের অভাবে এ অঞ্চলে প্রান হারায় এক কোটী মানুষ যা ছিল এতদঞ্চলের তৎকালীন জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। খাদ্যের অভাবে মানুষ ঘাস পাতা খেয়ে জীবন ধারনের বৃথা চেস্টা চালায়।মৃত্যুর ফলে গ্রামকে গ্রাম জনশুন্য হয়ে পড়ে এবং বিরান এলাকাগুলোতে গজিয়ে ওঠে বনজঙ্গল। এ এলাকাগুলোতে ফের জনবসতি গড়ে উঠতে সময় লাগে একশ বছরেরও বেশী। সবচে' বেশী ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ছিল পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম। খাদ্যের অভাবে মানুষ দেশগ্রাম ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে বাঁচার চেস্টা করে, কিন্তু অধিকাংশের ভাগ্যে খাদ্যের পরিবর্তে মৃত্যু জোটে। দুঃখের ব্যাপার হল যে ১৭৭০-৭১ সালে যখন লাখে লাখে মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী জমির খাজনা এবং অন্যান্য শুল্ক আরো ১০% বাড়িয়ে দেয়। এই দুর্ভিক্ষ চলে ১৭৭৩ সালের শেষ পর্যন্ত। বাঙ্গলা ১১৭৬ সাল ( ইংরেজী ১৭৬৯ সাল) অনুসারে এ দুর্ভিক্ষ "৭৬ এর মন্বন্তর" হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৭৭৪ সালে যথেস্ট বৃস্টিপাত হলে দুর্ভিক্ষ ক্রমে ক্রমে কমে আসে। কিন্তু দুর্ভিক্ষ থেমে থাকে নি। বৃটিশ শাসনামলে নিদেনপক্ষে এক ডজন বড় দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে ভারতবর্ষ। সর্বশেষ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ১৯৪৩ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই দিনগুলোতেও ভারত বর্ষে খাদ্যাভাব দেখা দিলেও বৃটিশ প্রশাসন পাত্তা দেয় নি। যুদ্ধ প্রচেস্টায় ভারত থেকে সম্পদ পাচার এ দিনগুলোতেও অব্যাহত রাখে বৃটিশ সরকার। সবচে' ঘৃন্য মন্তব্য করেন তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল “Famine or no famine, Indians will breed like rabbits.”। ভারতীয় গভর্নর জেনারেল অনাহারে মৃত্যুর উল্লেখ করে সাহায্য চাইলে তিনি বলেন “Then why hasn’t Gandhi died yet?"। বৃটিশ শাসনামলের সমস্ত দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যু যদি একত্রিত করা হয় তা নিঃসন্দেহে কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
©somewhere in net ltd.