নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ঝিলাম নদীর দেশ

আমি যত ভালোবাসি ততই উজ্জ্ল হয় সে তোমার নাম...

বুলবুল সরওয়ার

কবিতাই প্রিয়। কিন্তু গদ্যও যে তার আরশিনগর। তাই নারীর চেয়ে যতই প্রিয় বলি দেশকে; প্রকৃতি হেসে বলেঃ ও হলো কথার কথা। এভাবেই একদিন প্রেমে পড়লাম ঢাকার... স্বপ্নের মত সুন্দরী এক বারবনিতা। থাক এসব ব্যক্তিগত প্যাচাল। তার চেয়ে আসুন পাঠ হোক...

বুলবুল সরওয়ার › বিস্তারিত পোস্টঃ

নয়নমোহিনী ইস্তাম্বুল-১ / বুলবুল সরওয়ার

০২ রা মে, ২০১২ রাত ১২:১৬

নয়নমোহিনী ইস্তাম্বুল-১ / বুলবুল সরওয়ার

ইবনে বতুতার ভ্রমন-ইতিহাস পড়েছি শৈশবে। গল্পের বুননেও যে থাকেপ্রদর্শনের অমিত শক্তি- পরবর্তীতে হাড়ে-মজ্জায় টের পেয়েছি সৈয়দ মুজতবা আলীতেও। উদয়ন পত্রিকা আর প্রগতি-রাদুগা প্রকাশন যখন স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিল ভাসিলি ইয়ানকে- তখনই শিখেছি : ভ্রমণ একটি মাধ্যম। অত্যন্ত শক্তিশালী ধারা। ‘রম্যানী বৃক্ষ’ কিনতে শুরু করি কলেজেই। সানাউল হক এবং জগলুল হায়দার আফরিককে ভুলতে না পারার কুফল---“ঝিলাম নদীর দেশ”। মরহুম হাসনাইন ইমতিয়াজ, ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর এবং অনন্ত-অভিসারী আবদুল মান্নান তালিবের অনুপ্রেরণা, পরামর্শ, সংশোধনী দিয়ে হাঁটি হাঁটি পা। এরপর মাহবুবুল হকের বদান্যতায় আলোয় প্রত্যাবর্তন। এই পথযাত্রার পরোক্ষে সবসময়ই ছিলেন শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আর ব্রাদার আলবেরিকের নব্বই-বছরের পাঠ যে আমাকে কতটা শক্তি যুগিয়েছে তার নির্ণায়ক নিক্তি আজও তৈরী হয়নি।

বিখ্যাত নাইন-ইলেভেন প্রথম ছিলাম সস্ত্রীক ইস্তাবুল পথের-যাত্রী হলাম। তারপর আরো গিয়েছি। অর্থাভাবে কখনো ডাকাতী করেছি মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের পকেট। কখনো স্ত্রীকে বঞ্চিত করেছি দূর আবরের নেশায়। ফাঁকে ফাঁকে বুঝতে চেষ্টা করেছি সেই স্বপ্নভূমিকে। খড়ম-পায়ের হূমায়ন-স্যারের (সাম্প্রতিক) কটাক্ষ উপেক্ষা করেই যা-দেখেছি- তার ভেতরটায়ও উঁকি দিয়েছি-- হলোই বা তা দর্শন অথবা না-ই হলো ইতিহাস। ভাগ্যবান বহুলোকই তাজমহল দেখেছে, কিন্তু তাদের কজনই বা নজরুল হয়েছেন; সৌভাগ্য অনেকেই নিয়ে গেছে ভূস্বর্গ কাশ্মীরে, কিন্তু রবি-বাবু ছাড়া কেইবা দেখেছেন ঝিলমের তরবারি? পছন্দ বা সক্ষমতার তো এমন কোন বাধাধরা ধারক বা মাপক নেই যা লেখকের সৃজনক্ষমতাকে সীমানায় নির্ণীত করতে পারে।

তো আমি এ-ক্ষমাপ্রার্থনা দিয়েই আপনাদেরকে নিয়ে যেতে চাই তুর্কিস্থানে-- ইতিহাস ও ভূগোলের প্রাণকেন্দ্র সেই রহস্য-ভূমিতে--- যা হেলেন-অভ-ট্রয় থেকে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক পর্যন্ত জ্বলজ্বলে তারায় সমুজ্জ্বল। রাতের আকাশে মনপাখি যদি পাখিই না মেলল, তবে দেহপিঞ্জরে তাকে পুষে কি লাভ? তা্ই চলুন, ঝাপ দেই সেই নয়ন মোহিনীর উদাত্ত আলিঙ্গন।...

***



পাহাড়, সাগর, প্রাসাদ আর বিপরীত-আবহাওয়ার সেই সহাবস্থান পৃথিবীর খুব বেশি শহরে নেই- যা আছে ইস্তাম্বুলে। এর নাম থেকে শুরু করে ইতিহাস পর্যন্ত সব কিছুতেই বৈচিত্র্যের সমাহার। মনে হয়, এত পরস্পর-বিরোধীতার সমুজ্জ্বল উপস্থিতি দুনিয়ার আর কোন নগরীতে নেই।

প্রাচ্যের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী রাজাদের এই রাজধানী যেন স্বপ্নের শহর! বলা হয়, পৃথিবীর ইতিকথা যদি শুনতে চাও-- ইস্তাম্বুলের মাটিতে কান পাতো। যেদিকেই আমি চোখ ফেরাইঃ সেন্ট সোফিয়া কিংবা ব্লু মস্ক, টপকাপি প্রাসাদ কিংবা গ্র্যান্ড-বাজার-- বিমোহিত হয়ে পড়ি। অতীতের দিকে তাকালে দেখি- এখানেই সম্রাট দারিয়ুস, মহামতি আলেক্সান্ডার, ক্লিওপেট্রা, সালাদিন দ্য গ্রেট, মোহাম্মদ দ্য ম্যাগনিফিশেন্ট, অস্ট্রিয়-হাঙ্গেরী-জার্মান-রাশিয়ার দুঁদে সম্রাটেরা এসে ভীড় জমিয়েছেন। ভূগোল জুড়েও কী অপার বিস্ময়-- এটিই পৃথিবীর একমাত্র শহর, যা দুটো মহাদেশে অবস্থিত; দু’দুটো সাগরঃ ব্ল্যাক-সি ও মার্মারাকে যুক্ত করেছে এর বসফরাস-প্রণালী ঝুলন্ত ব্রীজ হবার আগ পর্যন্ত যে বারবার বিচ্ছিন্ন করেছে উচ্চাভিলাষী সেনানায়কদের অসংখ্য ষড়যন্ত্র! বসফরাসের দক্ষিণ প্রান্তে, গন্ডারের শিঙের যে শাখাটি ঢুকে গেছে ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় পেটে--‘দ্য গোল্ডেন হর্ন’- অনাদীকাল থেকে দোলা জাগিয়েছে সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটকদের চেতনায়। বিচিত্র মানুষের বহুবিচিত্র রঙ-রূপ-ভাষা ছাড়াও এ শহরে আছে চা-কফি-শরাবের ঢালাও আয়োজন; প্রাচ্য-প্রতীত্যের মিলনের তীব্র চেষ্টা এবং কামাল আতাতুর্কের বিস্ময়কর নিরব উপস্থিতি। পর্দার আড়ালে কিছু ক্রন্দনধ্বনিও আছে, কিন্তু সেগুলো শুনতে চাইলে আপনার চেতনাকে পান্না দিয়ে রাঙাতে হবে। থাক আপাতত রবি ঠাকুরের সেই স্বপ্নরঙিন কথকতা।

*

আমি আর আনোয়ার আয়া-সোফিয়া আর ব্লু-মস্কের মধ্যবর্তী ফুটপাতে বসে তুর্কীর বিখ্যাত তেতো-কফিতে চুমুক দিয়ে ওপাড়ের উঁচু পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের উত্তর পাশে ঝিলমিল করছে গোল্ডেন হর্ণ-- পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাকৃতিক-পোতাশ্রয়। এই হর্নের মুখ বন্ধ করেই ১৪৫৩ পর্যন্ত রোমানরা তুর্কীদের ইউরোপ-প্রবেশ ঠেকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সুলতান মোহাম্মদ-(টু) কল্পনার অতীত এক যুদ্ধকৌশলে পাহাড়ের উপর দিয়ে নৌ-বহর টেনে নিয়ে কনস্টান্টিনোপল্ জয় করেন। দ্বিতীয় মোহাম্মদকে এজন্য ‘ফাতিহ্’ বা ‘বিজয়ী’ (কনকোয়ারার) নামে অভিহিত করা হয়।



আয়া-সোফিয়া আর ব্লু-মস্ক ইস্তাম্বুলের এমন দুটি অনন্য স্থাপত্য যা ধর্ম, ইতিহাস, জাতিদ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে তুরস্কের প্রতীক-চিহ্ন। আইফেল টাওয়ার বা স্ট্যাচু অভ লিবার্টির চেয়ে বহু পুরানো এই নির্মাণ দুটিএকদিকে যেমন হৃদয় ও চোখকে মোহিত করে- অন্যদিকে তা চিন্তাকেও আপ্লুত করে মানুষের উচ্চতর আকাংখা ও স্বপ্নের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসায়। যুদ্ধ, রক্তপাত এবং শত-সহস্র সংঘর্ষের পরেও মানুষের শুভবুদ্ধি, সুন্দরের আরাধনা এবং মহত্বকেই তুলে ধরে এই অসাধারণ স্থাপনা দুটি।



দুটোই বসফরাসের পশ্চিম তীরে অর্থাৎ ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত। এই অংশকে আবার উত্তর-দক্ষিনে ভাগ করেছে গোল্ডেন হর্ণ। হর্ণের দক্ষিণ ভাগের নামই কনস্টান্টিনোপ্ল যেখানে ব্লু-মস্ক আর আয়া সোফিয়া এখনো দাড়িয়ে আছে সগৌরবে; উত্তরে আধুনিক নিমার্ণ- যার কেন্দ্রস্থলে তাকসীম আর ইসতিকলাল স্কয়ার। বসফরাসের উপর দুটি ঝুলন্ত ব্রীজ আর সংখ্যাহীন ফেরী-বোট যোগাযোগ রাখছে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে। এপাড় থেকে ওপাড়ে তাকালে শুধুই ব্যাকুলতা জাগে নজরুলের কবিতার মত : পাইনি বলে আজো তোমায় বাসছি ভালো রানী/ মধ্যে সাগর এপাড়-ওপার করছে কানাকানি।



তিন মাস আগে আমরা যখন সিনাইয়ে প্রবেশ করি- তখন সুয়েজ খালের উপর নির্মীয়মান ঝুলন্ত ব্রীজ দেখিয়ে আনোয়ার বলেছিল- এই হচ্ছে এশিয়া ও আফ্রিকার প্রথম স্থল-সংযোগ। যদিও সুয়েজের নীচ দিয়ে টানেল চালু হয়েছে বেশ ক’বছর আগে। বারো সপ্তাহ পার করে আজ দেখছি এশিয়া ইউরোপের মিলন-মালা। হে আমার জোড়া চোখের স্রষ্ঠা- তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তম। তুমি এই অধমের ভাগ্যে লিখেছো ইবনে বতুতার বিধিলিপি; অভাজনকে তুমি দিয়েছো ওমর খৈয়ামের স্বপ্নবিলাস। তুমি অকৃপণ নও বলে দরিদ্রতম দেশের এক ভিখিরিকে দিয়েছো রাজসিক অনুভব আর মস্তিষ্কে প্রজ্ঞার সামান্য পক্ষপাত...!

*

দেশ থেকে বাইরে পা ফেলার আগেই আমি দুটো বিষয় ভাবতে চা্ই: যেখানে যাচ্ছি, সেখানে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে কিনা। দ্বিতীয়ত: জায়গাটির নান্দনিক সৌন্দর্য হৃদয় ছোঁয় কিনা। প্রথমটি আমার প্রাণকে মুগ্ধ করে মায়াবতী নারীর মত- চেতনার পরতে পরতে তোলে ঢেউ। পরেরটিতে তৃপ্ত হয় চোখ, বুকের তৃঞ্চা আর বাসনার বহ্নি। এ কারণেই ঝকমকে বা আধুনিক শহর থেকে আমায় বেশি টানে ঐতিহাসিক স্থান। মুম্বাই ছেড়ে মুগ্ধ হই হায়দ্রাবাদে; মস্কো ছেড়ে প্রাণ ছোটে সমরখন্দ-বোখারায়। তবে দিল্লী-রোম-কায়রো-ইস্তাম্বুলের ক্ষেত্রে এ আবেগ পুরোপুরি খাটে না। এ সব নগরী সিদ্ধার্থের কমলার মত-- রূপে ও গুনে- দুটোতেই মনোহারিনী। সেখানে গেলেই জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের চেয়ে বাস্তব হয়ে ওঠে ক্লিওপেট্রা বা নেফারতিতির ছায়া। ইতিহাস যেন রাতের-জ্যোস্নার মত গ্রাস করে মনের-দিন। চেতনা বিহ্বল হয়ে পড়ে ঐতিহ্যের ছোঁয়ায় আর আবেগের প্রাবল্যের কাছে হার মানে যুক্তি। ক্লান্ত মাথা নত হয় মানুষের অবিনশ্বর কীর্তি, ইতিহাস আর রক্তগঙ্গার উত্তাল স্রোতে। তখন গুনগুন করে সুমনের জাতিস্বর গাই: যতবার তুমি জননী হয়েছো ততবার আমি পিতা...।

আবেগের তীব্র বিহ্বলতায় কার কাছ থেকে কখন ধারকর্জ করে প্লেনে চেপে বসি- নিজেই জানি না। সুন্দরী বিমান বালারা হয়ে ওঠে রোখসানা বা চায়না বেগম; আর আমিও হয়ে উঠি সুলতান মাহমুদ বা আলেক্সান্ডার দ্য-গ্রেট। ট্রাম-বাস-ট্রেন ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় ঘোড়ার গাড়ি বা অশ্বরথে; আর দরিদ্র কবি পা রাখে ক্ষুধিত পাষানের শ্যাঁওলাপরা সিড়ির পিচ্ছিল ধাপে...।

*

পৃথিবীর কেন্দ্রভূমি ইস্তাম্বুল অগুনিত রহস্যেরও আধার। কত স্মৃতি এখানে পাখা মেলেছে উপন্যাসের চেয়ে জান্তব ভাবে! আসার সনে পড়ে যায়--। বিকেলের মোহময়ী আলোয় মুগ্ধ মন আমার ধাবিত হল ইতিহাসের আলো আঁধারীতে। বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ থ্রিলার লেখক আগাথা ক্রিস্টির জীবন কাহিনী ইউরোপিয়ান ইস্তাম্বুলের পেরা-প্যালেস হোটেলে ডিনার খেতে গিয়েছিলাম গতকাল। লক্ষ্যঃ এই খ্যাতিমান হোটেলটিকে চর্মচক্ষুতে দেখা। ১৯২৬ থেকে ১৯৩২ এর মধ্যবর্তী সময়ে এ-হোটেলে প্রায়ই থাকতেন ক্রিস্টি। একবার হঠাৎ.হোটেল থেকে উধাও হয়ে যান তিনি। ১১ দিন পর্যন্ত তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সবারই মাথা খারাপ। এত নামজাদা লেখিকার কিছু হলে তো সর্বনাশ ! যাই হোক, সব শংকা ও আতংকের অবসান ঘটিয়ে ১২তম দিনে হঠাৎ তিনি ‘নাজিল’ হলেন। জেরবার স্বামী কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি স্ত্রীর এ রহস্যময়-আচরণ। বাকবিতন্ডায় কাটে তিন-তিনটি দিন। অবশেষে চতুর্থ সকালে স্বামী তাকে তালাক দিলেন। তবুও সেই ১১ দিনের বিষয় ক্রিস্টি মুখ না-খোলায় রহস্যপোন্যাসের চেয়েও জটিল হয়ে ওঠে এ-উপাখ্যান।



ষাটের দশকে এই লেখিকার জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী করতে যায় বিশ্বখ্যাত ওয়ার্নার ব্রাদার্স। সেই ১১ দিনের রহস্যের জট খোলা তখন জরুরী হয়ে দাঁড়াল। কোথাও কোন সুত্র না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ওয়ার্নারের গবেষকরা প্ল্যানচেটের সাহায্য নেন। তামারা র‌যান্ড নামের নির্ভরযোগ্য এক মিডিয়ামের মাধ্যমে প্রয়াত লেখিকাকে ডাকা হয়। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেনঃ ৪১১ নং কক্ষে রহস্যের সমাধান আছে। কোম্পানীর কর্মকর্তা, গবেষক এবং সাংবাদিকরা পেরা-প্যালসে ভীড় করেন। ওয়ার্নার ব্রাদার্স ৪১১ নং রুম ভাড়া নেন, কিন্তু রহস্যের সুরাহা হয় না। আবার তামারা র‌্যান্ডকে ডাকা হয়। এবার তামারা একটি পুরানো মর্চে ধরা চাবির সন্ধান বলেন- যা আগে কখনো ব্যবহার করা হয়নি। ওয়ার্নার কর্তৃপক্ষ চাবিটি ব্যবহার করতে চাইলে হোটেল-মালিক বিশ লাখ মার্কিন ডলার এবং নির্মিত ছবির শতকরা ১৫ ভাগ রয়্যালিটি দাবী করায় বিষয়টি জটিলতায় আটকে যায়।

পরবর্তীতে আবারও তামারা র‌্যান্ডের সাহায্য নিলে সে জানায়, চাবিটি সংরক্ষনের জন্য লেখিকার আত্মাই তাকে বারবার অনুরোধ জানাচ্ছে। কারণ, লেখিকার আত্মজীবনী লেখা ডায়রীটি ঐ চাবির আড়ালে লুকানো। সাংবাদিকদের কল্যাণে বিষয়টি চাউর হয়ে যায় এবং ওয়ার্নার কোম্পানী বিপুল জনদাবীর মুখে পড়ে। অবস্থা আঁচ করে ওয়ার্নার কোম্পানী শর্তে রাজী হয়। কিন্তু ততদিনে হোটেল মালিক মারা গেছেন গুপ্ত-বাক্সটির সন্ধান গোপন রেখেই। যদিও বাইওগ্লুর জোকাথিয়ান হোটেলে জনাব ড্যাশিয়েল হামেদের বাহুবন্ধনে সেই এগারো দিন ক্রিস্টি স্বেচ্ছায় বাহুবন্দী ছিলেন বলেও গুজব রটে যায়। কিন্তু এ গুজবের সত্যতা আর প্রমান করা যায় নি। ফলশ্র“তিতে ওয়ার্নারের সেই ডকুমেন্টারিও আর তৈরী হয়নি।

আমরা যখন পেরা-প্যালেসের রুমগুলো ঘুরে দেখার অনুমতি চাইলাম- ম্যানেজার বেঁকে বসল। দশ লাখ লিরার পাঁচটি নোট সামনে ধরতেই তার চেহারা দ্রুত পাল্টে গেল (প্রিয় পাঠক ভয় নেই- তুর্কি পঞ্চাশ লাখ লিরার দাম ১২/১৩ ডলার মাত্র)। একজন খানসামাকে দিয়ে আমাদেরকে উপরে পাঠাল সে।

১৮৯২-এ প্রতিষ্ঠিত হোটেলটি চরম বিলাসবহুল নয়। তবে খ্যাতি এর গগনচুম্বী। রুম নং- ৪১১ তে বসে ক্রিস্টি লিখেছেন তার বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ যা চলচ্চিত্রায়িত হয়েও বিপুল সাড়া তুলেছে। ১০১ নং রুমকে গালিপল্লির যুদ্ধের হেড-কোয়ার্টার বানিয়েছিলেন কামাল আতাতুর্ক; এখন সেটি মিউজিয়াম। বেয়ারা এক একটি রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আর বলে- এখানে ছিলেন গ্রেটা গার্বো, এখানে মাতা হারি, এখানে জ্যাকুলিন কেনেডি ওনাসিস; এই রূমে সম্রাট এডোয়ার্ড, এই-যে এখানে, এই খাটে ঘুমিয়েছেন জোসেফাইন বেকার আর হাত বাড়ায় বখশিশের জন্য। শেষ পর্যন্ত রাগ করে আনোয়ার দশ লাখ লিরার একটা নোট দিয়ে বলল, খালাস-খালাস!। আই’ল নট গো ফার।

১৪৫টা রুমের মধ্যে সোয়াশ’ বাকী থাকতেই আমরা নীচে ফিরে এলাম। যদিও বেয়ারার মুখে তখনো এমন সব জগদ্বিখ্যাত লোকের নাম খৈয়ের মত ফুটছে- যাদের চেহারা মনে পড়লেই মাথা ঘুরে যায়; ইতিহাস তো বাদই থাকল!

*

তখনো আমরা দেখিনি গ্র্যান্ড বাজার- যা প্রায় দু’হাজার বছর ধরে সিল্ক-রুটের প্রান্ত হিসেবে পৃথিবীকে যোগান দিয়ে আসছে লাখো রকমের রসনা-নিবারক মশলা এবং সুন্দরীদের রূপচর্চ্চার বিলাস সামগ্রী। এখনো ৪০০০ দোকান নিয়ে যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে স্বীকৃত। যে বাজার আবার দিনের চেয়ে রাতেই বেশি মজলিশি।

পেরা-প্যালেসের অদেখা-যাতনাকে বুকে চেপেই পা বাড়ালাম গ্র্যান্ড-বাজারে। ঢুকতেই মনে হলো মশ্লার সাথে আরো কি-যেন নাকে ঢুকছে। আনোয়ারের দিকে তাকাতেই হেসে বলল, মাফিশ্ মুশকিলা, ইয়া আফেন্দি। হাশিশ-হাশিশ।

কাবুল থেকে শুরু করে ইস্তাম্বুল পর্যন্ত সিল্ক রুটের যেখানেই গেছি- সে বোখারা হোক বা সমরখন্দ, তেহরান কিংবা বাকু- সর্বত্রই হাশিশের গন্ধ টের পাই। এ-যেন তুর্কীস্থানের টাইল্স- যা ছাড়া অভিজাত কোন নিমার্ণ সম্পূর্ণ হতে পারে না। মাঝে মাঝে ভাবি, হাজার বছর ধরে এই হাশিশ মধ্য-এশিয়ায় কোন সমস্যা তৈরী না করলেও গত পঞ্চাশ বছরে পশ্চিমী দুনিয়াকে সর্বনাশের অতলে ডুবিয়েছে। এ-কি হাভাতের গোগ্রাসে খাবার পরিনতি, না অন্য কিছু?

*

গোল্ডেন হর্ণের উত্তর পাশের পাহাড়টি কম উঁচু নয়। ১৪৫৩’র ৬ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ৮টি আক্রমন ব্যর্থ হবার পর ওসমান-বাহিনী যখন হতোদ্যম, তখন সুলতান মোহাম্মদ (টু) এর শিক্ষক ও ধর্মগুরু আকসেমেদ্দিন জানানঃ- আবশ্যই কনস্টান্টিনোপ্ল বিজিত হবে। এবং সেটি হবে আপনার হাতেই।

সুলতান বিস্মিত হয়ে বললেন, কিভাবে?

আল্লাহ রহমতে এবং আপনার সৌভাগ্যে সুলতান।

সেনাপতিরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।

আকসেমেদ্দিন এবং তার আরও তিনজন বন্ধু- ওস্তাদ জাগানস পাশা, মোল্লা গুরানী এবং মালিক হাসরার সুলতানকে এক অবিশ্বাস্য পরিকল্পনার কথা শোনান।

...আল্লার ইচ্ছা এ রকমই, মহামান্য সুলতান। পরিকল্পনার বিবরণ শেষ করে বলেন আকসেমেদ্দিন।

বসফরাসের মুখে গোল্ডেন হর্ণের প্রবেশ দ্বার ভারী লোহার চেন দিয়ে আটকানো। তার থেকেও কোয়ার্টার মাইল পশ্চিমে বারুদমুখো খ্রিস্টান রণতরী। দক্ষিণের পাহাড় সমান উচুঁতে দাঁড়ানো পবিত্র গীর্জা হাজিয়া সোফিয়া পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিস্ট- শক্তি ও বিশ্বাসের প্রতীক- তারই পেছনের সেনানিবাসে সুদক্ষ সাহসী নাইট ও জেনারেলদের অধীনে জানবাজ সৈনিকরা। সুতরাং সদাপ্রস্তুত মনোবলে কোন ঘাটতি নেই খ্রিস্টবাহিনীর।

কিন্তু ২২ তারিখ সকালে হর্ণের উত্তর পাশের বিশাল পাহাড়ের চূড়া থেকে একের পর এক সত্তরটি জাহাজ নামতে দেখে খিস্ট্রানদের সহস্র বর্ষের অটুট মনোবল ছাই হয়ে গেল। একি স্বপ্ন না সতি? প্রতিটি জাহাজ টেনে নামাচ্ছিল অসংখ্য গরু আর মহিষ। আর হাজার হাজার রশি দিয়ে পাহাড়ের অমসৃন গায়ে জাহাজগুলিকে দু’দিক থেকে ব্যালেন্স করছিল তুর্কী সেনারা। চাকা ও চর্বি লাগানো কাঠের অসংখ্য সিঁিড়র উপর দিয়ে হর্নের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে নামল তুর্কী বাহিনী পৃথিবীর সকল নৌ যুদ্ধের রেকর্ড ভেঙ্গে স্থলপথে! শুধু স্থল নয়, সুইচ্চ পাহাড় ডিঙ্গিয়ে !!

কিন্তু সেই হতবাক করা স্থবিরতাও বাইজান্টিয়ান সৈন্যরা কাটিয়ে উঠল। ২৮ এপ্রিল থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ৯ বার দ্বিমুখী আক্রমনেও তারা টললো না। ২৯ তারিখ সুলতান স্বয়ং যুদ্ধের ভার নিলেন। সেদিন হাজিয়া সোফিয়ায় পার্টি ছিল। সম্ভ্রান্ত সব খ্রিস্টান মিলিত হয়েছিলেন গীর্জায়। যুদ্ধ শুরু হল মধ্যরাতে।

প্রথম ৩০০ জন তুর্কী সৈন্যের জীবনের বিনিময়ে দূর্গের প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে গেল তরুণ তুর্কীরা। এরপর যুদ্ধে নামল জানেসারীরা। জানেসারীদের সাহস, বুদ্ধিমত্তা এবং কৌশল ছিল জগদ্বিখ্যাত। উলুবাতিল হাসান নামের মঙ্গোল বংশোদ্ভুত এক তুর্কী প্রথম পতাকা ওড়ালেন দূর্গের চূড়ায়-- কিন্তু শত্র“র গোলাকে এড়াতে পারলেন না। তার লাল-সবুজ নিশান নিয়েই শুরু হলো মুসলমানদের ইউরোপ অভিমুখে অগ্রযাত্রা।



যুদ্ধের পর দেখা গেল- কনস্টান্টিনোপ্লে খুব বেশি সৈন্য ছিল না। অবস্থানগত এবং কৌশলগত কারণেই অজেয় হয়ে উঠেছিল পূর্বান্চলীয় এই রোমান রাজধানী। তদুপরি হাঙ্গেরী, গ্রীস এবং বলকান থেকে দ্রুত সরবরাহ পেত কনস্টান্টিনোপল্স। যখনই এসব চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেল, তখনই বোঝা গেল- রোমান এই রাজধানী অজেয় নয় ; চিরস্থায়ী তো নয়ই।



পরদিন দুপুরে সুলতান মোহাম্মদ এইউপ মসজিদে নামাজ পড়ে ঘোষণা করলেনঃ এখন থেকে হাজিয়া সোফিয়া আর গীর্জা থাকবে না। সিনান, আপনি কাজ শুরু করুন।

*

নীল-মসজিদকে তুর্কীরা বলে সুলতান-হামেত (সুলতান মস্ক)। এর বিশাল প্রাঙ্গনে মসজিদ ছাড়াও আছে কবরস্থান, মাদ্রাসা, ফোয়ারা, হেল্থ ক্লাব, রন্ধনশালা, বিপনীবিতান, হাম্মাম, বাসগৃহ এবং হারেম। ১৯-বছর বয়সী সম্রাট আহমদ নিজ হাতে এর ভিত্তি খনন করেন এবং ৭ বছর পর ১৬১৬ সালে মসজিদের নিমার্ণ শেষ হয়। সুলতান আহমদ (ওয়ান) সম্পর্কে (নীল মসজিদ সংক্রান্ত) জনপ্রিয়তম বাক্য হচ্ছে এ রকম: ওসমানের ১৪তম বংশধর আহমদ ১৪ বছর বয়সে ক্ষমতায় বসে ১৪ বছর পর মারা যান।

নীল মসজিদের প্রধান স্থপতির নাম মোহাম্মদ আগা, যিনি সিনানের শিষ্য। সিনান (১৪৯১-১৫৮৮) হচ্ছেন সেই বিশ্বখ্যাত নির্মাতা, যার হাতে তুরস্কের ৪৭৭টি স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল। এক দরিদ্র কৃষকের সন্তান এই খ্রিস্টান ছেলেটি ৪৮ বছর বয়সে মিম্বারবাসি (প্রধান স্থপতি) হন এবং সুলতান সোলাইমান(ওয়ান), সেলিম(টু) এবং মুরাদ(থ্রি)’র রাজত্বকালে নির্মাণ সেবায় নিয়োজিত থাকেন (১৫৩৯-১৫৮৮)। পুরো পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন স্থপতির ভাগ্যে এত বিপুল নির্মানের সুযোগ, খ্যাতি এবং গৌরব জোটেনি- যা জুটেছিল সিনানের ভাগ্যে। কেউ যদি, এমনকি লুই-কানের সঙ্গেও সিনানের তুলনা করে, তাহলে সিনানের পাশে কানকে মনে হবে পূর্ণিমার চাঁদের পাশে ঝোনাকীর আলো মাত্র! বসফরাসের পশ্চিম পাড়ের আধুনিক তুর্কী বিশ্ববিদ্যালয়টি এই মহান স্থপতির নামে উৎসর্গিত।

*

নীল মসজিদের প্রধান দরোজা পাঁচটি। মূল মসজিদটি ২৬টি পিলারের উপর দাঁড়ানো ৩০টি গম্বুজের সমন্বয়ে নির্মিত। চার কোনায় চারটি সরল-একরৈখিক মিনার- যার প্রত্যেকটির গঠন ত্রিকোনাকার। এছাড়াও পশ্চিম কোনায় রয়েছে দুটি অতিরিক্ত মিনার। মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজটির ব্যাস সাড়ে তেহাত্তর ফুট এবং মাটি থেকে একশো একচল্লিশ ফুট উচুঁ।

হাতির পায়ের মত বিশাল চারটি পিলার এই গম্বুজের ভার বহন করছে।

নীল মসজিদে ২৬০টি জানালা- যার সবগুলো রঙিন, প্রধানত নীল কাঁচে মোড়া। ২১০০০ নীল টাইল্সে আবৃত্ত এই মসজিদের নীলাভ দ্যূতি শুধু চোখ নয়, চেতনাকেও ধাঁধিয়ে দেয়। জেনে আশ্চর্য হলাম যে এতে স্থাপিত ইজমিরি-টাইল্সের একেকটির বর্তমান দাম ছয়-লক্ষ মার্কিন ডলার। তাহলে নীল মসজিদে কত টাকার টাইল্স লাগানো আছে ? হিসাব করতে যেয়ে আমার মগজ আতংকে জমে গেল।...



তুরস্কের জাতীয় প্রতীক এই মসজিদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আয়া-সোফিয়া। তুর্কীরা যাকে বলে হাজিয়া সোফিয়া বা ‘স্বর্গীয় প্রজ্ঞা’। পিরামিড ও চীনের প্রাচীরের পর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও প্রাচীণ নির্মাণ আয়া সোফিয়া। খ্রিস্ট জগতে এটি সেন্ট-সোফিয়া নামেও পরিচিত। বর্তমানে এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম গীর্জা হলেও- চারশো বছর আগ পর্যন্ত এটিই ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম। একে এখন টপকে গেছে লন্ডনের সেন্ট পল, রোমের সেন্ট পিটার এবং মিলানের ডুয়োমো। যদিও আয়তনে সে এদের কাছে হেরেছে কিন্তু সেন্ট-সোফিয়াকে গন্য করা হয় মর্যাদার সর্বোচ্চ সম্মানে। পৃথিবী শ্রেষ্ঠ স্থপতি সিনানের মন্তব্যটি সবাইকে মনে করিয়ে দিল ইয়াসমীনাঃ- ‘সারা জীবন আমি শুধু একটি নির্মাণকেই অতিক্রম করতে চেয়েছি : আয়া-সোফিয়া। কিন্তু পারিনি।’



এটি আসলে কি? গীর্জা না মসজিদ? আনোয়ার আগ্রহী গলায় জানতে চায়।



ইয়াসমিনা লাস্যকন্ঠে বলে, কোনটাই নয়। ৯১৬ বছর এটি ছিল গীর্জা, ৪২১ বছর মসজিদ, এবং ১৯৩৪ থেকে যাদুঘর।



এর ইতিহাস একটু বল, ইয়াসমীনা?



আনোয়ারের কৌতূহলে ইয়াসমীনা উচ্ছ্বসিত। এই সফরের প্রথম থেকেই গাইড-মেয়েটি আনোয়ারের কোমল হাসি আর সলজ্জ পৌরুষের প্রেমে পাগল। আমরা সবাই সেটা টের পেলেও আনোয়ার উদাসীন।



বর্তমান হাজিয়া-সোফিয়ার স্থানে আগে দুটো গীর্জা ধ্বংস হয়েছে। সম্রাট জাস্টিনিয়ান ৫৩২ খ্রীস্টাব্দে বর্তমান গীর্জাটির নির্মাণ শুরু করেন প্রকৌশলী এন্থেমিয়াস এবং গানিতিক ইসিডোরাসকে দিয়ে। প্রাচীন যুগের সকল বড় নির্মাণ এভাবেই হত-- জ্যামিতি, ত্রিকোনোমিতি আর ভূবিজ্ঞানকে সামনে রেখে। একারণেই ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর নানাবিধ বিপর্যয়কে অতিক্রম করে এগুলো টিকে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এরই প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আয়া-সোফিয়া নির্মাণ শেষ হলে, ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে, এর মহিমান্বিত সৌন্দর্যে পুলকিত সম্রাট চিৎকার করে ওঠেন, ‘হে রাজাধিরাজ সোলায়মান! আমি তোমাকে অতিক্রম করে গেছি ।’



বহু রাজা-বাদশা এই গীর্জায় রাজ মুকুট পরেছেন। বহু চোর বাটপারের আশ্রয়স্থল হয়েছে এটি। চতুর্থ ক্রুসেডাররা ১২০৪-এ এটিকে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৮৫৩-তে কনস্টান্টিনোপ্লস জয় করে সুলতান মোহাম্মদ এটিকে মসজিদে রূপান্তর করান।



আমরা দু’চোখের মুগ্ধতা দিয়ে দেখলামঃ মূল গীর্জাটি আয়তকার; ২৩০-বাই-২৪৬ ফিট। ১৪৭টি স্তম্ভের উপর দন্ডায়মান প্রধান গম্বুজটির উচ্চতা ১৮২ ফিট। পুরো নির্মাণটি বিচিত্র টাইলসে সাজানো- যাতে চিত্রিত হয়েছে খৃষ্টপূর্ব, খ্রীস্টিয় এবং খ্রিস্টত্তোর যুগের অনেক দুর্লভ কাহিনী। মুসলিম যুগে এগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছিল। এখন অনেকগুলোই খোলা। যদিও চারদিকে এখনো ইসলামের নবী এবং তার খলিফাদের নামই ঝুলছে। তারপরেও বলা উচিত অর্থোডক্স চার্চের প্রধান ভিত্তি ক্রুশ-প্রতীকের কেন্দ্রীয় ধারনা বহন করে চলছে সেন্ট সোফিয়া। যার জন্য এর অন্য নাম আইকোনিক মাদার-চার্চ।

মা মেরী ও যীশুর আগেকার বহু কাহিনী- যা আমরা অস্বীকার করি মুসলমানদের সাথে মিল থাকার কারণে- এখনো অবিকৃত ভাবে বর্ণিত আছে আয়া সোফিয়ার দেয়াল-চিত্রে। ইয়াসমিনা খানিকটা আবেগাক্রান্ত গলায় বলল, আমরা তুর্কীরা ধর্মের কারণে ভাইয়ের গলায় ছুরি ধরি না- যদিও বসফরাসের স্রোতে পানির চেয়ে রক্তের পরিমানই বেশি। কিন্তু এই রক্তের দায় যতটা না আমাদের, তার চেয়ে অনেক বেশি বহিরাগতদের। মোস্তফা কামাল আবার আমাদেরকে এক করেছেন উদার বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে। এশিয়াকে ভাই করেছেন ইউরোপের। মুসলমানদের পাশাপাশি দাঁড়াতে দিয়েছেন খ্রিস্টানদের। এমনকি বিসমিল্লাহ বলে তিনি তার প্রথম ভাষণ শুরু করেও পার্লামেন্ট মর্যাদা দিয়েছেন ইহুদীদেরকেও। এই আমাদের ইতিহাস। এই আমাদের তুরস্ক। আমরা পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বলেই মূলের এত কাছাকাছি। আর কামাল আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই মর্মমূলে; ঐতিহ্য।...



নিজেকে বিতর্কে জড়াতে প্রবৃত্তি হল না আমার। আয়া সোফিয়ার পশ্চিম-উত্তর দিকে, মাইল-দশেক দূরে, সাহাবী হযরত আবু আইউব আনসারীর মাযার। ইস্তাম্বুল অবরোধকালে, রাসুলকে মদীনায় আতিথ্যদানকারী এই সাহাবী এখানেই মারা যান। কনস্টান্টিনোপ্লস জয়ের পর, সুলতান মোহাম্মদ নামটিকে পুনরায় গৌরবান্বিত করার জন্যই ইস্তাম্বুলের এই অংশের নাম রাখেন এইউপ।



সহসাই আমার মন কেঁদে উঠল। আতিথ্যের এক জ্যোতির্ময় আহ্বান যেন বেজে উঠল বুকের গহীনে। যে মসনবীর রুমীকে চেনে না; যে বাবরনামা’র জহির উদ্দীনকে দেখেনি, যে শোনেনি নাসির উদ্দীন হোজ্জার গল্পগাঁথা-- তার পক্ষে এই বুঝা হয়ত কষ্টকর।



আমি মুখ খুলবার আগেই আনোয়ার আমাকে বুঝতে পারল। হেসে বললঃ ফাদ্দাল, ইয়া সারোয়ার, ফাদ্দাল।

আনোয়ারকে নিয়ে আমি ধীর পায়ে নীল মসজিদে ঢুকলাম মনের তাৎক্ষণিক আবেগকে অনন্তের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে !! ে১।০৫।২০১২)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.