নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চরন বিল

চরন বিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

বেবিলিশাস!

১৯ শে জুন, ২০১৫ সকাল ৯:৪৮

আমাদের পুরনো বাড়ির ঠিক মুখোমুখি বাড়িতে তিন-চার বছরের একটা বাচ্চা থাকতো— নেহা। প্রথম প্রথম জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ‘হাই’ ‘বাই’ করত। বেশ ভালই লাগত। ক্রমে আমাদের বাড়ি এবং সেখান থেকে আনাগোনা শুরু হল আমার ঘরে। খুবই শান্তশিষ্ট বাচ্চা। কোনও জিনিসে হাত দিত না। শুধু সব ঘর ঘুরেটুরে সবার অলক্ষ্যে আমাদের পোষা বিড়াল বংশের কাউকে না কাউকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে চলে যেত। এরপর আমাদের বাড়িতে বিড়াল নিখোঁজ বলে হইহই রইরই, আর তাদের বাড়িতে বিড়াল আবিষ্কার করে হুলুস্থুলু।

বাচ্চা বয়সটা ভারি মজার বয়স। তবে অবশ্যই বড়দের চোখে। আমার অন্তত ছোটবেলায় ছোট থাকতে একটুও ভাল লাগেনি। এখন কচিকাঁচাদের কান্ডকারখানা দেখতে বেশ মজা লাগে। বিশেষত সদ্য কথা বলতে শেখা দুরন্ত বাচ্চা। তবে তা দূর থেকেই। বেশিকাছে এসে পড়লে প্যালপিটিশন শুরু হয়। হয়তো আমারই সাধের জিনিসপত্র ভেঙে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকবে, আর বড় বলে আমাকেও হাসিমুখে ‘না না, কিছু হয়নি। আরও কিছু ভাঙো’ ভাব নিয়ে সরে যেতে হবে। বড় হওয়ারও তো কম জ্বালা নেই। তাই ওদের থেকে আমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে ভালবাসি।

দু’বছর আগে জুলাইয়ে নতুন ফ্ল্যাটে আসি। আমাদের বাদ দিয়ে এই ফ্লোরের সবকটা দরজায় তালা দেখে খুশি হলাম। কোনও লোক নেই, অর্থাৎ দস্যি বাচ্চা থাকার সম্ভাবনাও নেই। তারপর একদিন অফিস থেকে ফিরছি। উপরে উঠে লিফট থেকে বেরতেই দরজা খুলে গেল পাশের ফ্ল্যাটের। ভ্রু নাচিয়ে আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে মূর্তিমান এক বিচ্ছু। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে চোখ আটকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলাম। কানে ভেসে এল মিষ্টি গলায় চিৎকার— ‘ওরে, তুই কে রে?’ আমি শুকনো হাসি হেসে টাটা বাই বাই করতে করতে ঘরে ঢুকে পড়লাম। পরের দিন জানলাম ওরা আমাদের নতুন প্রতিবেশী। এখন অবশ্য আমার মায়ের সঙ্গে তার বেশ ভাব জমে গেছে। আমি তার অর্ধেক কথা না বুঝলেও মা দিব্যি ডিকোড করে ফেলে। সেদিন আবার ফিরছি অফিস থেকে। সে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে বলে উঠল ‘আজ বিগুনের ঝুল দিয়ে মাচু খাচ্ছি’। আমি হাঁ করে তালা খুলতে ব্যস্ত মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা বলল ‘ওটা বেগুনের ঝোল দিয়ে মাছ’। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘আমি খেয়ে নেব বিগুন?’ সে প্রবল বেগে মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল। এরপর জানতে চাইলাম, ‘বিগুন এত প্রিয় বুঝি?’ গম্ভীর মুখে ভ্রূ তুলে চোখে অসন্তোষের ভাব ফুটিয়ে গুরুগম্ভীর গলায় উত্তর,‘এতটাই’।

পরের ঘটনা অফিস যাওয়ার পথে। একদিন বাসে সামনের দুটো সিটে এসে বসল স্কুল ফেরতা এক দস্যি আর তার মা। বাস মোটামুটি ফাঁকা। আমি নিবিষ্ট মোবাইলের পর্দায়। হঠাৎ চিলচিৎকারে চমকে উঠলাম। সে দস্যি আমার পাশে বসা এক বোরখা পরিহিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে চলেছে, ‘ওহ মাই গড! আন্টি আপকা অপরেশন হুয়া হ্যায়? নাক কাট দিয়া ডক্টর নে? বোলিয়ে না আন্টি...নাক কাঁহা হ্যায়?’ পাশের জন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার থেকেও সঙ্গিন অবস্থা বাচ্চার মায়ের। তিনি পিঠে ধপাস ধপাস করে দু’ঘা দিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করলেন। কাকস্যপরিবেদনা! চলতেই থাকল অপরেশন নিয়ে নানা জিজ্ঞাসাবাদ। ইতিমধ্যে তাঁর নামার সময় হয়ে এলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সকলেই।

নতুন পৃথিবী শিশুকে সবসময়ই অবাক করে বলে শুনেছি। কিন্তু আমার মনে হয়, পৃথিবীকে নতুন শিশু আরও বেশি অবাক করে। এরকম একজনের কথা প্রায়শই মনে পড়ে। অন্য সবার মধ্যে এই শিশুটির কথাবার্তা-কান্ডকারখানা আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে। যখন প্রথম আলাপ হয়, তখন বেশ ছোট। আমার সঙ্গে দারুণ ভাব হল। একটু বড় হতে যখন তাকে পড়াশোনা শেখানোর পালা এল, গোলমাল বাঁধল ইংরাজী বর্ণমালায় গিয়ে। ‘এ ফর অ্যাপল’, ‘বি ফর বল’ অব্দি ঠিক ছিল। তারপর থেকে সে বলছে, ‘সি ফর বিড়াল’, ‘ডি ফর কুকুর’ আর ‘ই ফর ডিম’। ‘ক্যাট-ডগ-এগ’কে সে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিতে নারাজ। এহেন শিশু যে অনেকের মধ্যে আলাদা হবে, তা বলাই বাহুল্য। উপহারের ব্যাপারে অন্তত সবার থেকে আলাদা ছিল। ওর বয়সী সব বাচ্চা ছেলেরই বড় গাড়ির প্রতি চরম আকর্ষণ থাকে। ওর ক্ষেত্রে ছিল একেবারে উল্টো ব্যাপার। উপহার যত ছোট, ও তত খুশি। একবার ওকে একটা বাক্সে কিছু খেলনা দেওয়া হয়েছিল। বাক্সটা সাজাতে কিছু শোলার বল ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ও বাক্সটা খোলামাত্র টেডি, হাঁস ইত্যাদি সব ছেড়ে ‘বেবি বল বেবি বল’ বলে শোলার বলগুলো নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ল। দেখে মনে হচ্ছিল, ওকে এক ব্যাগ শোলার বল দিলেই বোধহয় পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষকে চাক্ষুষ করতাম। এরপর একদিন তাকে দীঘা থেকে ঝিনুকের খরগোশ এনে দিই। বেশ কিছুদিন পর খবর এল সে আমার উপর খুব রেগে। দাবি, আমি তাকে একটুও ভালবাসি না। আমি হতচকিত। এমন কী অপরাধ করে ফেললাম, যে এরকম গুরুতর অভিযোগ! পরে জানা গেল কারণ— খরগোশগুলোর কান ভেঙে গেছে। সে রাগ আর ভাঙেনি যতদিন যোগাযোগ ছিল। পরে আবার সমুদ্রে গিয়ে খরগোশ না পাওয়ায় কয়েকটা পাখি নিয়ে আসি। কিন্তু সেগুলো দেওয়ার আগেই অনিবার্য কারণবশত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার সঙ্গে শেষবার রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার ঘটনাও কখনও ভুলব না। কলকাতার এক জনপ্রিয় দক্ষিণ ভারতীয় রেস্তোরাঁয় তার বাবা-মা, সে আর আমি লাঞ্চ সারছি। হঠাৎ সে বলে উঠল— ‘ও মোতা। মোতা খাচ্ছে’। আমরা তার আঙুল বরাবর পিছনে ঘুরতে চোখে পড়ল, একজন অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি বসে গবগবিয়ে ধোসা খেয়ে চলেছেন। যতটা সম্ভব চাপা গলায় তাকে বকে বোঝানো হল, কাউকে দেখে ওরকম বলতে নেই। তারপর আবার সবাই খাওয়ায় মন দিয়েছে। এমন সময় সে চাপা গলায় রহস্য ফুটিয়ে বলল, ‘মোতাতা উড়ে গেল’। এরপর উড়ন্ত মশা লক্ষ্য করে আমরা কয়েকমুহূর্তের জন্য হতবাক... আর তারপর হাসি এবং হাসি থামাতে কাশি। সব মিলিয়ে একশা কান্ড।

এই নিষ্পাপ প্রশ্ন করা বা সোজা কথা সোজাসাপ্টা বলার সৎ সাহসের সামনে মাঝেমাঝেই নিজেদের বড্ড জটিল আর ভীতু বলে মনে হয়। যে সত্যিটা ওরা অনায়াসে বলে ফেলতে পারে, আমরা তা পেরে উঠি না। আমরা মুখের উপর মুখোশ চাপিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে চাই। আদপে তা হয়েও ওঠে না। বরং মুখোশ পড়ে অভিনয় করতে করতে জীবটাকেই সিনেমা বানিয়ে ফেলি, যেখানে সবকিছুই মিথ্যেময়। তাই, যতদিন নিজের মধ্যে একটা শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তার মতো যা খুশি তাই করে ফেলা যায়... ততদিন আর কারও না হোক, নিজের বেশ মঙ্গল।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.