নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি পথহারা এক তরীর মাঝি।

ইলিয়াছুর রহমান

সাপে কাটলে সবাই দৌড়ে পালায়,অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই।

ইলিয়াছুর রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাদা গোলাপ (ছোট গল্প)

১১ ই জুন, ২০১৬ রাত ৩:৫৭

কিছু বিষয়ে রোমেলা খুবই সিরিয়াস। আপনজন বা ঘনিষ্ট মানুষজনের জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকীর তারিখ মনে রাখা, সময়মতো উইশ করা, গিফট পাঠানো তার মনে থাকে খুব। আমাদের দেশে প্রচলিত সকল উৎসবমুখর দিবসগুলো সেলিব্রেশনে তার উপস্থিতি চোখে পড়ার মত। শ্রাবণ এসব দিক দিয়ে পুরো উল্টো যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এ নিয়ে রোমেলার সাথে শ্রাবণের কতো বার যে মনোমালিণ্য হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।

শ্রাবণ ছেলেটা বড্ড বেশী এলোমেলো আর ছটপটে তবে মেধাবী। সবসময়ই ক্লাসের ফার্স্টবয় অথচ কখনোই তার আচরণে মনে হয় নি ভালো রেজাল্ট করাটা তার জন্য জরুরী বরং তার হাব-ভাব দেখে মনে হয় পড়াশুনা করতে নয় বরং বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেই ইউনিভার্সিটিতে আসে। বসে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে। ক্লাসে কোন অ্যাক্টিভিটি নেই। কখনো কোন টিচারকে কোন প্রশ্ন করতে দেখা যায় নি তাকে বরং কোন টিচার তাকে কোন প্রশ্ন করে উত্তর পায় এমন হয়নি কখনোই।পড়াশুনার পাশাপাশি একটা ছোট্ট একটা চাকুরীও করে শ্রাবণ।

সেদিন অফিসের কাজে সারাদিন খুবই ব্যস্ত। নতুন অফিস,কাজকর্ম একটু গুছিয়ে করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে। এখানকার নতুন বস যেমন ফ্রি আর খোলামেলা তেমনি কাজের প্রতি কঠোর আর কড়া। শ্রাবণ কয়েকদিন আগেই একটা কোম্পানি ছেড়ে দিয়ে এই কোম্পানীতে জয়েন করেছে,শুরুতেই কাজকর্মে দক্ষতা আর পারফরম্যান্স দেখানোর মোক্ষম সময়। শুরুতেই নিজের ভাবমুর্তি ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারলে পরবর্তিতে কাজকর্মে বেশ সুবিধা ও সম্মান পাওয়া যায়। কাজের ভীড়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার ফুসরত পায় নি বেচারা। ১.৩০ থেকে ২.০০ টার মধ্যে দুপুরের খাওয়া হয়ে যায়। খাওয়ার আগে মনের খেয়ালেই রোমেলাকে একটা ফোন দেয়াই নিয়ম হয়ে গেছে ।ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা ৪টা ছুঁই ছুঁই। এখনো পেটে কিছু পড়ে নি,রোমেলাকেও কল করা হয় নি। ইচ্ছে করেই কল দেয় নি সে। কল করলেই প্রথম প্রশ্নটা হবে "লাঞ্চ করেছো ?" এটার উপযুক্ত উত্তরের ব্যবস্থা করেই রোমেলাকে ফোন করবে বলেই এখনো কথা বলা হয় নি ।

ক্লায়েন্টের অফিস থেকে বের হয়েই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল। হাতে একটা কালো ব্যাগে কিছু বই-খাতা,অফিসের কাগজ পত্র,অফিসের আইডি কার্ড,ইউনিভার্সিটির আইডি কার্ড,কয়েক কালারের কলম এবং আনুষঙ্গিক কিছু জিনিষপত্রের সাথে একটা হলুদ খামে বেশ কিছু টাকা আছে। নিজের নয়,অফিসের টাকা ক্লায়েন্টের কাছ থেকে মাত্রই রিসিভ করলো। ক্লায়েন্টের অফিস থেকে সরাসরি অফিসেই যাওয়ার কথা ছিলো। পেট চো-চো করছে। তাই আগে ভুরিভোজটাই হোক। অর্ডার করা মাত্র খাবার আসলো টেবিলে,পকেটে থাকা ফোন বেজে উঠলো। রোমেলার কল...।

-কই তুমি ?
-এইতো অফিসের কাজে একটু বাহিরে এসেছি।
-বাহিরে টা কোথায় ? সারাদিন কোন খোঁজ নাই কেন ! খুব বেশী ব্যস্ত ?
- হ্যাঁ একটু ছিলাম । আমি এখন মিরপুরে।
-তার মানে এখন ফ্রি আছো?
- না তা নয় এখনো কাজেই আছি।
- আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে রাখি। তুমি কাজ করো।
-আরে না না অতোটা ব্যস্ত নয় যে কথা বলতে পারবো না। বলো তুমি।
-লাঞ্চ করেছো ?
-হ্যাঁ করেছি। তুমি করেছো ?
-তুমি কি ভেবেছো তুমি ফোন দাও নি বলে আমি না খেয়ে বসে আছি ? আমি নিজের খেয়াল ঠিকই রাখি। কেউ খোজখবর নিলেও রাখি না নিলেও রাখি।
- ও আচ্ছা আচ্ছা। এমন করে কথা বলছো কেন? ফোন তো তুমিও করতে পারতে! তাই না? আমাকেই ফোন করতে হবে এমন তো কোন কথা নেই ! আমি একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম তাই ফোন করতে পারি নি।
-আচ্ছা বুঝলাম। তা এখন ফোনটা কি আপনি আগে করেছেন নাকি আমি? আজ প্রথম পিরিয়ডে ক্লাসটেস্ট মনে আছে সেকথা ?
- ও হ্যাঁ মনে আছে।
-মনে যে ছিলো না সেটা তোমার কথা শুনেই বুঝতে পারছি। মিথ্যে বলা ছাড়ো। আর সময়মতো যেন লাইব্রেরীতে পাই। কিছু জিনিষ তোমার কাছে বুঝিয়ে নিতে হবে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে।
-আমার কাছে অফিসের কিছু টাকা আছে মিরপুর থেকে ফিরে অফিসে জমা দিয়েই বের হবো।অফিস থেকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে পায়ে হেটে ১০ মিনিটের পথ। আমি ঠিক ৫.৩০টায় লাইব্রেরীতে থাকবো।
-অফিসের টাকা মানে? অফিসের টাকা তোমার কাছে কেন? তোমাকে না বলেছি এসব কাজে নিজেকে না জড়াতে? এটা কি তোমার দায়িত্বে্র মধ্যে পড়ে? কতো টাকা?

এ পাশে চুপচাপ। পিনপতন নীরবতা। বিরক্তির সুরে রোমেলা প্রশ্ন করলো

-চুপ করে আছো কেন ?
-কোন প্রশ্নের উত্তর দেবো সেটাই ভাবছি।
-অসময়ে ফান করা তোমার বদঅভ্যাস হয়ে গেছে। কতো টাকা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছো?
-৯৫ হাজার। ক্লায়েন্টের কাছ থেকে রিসিভ করলাম মাত্র। মাঝে মধ্যে বসের আদেশে দায়িত্বের বাহিরেও কাজ করতে হয়।কিছু করার নেই। প্রাইভেট জব এরকমই।
-হয়েছে আর জ্ঞ্যান দিতে হবে না। আল্লাহ না করুক কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কি হবে?
-চিন্তা করো না। ওরকম কিছু হবে না ইনশাল্লাহ।
-আপনি যা খুশী করেন। আমি রাখলাম।

ফোনটা কেটে যেতেই, সামনে থাকা খাবারের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছে রোমেলার কাছে মিথ্যেটা বলা মনে হয় ঠিক হলো না। খাই নি এখনো !! বললেই পারতাম,না থাক এটা নিয়ে আবার শুরু হবে একটা ঝামেলা। এমনিই মান অভিমান লেগেই আছে।
শ্রাবণ দেখলো যা কিছু অর্ডার করেছে সব কিছু ঠিকঠাক টেবিলে রেডি। গো-গ্রাসে খেতে খেতেই দেখলো ফোনটা সিগন্যাল দিচ্ছে তারও কিছু খাওয়া দরকার মানে ব্যাটারীর চার্জ শেষের দিকে। খাওয়া শেষে তড়িঘড়ি করে শ্রাবণ যখন রাস্তায় সিএনজির জন্য দাড়িয়েছে ঠিক তখনি আবার রোমেলার ফোনকল।

-অফিসে এখনো পৌঁছাও নি?
-আরে না। এখনো সিএনজিই পাই নি।আর সিএনজি পেলেও কি ১০ মিনিটে মিরপুর থেকে বাংলামোটর যাওয়া যায় নাকি!
- সাবধানে এসো। অফিসে টাকাটা জমা দিয়ে সাথে সাথে আমাকে জানাবে। আর আমার জন্য সাদা গোলাপ নিয়ে আসবে।
-সাদা গোলাপ !! সাদা গোলাপ কেন ? অন্য একদিন আমি তোমাকে অনেকগুলো গোলাপ এনে দেবো জান। আজ না।
-আজ নাহ মানে? আমি বলেছি আজকেই !!
- এই শর্ট টাইমে সাদা গোলাপ কোথায় পাবো !!
-এতো কথা বুঝি না। গত চার বছর থেকে তোমার এসব কথা শুনতে শুনতে আমি বোর হয়ে গেছি।এর আগের দিনও তুমি একই কথা বলেছো। তোমার দেয়া নীল শাড়ীটা পরে আজ আমি ভার্সিটি তে যাবো। সাদা গোলাপ আমার আজকে চাই-ই চাই। কোথায় পাবে জানি না। সাদা গোলাপ ছাড়া আমার সামনে আসবে না। আর হ্যাঁ ঠিক সাড়ে পাঁচটায়,সাড়ে পাঁচটা মানে কিন্তু সাড়ে পাঁচটাই। এক মিনিটও যদি দেরি হয় আর হাতে যদি গোলাপ না থাকে তবে মনে রেখ আজকেই তোমার আমার সম্পর্কের শেষ দিন।একটু কষ্ট করো প্লিজ।সকাল থেকে একটা ফোনও দাও নি এটা তারই শাস্তি ।
-নীল শাড়ী,সাদা গোলাপ কিছুই তো বুঝছি না। এই এক জীবনে আমাকে আর কতো শাস্তি দেবে তুমি! ভালোবাসি বলে তুমিও সুযোগ নেয়া শুরু করেছো। প্রতিদিন একটা না একটা শাস্তি দিয়েই চলেছো। আচ্ছা ঠিক আছে দেখি কি করা যায়।
-যখন খুশী শাস্তি দেবো যখন খুশী আদর করবো। আমার হাত থেকে তোমার রেহাই নেই। দেখি কি করা যায় মানে কি? কি করবে বলো !! গোলাপ কই পাবে ?
-বাংলামোটরের কাছাকাছি শাহবাগ ছাড়া আর কোথায় ! তোমার এতো চিন্তা করতে হবে না আমি গোলাপ কোথায় পাবো। আর শোনো আমার ফোনে চার্জ নাই,ফোন বন্ধ হয়ে যাবে যখন তখন। ফোনে না পেলে তুমি লাইব্রেরীতে থেকো আমি সময়মত আসবো।
-তোমার ফোনে চার্জ না থাকাই স্বাভাবিক,তুমি তো একটা কেলাস টাইপের মানুষ। তুমি মানুষটা এমন কেন বুঝি না ! গত রাত্রে ফোনে চার্জ দাও নি?
-মনে ছিলো না।
-মনে থাকবে কি করে ! সারাদিন তো ফেসবুকে মাথাটা ঢূকিয়ে দিয়ে রাখো। কখনো শুনেছো আমার ফোনে চার্জ নেই ?
-তুমি আর আমি এক না। আমার মতো তুমি হলে তো কাজই হতো। আর আমি তোমার মতোও হতে চাই না।
-আজাইরা কথা ভালোই বলতে পারো দেখছি । আচ্ছা গত পরশু তুমি স্যালারী উঠিয়েছো না ?
-হ্যাঁ । তো ?
-তো কিছু না । আজকে তুমি আমাকে খাওয়াবে।নাহ, আচ্ছা ঠিক আছে আমিই আজ তোমাকে খাওয়াবো। উম্মাহ। লাভ ইউ জান। তাহলে দেখা হচ্ছে,টাইমটা কত যেন ?
-হয়েছে হয়েছে। আর ঢং করতে হবে না। রাখো!!
-না না সময়টা বলো।
-সাড়ে পাঁচটা।

শুনেই একটা হাসি দিয়ে রোমেলা ফোন ছেড়ে দিলো।

সাথে সাথে একটা সিএনজিও এসে সামনে দাড়ালো । সিএনজি ড্রাইভারের মাথা ভরা লম্বা চুল, খোঁচাখোঁচা দাড়ি,চোখ দুটো লাল টকটকে।গায়ের রঙ তামাটে বর্ণের।
-মামা কই যাবেন ?
-যাবো বাংলামোটর । তবে শাহবাগে আমার পাঁচমিনিটের একটা কাজ আছে। শাহবাগ থেকে ঘুরে,বাংলামোটর মোড়ে আসবো।
- ওইদিকে অনেক জ্যাম মামা।মিটারের থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে।
-বাড়িয়ে দিতে হবে কেন মামা? মিটারে যা আসে তাই দেবো। মিটারের চেয়ে বেশী ভাড়া দাবি করাটা তো অন্যায় মামা।
-অন্যায় তো অনেক কিছুই। এইযে আমাকে মামা ডাকছেন এটাও তো অন্যায়।আমি কি আপনার বাপের শালা লাগি ? আর আপনি তো শাহবাগে দাঁড়াবেন। আমার সময়ের মুল্য আছে না !!

হাতে বেশী সময় নেই, শ্রাবণ কথা না বাড়িয়ে সিএনজি তে উঠে পড়লো।

কিছু দূর যেতেই অফিস থেকে একাউন্ট ম্যানেজারের ফোন।
-কোথায় আছেন ?
-পথে অফিসের দিকেই আসছি। ৩০ মিনিটের মতো লাগবে হয়তো।
-টাকা কি পূরোটাই দিয়েছেন ?
-পুরোটাই মানে ? ৯৫ হাজার টাকা দিয়ে বলেছে আপনার সাথে নাকি কথা হয়েছে। তাই আমি কথা বাড়াই নি। উনার সাথে তো চুক্তি হয়েছিলো ১ লক্ষ বিশ হাজারের মতো।
-আচ্ছা ওটাই নিয়ে আসেন দেখি আমি কথা বলছি ওনার সাথে।

কথা শেষ করতে না করতেই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেলো।ঠিক মতো কথাও শেষ করতে পারলো না । নিজের প্রতি নিজেরই রাগ হলো শ্রাবণের।রাতে ঘুমানোর সময় চার্জে দিয়ে ঘুমালেই সারাদিন নিশ্চিন্তে থাকা যায় অথচ এই সহজ কাজটা করা হয় না মাঝে মধ্যেই। এর আগেও বহুবার রোমেলার সাথে এটা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে।

এতোক্ষন ফোনে বলা কথাগুলো চুপ করে শুনছিলেন সিএনজির ড্রাইভার ।কিছুক্ষন চুপ থাকার পর সিএনজির ড্রাইভার বলে ,মামা আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায় ?
-কুড়িগ্রাম। আপনার ?
-আমার ও বাসা ওদিকেই । গাইবান্ধার সাদুল্ল্যাপুরে। ঢাকায় কি করেন?
-তেমন কিছু না। পড়াশুনা করি এখোনো।পাশাপাশি একটা ছোট্ট চাকুরী করি। অফিসের কাজেই মিরপুর এসেছিলাম। এখন অফিসেই যাচ্ছি।

দুজনে চুপচাপ। শ্রাবণও আর কথা বাড়ালো না। এখন তার মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কখন রোমেলার সাথে দেখা হবে। রোমেলার মিষ্টি হাসি আর মৃদু ছোঁয়া শ্রাবণকে বিভোর করে রাখে প্রতিটা মুহুর্ত। অনেকদিনপর প্রিয়তমা শাড়ী পরে আসবে। কাজলে সাজানো চোখে আর শাড়িতে রোমেলাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে যেন, এক ডানাকাঁটা পরী। এই শাড়ীতেই মোহনীয় সৌন্দর্য দেখেই প্রথমবার রোমেলার প্রেমে পড়েছিল শ্রাবণ। এখন শুধু সেই সময়ের অপেক্ষা কখন দেখবে প্রিয়ার ছলনামাখা হাসিমুখ।পারলে শ্রাবণ এক্ষুনি পাখা মেলে উড়ে চলে যায় রোমেলার কাছে।

ঠিক পাঁচটায় রোমেলা ভার্সিটির গেটে । একটু আগে ভাগেই সেজেগুজে এসেছে। আর বাসায় বসে থাকতে পারছে না উত্তেজনায়। শ্রাবণকে সারপ্রাইজ দেয়ার উত্তেজনা। আজ এই দিনটার কথা নিশ্চয়ই মনে থাকবে না শ্রাবণের সেটা রোমেলা আগে থেকেই জানতো। সেকারনেই নিজে সারপ্রাইজ পাওয়ার বদলে উল্টা তাকেই সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য রোমেলা নিজের সাজুগুজু করছে দুপুরের পর থেকেই।পড়নে একবছর আগে শ্রাবণের নিজের হাতে কেনা নীল শাড়ী মুখে হালকা মেকআপ,চোখে কাজল,চুলে খোপার মাঝে গুজে রাখা শাড়ির সাথে ম্যাচ করা নীল রঙয়ের জারবেরা ফুল। কাজলে চোখটা এতো স্পষ্ট করে তুলেছে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন শিল্পির সুনিপুণ হাতে আকা একেকটা চোখ একেকটা পোট্রেট।সুনিপুণভাবে বাধা খোপা রোমেলার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুনে। নিশ্চয়ই শ্রাবণ অন্যান্য দিনের মতো ফুল হাতে প্রথমেই রোমেলাকে বলবে, রোমেলা তুমি ঠিক পরীর মতো সুন্দর। তোমাকে পেয়ে আমার এ জীবন ধন্য।তুমিই আমার কাছে সৃষ্টিকর্তার সেরা উপহার।

উত্তরে,রোমেলা আড়চোখে তাকিয়ে শুধু বলবে, I Know.
শুরু হয়ে যাবে দুজনের মান-অভিমান। গত ৪ বছর থেকে এই চলছে। :D

ভার্সিটিতে পৌঁছেই একটা কল দিলো শ্রাবণের ফোনে। ফোনটা বন্ধ। প্রথমে রাগ হলো পরক্ষনেই মনে পড়লো সেতো বলেছিলো ফোনে চার্জ শেষের দিকে হয়তো চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে।বসতে বলেছিলো লাইব্রেরীতে। লাইব্রেরীতে পাশাপাশি দুটো চেয়ার ছিলো যেখানে শ্রাবণ আর রোমেলা নিয়মিত বসে। অন্যগুলোরও মত আর কোন চেয়ার নেই ওই দুটো চেয়ারের আশেপাশে।আজ একটি ছেলে সেখানে বসে মনযোগ সহকারে পড়ছে। রোমেলা গিয়ে ছেলেটার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। ছেলেটা হকচকিয়ে উঠল। এমন একটা সুন্দরী মেয়ে অমন অপলক চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলেটা কিছুটা অবাক এবং অপ্রস্তুত। যখন উঠে ছেলেটা ঠিক করে বস্তে যাচ্ছে ভদ্রভাবে রোমেলা তাকে বললো "ভাইয়া কিছু মনে করবেন না ! একটু ওদিকে বসবেন? আমার একটা ফ্রেন্ড আসছে আমরা এখানে বসবো।"
কথা শেষ হতে না হতেই ছেলেটা বইপত্র নিয়ে উঠে গেলো। রোমেলা ছেলেটাকে হাসি মুখে ধন্যবাদ জানিয়ে হাতের ব্যাগটা এক চেয়ারে রেখে অন্য চেয়ারে নিজেই বসে পড়লো। এখন শুধুই অপেক্ষা শ্রাবণের জন্য। রোমেলা বার বার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে সময় যেন পারই হতে চায় না,এদিকে শ্রাবণের ফোন বন্ধ।

তখন সময় ৫ টা বেজে চল্লিশ মিনিট,তার আসার কোন নাম-গন্ধ নেই। অথচ শ্রাবণের আসার কথা ছিলো ঠিক সাড়ে ৫ টায়। হয়তো ফুল জোগাড় করতে পারে নি তাই দেরী হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা বসি আরো কিছুক্ষন আসতে যখন চেয়েছে আসবেই। রোমেলা ডেকেছে আর শ্রাবণ আসে কি এমন কখনো হয় নি আগে। একটা বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগলো কিন্তু তার মন বইয়ের মাঝে নেই শুধু ছটপট করছিলো শ্রাবণের জন্য। মনে মনে রোমেলা ভাবছে আজকে আসুক দেবো উচিৎ শিক্ষা।

আজ রোমেলার জন্মদিন। এইদিনটা শ্রাবণ কোন বছরেই মনে রাখতে পারে নি। বরাবরের মতো এবারোও ভুলে গেছে। গত বছর মনে করিয়ে দেয়ার পর রোমেলার মান ভাঙ্গানোর জন্য শাহবাগ থেকে ১৮ প্রকারের এক রিকশা ফুল আর এই নীল শাড়ীটা কিনে হাজির হয়েছিলো রোমেলার হোস্টেলের গেটে। এতগুলো প্রিয় ফুল একসাথে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো রোমেলা।রোমেলা আজকে আবারও সেরকম কিছু হোক সেটা চায় না । বরং আজকের সন্ধ্যাটা কোন ক্লাস নয় ক্লাসটেস্ট নয় দুজনে একান্ত কিছু সময় কাটানোর জন্যই সেজেগুজে বেড়িয়েছে সে। ভার্সিটি থেকে শ্রাবণকে নিয়ে রিকশায় উঠবে আর ঘুরবে পুরো ঢাকা শহর যেখানে ইচ্ছে নেমে পানির ধারে বসে বসে বাদাম খাবে দুজনে।শুধু এতটুকুই চাওয়া রোমেলার।

ঘড়িতে সোয়া ছয়টা। অপেক্ষা করতে করতে শ্রাবণের প্রতি রাগ-ক্ষোভে রোমেলার কান্না পাচ্ছে ভীষণ। কিন্তু কাদতেও পারছে না সে। কাদলেই পুরো বিকেলের শ্রমটা তার বৃথা যাবে। চোখের কাজল আর মুখের মেকাপ একাকার হয়ে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে যাবে। আর শ্রাবণ এসে মান ভাঙ্গানোর বদলে প্রাণ খুলে হো হো করে হাসবে।এটা তার স্বভাব। পরিস্থিতি যেমনই হোক হাসি দিয়ে দুনিয়া ভুলানোর ক্ষেত্রে দক্ষ।

লাইব্রেরীর অন্য সবার চোখ সাজুগুজু করা বিমর্ষ চেহেরার সুন্দরী রোমেলার দিকে।জুনিয়ররাও একা একা বসে থাকতে দেখে কানাঘুষা করছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ক্লাসমেটরাও আসা শুরু করেছে। মিনিট দশেক পরেই ক্লাস শুরু হবে। অন্য সবাই ক্লাসটেস্টের প্রস্তুতির জন্য ব্যস্ত। সেখানে শ্রাবণের কোন খবর নেই।রোমেলা অনবরত ফোনে ট্রাই করেই যাচ্ছে। ফোন বন্ধ।সময় যত পেরোচ্ছে তার বিরক্তিমাখা মুখ ততই বেশী অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে।

হটাৎ রাসেল পিছনে থেকেই বলছে, কিরে রোমেলা তুই এখানে একা বসে বসে কি করিস ওদিকে ক্লাসটেস্ট তো শুরু হয়ে যাচ্ছে আর শ্রাবণকেও দেখছি না ও কোথায়?
কথাটা শোনা মাত্রই মনের অজান্তেই ভিতরটা হু হু করে উঠলো রোমেলার আর দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোটা অশ্রুও ঝড়ে পড়লো কোলের উপর। কোন কথা না বলেই চোখের পানি মুছতে মুছতে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দ্রুতগতিতে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে গেল ।

রাসেল শ্রাবণ আর রোমেলার সব থেকে কাছের বন্ধু।তার সাথে রোমেলার এমন ব্যবহার মেনে নিতে পারে নি সে। থতমত খেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষন। মনে মনে ভাবলো হয়তো শ্রাবণের সাথে হয়েছে কিছু একটা। ফোনটা বের করে শ্রাবণের ফোনে ট্রাই করলো কল দেয়ার কিন্তু সেও শুনতে পেলো "দুঃখিত এই মহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না কিছুক্ষন পরে......"
তাড়াহুড়া করে ক্লাসে ঢুকে পড়লো রাসেল। কিন্তু একি !ইম্পরট্যান্ট একটা ক্লাস টেস্ট অথচ শ্রাবণ-রোমেল ক্লাসে নেই। সে বুঝলো রোমেলা শ্রাবণের সাথে রাগ করে বাসায় চলে গেছে।হয়তো লেগেছে ওর সাথে কিছু একটা নিয়ে প্রায়ই এরকম হয় ওদের। ওসব নিয়ে না ভেবে রাসেল নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।

পুরো সন্ধ্যা জুড়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে রোমেলা। এমনি আচার-ব্যবহারে শক্ত মনের মানুষ মনে হলেও তার মনটা অনেক কোমল। এই প্রথমবার শ্রাবণ কথা দিয়েও আসে নি তার উপর কোন খবরও পাচ্ছে না । অন্যদিকে অনেক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কোন বিপদ হলো নাতো ? শেষবার যখন কথা বলেছে তখন তার সাথে অনেকগুলো টাকাও ছিলো । কিছুতেই মনকে স্থির করতে পারছে না। কাউকেই কিছু বলছে না শুধু বালিশ জড়িয়ে কেঁদেই চলেছে।

১২টা বেজে গেছে। রাতে খাওয়া হয় নি রোমেলার। খিদেও নেই।শুধু ফোনে ট্রাই করছে কোনভাবে শ্রাবণকে পাওয়া যায় কিনা। শ্রাবনের বাসার নাম্বার আছে রোমেলার কাছে কিন্তু কল করার সাহস হচ্ছে না। কি বলবে শ্রাবণের বাসায়। তারাই বা কি ভাববে !! রোমেলার সাথে তো শ্রাবণের পরিবারের কোন পরিচয় নেই। সাতপাঁচ ভেবেই সময় চলে যাচ্ছে। কোন খোঁজ নেই শ্রাবণের।

সাড়ে বারোটার দিকে রাসেলের ফোন। প্রথমবার কেটে দিলো রোমেলা কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। রাসেল হয়তো জিজ্ঞ্যেস করবে কি হয়েছে সন্ধ্যায় এরকম কেন করলো এসবই হয়তো বলবে। আবার কল আসলো রাসেলের নাম্বার থেকে এবার পুরোটা রিং হয়ে গেলেও রিসিভ করলো না রোমেলা। একটু পর রাসেলের একটা এসএমএস আসলো। "শ্রাবণ হসপিটালে,আমি ওর সাথে"।

এসএমএস টা পড়েই যেন আকাশ থেকে পড়লো রোমেলা। হাউমাউ করে কেদে উঠলো। তড়িঘড়ি করে কল ব্যাক করেই জিজ্ঞ্যেস করলো "কি হয়েছে আমার শ্রাবণের?" কান্নার শব্দে কথা বুঝতেই অসুবিধা হচ্ছে রাসেলের। রাসেল বললো, "স্কয়ার হসপিটালে তৃতীয় তলার আইসিইউ তে আছে এখন"।কথাটা শেষ না হতেই হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো রোমেলার।

রাত ঠিক দুটোয় রোমেলা দুজন বান্ধবীকে নিয়ে আইসিইউ এর সামনে হাজির। কেমন যেন অদ্ভুত শান্ত লাগছে রোমেলাকে। সেখানে রাসেলসহ আরো চার-পাঁচ জন বন্ধু। কারো চেহেরার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রোমেলাকে দেখে অশ্রুসিক্ত স্ট্যাচু হয়ে গেছে সবাই। কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই চুপচাপ,মনে হচ্ছে এখানে পৃথিবী থমকে গেছে।

আমার জন্য সাদা গোলাপ নিয়ে আসতে বলেছিলাম শ্রাবণকে,কোথায় আমার শ্রাবণ ? নীচু গলায় জিজ্ঞ্যেস করলো রোমেলা। রাসেল ছোট বাচ্চার মতো কেঁদে উঠে দরজার মাঝখানের গ্লাসের মধ্য দিয়ে তাকালো। দেখা যাচ্ছে,একটা নিথর দেহ সাদা ধবধবে কাপড় দিয়ে ঢাকা। সাথে সাথে ফ্লোরে লুটে পড়ে রোমেলা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.