নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবনের জন্য প্রবাস নাকি প্রবাসের জন্য জীবন!

প্রবাসী বিশেষজ্ঞ

ব্যারিস্টার এট ল

প্রবাসী বিশেষজ্ঞ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মেঘে রোদ্দুরে মাখামাখি – ধারাবাহিক রচনা – অনুচ্ছেদ ১

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:১৬

দেশের বাইরে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা সম্ভবত কেউই ভোলেনা। আর যারা আগে থেকেই প্রবাসী, তারাও পরে বসবাসের উদ্দেশ্যে নতুন কোন দেশে গেলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাকে বাকী জীবন লালন করে। আসিফ দেশের বাইরে প্রথম পা রাখে লন্ডন শহরে আজ থেকে নয় বছর আগে। অথচ প্রতটি মূহুর্ত ওর স্মৃতিতে এখনো এতই স্পষ্ট যে মনে হয় নয় মিনিট আগের কথা। আজ ওর নিউ ইয়র্কের প্রথম দিন। মাঝখানে নয় বছর প্যারিস, দুবাই, দিল্লী, বেইজিং, মক্কা ঘুরে বেড়িয়েছে। আর সর্বশেষ ছয় মাস শিকড় গেড়েছিল কুয়ালা লামপুর। আজকের ঘটনাবহুল দিনটাও ও ভুলবেনা কখনোই।

সৌদি এয়ারলাইন্স এর বোয়িং ৭৭৭ এর পেটে বসে ডাচ পরিচালক পল ভেরহোভেন এর রোবোকপ মুভি দেখতে দেখতে নিজের পেটে ভরা বালসামিক গ্লেইযড সালমন ফিলেট এর সাথে মেডিটেরিয়ান ড্রেসিং এর সালাদ এর স্বাদটা এখনো ওর মুখে লেগে আছে। রওনা হওয়ার আগে সবাই সাবধান করেছিল জেএফকে এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনে অনেক বিড়ম্বনার শীকাড় হতে হবে। ও আবিষ্কার করেছে উল্টোটা। বিশ মিনিটও লাগেনি ওর ইমিগ্রেশন, লাগেজ বেল্ট আর কাস্টমস পার হয়ে টারমিনাল ওয়ান এর এয়ার ট্রেইন এর প্লাটফর্মে পৌঁছাতে। ও গুগলএ দেখেছে টার্মিনাল ফাইভ থেকে বি ফিফটিন বাস ব্রুকলিনের বুশউইকের হালসে স্ট্রীটএ যায়। ওখান থেকে বি টুএন্টিসিক্স এ দুটো স্টপ গেলেই এভারগ্রীন এভিনিউতে ওর বুকিং দেয়া ডরমিটরি। মুশকিল হল, এয়ারপোর্টে সবকিছু এত সুন্দর ও দ্রুত হয়ে যাওয়াতে ও আর দেরি না করে টারমিনাল ফাইভ এ চলে এসেছে, ভেবেছে এখান থেকে সাত দিনের আনলিমিটেড রাইড মেট্রো কার্ড কিনে বাসে উঠবে। কিন্তু টারমিনাল ফাইভে এসে এমটিএ এর বাস অপারেটরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল মেট্রো কার্ড এখানে নেই, কিনতে হলে নিদেনপক্ষে টারমিনাল ফোর এ যেতে হবে, এর আগে কোথাও পাবেনা। আসিফ আগেই এয়ারপোর্টে মেট্রো কার্ড না কিনার জন্য নিজের উপর রাগ করে আবার টারমিনাল ফাইভের প্লাটফর্মে চলে এল টারমিনাল ফোর যাবে বলে। সেখানে এক এয়ারপোর্ট স্টাফ এর সাথে যখন ব্যাপারটা নিয়ে ও আলাপ করছিল তখন পেছন থেকে এক সুদর্শন তরুণ ওকে ডেকে বলল, ‘তুমি কি মেট্রো কার্ড কিনতে চাইছ? আমি আজ শিকাগো চলে যাচ্ছি। আমার কাছে একটা মেট্রো কার্ড আছে, মনে হয় ডলার ছয়েক এর মত ব্যালান্সও আছে। আমার যেহেতু এটার আর প্রয়োজন নেই, তুমি নিতে পার’। আসিফ ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে অফারটা প্রত্যাখ্যান করল এই বলে যে ওর কাছে সব একশো ডলার নোট, ছয় ডলার চেইঞ্জ নেই। কিন্তু ওই তরুন হাসিমুখে আবার রিকোয়েস্ট করল। জানল ও মুসলিম, আসিফ কে দেখেও মুসলিম বলেই মনে হওয়ায় ও হেল্প করতে চাইছে, ডলার দিলেও ও নিবেনা। এবার আসিফ ওর ব্যবহার, হাসি আর কথার যাদু অগ্রাহ্য করতে পারল না। নিজের পরিচয় দিয়ে জানল ওই তরুনের নাম ইনফাস মোহাম্মদ, জাতিতে শ্রীলঙ্কান। আসিফ অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ওর ফোন নম্বর আর মেট্রো কার্ডটা নিয়ে বি ফিফটিন বাস স্টপে চলে আসতে আসতে ভাবতে থাকল মহান আল্লাহ তাআলার নেয়ামতের কি দারুন নমুনা ও পেল এই দূরদেশের মাটিতে পা রাখার প্রথম লগ্নেই।

বাসের ভেতরে বড়সর দুটো লাগেজ নিয়ে ওঠার কারণে ও সবার মনোযোগের কারণ হল। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত যতগুলো স্টপে যত যাত্রী ওঠানামা করল, তাদের পচানব্বই শতাংশ মানুষ কৃষ্ণাজ্ঞ দেখে ও বুঝতে পারল লিন্ডেনউড আর ব্রাউন্সভিল এর যে নাইবারহুড দিয়ে বাস এসেছে সেটা মূলত কৃষ্ণাজ্ঞদেরই কমিউনিটি। এক স্টপে একজন হুইলচেয়ার আরোহী উঠতে চাইলে ড্রাইভার প্রথমে সামনের দিকের তিনটি সিট ফোল্ড করে স্পেস তৈরী করলেন, বাস থেকে ফুটপাথ পর্যন্ত র্যােম্প প্লেস করলেন যেন প্যাসেঞ্জার নিজেই হুইলচেয়ার একসেস করতে পারেন, এরপর উঠে এসে চেইন দিয়ে হুইলচেয়ারটাকে বাসের সাথে লক করে দিলেন, আবার প্যাসেঞ্জার নামার সময়ও একি কাজ করলেন ধৈর্যের সাথে। একজন হুইলচেয়ার এর প্যাসেঞ্জারকে বাসে তুলতে আর নামাতে ড্রাইভার এর এই সহায়ক তৎপরতা দেখে এদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় একজন প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদা আর অধিকারের তুলনায় আমাদের দেশে একজন প্রতীবন্ধী মানুষের নিগ্রহের চিত্রটা আসিফ কে আহত করল।

ভিক্টরিয়া স্টাইলে তোইরী তিনতলা ডরমিটরীর সামনে এসে দরজায় বেশ অনেকবার বেল দিল আসিফ , কেউ খুললনা। পাশের লট এর দরজায় নক করলে একটা ছেলে বেরিয়ে এল কিন্তু সে কোন হেল্প করতে পারল না। আরও অনেকক্ষণ বেল দেয়ার পর, ভেতর থেকে একজন মেয়ে জানাল, ম্যানেজার ভেতরে নেই, সে দরজা খুলতে পারবেনা কারন সে আসিফকে চিনেনা। আর সে নিজেও এই ডরমিটরির গেস্ট। ম্যানেজারকে ফোন করতে বলে মেয়েটা ভেতরে চলে গেল, আসিফ অনেক ডাকাডাকি করেও আর সাড়া পেলনা। রাস্তার ওপাশে একটু দূরে দেখল একটা গ্রসারি স্টেশনারী। আসিফ ভেতরে গিয়ে প্রথমে সিম কিনতে চেয়ে ব্যর্থ হল, ওরা বিক্রি করে না। পরে দোকানের ছেলেটাকে আসিফ ডরমিটরীতে ঢুকতে না পারার ব্যাপারটা জানাল। কথা বলে জানতে পারল সে ডমিনিকান রপাবলিকের মানুষ, মাতৃভাষা স্প্যানিশ। ছেলেটা দোকানের ল্যান্ড ফোন আসিফকে ব্যবহার করতে দিল। ডরমিটরীর ম্যানেজার ফোন ধরলনা। আসিফ ভাবল এরকম পরিস্থিতি হতে পারে ভেবে ও ব্যাকআপ হিসেবে ম্যানহাটানএ যে আরেকটা হোটেলে বুকিং দিয়ে রেখেছে সেখানে যাবে কিনা। তখনি ম্যানেজার নিজেই কলব্যাক করে জানাল সে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছে। কিছুক্ষণ পরেই আসিফ শুনতে পেল পেছন থেকে কেউ একজন তাকে জিজ্ঞেসস করছে, ‘তুমি কি মালয়েশিয়া থেকে এসেছ’? ঘাড় ঘুরিয়ে আসিফ বুঝতে পারল, সেই হল ডরমিটরীর ম্যানেজার। নাম ডেনিসন, দেশ ঘানা। সাথে তার সহকর্মী জাজা, সাউথ আফ্রিকান বংশদ্ভূত নিউজিল্যান্ড এর নাগরিক। ওদের পেয়ে আসিফ এর দুশ্চিন্তা কমল। ডরমিটরীতে ঢুকে দেখতে পেল পরিবেশটা ওর কল্পনার চেয়েও নিম্নস্তরের। দুইপাশে দুটো রুম এর মাঝখানে সরুগলি পার হয়ে ছোট নোংরা লবি। লবিতেই কিচেন। কিচেন এর পাশে একটা রুমে ওকে নিয়ে যাওয়া হল। ছোট্ট একটা রুমের ভেতর তিনটা দ্বিতল বাঙ্ক বেড, মানে ছয়জন মানুষের ঘুমানোর জায়গা। আক্ষরিক অর্থেই ঘুমানোর জায়গা, কারন বেডগুলো বসানোর পর কোনরকমে হাঁটার জায়গা ছাড়া আর জায়গা নেই। ময়লা বেডশীট আর ডুভেট। কোন ক্যাবিনেট নেই, রুমে যেহেতু আরও গেস্ট আছে তাই ডোর কি নেই। মোট কথা সেফটি আর সিকিউরিটির জন্য আল্লাহকে ভরসা করেই কোন রকম প্রিকেউশন ছাড়া উঠে যেতে হবে। আসিফ সাত দিনের বুকিং দিয়েছিল, এখন তিনদিনের প্যামেন্ট এডভান্স করে ওয়াইফাই এর পাসওয়ার্ড নিয়ে রুমে ঢুকে গেল। আসিফ জানত প্রতি রাত মাত্র তেত্রিশ ডলারে খুব ভাল কিছু আশা করা ঠিক না, কিন্তু এতটাই করুণ অবস্থা ও আশা করেনি। মনে পড়ল ওর দেখা একমাত্র এয়ারপোর্ট হল জেএফকে, যেখানে লাগেজ ট্রলী নিতে পে করতে হয়। ভাবল, আমেরিকা কি তবে হাহাকারের দেশ?

লাগেজ রেখে রুম থেকে বের হয়ে আসিফ কাছেই ব্রডওয়েতে গেল। একটা থ্রি হোল এড্যাপটার আর সাথে টি মোবাইলের এক মাসের ভ্যালিডিটির আনলিমিটেড টক অ্যান্ড টেক্সট আর তিন জিবি ডাটার প্যাকেজ কিনে যখন রুমে ফিরল তখন বিকেল গরিয়ে সন্ধ্যা। বিছানার উপরেই মাগরবের নামায আদায় করল। একটু পরেই দেখা মিলল প্রথম রুমমেটের। নাম জানতে চাইলে বলল রোমান, ইংল্যান্ডের নাগরিক। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ইকনমিক্স এ গ্রাজুয়েশন করেছে। কি একটা কাজে নিউ ইয়র্ক এসেছে। আজ রাতেই ভার্জিন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে লন্ডন চলে যাবে। দশ মিনিটের মধ্যেই সে ব্যাগ গুছিয়ে ট্যাক্সি ডেকে রওনা হয়ে গেল। যাবার আগে উইশ করতে গিয়ে বলল, ‘ইট ইস আ ভেরি হার্ড প্লেস টু সাকসিড’। রোমান চলে যেতেই এল আরেক রুমমেট। নাম জেমস। বাবা মার্কিন, মা চাইনিজ। জেমস মায়ের সাথে সাংহাই থাকে, নিউ ইয়র্ক বেড়াতে এসেছে। বাবা আমেরিকাতেই সানফ্রান্সিস্কো আছেন, ওর সাথে এবারও দেখা হয়নি। আবার সংসার পেতেছেন অনেক দিন হল। বছরে একবার তার বাবার সাথে ফোনে কথা হয়। জেমস খুব সহজভাবে বলল, ‘ওয়েল, আফটার অল হি হ্যাজ আ ফ্যামিলি, সো ......’। রাতে আসিফ শুয়ে পড়ার ঠিক আগে দেখা পেল আরেকজনের। কার্লোস আলবার্তো। চল্লিশোর্ধ বয়স। নিজের জাতিস্বত্তার পরিচয় দিল কিউবান লেবানিজ। পরিবার বলতে কিছুই তার অবশিষ্ট নেই, একদমই একা। তাই ডরমিটরীতে থাকে। আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিয়ে, সংসার, পরিবার, পিতৃস্নেহ ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয়(!) বিষগুলো ইতিহাসের বই এ ঢুকতে বেশী বাকি নেই, খুব বেশি বাকি নেই পৃথিবীর মানুষগুলো সব রোবট হতেও। আসিফ এর মনে হল ফ্লাইটে দেখা রোবোকপ মুভির প্রধান চরিত্র পিটার ফ্রেড্রিক ঊইলার যেন জেমস আর আলবার্তো এর বেশে স্বয়ং ওর রুমে হাজির।

বিছানায় শুয়ে আসিফ চোখ বুঁজে ভাবতে থাকল এই যে জীবনটাকে কাধে করে বয়ে বেড়াচ্ছে কেমন কাটল সেই জীবনের বারান্দা থেকে ঝুলে পড়া আরেকটা দিন। মনে হলে ভাল মন্দ মিলিয়েই গেল। এ যেন মেঘে রোদ্দুরে মাখামাখি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৫৪

মাহবুবুল আজাদ বলেছেন: প্রথম দিনের কথা কোনদিনও ভুলে যাবার নয়। এখনো কানে বাজে আজ থেকে ছয় বছর আগের কথা অষ্ট্রিয়ার পাহাড়ি পাথুরে রাস্তা দিয়ে টেনে তোলা লাগেজ হুইলের গর গর শব্দ।

২| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:০৩

মাকড়সাঁ বলেছেন: ভাল লাগলো খুব ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.