নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবনের জন্য প্রবাস নাকি প্রবাসের জন্য জীবন!

প্রবাসী বিশেষজ্ঞ

ব্যারিস্টার এট ল

প্রবাসী বিশেষজ্ঞ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মেঘে রোদ্দুরে মাখামাখি – ধারাবাহিক রচনা – অনুচ্ছেদ ২

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৩

আসিফ মনে মনে ভাবছে, এরকমকি ওর বেলায়ই হল নাকি অন্য কারো জীবনেও ঘটেছে! ওকি একমাত্র বাঙালি যেকিনা নিউইয়র্কের মাটিতে যখন পা রাখে তখন একজন বাঙালিকেও চিনে না? আর একজন বাঙালিও কি আছে যাকে প্রথম নিউইয়র্কে এসে নিজেয় বুকিং দেয়া ডরমিটরীতে উঠতে হয়েছে? এয়ারপোর্ট থেকে একা একা আসতে হয়েছে, কেউ আনতে যায়নি? সেই হিসেবে ওর প্রথম দু সপ্তাহ কেমন কাটল? ওকি এই দু সপ্তাহে আল্লাহর রহমতে নিজের অর্জন নিয়ে সন্তুষ্ট?

আসার পরদিনই আসিফ এখানকার কয়েকটা বাঙলা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে টিউশন করানোর জন্য। সেই সূত্রে খুঁজে পাওয়া গ্রেড ইলেভেন এর ছাত্র সাইহামকে ম্যাথস পড়াচ্ছে। সাইহাম ওর বাবা মার সাথে দুবছর আগে প্রথম এদেশে আসে। তখন ওরা নিউজার্সি থাকত। দুমাস আগে যখন ওরা নিউইইয়র্ক আসে তখনি জামাইকার হাইল্যান্ড এভিনিউ এর এই বাসায় দুটো ছোট ছোট রুম আর একটা লিভিংরুম কাম কিচেন এর ছোট্ট বাসায় মুভ করে। একটা গ্রসারীতে দিনে ষোল সতের ঘন্টার অমানুষিক পরিশ্রম আর চোখেমুখে ক্রমশঃ ধূসর হয়ে আসা স্বপ্নকে সাথী করে সায়হামের বাবা সোহেল আহমেদ এসাইলাম এপ্লিকেশন সাবমিট করে ভাগ্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর সায়হামের মা ঢাকায় তার ফেলে আসা সুবর্ণ সময়টাকে স্মরণ করেন স্বারাক্ষণ - একমাত্র ছেলে সায়হাম তখন স্কলাস্টিকায় পড়ত, মিরপুরের ফ্ল্যাট, নিজেদের গাড়ি সবকিছুই এখন কতদূরে। হাসি গানে ভরপুর জীবনটাই এখন তাকে নিয়ে যেন পরিহাস করছে। সায়হাম দিনে দিনে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। স্কুল থেকে এসেই জিম আর মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। ছেলে ভাত খায়না, ভাত নাকি সবচেয়ে ক্ষতিকর খাবার। স্যান্ডউইচ, সিরিয়াল আর ফ্রুটস হল তার আহার্য। যেকোন কথা বলতেই বাবা মা ইতস্তত করেন, এই বুঝি না ছেলে আবার ধমক দিল। আসিফের মনে পরে যায় ম্যানহাটানের আপটাউনে পুয়ের্তোরিকান মালিকানাধীন বরিকুয়া কলেজে প্যারালিগাল কোর্স এ এডমিশন এর খোঁজ নিতে গিয়ে পরিচয় হওয়া ১৫৭ স্ট্রীটের সাবওয়ে স্টেশনের ভেতরে একটা নিউজ স্ট্যান্ডে কাজ করা এক বাঙালি ভদ্রলোকের কথা। ট্রেন এর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভদ্রলোক এর সাথে কয়েক মিনিটের আলাপ। সে আসিফকে বলল, ‘এদেশে তবেই আসবেন যদি পরের জেনারেশন বরবাদ হয়ে গেলে আফসোস না থাকে’। আসিফ তার ফোন নম্বর চাইলে সে বলল, ‘ফোন ব্যাবাহার করিনা’। নাম জানতে চাইলে সে বলল, ‘নিজের নাম পরিচয় অনেক আগেই ভূলে গেছি’। আর বাঙলাদেশে বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে বলল, ‘জীবিত অবস্থায় জীবিকার জন্য এই মাটির নিচের স্টেশনে কাজ করছি, মৃত্যুর পরেওতো মাটির নিচেই যাব, কাজেই মাটির নীচেই আমার বাড়ি’। সন্তান মানুষ করার স্বপ্নের কাছে পরাজিত আরেকজন মানুষের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আসিফ সাউথ বাউন্ড ট্রেনে উঠে গেল।

এখানে এসে জীবন যুদ্ধে নামার আগে কিছু হোম ওয়ার্ক আসিফ করে এসেছে। তারই একটা অংশ হিসেবে নিউইয়র্কে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে সফল কিছু বাঙালিকে অনলাইনে খুঁজে বের করেছে। যাদের মধ্যে একজন হলেন এখানকার বাঙলাদেশ ল’ সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলি বাবুল। ফেসবুকে ইনবক্স করে নিজের পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে ভদ্রলোক তার ফোন নম্বর আসিফকে দেন। আসিফ তার সঙ্গে দেখা করে এটর্নী অশোক কর্মকারের অফিসে। ভদ্রলোক ভীষণ অমায়িক, সম্ভ্রান্ত ঘরের বনেদী পরিবারের সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ফার্স্ট ব্যাচ। সেইসময়ই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে আগারগাঁও থেকে ক্যাম্পাসে আসতেন। আমেরিকায় এসে ব্যক্তিজীবনে নিজের সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে কিছু নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন বটে, কিন্তু সেটা কাটিয়ে উঠার চেষ্টাটাই তাকে আবার কবিও করে তুলেছে। এখন এসাইলামের ড্রাফটিং আর ইন্টারপ্রিটেশন এর কাজ করেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে, আর কবিতা লিখেন নিজের অতীতকে স্মরণ করে। তাকে দেখে আসিফের মনে হয়, প্রতিটি মানুষই আসলে খুব একা।

আসিফ আগের ডরমিটরী ছেড়ে ওযোন পার্কের কাছে ৪৩০ এসেক্স স্ত্রীটের একটা বাড়িতে উঠে এসেছে। বাড়িওয়ালা মঞ্জুর সাহেব চট্টগ্রামের মানুষ। এসেছেন তার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে। তিন মেয়ে দুই ছেলের সবারই এখানে জন্ম। দেশে গিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে জামাই এখানে নিয়ে এসেছেন। ছোট ছেলে মহিউদ্দিন ছাড়া কেউই তার সাথে থাকেনা। মেয়েরা জামাই নিয়ে নিজেদের সংসারে, বড় ছেলে আলাদা থাকে। মঞ্জুর সাহেব তার বাড়ির উপরতলা, বেজমেন্ট সবই ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। নিজে স্ত্রী আর ছোট ছেলেকে নিয়ে কোনরকমে থাকছেন। মর্টগেজ বাবদ প্রতিমাসে তাকে যা পেমেন্ট করতে হয় তার থেকে অনেক বেশী তিনি ভাড়া দিয়ে তুলে নিচ্ছেন। আসিফের রুমেই আরেক রুমমেটও থাকেন। রেজা সাহেব। স্ত্রী আর দুই মেয়ে দেশে রেখে এখানে ব্রঙ্কস এর একটা ডানকিন ডোনাটসে নাইট শীফটে কাজ করছেন। ভদ্রলোক সারা রাত কাজ করেন, আর ম্যানেজার দিনের শুরুতে এসেই তাকে সমানে বকাঝকা করেন, বাসায় এসে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সে বাসার সকলের সাথে নিজের এই গঞ্জনার কথা শেয়ার করে হালকা হতে চেষ্টা করেন। আসিফ ভেবে পায়না - জীবনের জন্য প্রবাস, নাকি প্রবাসের জন্য জীবন!

এবার কুয়ালালামপুর ফিরে গিয়ে স্ত্রী আর মেয়েসহ আগামী জানুয়ারয়তে এখানে আসার জন্য টিকেটের প্রাইস খোঁজ করতে গিয়ে আসিফের পরিচয় হল বাবু নামে একজনের সাথে। জ্যাকসন হাইটসে এভারেস্ট ট্রাভেলস এ কাজ করছে, স্টুডেন্ট হয়ে এসেছে, ভাবছে এখানে বিয়ে করে স্থায়ী হবে। হিলসাইড এভিনিউতে ঘরোয়া রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে আসিফের সাথে পরিচয় ওই রেস্টুরেন্টের ক্রু মেম্বার আনিম আহমেদ এর। আনিমও এখানে বিয়ে করে গ্রীনকার্ড করেছে। আসিফ অবশ্য ওদের বলেনি যে বিয়ে করে স্ত্রীর মাধ্যমে যারা ইমিগ্র্যান্ট হয় ইংল্যান্ডে তাদের ভিসাকে বলে পেটিকোট ভিসা আর এধরনের স্ত্রীদের বলে এঙ্কর ওয়াইফ। টি মোবাইলের যে প্রিপেইড প্যাকেজ আসিফ নিয়েছে সেটার রোমিং অপশন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পরিচয় হল টি মোবাইলের রুজভেল্ট এভিনিউ এর স্টোর এক্সিকিউটিভ আদনানের সাথে, বড় ভাইএর মাধ্যমে এখানে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এসেছে। এখনো স্বপ্ন দেখছেন, তবে ভিন্ন কিছুর। কিউ ৩৩ বাসের স্টপে আসিফের সাথে পরিচয় বাঙ্লাদেশের বিসিএস ক্যাডার গাইনোকোলজিস্ট শাম্মীর সাথে। দেশের চাকুরী ছেড়ে স্বামী সন্তান নিয়ে এদেশের ইমিগ্র্যান্ট। অন্য ডাক্তারের মেডিকেল কেয়ারে সনোগ্রাফির কাজ করছেন ঘন্টাচুক্তিতে। জগন্নাথ কলেজ থেকে মাটার্স ডিগ্রী করে এখানে স্টুডেন্ট হিসেবে এসোসিয়েট প্রোগ্রামে এসেছেন রুবেল, কিউ ৩৩ বাসের স্টপেই আসিফের সাথে দেখা। ৩৭ এভিনিউ এর আব্দুল্লাহ রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন। দুই হাতের তালু গায়ে হলুদের দিন বরের হাতের তালুর মত হলুদ হয়ে আছে, রেস্টুরেন্টে কাজের চিহ্ন। স্বপ্নের নিউইয়র্ক বলে কথা, চিহ্ন রেখে যায়!

একদিন জ্যাকসন হাইটসের ৭৩স্ট্রীটে দারুল হাদিয়া মসজিদে মাগরিব নামায পড়ে বের হতেই আসিফের চোখে পড়ল সাপ্তাহিক প্রবাস পত্রিকার অফিস। ভেতরে ঢুকে ও দেখা পেল সম্পাদক সাঈদ মাহমুদ এর। তিনি কথায় কথায় বললেন সেই সন্ধ্যায়ই পি এস ৬৯ এ মিলেনিয়াম টিভির দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। সেখানে গিয়ে আসিফ দেখা পেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটিতে ওর সাথে কাজ করা পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনের শিবলি সাদিক এর। আসিফকে পেয়ে শিবলীর সেকি উচ্ছাস, একসাথে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিল ‘বার বছর পর বন্ধুর দেখা পেলাম’। নিজের গ্রীন ক্যাবে করে আসিফকে রাতের নিউইয়র্কের স্কাইলাইন দেখাতে নিয়ে গেল ব্রুকলীন ব্রীজ, ডীনার করাল প্রিমিয়াম রেস্টুরেন্টে। ওখানে আরও পরিচয় হল মামুন’স টিউটোরিয়ালের শেখ আল মামুন, শিল্পকলা একাডেমী এউএসএ’র প্রেসিডেন্ট মনিকা রায় সহ কমিউনিটির আরও অনেকের সাথে। দেখা হল নিউইয়র্ক ডিপার্টেমেন্ট অব এডুকেশনে টিচিং এসিস্ট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সীতেষ ধরের সাথে। উইকেন্ডএ ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর এর কাজ করেন। গত ষোল বছর বাঙলাদেশে যান না। অথচ মনের গহীন গভীরে এখনো দেশীয় সংস্কৃতি লালন করেন বলেই এই সেদিনও এস্টোরিয়ার পিএস২৩৪ মিলনায়তনে তার প্রযোজনায় মঞ্ছস্থ হল সূনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ‘রাজা রানী’। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ইউ এস এর উদ্যোক্তা মাহফুজা হাসানকে পেয়ে আসিফ যেন লন্ডনে ফেলে আসা কবি শামীম আজাদকে পেল। মাহফুজা হাসান নিজের পেশাগত পরিচয় ছাপিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচয়ে পরিচিত হতেই বেশী ভালবাসেন, কেন? বুকের ভেতর বাঙলাদেশকে লালন করেন বলেই।

এইকয়েকদিনে আসিফ প্রবাসী বাঙালীদের আদর আতিথেয়তা পেয়েছে অপরিসীম। এটর্নী মঈন চৌধুরী, সিনিয়র প্যারালিগাল এন মজুমদার, ট্যাক্স প্র্যাক্টিশনার জাকির মিয়া, ব্যারিস্টার ইসরাত সামী, গণজাগর মঞ্ছের সক্রীয় কর্মী জাকির আহমেদ রনি, সাপ্তাহিক বাঙালী পত্রিকার সম্পাদক কৌশিক আহমেদ, সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার সাংবাদিক মঞ্জুর হোসেইন সবাই আসিফকে স্বাগত জানিয়েছেন, পরামর্শ ও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তেমনি মুদ্রার অপর পিঠো ওর দেখা হয়ে গেছে। আসিফের ছোট বেলার খুব কাছের বন্ধু শফিক এখানে বহুবছর আগে গ্রীনকার্ড নিয়ে এসেছে, আসিফ আসার আগেপরে বহুবার শফিককে জানিয়েছে যে ও আসছে। কিন্তু শফিক ব্যস্ততার অজুহাতে দেখা করেনি, একদিন সময় দিয়েও আসেনি। ঠিকএকিরকম আচরণ ও পেয়েছে ৭৪স্ট্রীটে ফোনকার্ড ব্যবসায়ী হোসেইন, এ এস এ কলেজের বাংলাদেশি স্টুডেন্টদের কাউন্সিলর আগাথা ক্যাস্টেলিনোর দুই সহযোগী আলি ও হাসনাত, আসার সময় সোদি এয়ারলাইন্সে পরিচয় হওয়া ব্রুকলীনে ডরএলডর ফ্যাশন হাউজের স্টাফ নাসিমার মত অনেকের কাছেই।

ভালোবাসা আর অবজ্ঞা দুটোই আসিফ বরণ করেছে দুহাত ভরে। ও জানে জীবনটাই হল মেঘে রোদ্দুরে মাখামাখি।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৯

মাকড়সাঁ বলেছেন: Onak boro lakha.....

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.