![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষ জীবনের ক্রীড়ানক। জীবন মানুষকে দিয়ে অনেক রকম কাজ করিয়ে নেয়, অনেক রকম জায়গায় নিয়ে যায়, অনেকের সাথে পরিচয় করায়। অনেক কিছু দেখায়-শোনায়। মানুষ আরও একটা ব্যাপারের বশবর্তী। আর তা হল সময়। সময় নিজে কখনো ফিরে আসেনা কিন্তু মানুষকে ঠিকই সময়ের পরিক্রমায় এমন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় যা তার জীবনে আগেও ঘটেছিল, এমন এমন মানুষের সামনে এসে দাঁড়াতে হয় যার সাথে হয়ত বহুবছর আগেও দেখা হয়েছিল। রিয়াদ এর কিং খালেদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এর প্রিইমিয়ার লাউঞ্জে বসে আসিফ এসব এলোমেলো ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে, মিলিয়ে দেখছে বিগত ২৬ দিনের নিউইয়র্কে কাটানো জীবন আর সময়ের খেরোখাতা।
কুয়ালা লামপুরের পথে নিউইয়র্ক থেকে রিয়াদ ১৫ ঘন্টার লম্বা ফ্লাইটে আসিফকে আজ সঙ্গ দিয়েছিল কুইন্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরী থেকে ইস্যু করানো এরিক মারিয়া রেমার্ক এর উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়স্টার্ণ ফ্রন্ট’। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ও অবশ্য একটা মুভিও দেখে ফেলল। পরিচালক ফ্রাঙ্ক কোরাসি তার ‘ব্লেন্ডেড’ নামক মুভিতে এক সদ্য ডিভোর্সড মা এর চরিত্রে ড্রিউ ব্যারিমুরকে দিয়ে আর বিপত্নীক বাবার চরিত্রে এডাম স্যান্ডলারকে দিয়ে নিপুণভাবে দেখিয়েছেন ছেলেমেয়েদের পূর্ণাঙ্গভাবে মানুষ করার জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ পরিবার কতটা জরুরী। আসিফ এর মনে পড়ল ক্লারা, আনিকা আর জারা’র কথা। হিলসাইড এভিনিউতে আলফা টিঊটোরিয়ালের কর্ণধার সোহান এর সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে গত এক সপ্তাহ আসিফ ওখানে গ্রেড ফোর থেকে সিক্স এর বাচ্চাদের ক্লাস নিয়েছে। তামজিদুল আর রহমান নামে দুটো বাঙ্গালী ছেলে ইতিমধ্যে ওর ভক্ত হয়ে গেছে। ছেলেদুটো পড়াশুনায়ও ভালো। মুশকিল হল ক্লারা, আনিকা আর জারা নামের তিন বোনের একটা দল নিয়ে, আনিকা আর জারা যমজ বোন, গ্রেড ফোর এ পড়ে। পরাশুনায় ভীষণ ফাঁকিবাজ। ক্লারা ওদের এক বছরের বড়, পড়াশোনায় কিছুটা ভাল, তবে তিন বোনের কেউই আসিফকে একদম পছন্দ করেনা। আসিফ একদিন ক্লাসে ওদের বাবার নাম জিজ্ঞেস করেছিল, এটাই ওর অপরাধ। ওদের গায়ানিজ মা এসে আসিফকে ধমক দিয়ে গিয়েছে, পার্সোনাল কোশ্চেন করার কারণে। কারো বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে যে প্রাইভেসী নষ্ট হয় সেটা আসিফ সেদিন বুঝল! আসিফ যখন জানতে পারল ওদের বাবা বাঙ্গালী, নাম এহসান, অথচ মা গায়ানীজ, তখনই বুঝতে পারল বাবার কথা ওদের কাছে জানতে চাওয়ায় গায়ানিজ মা ক্ষেপে যাওয়ার একটাই কারণ হতে পারে। আর তা হল তাদের পরষ্পরের বিচ্ছেদ। কোথায় পরিবার! কোথায় ফ্রাঙ্ক কোরাসি!
এবার নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পথে আসিফের সাথে কুয়ালালামপুরে পরিচয় হয় হোসেন নামে এক ব্যক্তির, তার চাচাতো ভাই মহসিন নিউ ইয়র্ক থাকে। হোসেন আসিফকে মহসিনের কন্টাক্ট নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে। আসিফ যোগাযোগ করে। বেচারা লিনব্রুকে একটা হোম বিল্ডার্স শপ এ কাজ করে, বয়স পঞ্চাশ ছুই ছুই, ঢাকায় একটা ছোটখাট সরকারী চাকুরী আর টিউশনি করত। হঠাৎ ডিভি পেয়ে যায়, ওমনি টিউশনিতে গড়ে ওঠা সখ্যতাকে পুঁজি করে ছাত্রীকে বিয়ে করে এখানে নিয়ে আসে। আগের স্ত্রীর ঘরের দুই ছেলের এক জনকে নিয়ে আসে কিন্তু আরেক ছেলে ও স্ত্রীকে ছেড়ে আসে। ওর এখনকার স্ত্রী বয়স ত্রিশ পেরোয়নি। বিয়ে হয়েছে বছর দশেক আগে, অথচ এর মধ্যেই সে চার বাচ্চার মা। পিঠেপিঠি এত ছেলে মেয়ে কেন? এখানে বাচ্চা হলেইতো জন্ম সূত্রে নাগরিক আর বাবা মায়ের আয় রোজগার কম দেখানো গেলে প্রতিটি বাচ্চার জন্য হাউসিং এলাউএ্যান্স, ফুড স্টাম্প, বেবি সিটিং ফি সো আরও অনেক কিছু যে পাওয়া যায়! আর এসবের সাথে বেমানান বিষয়টা হচ্ছে, মহিলা ঢাকার হোম ইকনমিক্স কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছে, আবার নিউ ইয়র্ক আসার পরে নিউট্রিশনে গ্রাডুয়েশনও করেছে। কথাবার্তা চটপটে ও তথ্যবহুল। এরকম একটা মেয়ে বাবার বয়সী টিউটরকে বিয়ে করবে আমেরিকা আসার জন্য, ভাবা যায়! ক্রিস্টোফার কলম্বাস যে কি জাদু ফেলে গেছেন এখানে কে জানে!
আসিফ ওর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ৩১ ডিসেম্বর আবার নিউইয়র্ক আসবে। তখন এসে থাকার জন্য বাসা খোঁজ করতে গিয়ে ও ঋষীকেষ নামে একজনের খোঁজ পায়, এখানে ইয়েলো ক্যাব চালায়। ভদ্রলোক স্ত্রী আর এক সন্তান সহ জ্যাকসান হাইটসের ৩৭ এভিনিউর ৮৭ স্ট্রীটে একটা স্টুডিও ফ্ল্যাটে থাকে। গ্রামের বাড়ী লালমনিরহাট। ভাইয়ের বিয়েতে সে ৩১ ডিসেম্বর দেশে যাবে, ফিরবে এপ্রিলের শুরুতে, তাই এই তিনমাসের জন্য সে বাসা ভাড়া দিয়ে যাবে। লোকেশন ও বাসার কন্ডিশন দেখে আসিফের পছন্দ হয়। যেদিন ও কথা পাকাপাকি করে, সেদিন ঋষিকেষ এর ক্যাব অন্যশিফটে চালানো আরেক ভদ্রলোকের সাথে ওর পরিচয় হয়, নাম আনিস। এখানে আসার পর অনেক মানুষের ভিড়ে এই একজন মানুষকে আসিফ দেখল যে কিনা সত্যিকার অর্থে জীবনকে সামনে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট। কথাটা এভাবেও বলা যায় যে আসিফের দেখা অন্য সবাই যাপিত জীবনের ঘানি টানছে, কিন্তু আনিস জীবনটাকে একস্তর থেকে অন্যস্তরে নিতে ব্যস্ত। এমনিতে ইয়েলো ক্যাব চালায় ঠিকই, পাশাপাশি সিপিএ কোর্স করছে, একটা মাল্টিসার্ভিসে কাজ করছে। দুই মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে আরেকটু মানসম্মত জীবন জাপনের প্রয়াস থেকেই এই নিরন্তর প্রচেষ্টা।
মন্দীপ সিং নামে এক ভারতীয় ব্যবসায়ী এখানে উডহ্যাভেন ম্যানর নামে একটা কমিউনিটি সেন্টার এর মালিক। তার ক্যাটারিং এর ব্যবসাও আছে। আসিফ একদিন তার কাছে গিয়েছিল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাফকাত চৌধুরীর কথা উঠতেই মন্দীপ সিং এর দীপ নিভে যায়, সে চুপসে যায়। আসিফকে নিষেধ করে শাফকাত চৌধুরীর কাছে যেতে। সে নাকি প্রচন্ড রকম জাত্যাভিমানী, পাকিস্তানি ছাড়া অন্য কাউকে কখনোই কোন রকম সহযগিতা করে না। আসিফ যা বোঝার বুঝে নেয়। মন্দীপ সিং সেই চিরকালীন ভারত পাকিস্তান বৈরীতা নিউ ইয়র্কেও বয়ে বেড়াচ্ছে। আসিফ অবশ্য ঠিক করেছে সে সাউন্ডভিঊ ব্রডকাস্টিং এর অফিসে গিয়েই শাফকাত চৌধুরীর সাথে দেখা করবে। কেননা জাতীয়তাকে ও কখনোই কোনধরনের বিচারের মানদন্ড মনে করেনা। ও অনেক পাকিস্তানীর সাথে কাজ করেছে যারা অতিশয় ভদ্র ও শান্তিপ্রিয় আবার একেবারে এর বিপরীত চরিত্রেরই এক পাকিস্তানী ছেলে লন্ডনে কিছুদিন ওর রুমমেট থেকে ওর জানটই প্রায় কবজ করে ফেলেছিল। মন্দীপ সিংকে দোষ দিয়ে কি লাভ! যেকোন বিষয়ে যেকেউ এখন দ্বিধাবিভক্ত। এখানেও বাঙ্গালীরা দেশের শীর্ষদুটো রাজনৈতিক দলের মেরুকরণ থেকে বের হতে পারেনি। সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পরে সন্ধ্যার জমাট ঠান্ডায় আরও জবুথবু হয়ে ঠিকই চলছে চার্চ-ম্যাকডনাল্ড, সাটফিন বুলেভার্ড কিংবা রুজভেল্ট এভিনিউ এর আশে পাশের রাজনৈতিক আড্ডা, থেমে নেই আঞ্ছলিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রমও। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার এমনকি কোন কোন থানারও সংগঠন আছে এখানে, দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই এসোসিয়েশন আছে, আছে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সমিতি আর সেগুলোর নির্বাচন। আসিফ জানে এর কোনটাই খারাপ না, বরং এগুলোর মাধ্যমেই দেশের বাইরে দেশকে খোঁজেন প্রবাসীরা, কিন্তু সমীকরণটা এতটা সরল থাকেনা যখন এগুলো হয়ে যায় দলাদলি আর বিভক্তির প্রভাবক, নিয়ামক ও অনুঘটক।
স্যার, ‘ইউর ফ্লাইট ইস রেডি ফর বোর্ডিং’।
আসিফের গাঢ় চিন্তায় ছেদ পড়ল, প্রিমিয়ার লাউঞ্জের ২৫-২৬ বছরের তরুণ নেপালী স্টাফ পোখরেল ঘায়াল এর ডাকে। ছেলেটা এখানে এসেছে বছর চারেক হল। গায়ের রঙ অত্যন্ত ফর্সা, সুন্দর চেহারা আর শারিরীক গঠন দেখে নেপালী মনে হওয়ার কোন কারণই নেই। সে ইন্টারমেডিয়েট পাশ, তার মানদন্ডে এত ভাল চাকুরীর পেছনে ভূমিকা রেখেছে তার নিষ্ঠা আর উদ্যম, শিক্ষার ঘাটতি কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নিজে বেশিদূর পড়তে পারেনি, তাই সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর পড়াশুনায় উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। স্ত্রী কাঠমুন্ডুতে ইংরেজী সাহিত্যে এম এ পড়ছে। তার ইচ্ছে আছে নেপাল থেকে স্ত্রীর এম এ কমপ্লিট হলে কম্প্যারাটিভ লিঙ্গুইস্টিক সায়েন্স এর উপর পিএইচডি করাতে স্ত্রীকে কানাডা পাঠাবে, তখন সম্ভব হলে সেও যাবে। এখনো সন্তান নেয়নি, কানাডায় গিয়ে তারপর নেয়ার ইচ্ছে। তার আগ পর্যন্ত এখানেই সততার সাথে পরিশ্রম করবে। আসিফ লাউঞ্জ থেকে বোর্ডিং গেইট এর উদ্দেশ্যে বের হবার আগে ফ্রেশ হওয়ার জন্য রেস্টরুমে ঢুকতেই ফ্লোর মপ করতে থাকা এক তরুন সালাম দিল। উচ্চারণ আর চেহারায় আসিফ বুঝে গেল এই ছেলে বাঙ্গালী। জানল ও হায়দার, টাঙ্গাইল বাড়ী, পোখরেল এর বয়সী। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর গ্রাডুয়েট। বিবাহিত, তিন ছেলে মেয়ে, প্রতি ১৫-১৬ মাস পর পর ছুটিতে সে দেশে যায়। আসিফের আফসোস হল, পোখরেল এর চেয়ে এই ছেলের একাডেমিক শিক্ষা বেশী, একই জায়গায় কাজ করছে অথচ হায়দার এর পজিশন পোখরেল এর চেয়ে নীচে, ব্যক্তিজীবনেওতো পোখরেল অধীক সফল। এর একটাই কারণ, পোখরেল আরো উপরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করে, আর হায়দার এর কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ঠিকই বলেন, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’।
চলে আসার আগে আসিফ টিবিএন২৪ এর কর্ণধার বুলবুল হাসান, টাইম টিভি’র কর্ণধার আবু তাহের, কার্টুনিস্ট টিপু আলম, আবৃত্তিকার মিঠুন আহমেদ, সময় টিভির সাংবাদিক কিশলু সহ আরও অনেকের সাথে যেমন দেখা করেছে তেমনি সময়ের অভাবে দেখা করতে পারেনি সিবিনএন নিউজ এর রাহাত চৌধুরী, চ্যানেল আই এর আবিদ রহমান সহ আরো অনেকের সাথে। আর কখনো দেখা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী এমন স্বল্প পরিচিত তিনজন মানুষ যখন ঘরের বাইরে এসে হাত নেড়ে বিদায় জানায়, জেএফকে এয়ারপোর্ট এর টার্মিনাল ওয়ান’এ পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ফোন করে খবর নেয়, তখন ভালোবাসার এই বহিঃপ্রকাশ আসিফকে আরো একবার কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে। স্বপ পরিচিত এই মানুষগুলোর জন্য, এই শহরের জন্য ওর মন খারাপ হয়। মেঘে রোদ্দুরে মাখামাখি এই জীবন ওকে কোথায় নিয়ে যায়, সময় আবার ওকে এদের মাঝে ফিরিয়ে আনে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
©somewhere in net ltd.