![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
গণপ্রত্যাশা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকা
ফকির ইলিয়াস
=======================================
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একটি রাজনৈতিক চেতনায়। সেই চেতনার দূরদর্শিতা ছিল। গোটা জাতির মানুষের সমন্বয় ছিল। কিছু রাজাকার বিরোধিতা করেছিল ঠিকই, কিন্তু ওরা টিকে থাকতে পারেনি। জয়ী হয়েছিল বাংলার মানুষ। সেই জয়ের পথ ধরে আজকের এই বাংলাদেশ। মহান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসী সকলের অবদান ছিল। রক্তে দিতে হয়েছে সবাইকে। সেই বাংলাদেশে আজো সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের নানাভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারা করছে এসব? ওদের পরিচয় কী? ওরা কি আজো বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারছে? না পারছে না। আর পারছে না বলেই গেলো কয়েকদিনে গোটা দেশে শতাধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কী সেসব মানুষের অপরাধ? আমরা পূর্ণিমা রানীর ইতিহাস ভুলে যাইনি। যারা একাত্তরে এদেশে নারী সমাজকে ‘গনিমতের মাল’ বলে আখ্যা দিয়েছিল- ২০১৩ সালে এই প্রজন্ম আবারো ওদের মুখে থু থু ছুড়ে দিচ্ছে। তারপরও বে-শরম ওসব নালায়েকদের বোধোদয় হচ্ছে না।
গুজব ছড়ানো হয়েছে, চাঁদে নাকি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি সাঈদীর ছবি দেখা গেছে! কী আজব প্রচার! এই আধুনিক যুগেও তা মানুষ বিশ্বাস করেছে এবং কেউ কেউ আত্মাহুতিও দিয়েছে- তা বিশ্বাস করা যায়? অথচ তাই হয়েছে। ওরা কিভাবে হামলে পড়েছে, তা দেশের মানুষ দেখেছেন। বাংলাদেশকে বিশ্বাস করলে এদেশের আইন মানতে হবে। বিচার ব্যবস্থার রায় মেনে আইনি প্রক্রিয়ায় তা মোকাবেলা করতে হবে। আপিল তো করা যায়। তা করার আগেই হায়েনারা এভাবে হামলে পড়লো কেন? এই কয়েকদিনে অসংখ্য অমানবিক, পাশবিক কাজ করেছে একাত্তরের হয়েনারা। তা-ব ও লুটপাটের বর্ণনা দিতে গিয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (পবিবো) চেয়ারম্যানের ছলছল চোখের ভাষা বলে দিচ্ছিল কী তা-ব চালানো হয়েছে কানসাটের পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির দপ্তরে। যারা শুনছিলেন তাদের চোখও ছলছল করে ওঠে। পবিবোর চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দীন বলেন- এমন নারকীয় তা-ব জীবনে কখনো দেখেননি।
তিনি বলেন, ‘ধ্বংসযজ্ঞে গিয়ে আমি যা দেখেছি তা দেখে কোনো মানুষ কান্না থামাতে পারবে না। ওইসব পরিবার কিভাবে যে দিন কাটাচ্ছে, তা চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না।’ তিনি জানান, কানসাটে পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির দপ্তর অবরুদ্ধ করে রেখে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে জামাত-শিবির। নিঃস্ব হয়েছেন সেখানে কর্মরত ৪৩টি পরিবার। প্রায় সমস্ত মেশিনপত্র ও মালামাল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের দিন ২৮ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির সদর দপ্তরে এই তা-ব চালায় জামাতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের দাবি, তা-বে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার মঈন বলেন, ‘ধ্বংসযজ্ঞের পর বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে ওই অঞ্চলের ৪৫ হাজার গ্রাহক ও ২৩০০ কৃষি সেচ পাম্প। বিদ্যুতের অভাবে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমির সেচ বিঘিœত হচ্ছে।’ ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে মঈন বলেন, ‘দুপুর দেড়টার দিকে কিছু হরতাল সমর্থক সেখানে গিয়ে ইট ছোড়ে, ভাঙচুর করে এবং আগুন লাগিয়ে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ সমিতি কার্যালয়ে একসঙ্গে ঢুকে পড়ে। তারা সমিতির কর্মকর্তাদের বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের বাইরে বের করে দিয়ে লুটপাট শুরু করে। এরপর শুরু হয় অগ্নিকা-।’
‘যানবাহন, সরঞ্জাম, খুচরা যন্ত্রাংশ, সাবস্টেশন, আবাসিক ও অফিস ভবন, স্টোর ইয়ার্ড, সব দলিল দস্তাবেজ এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে আগুন দেয়া হয়। এভাবে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা একটানা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চলে। জানান তিনি। এ থেকে প্রমাণিত হয়, একজন রাজাকার ওদের কাছে একটি রাষ্ট্রের মানুষের চেয়েও বড়। তা না হলে ওরা রাষ্ট্রের আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এভাবে রাষ্ট্রের, গণমানুষের জানমালের ক্ষতি করবে কেন?
আমরা দেখছি, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবার জন্য একটি মিশন নিয়ে নেমেছে বিদেশেরও কিছু মৌলবাদী মিডিয়া। ‘আল জাজিরা’ নামের মিডিয়াটি যারা এর আগেও ‘আল কায়েদা’কে নানাভাবে সমর্থন করেছে ওরাও মেতেছে বাংলাদেশের আলবদরদের বঁাঁচাতে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামাতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের পক্ষে সাফাই গেয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে আল জাজিরা টেলিভিশন। টিভি চ্যানেলটির অনলাইনেও এ বিষয়ে ‘বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সাবেক রাজনীতিবিদ গোলাম আযম ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি। ৮৯ বছর বয়সী গোলাম আযম হাঁটতে পারেন না, দেখতে পান না, এমনকি শুনতেও পান না। তা সত্ত্বেও ১০ জন সশস্ত্র পুলিশ কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক তাকে পাহারা দিচ্ছেন।’
এতে বুঝা যাচ্ছে, রাজাকাররা কতো টাকা ছড়াচ্ছে মিডিয়া কিনে নিতে। মনে রাখা দরকার কেউ ব্যক্তিগত ধর্মকর্ম করলেই তো তার অপরাধ মাফ হয়ে যেতে পারে না। এটা জানার পরও একশ্রেণীর মতলববাজরা বলছেÑ ‘জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত’ করা হচ্ছে। অপরাধী শাস্তি পাবে না- তা তো কোনো জাতিরই কাম্য হতে পারে না। অসভ্যতারও একটা সীমারেখা আছে। একাত্তরে বর্বরতার সেই সীমারেখাও ওরা মানেনি। আর এরপরেও তারা থেমে থাকেনি। একাত্তরের ধর্ষক, লম্পট, খুনি দেইল্লা রাজাকার ওরফে সাঈদী শুধু দেশেই অপরাধ করে ক্ষান্ত হয়নি। এই লোকটি ইংল্যান্ডে গিয়েও দেশের জন্য চরম বদনাম হাসিল করে এসেছিল ২০০৬ সালে। ইসলাম ধর্মের কথা বলে সেখানে এই ধর্মকেই সবার সামনে হেয় করেছিল সাঈদী। সে সময় সাঈদী বলেছিল ‘ইংল্যান্ডে ও আমেরিকায় বোমা মারা একদম সঠিক। ইংল্যান্ড বোমা খাওয়া ডিজার্ভ করে’ তখন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ট্যাবলয়েড ঞযব ঝঁহ সাঈদীকে নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ১৫ জুলাই ২০০৬ সালে। লেখাটির শিরোনাম ছিল- ইধহ ঃযরং নবধংঃ ধহফ করষষ ইৎরঃং ঐধঃব ঈষবৎরপ ষবঃ রহঃড় টক, এখানে সাঈদীকে ‘জানোয়ার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। এসব তথ্য আর্কাইভে আছে। আমেরিকায়ও সাঈদীর তাফসির মাহফিলে নজরদারিতে ছিল বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিবাদীদের তোপের মুখে সাঈদীর মাহফিল প- হয় অনেক জায়গায়। পরে আমেরিকা সাঈদীকে ভিসা দেয়াই বন্ধ করে দেয়।
এসব লিখলে অনেক লেখা যাবে। আজ সময় এসেছে এদের মুখোশ উন্মোচন করে দেশবাসীকে প্রতিরোধে এগিয়ে আসার। আর রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে নিয়ামকের ভূমিকা নিতে হবে। কারণ আইন প্রয়োগ করার মালিক রাষ্ট্র। দেশের জনগণ দাবি জানাবেন। দাবি ন্যায্য হলে তা মেনে, প্রয়োগ রাষ্ট্রকেই করতে হবে। আমরা দেখছি, হরতাল ডেকেছে বিএনপি। আর পিকেটিং করছে আলবদররা। খালেদা জিয়া যেভাবে রাজাকারদের নিজের দল ইজারা দিয়েছেন, তাতে তার দলের ভবিষ্যৎ কী তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। একদিকে অহিংস শাহবাগ। অন্য দিকে পরাজিত হায়েনাদের জ্বালাও পোড়াও। যেকোনো দাঙ্গা এড়াতে মুসলমানদের মসজিদে নামাজ পড়ে মন্দির এবং হিন্দুদের মসজিদের নিরাপত্তা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার। তার এই আহ্বান মানবতার বাণীই উচ্চারণ করছে। তিনি বলেছেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধীরা যখনই বিপদে পড়েছে, তখনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করেছে। আমরা মুসলমান ভাইদের বলছি, আপনারা মসজিদে নামাজ পড়ে মন্দির পাহারা দেবেন। হিন্দু ভাইয়েরা মসজিদের নিরাপত্তা দেবেন। যাতে কেউ ধর্মীয় দাঙ্গা বাধাতে না পারে।’
তিনি বলেন, ‘জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারবো। যেখানে ‘সংখ্যালঘু’ নামে কোনো শব্দ থাকবে না, হারিয়ে যাবে জঙ্গিবাদ।’ ডা. ইমরান বলেছেন, ‘গণতন্ত্র মানে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, উপাসনালয়-বসতবাড়িতে আগুন দেয়া নয়। গত কয়েক দিনে ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে। তারা আমাদের আন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলেছিল। কিন্তু সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ তা মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। পরে তারা এ আন্দোলনকে রাজনৈতিক লেবেল দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এখানে অনেক ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন অংশ নেয়ায় তারা ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় নেতাদের এটা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।’ আমি নিজেও মনে করি, বিএনপি যদি ঘাতক দালালদের বিচারের উদ্যোগ নিতো, এ দেশের কোটি মানুষ তা সমর্থন করতেন। কিন্তু তারা তা করেনি, করবেও না। কারণ তারা জানে ডানপন্থী মৌলবাদীদের তোয়াজ না করলে বিএনপি নামে কোনো দলই থাকবে না। তাই জামাত-বিএনপি অনেক আগে থেকেই একীভূত হয়ে আছে একই অঙ্গে। বাংলাদেশের বড় দুই দল এই ইস্যুতে এক হতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। তাই যে কোনো সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ। অন্যদিকে স্বৈরাচারী এরশাদের দল জাতীয় পার্টি সুস্পষ্ট কোনো অবস্থানে যেতে পারছে না। কারণ এরশাদের সেই দূরদর্শিতা নেই, কেমন হতে পারে আগামী দিনগুলো। তাই একাত্তরের মতো প্রজন্মের পক্ষে সকল দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে। এ বিষয়ে আমি দুটি প্রস্তাব রাখতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সমীপে।
১। দেশের হাক্কানি আলেম সমাজকে একত্রিত করে মওদুদীপন্থী ফেতনাবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কারণ আমরা জেনেছি ওরা চট্টগ্রামে আলেমদেরও হত্যার নীলনকশা করেছিল। এজন্য সরকারি জোরালো উদ্যোগ দরকার। যাতে দেশের সকল মাদ্রাসায় মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে প্রজন্ম জেগে ওঠে। একই সঙ্গে কেউ যাতে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে, রিভার্স খেলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে না পারে- সে বিষয়েও সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। ২। রাষ্ট্রের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি যারা করছে ওদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইন, সন্ত্রাস দমন আইনে বিচার করা হোক । মামলা রুজু করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হোক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পুলিশি তৎপরতা জোরদার হলেই অনেক গ্রামই পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। ওরা দাঁড়াবার মাটিই খুঁজে পায় না পায়ের নিচে। বিদ্যুৎকেন্দ্র, ট্রেন, থানা, সরকারি স্থাপনা যারা পোড়াচ্ছে এরা রাষ্ট্রের শত্রু। এদের দমনে সরকারকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। ধর্ম যার যার। রাষ্ট্র সকলের। তাই খুনখারাবি করে যারা দেশে উন্মাদনা সৃষ্টি করছে, ওদের ছাড় দেয়া যায় না। আজ সবাইকে দাঁড়াতে হবে মানবতার পক্ষে। মানুষের পক্ষে। নিজ ভূমি রক্ষার পক্ষে।
--------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ // ঢাকা // : শনিবার, ৯ মার্চ ২০১৩
©somewhere in net ltd.