নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস

এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস › বিস্তারিত পোস্টঃ

যদি অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সুবিচার না হয়

০৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:২৬





যদি অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সুবিচার না হয়
ফকির ইলিয়াস
==========================================

নিউইয়র্ক আমার খুব প্রিয় নগরী। এই নগরে তিরিশ বছরের কাছাকাছি সময়, আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এই নগরেই আমি যখন বাকরুদ্ধ হয়ে যাই, তখন বুঝতে পারি আমি আর ঠিক নেই। আমার বুদ্ধি-ধ্যান কাজ করছে না। অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড আমাকে স্তম্ভিত করেছে। অভিজিৎ আমার অনুজের মতো। তার সব কথার সঙ্গে আমার মতের মিল ছিল না। কিন্তু আমি তার মতের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতাম। তাকে সম্মান করতাম। তিনি এই আমেরিকা থেকেই পিএইচডি করেছিলেন। ড. অভিজিৎ রায় পরিচয় দিতেন না নিজেকে। বলতেন নিজেকে- শব্দচাষি।

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ শনিবার রাতে নিউইয়র্কে একুশের বইমেলায় ‘মুক্তধারা’ যে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিল, সেখানে আমার কবিতা পড়ার কথা ছিল। আমি কবিতা পড়তে পারিনি। বলেছি- আমার বোন বন্যা যখন রক্তাক্ত হয়ে ঢাকার রাজপথে হাঁক দিয়েও কোনো সাহায্য পায় না- আমার কবিতা পড়ে কী হবে! আমার অনুজ অভিজিৎ-এর লাশ যখন রাস্তায় পড়ে থাকে- তখন আমার কবিতা পড়ে কী হবে! কথা বলেছি। খুব কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করেছি। বলেছি- অভিজিৎ রায় মার্কিন নাগরিক ছিলেন। আমাদের ট্যাক্সের ডলারে পরিচালিত মার্কিনি গোয়েন্দাদের বাংলাদেশে তদন্তের সুযোগ দিতে হবে। দাবি এই একটাই। যারা এই প্রবাসে বসেও আমাদের নমস্য বুদ্ধিজীবী ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে স্ট্যাটস দেয়- তাদের চিহ্নিত করতে হবে।

অভিজিৎ রায় আটলান্টায় থাকতেন। নিউইয়র্কে মুক্তধারার বইমেলায় তিনি স্বস্ত্রীক আসতেন প্রায় প্রতি বছর। আড্ডা হতো। কথা হতো। তিনি লিখতেন তার মতো করে। তার লেখার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল, তিনি ছিলেন প্রখর ধীশক্তি সম্পন্ন লেখক। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী লেখক। তিনি তার যুক্তির সপক্ষে প্রচুর তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারতেন। লেখা নিয়ে খাটাখাটি করতেন অনেক। ধর্ম-বিজ্ঞান-যুক্তি-বিশ্বাস-অবিশ্বাস ছিল তার লেখার মূল উপপাদ্য বিষয়। একজন লেখকের লেখার একটি মূল থিম থাকে। থাকতেই পারে। বিশ্বসাহিত্য পড়ে আমরা সেই অভিজ্ঞতাই পাই। তাই আমি তাকে সেই নজরেই দেখতাম। তিনি তার অবস্থান থেকে কাজ করবেন। আমার স্থান থেকে আমি।

বাংলাদেশে এর আগেও এমন পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। শাহ এ এম এস কিবরিয়া, হুমায়ুন আজাদকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ব্লুগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলা ভাষার একজন লেখক হিসেবে নিজেকে ছি দিতে ইচ্ছে করে খুব। এই বাংলাদেশ শাহ কিবরিয়া হত্যার বিচার শেষ করতে পারেনি। পারেনি হুমায়ুন আজাদ হত্যার বিচার করতে। মৌলবাদীরা দেখাচ্ছে তাদের ফণা। আর প্রগতিবাদীরা লেজ গুটিয়ে মার খাচ্ছে! আমরা অনেকবার বলেছি, এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? কাজ হয়নি। আমরা কি প্রতিরোধ করতে ভুলে গেলাম? আমরা কি একাত্তর ভুলে গেলাম? ভুলে গেলে তো বাঁচতে পারবো না। বড় মর্মান্তিক ছিল সেই দৃশ্য। ঢাকার রাস্তায় ওই রাতে দাঁড়িয়ে লোকজন রক্তাক্ত বন্যাকে দেখছে। পাশে পড়ে আছে অভিজিতের দেহ। কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। মানবতা, সাহায্যের হাত কি এতোই খাটো হয়ে গেল? আমরা কি এতোই অমানুষ হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে? অভিজিৎ প্রাণের টানে বইমেলায় গিয়েছিলেন। সেটা তার জন্মমাটি। বন্যা আহমেদ যে দেশে জন্মেছিলেন- সেখানেই বেড়াতে গিয়েছিলেন। তারা এভাবে আক্রান্ত হওয়ার জন্য তাদের মেধা ও মনন উজাড় করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে?

প্রতিবাদের ভাষা আমরা ভুলে গেছি। কথা বলার আর কি আছে। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু সংবাদের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়েছে গোটা বিশ্ব। তিনি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন- সেই আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট (বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়) বিবৃতি দিয়েছে। নিন্দা জানিয়েছে খুব কঠোর ভাষায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ চাইলে এই হত্যাকাণ্ড তদন্তে সহায়তা দিতে প্রস্তুত দেশটি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র জেন সাকি এ সব কথা বলেছেন। প্রেস ব্রিফিংয়ের শুরুতেই অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই মুখপাত্র। এই হত্যাকাণ্ডকে নৃশংস ও কাপুরুষোচিত অভিহিত করে জেন সাকি বলেন, অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডে তীব্র নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র।

অভিজিৎকে একজন সাংবাদিক, মানবতাবাদী, স্বামী ও বন্ধু অভিহিত করে তার পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে সমবেদনা জানান জেন সাকি। তিনি বলেন, জঘন্য সহিংসতার মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে তাকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এটা কেবল একজন ব্যক্তির ওপর হামলা নয়, বাংলাদেশের সংবিধানে সংরক্ষিত সর্বজনীন আদর্শ এবং বুদ্ধি ও ধর্মীয় আলোচনার স্বাধীনতার বিষয়ে দেশটির গর্ব করার মতো ঐতিহ্যের প্রতি এটা কাপুরুষোচিত আঘাত। এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ চাইলে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহায়তা দিতে তারা প্রস্তুত। মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের খবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে।

বাংলাদেশে লেখক-সাংবাদিক আক্রান্ত হলেও সময়মতো সে সব ঘটনার বিচার না হওয়াই অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পথ করে দিয়েছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’-সিপিজে। মুক্ত সাংবাদিকতার পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে আসা সংগঠনটির পক্ষ থেকে দ্রুত অভিজিতের হত্যাকারীদের ধরে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত এবং বিচারের আওতায় আনতে সরকারের জোরদার তদন্ত করা উচিত, এ কথা বিবৃতিতে বলা হয়েছে। অভিজিৎ হত্যায় উদ্বেগ জানিয়ে সিপিজের এশিয়া বিষয়ক প্রোগ্রাম সমন্বয়ক বব ডায়েটজ বলেছেন, বাংলাদেশে হামলাকারীদের বিচার না হওয়ার যে নজির রয়েছে তারই ফলে অভিজিতের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর আগে গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণের ঘটনায় কারোর বিচার না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যম কর্মীদের হত্যার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। সিপিজের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে যারা ব্লুগে বা অন্য কোনো মাধ্যমে লিখেছেন তারা হুমকির মুখে রয়েছেন। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের সময় ব্লুগারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে এতে বলা হয়, সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্লুগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা করে ধর্মের নামে সন্ত্রাসকারীরা। ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য এখনো কেউ শাস্তি পায়নি। বইমেলা থেকে ফেরার পথে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার ওপর যেভাবে হামলা হয়, সেভাবেই ১১ বছর আগে হামলা হয়েছিল লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বাংলা একাডেমি ও টিএসসির মাঝামাঝি এলাকায় হামলার শিকার হন হুমায়ুন আজাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। ওই হত্যাকাণ্ডের পর ১১ বছর পার হলেও এখনো বিচার শেষ হয়নি।

অভিজিৎ রায়কে হত্যার মধ্য দিয়ে খুনিরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছে, তা তারা পারবে না। কারণ এই চলমান সময়ে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী একেকজন অভিজিৎ হয়ে নিজেকে গড়ে তুলছে। এটা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। বিভিন্ন ভাষায়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। বিশেষ করে মুঠোফোন, ফেসবুক, টুইটার, ব্লুগ, অনলাইন মিডিয়া, ওয়েব ম্যাগাজিন ইত্যাকার দ্রুত শক্তিসম্পন্ন মিডিয়াগুলো মানুষকে সচেতন, বিবেকবান করে তুলছে।

আগেই বলেছি, অভিজিৎ রায় আমেরিকার নাগরিক ছিলেন। তাই তার হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায় মার্কিন সরকারের ওপরও বর্তায়। আমরা জানি, আমেরিকা এমন শক্তি, যারা পানামার প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে ধরে নিয়ে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারা চাইলে সবই পারে। একজন আমেরিকার নাগরিককে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তদন্তে তাই আমেরিকার হাত বাড়ানো প্রয়োজন। আমেরিকা ইতোমধ্যেই তাদের গোয়েন্দা পাঠানোর কথা বলেছে। বাংলাদেশও রাজি হয়েছে। আমরা এর প্রয়োগ চাই। আমরা চাই- দ্রুত অপরাধীদের ধরা হোক।

আজ যদি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করা না যায়, তাহলে দেশে বিদেশে অবস্থানরত কোনো মুক্তচিন্তার লেখক-বুদ্ধিজীবীই এদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। যারা যুক্তি দিয়ে পারে না তারাই রক্ত নিয়ে খেলে। আজকের বাংলাদেশে যে হোলিখেলা মৌলবাদীরা শুরু করেছে তা থেকে প্রধানমন্ত্রী নিজেও যে নিরাপদ নন- তাতো তিনি বারবার নিজেই বলেছেন। তাহলে এর সুরাহা কী?

রাফিদা আহমেদ বন্যা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছেন। জখম বন্যা আহমেদকে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে আমেরিকায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। না, অভিজিৎ আর ফিরতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রে। ঘাতকরা অভিজিৎকে হুমকি দিয়েই যাচ্ছিল। তিনি তা পরোয়া করেননি। তিনি লিখেছেন তার চিন্তা-চেতনা নিয়ে। তার মতের সঙ্গে অমিল হলে তাকে মেরে ফেলতে হবে? এটা কোনো ধর্ম গ্রাহ্য করে?

আমরা অভিজিৎ হত্যার সুবিচার চাই। আমরা সব নির্মম হত্যাকাণ্ডের অশুভ পরিকল্পনার মূলোৎপাটন চাই। এ জন্য মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এত নিরাপত্তা বলয়ের দোহাইয়ের পরও কীভাবে অভিজিৎকে খুন করা হলো এই বিষয় জাতির সামনে তুলে ধরা হোক। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক।
------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শুক্রবার, ৬ মার্চ ২০১৫ প্রকাশিত

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.