![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
সিলেটে রাজন হত্যা ও আমাদের সামাজিক দায়
ফকির ইলিয়াস
==========================================
সিলেটের কুমার গাঁও আমার বাড়ী থেকে খুব দূরে নয়। বাইপাস সড়ক ধরে আড়াই মাইল হতে পারে। এই পথ দিয়েই আমার শহরে আসা যাওয়া হয়। কুমার গাঁও
এর কাছে সুরমা নদীতে সেতু হওয়ার পর উন্নয়নের জোয়ার এসেছে এই এলাকায়। গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-বিতান। এই এলাকার মানুষ কাজ করতে পারছেন বিভিন্ন ফিল্ডে। আসছেন অন্য এলাকা থেকে মানুষজনও।
এই এলাকায়ই কিশোর শেখ সামিউল আলম রাজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
ক'দিন আগে যখন খবরের কাগজে পড়ি, এক কিশোরের লাশ গুম করতে গিয়ে দুজন গ্রেফতার- তখনও ভাবি নি এর পেছনে রয়েছে এমন জঘন্য নির্মমতা।
কী আকুতি করে নি রাজন ! বাঁচতে চেয়েছে। না পাষণ্ডরা তাকে বাঁচতে দেয়নি।
কী অপরাধ করেছিল এই ১৩ বছরের কিশোরটি ? বলা হয়েছে, সে চুরি
করতে গিয়েছিল। তার শারীরিক গড়ন দেখে কি মনে হয় সে একজন পেশাদার চোর?
এই ঘটনার ভিডিও করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ভিডিওটি করা হয়েছে, নির্যাতনকারীদের
জ্ঞাতসারে। তারা তাদের বাহাদুরি বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছে স্বেচ্ছায়। কত বর্বরতম
মানসিকতা !
খুব বেদনাহতভাবে ভিডিওর কিছু অংশ আমি দেখেছি। শুনেছি রাজনের শেষ আকুতি।সে বলছে-''আমাকে আর মারবেন না, মরে যাবো। হাড়-গুড় ভেঙে গেছে। পুলিশের দিয়ে দেন। একটু পানি খাওয়ান। আর পারছি না।’
পানি খেতে চেয়েছিল ছেলেটি। তাকে বলেছে 'পানি নাই, ঘাম খা'। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে।‘ আর প্রচণ্ড উল্লাসে সেই মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনার ভিডিও করেছে তারা।
রাজনের বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামে। রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান পেশায় একজন মাইক্রোবাসচালক। তার দুই ছেলের মধ্যে রাজন বড়। অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা রাজন সবজি বিক্রি করত। আর সবজি বিক্রির টাকা দিয়েই চলতো রাজনের পরিবারের খরচ।
দুষ্কৃতকারীরা রাজনের লাশ গুম করার চেষ্টা করেছিল। ওই দিনই পুলিশ লাশসহ দুজনকে আটক করে। তবে ওই ঘটনা, সাধারণ চোর পেটানোর ঘটনা হিসেবেই চাপা পড়ে যায়। কোনো প্রমাণ নেই, হাতেনাতে ধরার বিষয়টিও নেই। চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ছেলেটিকে। সবজি বিক্রি করতে বাড়ি থেকে বের হয়। শহরতলির কুমারগাঁও এলাকায় আসার পর চোর সন্দেহে তাকে আটক করে স্থানীয়রা। কুমারগাও বাসস্ট্যান্ড এলাকার বড়গাঁও সুন্দর আলী ও গাজী লালাই মিয়া মার্কেটসংলগ্ন স্থানে তাকে একটি খুঁটির সঙ্গে হাত-পা বেঁধে টানা আধাঘণ্টা ধরে মারধর করে তারা। তাদের পিটুনিতে মারা যায় রাজন। রাজন মারা গেছে বুঝতে পেরে তার লাশ গুমের চেষ্টা চালায় তারা। লাশ গুমের চেষ্টাকালে মুহিত আলম নামে একজনকে স্থানীয় জনতা আটক করে পুলিশে দেয়। পুলিশ ওই দিন দুপরের দিকে রাজনের লাশ উদ্ধার করে।
তখনও রাজানের বাব-মা জানতেন না যে তার ছেলেকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। রাতে ছেলে বাড়ি না ফেরায় রাজনের বাবা-মা জালালাবাদ থানায় জিডি করতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন একটি কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একপর্যায়ে তারা তাদের সন্তানকে শনাক্ত করেন। আজিজুর যেদিন ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাতে পারেন না, সেদিন সংসার খরচ চালাতে সবজি বিক্রি করতে বের হয় রাজন। মা লুবনা আক্তার জানিয়েছেন, রাজনের বাবা গাড়িতে (ভাড়ার ট্রিপে) ছিলেন বলে বাড়ি ফেরেননি। ভোরে টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য রাজন বের হয়েছিল। সারা দিন ছেলের খোঁজ পাননি তারা। রাতে থানায় গিয়ে জিডি করার সময় এক কিশোরের লাশ পাওয়া গেছে জানতে পেরে তারা রাজনকে শনাক্ত করা হয়। তিনি বলেন, 'আমার পুয়া (ছেলে) চোর না। ই কথা সারা এলাকার মানুষ জানে।আমি এর উচিত বিচার চাই।'
ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে আটক মুহিত আলমকেও। তার দেওয়া তথ্যমতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও উদ্ধার করে। এ ছাড়াও ওই ভিডিওটি এলাকাবাসীও সংগ্রহ করেছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে নির্মম সেই হত্যার ঘটনা। ভিডিওতে দেখে গেছে, কুমারগাঁও এলাকায় একটি দোকানের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে প্রায় আধা ঘণ্টা নির্যাতন করা হয় ১৩ বছরের কিশোর শেখ সামিউল আলম রাজনকে। বাঁধা অবস্থায় পানির জন্য বেশ কয়েকবার আর্তনাদ করেও রাজনকে পানি দেয়নি নির্যাতনকারীরা।
কয়েকজন মিলে উল্লাসের সঙ্গে কিশোর রাজনের ওপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। টানা ২৮ মিনিট বাঁধা অবস্থায় অনেকটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চলে নির্যাতন। কিশোর শরীরে টানা নির্যাতন সইতে না পেরে শেষে পানি খাওয়ার আকুতি জানায়। ভিডিওচিত্রে তিন-চারজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও ভিডিও ধারণকারী আরও দুজনের উপস্থিতিও দেখা গেছে।
একনাগাড়ে প্রায় ১৬ মিনিট রাজনকে অনেকটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রোল দিয়ে পেটানো হয়। নির্যাতনকারীরা রাজনের নখে, মাথা ও পেটে রোল দিয়ে আঘাত করে এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। কয়েক মিনিটের জন্য রাজনকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয়। 'হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, আরও মারো…' বলে রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেকদফা পেটানো হয়। এ সময় রাজনের শরীর ও চোখ-মুখ বেশ ফোলা দেখা গেছে। একপর্যায়ে মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রাজন। নির্যাতনের সময় নির্যাতনকারীদের উল্লাস করতে দেখা গেছে। এ ছাড়াও নির্যাতনের একপর্যায়ে সামিউলকে বোতলের কর্ক দিয়ে একজন কয়েক ফোটা পানিও দিতে দেখা গেছে। মারধর করার সময় একদিকে রাজনের মুখে আর্তচিৎকার, আর অন্যদিকে নির্যাতনকারীদের মুখে অট্টহাসি দিয়ে নানা কটূক্তি করতেও শোনা গেছে। যে ভিডিও ধারণ করার কাজটি করছিল, তাকে নির্দেশ করে নির্যাতনকারীরা জানতে চায়- ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কি-না। ওপাশ থেকে 'ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব…' বলতে শোনা গেছে। শেষ দিকে নির্যাতনকারী একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চায়- 'কিতা করতাম?' অপর একজনকে তখন 'মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!' বলতে শোনা যায়।
আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, মামলায় রাজনের লাশ গুমের সময় হাতেনাতে আটক মুহিত ও তার ভাই কামরুল ইসলাম (২৪), তাদের সহযোগী আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪) ও চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়নাকে (৪৫) আসামি করা হয়েছে।
ভিডিওতে সে কয়েকজনকে দেখা গেছে, তাদের ক্লোজলুক ও ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে
মিডিয়ায়। এরা কারা ?
পবিত্র রমজান মাসের শেষ দিক এখন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রহমত আর বরকতের মাস রমজান। এই মাসেই ঘৃণ্য,জঘন্য কায়দায় একজন কিশোরকে খুন করা
হলো ! যারা এই কাজটি করলো- এদের মানবিকতা,ধর্ম,জাত-পাত কিছুই নেই ?
একটি চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে আজকের এই বাংলাদেশ। কঠিন সময়
পার করছে বাঙালী জাতি। হাতে হাতে মুঠোফোনের দৌরাত্ম্য অস্থির করে তুলেছে
এই প্রজন্মকে। রাজন হত্যায় এরা এটাকে ব্যবহার করেছে তাদের উল্লাসনৃত্য দেখাবার
কাজে। যা বিশ্বের তাবৎ মানবিকতার মুখে ছাই দিয়েছে।
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে শিশুশ্রম একটি মামুলি বিষয়। এদেশে
শিশু অপরাধীদের শোধরানোর জন্য নেই কোনো শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র। ফলে শিশু-কিশোররা অপরাধপ্রবণ হচ্ছে। এদেরকে না না ভাবে প্ররোচিত করছে কিছু
সামাজিক 'গড ফাদার'।
হাতে আইন তুলে নেয়ার মানসিকতা বর্বরদেরই হয়। রাজনকে যারা এমন নির্মমভাবে হত্যা করেছে- এরা বিকারগ্রস্থ মানুষ। সমাজের জন্য এমন বিকারগ্রস্থ মানুষ আসলেই খুব বিপদজনক।
রাজন একটি হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। এই পরিবারকে সাহায্য করতে স্থানীয়
প্রশাসন এগিয়ে এসেছে কী না - আমার জানা নেই। যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছেন, তাদের উচিত এই চরম দুঃসময়ে পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো।
রাজন হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না করলে- বাংলাদেশ বিপর্যস্ত হবে। কলংকিত থেকে
যাবে বাঙালী সমাজ। হেয় প্রতিপন্ন হবে পবিত্র রমজানের ধর্মীয় মূল্যবোধ।
মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উচিত এ বিষয়ে সার্বিক ব্যবস্থা নেয়ার জরুরি নির্দেশ দেয়া।
একদল খুনি খুন করে তা আবার রেকর্ড করে মানুষজনকে দেখাবে- এমন জঘন্য
অপসভ্যতার দিকে এগুচ্ছি আমরা ? আজ চাই, সামাজিক প্রতিরোধ। চাই সুবিচার।
রাজন তার প্রাণ দিয়ে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে এখনও এই বাঙালী
জাতির কিছু কুসন্তান কতটা পশুত্ব বহন করছে তাদের মননে।
------------------------------------------
দৈনিক আজকের পত্রিকা ॥ ঢাকা ॥ ১৫ জুলাই ২০১৫ বুধবার প্রকাশিত
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৩:৪৫
সচেতনহ্যাপী বলেছেন: এলাকার বলে আপনার লেখায় ফুটে উঠেছে বাস্তবতার কথা।।
কিন্তু একটি কথা, তাই বলে কি আপনাকে সাহায্য নিতে হলো পত্রিকার!!