নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
এ পি জে আবদুল কালাম ও তাঁর স্বপ্নের প্রজন্ম
ফকির ইলিয়াস
=============================================
একজন মহান মানুষ চিরবিদায় নিলেন। তিনি ছিলেন একজন স্বাপ্নিক পুরুষ। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, একজন ধ্যানী, প্রজন্মের প্রতি একজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। এ পি জে আবদুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার চেয়েও বড় পরিচয়- তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী। নিজ জাতিসত্তার প্রয়োজনে তিনি দাঁড়িয়েছেন খুব সাহসের সঙ্গে। তাঁর একটি বড় কাজ ছিল এই প্রজন্মকে শাণিত করা। এজন্য তিনি প্রজন্মের মাঝে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন। দুই দশকে এক কোটি ৮০ লাখ তরুণের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথা গত বছর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি এমনই একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার সময়ই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ধারণা করা হয়েছে, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শোক বার্তায় লিখেছেন, ‘ড. কালাম মানুষের সঙ্গ উপভোগ করতেন। তিনি ছাত্রদের ভালোবাসতেন, শেষ সময়টিও তাদের সঙ্গেই ছিলেন তিনি।’
ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতি ছিলেন ড. এ পি জে আবদুল কালাম। দায়িত্ব পালন করেছেন ২০০২ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। পেয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরতœ’ খেতাব। তার চেয়েও বড় কথা- তিনি পেয়েছেন কোটি কোটি মানুষের প্রণতি- গোটা বিশ্বব্যাপী। অকৃতদার এই বিজ্ঞানী একাধিকবার এসেছিলেন বাংলাদেশে। গত বছর ঢাকা সফরের সময় তরুণদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, সবগুলো স্বপ্ন অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থামা যাবে না। ‘স্বপ্নকে হতে হবে বিশাল। জীবনে ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ একটি অপরাধ।’ ব্যক্তিগত জীবনে সচ্ছলতার শৈশব ছিল না কালামের। খাবার জোটাতে আট বছর বয়সে যে খবরের কাগজও বিক্রি করতে হয়েছিল, তাও বাংলাদেশের তরুণদের বলেছিলেন তিনি। তাঁর মনোজগত ছিল মানবিক দর্শনের লীলাভূমি। কবি জালালউদ্দিন রুমির একটি কবিতাই কালামের হৃদয়ে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিল, সে কথা তিনি তাঁর ভাষণে বারবার বলতেন। যে কবিতাটি গত বছর ঢাকার তরুণদের আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল তিনি।
কবিতাটির তর্জমা ছিল এরকম- ‘আমি সম্ভাবনা নিয়ে জন্মেছি। আমি জন্মেছি মঙ্গল আর বিশ্বাস নিয়ে। আমি এসেছি স্বপ্ন নিয়ে। মহৎ লক্ষ্য নিয়েই আমার জন্ম। হামাগুড়ির জীবন আমার জন্য নয়, কারণ আমি ডানা নিয়ে এসেছি। আমি উড়ব, উড়ব, আমি উড়বই।’ বিশ্বে ভারতকে মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করাতে আজন্ম মনোযোগী ছিলেন এই বিজ্ঞানী। তাঁর মিসাইল উদ্ভাবনই দেশটিকে নতুন পরিচিতি এনে দেয়।
ভারতের প্রথম মহাকাশ যান এসএলভি-৩ তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখেন কালাম। ওই মহাকাশ যান দিয়েই ১৯৮০ সালে ভারত প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র রোহিনী উৎক্ষেপণ করে। ভারতের কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাপনা (স্ট্র্যাটেজিক মিসাইল সিস্টেমস) এবং ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষায়ও প্রধান ভূমিকা রাখেন এই বিজ্ঞানী। গত বছর ঢাকা সফরকালে তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এই বিজ্ঞানী বলেছিলেন- জীবনের লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে যেতে বারবার সমস্যা আসবে, সংকট পথ আটকাবে। কিন্তু হৃদয়ে রাখতে হবে একটি সংকল্প- ‘আমি সংকটজয়ী হব, সব সমস্যা পেছনে ফেলে ছিনিয়ে নেব সাফল্য।’ উপস্থিত তরুণদের অনুষ্ঠান থেকে বাড়ি ফিরে নিজের জীবনের লক্ষ্য নিয়ে এক পৃষ্ঠা লিখে তা, তাঁকে ই-মেইল করতে বলেছিলেন এই মহান মানুষ। কত উদার ও বড় মনের মানুষ হলে এমনটি বলা যায়- তা সহজেই অনুমানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন- ‘প্রিয় বন্ধুরা, এদিকে তাকাও, কি দেখছ আলো। মনে পড়ে আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের কথা, তার বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কারের কথা।’ ‘টেলিফোন তোমাদের কার কথা মনে করিয়ে দেয়? আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল’।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তিনি স্মরণ করেছিলেন এভাবে। বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশের জন্মের কথা বললে তোমাদের কার নাম মনে আসে? শেখ মুজিবুর রহমান।’ তাঁর আত্মতত্ত্ব মনে রাখবে আজীবন এই প্রজন্ম। তিনি বলেছিলেন- ‘নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে- আমাকে মানুষ কেন মনে রাখবে?’ ছাত্ররাজনীতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কালাম তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে সবাইকে বলতে বলেন, ‘…যেখানে হৃদয় হবে ন্যায়-পরায়ণ, চরিত্রে থাকবে সৌন্দর্য, সেই রাজনীতিই আমরা চাই।’
এ পি জে আবদুল কালাম ছিলেন খুব সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু তাঁর কাজ ছিল খুবই বড়। নিজ জীবনের আখ্যান লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘যখন আমি ছোট ছিলাম, আমার মা আমাদের জন্য রান্না করতেন। তিনি সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করার পর রাতের খাবার তৈরি করতেন। এক রাতে তিনি বাবাকে এক প্লেট সবজি আর একেবারে পুড়ে যাওয়া রুটি খেতে দিলেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম বাবার প্রতিক্রিয়া কেমন হয় সেটা দেখার জন্য। কিন্তু বাবা চুপচাপ রুটিটা খেয়ে নিলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন স্কুলে আমার আজকের দিনটা কেমন গেছে।
আমার মনে নেই বাবাকে সেদিন আমি কি উত্তর দিয়ে ছিলাম কিন্তু এটা মনে আছে যে, মা পোড়া রুটি খেতে দেয়ার জন্য বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এর উত্তরে বাবা মা’কে যা বলেছিলেন সেটা আমি কোনোদিন ভুলব না। বাবা বললেন, ‘প্রিয়তমা, পোড়া রুটিই আমার পছন্দ।’ পরবর্তীতে সেদিন রাতে আমি যখন বাবাকে শুভরাত্রি বলে চুমু খেতে গিয়েছিলাম তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তিনি কি আসলেই পোড়া রুটিটা পছন্দ করেছিলেন কিনা। বাবা আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তোমার মা আজ সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছেন এবং তিনি অনেক ক্লান্ত ছিলেন। তাছাড়া একটা পোড়া রুটি খেয়ে মানুষ কষ্ট পায় না বরং মানুষ কষ্ট পায় কর্কশ ও নিষ্ঠুর কথায়। জেনে রেখো, জীবন হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ জিনিস এবং ত্রুটিপূর্ণ মানুষের সমষ্টি। আমি কোনো ক্ষেত্রেই সেরা না বরং খুব কম ক্ষেত্রেই ভালো বলা যায়। আর সবার মতোই আমিও জন্মদিন এবং বিভিন্ন বার্ষিকীর তারিখ ভুলে যাই। এ জীবনে আমি যা শিখেছি সেটা হচ্ছে, আমাদের একে অপরের ভুলগুলোকে মেনে নিতে হবে এবং সম্পর্কগুলোকে উপভোগ করতে হবে। জীবন খুবই ছোট; প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অনুতপ্ত বোধ করার কোনো মানেই হয় না। যে মানুষগুলো তোমাকে যথার্থ মূল্যায়ন করে তাদের ভালোবাসো আর যারা তোমাকে মূল্যায়ন করে না তাদের প্রতিও সহানুভূতিশীল হও।’
কি চমৎকার তাঁর দর্শন। কত ব্যাপক তাঁর ভাবনার পরিধি। তিনি একটি মননশীল জীবন ও বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছেন সবসময়। তিনি বলেছেন- ‘তরুণদের প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে, ভিন্নভাবে ভাবার সাহস রাখো। নতুন আবিষ্কারের সাহস রাখো। নতুন পথ আবিষ্কারের সাহস সঞ্চয় করো, অসম্ভবকে সম্ভব করার সাহস রাখো। সমস্যা অতিক্রম করে সফল হওয়ার সাহস অর্জন কর। এই গুণগুলোর ওপরই জোর দাও। একমাত্র কঠোর পরিশ্রমীদেরই ঈশ্বর সাহায্য করেন। এই নীতিটি খুব স্পষ্ট।’ এই মহান বিজ্ঞানী তাঁর ভাষণের বিভিন্ন সময়েই বিশ্বের সমসাময়িক বিষয়গুলোর ওপর নিজের ব্যাখ্যা দিয়েছেন সাহসের সঙ্গে। তিনি ভারতের সোলাপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘বন্ধুরা, সেই মহান নারী বিজ্ঞানীর কথা নিশ্চয় মনে আছে তোমাদের। তিনি একটা নয়, দু-দুটো নোবেল পেয়েছিলেন। একটা পদার্থবিজ্ঞানে, আরেকটা রসায়নে। তিনি হলেন মাদাম কুরি। মাদাম কুরি তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। এবং তিনি মানবদেহের ওপর রেডিয়ামের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। যে রেডিয়াম তিনি নিজে আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁর তেজস্ক্রিয় প্রভাবেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মানুষকে ব্যথামুক্ত জীবন দিতে গিয়ে নিজে অবর্ণনীয় ব্যথা সহ্য করেছিলেন। আমি দেখেছি, আমি যেখানেই কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের কথা বলি, তোমরা উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠো। আমি এক কোটির বেশি তরুণের সামনে কথা বলেছি দীর্ঘ সময়। তাদের প্রত্যেকেই সবার চেয়ে আলাদা, অনন্য হতে চায়। কিন্তু গোটা পৃথিবী তার সেরাটা দিয়ে যাচ্ছে সব সময়, তোমাকে আর সবার মতো সাধারণ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে পৃথিবীটা। এই যেমন ধরো, তোমার মা-বাবা সারা জীবন তোমাকে বলে এসেছেন পাশের বাসার ভালো ছাত্রটির মতো হতে। স্কুলে যখন গিয়েছ, শিক্ষক বলেছেন, প্রথম পাঁচ রোলের মধ্যে যারা আছে, তাদের মতো হতে। যেখানেই যাও না কেন, সেখানেই সবাই বলতে থাকবে, অন্য কারও মতো হতে অথবা অন্য সবার মতো হতে। এর পরও তোমাদের মধ্যে কতজন একেবারে অন্য রকম হতে চাও, বলো আমাকে। এটাই চ্যালেঞ্জ। কঠিন যুদ্ধে নামতে হবে তোমাকে। অবিরত জ্ঞানার্জন, কঠিন পরিশ্রম ও লক্ষ্য পূরণের সংকল্প- এসব থাকতেই হবে।
বিজ্ঞান তোমাদের কী দিতে পারে? বিজ্ঞান তোমাকে অনেক কিছুই দিতে পারে। বিজ্ঞানী হওয়ার অনেক মজা। তোমার বন্ধুরা সময়ের হিসাব করবে বড়জোর সেকেন্ডে, আর তুমি তা করতে পারবে সেকেন্ডের কোটি কোটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে, ফেমটো সেকেন্ডে। বিজ্ঞানী হলে নিজেকে আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটনের কাতারে ভাবতে পারবে। কোন জিনিসগুলো তোমাকে উদ্ভাবক ও অনুসন্ধিৎসু করে তুলতে পারে জানো? এমন তিনটি জিনিস আছে। সেগুলো হলো ভালো বই, ভালো মানুষ ও ভালো শিক্ষক। আর সেই সঙ্গে উন্মুক্ত চিন্তাধারা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে। কিছুদিন আগে আমি হার্ভার্ডে গিয়ে দেখেছি, ওখানে এমন একটা ন্যানো সুচ তৈরি হয়েছে, যা দিয়ে কিনা একটা অতি ক্ষুদ্র কোষেও প্রয়োগ করা যাবে ওষুধ। বিজ্ঞান থেকে প্রযুক্তি আলাদা রাখলে চলবে না।’
ড. কালাম ছিলেন একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক। আমরা দেখেছি- তাঁর মৃত্যুর পর একশ্রেণির হীনমন্যরা তাঁর আবিষ্কার নিয়ে না না কটুকথা বলছে। আজ তাঁর আবিষ্কার নিয়ে নেগেটিভ কথা বললে, এই সমালোচনা থেকে বিশ্বের কোনো বিজ্ঞানীই বাদ যাবেন না। তাহলে এরা এমনটি করছে কেন? এর কারণ হলো তারা তাদের মনের কোণে একটি পশুত্ব লালন করে। আর মাঝে মাঝে সেই পশুই তাদের খুব নিচে নামিয়ে হীনমন্য করে তুলে। প্রজন্মকে দাঁড়াতে হবে। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচু হবে সত্যের পক্ষে। এই সত্য ইতিহাসের। এই সত্য জাগরণের। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-জাতি নির্বিশেষে মানবতাই মানুষের মূল আরাধ্য বিষয়। এই কথাটিই প্রচার করতে চেয়েছেন এ পি জে আবুল কালাম। মানুষ তাঁকে বহুকাল মনে রাখবে। প্রজন্মের কাছে তিনি হয়ে থাকবেন আলোকবর্তিকা। তাঁর আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।
-------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ১ আগস্ট ২০১৫
©somewhere in net ltd.
১| ০১ লা আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৯:৩৭
মহান অতন্দ্র বলেছেন: অনুসরণ করবার মত একজন। অনেক শ্রদ্ধা তাকে। ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য। ভাল পোস্ট।