![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
এনএবিসি কনভেনশনে প্রজন্মের প্রত্যয়
ফকির ইলিয়াস
===================================
খুব ব্যস্ত কাটল এই কয়েকটা দিন। আমেরিকায় এখন গ্রীষ্মের শেষ সময়। শীতের আমেজ শুরু হবে আর কয়েক সপ্তাহ পরই। অভিবাসী বাঙালিরা তাদের অবকাশ শেষ করে ফিরে আসছেন। গত সপ্তাহান্ত ছিল আমেরিকায় লেবার-ডে উইকেন্ড। এই উইকেন্ডেই নিউইয়র্কে দুদিনব্যাপী নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ কনভেনশন (এনএবিসি) শেষ হলো। ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর শনি-রোববার বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্কে অভিজাত পেনসিলভেনিয়া হোটেলের দি প্যান প্লাজা অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় এই কনভেনশন।
শনিবার বিকেল তিনটায় এই কনভেনশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ওয়াকিল আহমেদ। উপস্থিত ছিলেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান, কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সতিনাথ মুখোপাধ্যায়, ড. খালেকুজ্জামান মতিন, ড. মিয়া মোহাম্মদ আদেল, ড. নজরুল ইসলাম, ড. সালাহউদ্দিন আইয়ুবসহ প্রবাসের একঝাঁক লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক। দুপুর থেকেই মঞ্চে অবস্থান নেন প্রবাসের ৭০টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা। তাদের সমবেত সঙ্গীতের পরই শুরু হয় অন্যান্য পর্ব। একে একে বাংলাদেশ, আমেরিকা ও কানাডার জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয় বাংলাদেশের মহান শহীদ ও নাইন-ইলেভেনে নিহতদের সম্মানে।
এরপর শুরু হয় শুভেচ্ছা বক্তব্য। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ড. ওয়াকিল আহমেদ বলেন, এটা খুবই গর্বের বিষয় এই বিদেশেও বাঙালি জাতি তার শিকড় ভুলে যাচ্ছে না। এ প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে নিজ সাহিত্য, নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির দিকে। বক্তব্য রাখেন, শফিক রেহমান, কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সতিনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
বেলা চারটা থেকেই শুরু হয় ধারাবাহিক সঙ্গীতানুষ্ঠান। অংশ নেয়- স্কুল অব মিউজিক, সঙ্গীত পরিষদ, সুরবাহার, হিন্দোল সঙ্গীতালয়, বহ্নিশিখা সঙ্গীত নিকেতন, স্বরলিপি স্কুল অব মিউজিক, প্রিয়া ডান্স স্কুল, নজরুল একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি ইউএসএ, বাংলাদেশি অর্গানাইজেশন, ম্যানহাটন বাংলা ও সাংস্কৃতিক স্কুল, পণ্ডিত কৃষাণ মাহারাজ তাল তরঙ্গ ইনস্টিটিউট, ওস্তাদ খুরশীদ খান ইনস্টিটিউট ইত্যাদি সংগঠন। ৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে ছিল- ‘আমাদের কথাসাহিত্যে শিল্প ও সৌন্দর্য’ বিষয়ক সেমিনার। অন্যতম কবি তমিজ উদদীন লোদীর উপস্থাপনায় এই সেমিনারে মুখ্য বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। আলোচনায় অংশ নেন- নাট্যজন মুজিব বিন হক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সতিনাথ মুখোপাধ্যায়। স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেন, শিল্প মানুষের সৃষ্টি। আর সৌন্দর্য মানুষের বোধ। এই সৃষ্টিচেতনা ও বোধের সমন্বয়ই হচ্ছে সাহিত্যকর্ম। শিল্পকর্ম। মানুষ তার মনের নিরিখেই সৌন্দর্য দেখে। এই দেখায়ও পার্থক্য আছে। দীর্ঘ চল্লিশ মিনিটের তার বক্তব্যে তিনি উপন্যাস, গল্প ও কথাসাহিত্যের অন্যান্য ধারা-উপধারা নিয়েও কথা বলেন। নাট্যজন মুজিব বিন হক মূলত কথা বলেন সাহিত্যে নাটকের প্রভাব ও বহমানতা নিয়ে। তিনি বলেন, নাটক সাহিত্যের সিঁড়ি, যা আমাদের জীবনচিত্রকে সমৃদ্ধ করার পথ দেখায়।
সতিনাথ মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু কবিতা পড়ে শোনান। সাহিত্য জীবনকে কিভাবে পরিপুষ্ট করে, কিভাবে একজন লেখক লেখালেখিতে একা হয়ে যান- সে চিত্রও তুলে ধরেন তিনি। সেমিনারের উপস্থাপক কবি তমিজ উদদীন লোদী বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যে শিল্প ও সৌন্দর্যের ব্যবহারের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যে আকর আমাদের মননকে শাণিত করে তাই সৌন্দর্য। শিল্পময় সাহিত্যই বেঁচে থাকে দীর্ঘকাল মানুষে মানুষে।
৫ সেপ্টেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় মূলমঞ্চে ভাষণ প্রদান করেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা নীনা আহমেদ। তিনি প্রবাসে বাঙালিদের আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমেরিকার মূলধারা রজনীতির সঙ্গে সম্প্রীতি বাড়ানোর তাগিদ দেন। তিনি বলেন, এই প্রজন্মকে শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, আমেরিকান বাংলাদেশিদের স্বার্থ দেখার জন্য ওবামার অফিস খুবই তৎপর। রাত নয়টা থেকে শুরু হয় মূল সাংস্কৃতিক পর্ব। এতে অংশ নেন প্রায় শতাধিক শিল্পী। ৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে ছিল সেমিনার। প্রথম সেমিনারটির বিষয় ছিল- ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’। এতে কি-নোট স্পিকার ছিলেন শফিক রেহমান। তার সঙ্গে প্যানালিস্ট ছিলেন- সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, সাংবাদিক মনোয়ারুল ইসলাম, ইমরান আনসারী ও আমেরিকান চ্যানেল এবিসির সাংবাদিক অনিভা জামান।
শফিক রেহমান তার ৩০ মিনিটের বক্তব্যে বর্তমান সরকারের সমালোচনামুখর ছিলেন নেতিবাচকভাবে। তিনি বলেন, আজকে দাবি করা হচ্ছে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ; এটা ডাহা মিথ্যা কথা। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হলে সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিতে গিয়ে এতগুলো মানুষকে মরতে হতো না। আমি বলব বাংলাদেশের উন্নয়ন সব ভূমধ্যসাগর ও বঙ্গোপসাগরে ডুবে গেছে। বাংলাদেশে সভ্যতা, গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। মধ্যম আয় নয়; সবার আগে দরকার মধ্যম সভ্য দেশ প্রতিষ্ঠা।
সাংবাদিক মঈনুদ্দিন নাসেরের সঞ্চালনায় এই সেমিনারে সাংবাদিক আনিভা জামান বলেন, আমার আমেরিকাতে জন্ম। আমি একজন গণমাধ্যম কর্মী। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের টিভিতে যেসব খুন-রক্তপাত দেখানো হচ্ছে তা দেখে বিস্মিত পুরো বিশ্ব। আমার আম্মু মাঝেমধ্যে বলেন এসব দেখাচ্ছে কেন; ভয় লাগছে। আমি বলি দেখানো উচিত। আরো অনেক ঘটনা আছে, এসব প্রকাশ করাই হচ্ছে স্বাধীনতা। অনেক সাংবাদিক সত্য বলে খুনের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশে। এটা ঠিক না। চুপ করে থাকা যাবে না। সত্য প্রকাশ করতে হবে। এই তরুণী সাংবাদিক আনিভা জামানকে আমি একটি প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলাম, আমেরিকায় কি সংবাদ মাধ্যম স্বাধীন। তিনি খুব স্পষ্টই জানালেন- ‘না’।
সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজুর রহমান বলেন, গণমাধ্যমের দুর্দশার জন্য দায়ী কারা। দ্বিধাবিভক্তির সাংবাদিকরা। সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে অতীত বিএনপির আমলে। সে সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে পুলিশ প্রবেশ করে সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানা বিষয়ই আজকের এই পরিণতি। এই সেমিনারে পরে শফিক রেহমানকে উপস্থিত দর্শকরা নানা প্রশ্ন করেন। তারা জানতে চান, ২০০১-২০০৬ সময়ে দেশে যখন জঙ্গিবাদ চলছিল, বাংলাভাই-শায়খ রহমানের রাজত্ব ছিল তখন তিনি প্রতিবাদ করেননি কেন?
এর জবাবে তিনি বলেন আমাদের সামনে এগোতে হবে- পেছনে নয়। দর্শকরা তখন ছি ছি দিতে থাকেন। এনএবিসি সম্মেলনে এর পরের সেমিনারটি ছিল- ‘নদী সমস্যায় আঞ্চলিক সমাধান কি আঁস্তাকুড়ে?’ এতে মূলপ্রবন্ধ পাঠ করেন ড. মিয়া মোহাম্মদ আদেল। আলোচনায় অংশ নেন পানি বিশেষজ্ঞ ড. খালেকুজ্জামান মতিন ও ড. নজরুল ইসলাম। তারা জলবায়ু পরিবর্তনে গণমানুষের সচেতনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
রোববার সন্ধ্যা ছয়টায় শুরু হয় কবিতা পাঠের আসর। কবি এ বি এম সালেহউদ্দিনের উপস্থাপনায় ৩৫ জন কবি এই অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করে। অতিথি হিসেবে ছিলেন ড. ওয়াকিল আহমেদ, কবি সৈয়দ আল ফারুক ও সতিনাথ মুখোপাধ্যায়।
কনভেনশনের শেষ সেমিনারটি ছিল- ‘বাংলা সাহিত্যচর্চার গুণগত মান : অতীত ও বর্তমান’। এটি উপস্থাপনা করেন কবি ফকির ইলিয়াস। এতে মূল প্রবন্ধ পড়েন ড. সালাহ উদ্দিন আইয়ুব। প্যানালিস্ট ছিলেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী ও কবি শামস আল মমীন। মূল প্রবন্ধে সালাহউদ্দিন আইয়ুব বলেন, সাহিত্য একটি সাধনার বিষয়। এটি শর্টকাটের বিষয় নয়। আজ ইন্টারনেট-ফেসবুক দখল করছে আমাদের সময়। আমি জানতে চাই- ৭০০ পৃষ্ঠার একটি বই কি নেটে বসে পড়া যায়? তা থেকে কি প্রকৃত জ্ঞান আহরণ করা যায়?
স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেন, লেখক তার মতো করেই লিখবেন। গুণগত মান নির্ণয় করবে মহাকাল। অতীতে কি ছিল আর ভবিষ্যতে কি হবে, তা বলা কঠিন। তারপরও আমাদের আশাবাদ সাহিত্য মানুষের জন্য পুষ্পবর্ষণ করে যাবে পথে পথে। শামস আল মমীন বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশ্বসাহিত্যের নিরিখে এগোচ্ছে। বাংলা সাহিত্য এটা খুবই আশার বিষয়।
সমাপনী বক্তব্যে আমি যে কথাগুলো বলেছি তা হচ্ছে, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ এবং দ্বিতীয় আবাসস্থল আমেরিকায় আমাদের সমস্যার শেষ নেই। এ সব সমস্যা নিয়ে কনভেনশনে আমরা বিভিন্ন সেমিনার এবং সিম্পোজিয়াম করেছি। নতুন প্রজন্মের সরব উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণ ছিল আশাপ্রদ। আমরা বিশ্বাস করি, নতুন প্রজন্মকে বাদ দিয়ে আমরা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ এবং প্রবাসের সমস্যার সমাধান করতে হলে নতুন প্রজন্মের হাতেই আমাদের নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে। সে জন্য আগামী কনভেনশনগুলোতেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে প্রবাসে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের হাতে। আগামীর আলোর মিছিল আমরা তাদের হাতে তুলে দিতে চাই। যে আলোয় আমরা আলোকিত হবো। আলোকিত হবে সমাজ হবে, আলোকিত হবে সংস্কৃতি, আলোকিত হবে দেশ।
২০১৬-এর এনএবিসি কনভেনশন হবে কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে। ২০১৭-এর কনভেনশন হবে ফ্লোরিডায়। এবারের কনভেনশনে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এরা বাংলা ভাষা শিখে নিয়েছে এখানেই, এই বিদেশে- বিভিন্ন বাংলা স্কুলে। কত আনন্দের কথা তা আমাদের জন্য। মূলত ভাষা একটি শক্তি। এই শক্তি যখন জীবিকার প্রয়োজনে প্রজন্ম ব্যবহার করতে পারবে- তখন সে নিজেই শিখতে চাইবে সেই ভাষা। তা বাংলা হোক, কিংবা চায়নিজ-জার্মানই হোক।
------------------------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫
©somewhere in net ltd.