| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(লেখাটি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছবিটা সেখান থেকেই নেওয়া।)
ওয়েটারের কাছে চায়ের বিলটা মিটিয়ে দিয়ে পাশের টেবিলে রাখা নিজের ব্যাকপ্যাকটা টেনে নিচ্ছিল আসিফ।
ওয়েটার তখনো একই কথা বলেই চলেছে, ‘স্যার আর কিছু অর্ডার করবেন না?’
আসার পর থেকে সে এই প্রশ্ন না হলেও চারবার করেছে। এই হোটেলে কেউ শুধু চা খেতে আসবে এটা যেন বেচারা ওয়েটার কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
মফঃস্বল শহরের শহরতলীতে গড়ে ওঠা এই জমজমাট স্ট্রিট রেস্তোরাঁটি জমেই ওঠে সন্ধ্যার পরে। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসতে থাকে পঙ্গপালের মতো। কোনো আলাদা বিশেষত্ব নেই এই রেস্তোরাঁর। ভাত মাছ শাক সবজি থেকে শুরু করে নুডলস পাস্তা বার্গার সবকিছুই পাওয়া যায়। আর দামটাও একেবারে হাতের নাগালে।
রেস্তোরাঁর কিছু অংশ ভেতরে আর কিছু অংশ রাস্তার ফুটপাথের মধ্যে এসে পড়েছে। ফুটপাথের সেই অংশটুকুতে পলিকার্বোনেটের প্লাস্টিক শেড দিয়ে সুন্দর ছাউনি বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু চেয়ার টেবিলও পেতে দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো আপত্তি নেই। চালু রেস্তোরাঁর মালিক কীভাবে সবাইকে খুশি রাখে সেটা তাদের ব্যাপার।
সাধারণত মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্তরাই এখানে বেশি আসে। পেটপুরে খেয়ে নেয় মজার মজার খাবার। এমন একটা রেস্তোরাঁতে কেউ শুধু চা খেতে আসবে এটা সেজন্যই বিশ্বাস করা যায় না। আর চা টা এখানে তেমন একটা ভালোও হয় না!
বার কয়েক ওয়েটারের একই প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আসিফ এখন একটু বিরক্তবোধ করছে। বাংলা ভাষা বোঝে না নাকি? বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময়েই চোখ পড়ল রাস্তার অপরপাশ থেকে হনহন করে হেঁটে আসা তার বড়ভাই আশিকের দিকে।
আসিফ বসেছিল ফুটপাতের ওপরে সাজিয়ে রাখা একটি চেয়ারে। সেখানে বসে পরিষ্কার দেখতে পেল আশিক হাত নাড়তে নাড়তে তার দিকেই হনহনিয়ে ছুটে আসছে। ভেতরে ভেতরে মেজাজটা খিচড়ে গেল তার। সব এই বাচাল ওয়েটারের জন্য!
দিব্যি চা শেষ করে সে এখন নিজের ডেরায় ফিরতে পারত। এখন আশিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়া মানে শুধু শুধু কিছু পয়সা খসা। যে কঞ্জুস তার এই ভাই! কিছু তো খসাবেই না কখনো, পারলে তার ঘাড়টাকে মটকে খেয়ে নিবে!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আসিফ এবারে হাত দেখাতে বাধ্য হলো। আর তো ওঠা হচ্ছে না এখান থেকে। ওয়েটারকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘নাও তোমার ইচ্ছাই পূরণ হলো। চায়ের সঙ্গে এবারে মনে হচ্ছে টাও খেতে হবে!’
ওয়েটার একটু হাসি দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা তাহলে আমি বরং একটু পরেই আসি স্যার! আপনি রেডি হলে ডাকবেন প্লিজ।’
ওয়েটার যেতে যেতে ভাবল, ‘এমন হাড় কিপ্টা জিন্দেগীতে দেখিনিরে ভাই!’
আশিক কাছে এসে ভাইয়ের সাথে কোলাকুলি করল। চোখের কোণা দিয়ে দেখে নিয়েছে, আসিফের চা খাওয়া শেষ। মনে মনে আফসোস করতে লাগল, ইস! আরেকটু পা চালিয়ে আসত যদি!
কিন্তু মনের ভাব মনেই চেপে রেখে মুখে অকৃত্রিম আন্তরিকতা ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘ভাইরে কতদিন পরে দেখা হলো তোর সঙ্গে! একই শহরে থাকিস! অথচ একটু বাসাতেও আসিস না! তোর ভাবি প্রায়ই তোর কথা বলে। আর বাচ্চারা তো তাদের চাচুর কথা ভুলতেই পারে না!’
আসিফ মনে মনে ভাইয়ের এই বাকপটুতার তারিফ না করে পারল না। আর কিছু না হোক, ভাইটি তার কথায় ওস্তাদ। আসিফ তার বাসাতেই গিয়েছে বড়জোর দুইবার। একবার তো তার ভাবি আর বাচ্চারা কেউ বাসাতেই ছিল না। আরেকবার যাও বা বাসাতে ছিল, মুখেচোখে এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুলেছিল যে আসিফ বুঝি বাক্স পেটরা নিয়ে থাকতে চলে গিয়েছে। ভাস্তে ভাস্তিরাও কেউ আশেপাশে ভিড়ছিল না। আর আশিক ভাইয়ের কী ফাঁকা আওয়াজ!
মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে রেখে আসিফ বলল, ‘আমি অবশ্য উঠছিলাম ভাইয়া। তুমি কি বসবা কিছুক্ষণ?’
আসিফকে মনে মনে ‘কঞ্জুস’ বলে একটা গালি দিলো আশিক। দুই ভাইই দুজনকে দুনিয়ার সেরা কঞ্জুস মনে করে, তবে মুখে কেউ তা প্রকাশ করে না। মুখে তরল একটা ভাব ফুটিয়ে তুলে আশিক বলল, ‘হ্যাঁ তুইও বস না! কতদিন তোর সঙ্গে কথা হয় না! আছিস কী রকম? মামার খবর টবর জানিস কিছু? ব্যাটা তো দিব্যি বহাল তবিয়তে টিকে আছে এখনো! প্রায়ই শুনি আজ যায়, কাল যায়! কিন্তু যায় তো আর না!’
‘নাহ! আমি তো দরকার না পড়লে কারো বাসায় যাই না। নিজের দুনিয়া নিয়ে ভালোই আছি। ঝুট ঝামেলা নাই!’
আশিকের মুখে এবারে একটা নিখাঁদ কষ্টের ছায়া ফুটে উঠল। মুখটাকে করুণ করে বলল, ‘তুইই ঠিক কাজ করেছিস রে ভাই। বিয়েশাদি করিসনি। দিব্যি আছিস। আমাকে দ্যাখ, কে বলবে তোর চাইতে আমি মোটে পাঁচ বছরের বড়? অন্তত দশ বছরের বড় বলবে সবাই। তিন তিনটা বাচ্চা পালতে গিয়ে হাড়মাস সব এক হয়ে গেল। এর মধ্যে তোর ভাবি আবার সেদিন ‘সুখবর’ শুনিয়েছে। আমি তো আর পারছি না রে! সবকিছু ছেড়েছুড়ে কোথাও যদি চলে যেতে পারতাম!’
আসিফের এবারে সত্যিই ভাইয়ের জন্য একটু মায়া হলো। হাজার হলেও মায়ের পেটের ভাই। অল্প বয়সেই বিয়েশাদি করে ফেঁসে গেছে বেচারা। নামটাও আশিক, আশিকের মতোই তার চালচলন। কবে কোন মেয়ে একটু চলার পথে হাসি দিয়েছে, ব্যস! তাতেই জীবন একেবারে কোরবান! বিয়ে করবে তো সেই মেয়েকেই! শেষমেশ করেও ছেড়েছে। আর বিয়ের পরেই বুঝেছে, সর্ষেক্ষেতের শোভা দূর থেকেই ভালো লাগে। কাছে গেলে ভেতরে নোংরা আবর্জনার শেষ নাই। হাতে পয়সা না থাকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। কেরানীর অল্প বেতনের চাকরি করে কি আর বেশিদিন মেয়েদের মন ভোলানো যায়? তারা চায় বিলাসিতা, প্রাচুর্য। না দিতে পারলে ভালোবাসাও ফিকে হতে সময় লাগে না!
অন্যদিকে আসিফ এত সহজে মেয়েদের ফাঁদে জড়ানোর পাত্র নয়। সে স্থানীয় একটা দৈনিকে রিপোর্টারের ছোট কাজ করে। বেতন আহামরি কিছু না, আবার একেবারে খারাপও না। সে দেখতে রাজপুত্রের মতো সুন্দর। সৌন্দর্যটা মায়ের বাড়ির দিক থেকেই এসেছে। অফিসের অনেক মেয়েই আড়ে আড়ে তাকে দেখে। আসিফ সবকিছুই বুঝতে পারে, কিন্তু কাউকেই পাত্তা দেয় না সে। আগে চাকরি বাকরি করে নিজের একটা ভালো অবস্থান তৈরি করবে। ব্যাংকে টাকা পয়সা জমাবে। তারপর বিয়ের কথা ভাবলেও ভাবা যেতে পারে।
ওদিকে একই মায়ের পেটের ভাই হয়েও আশিক কিন্তু দেখতে একেবারেই সাদাসিধে, বেঁটে। সংসারের চাপে বেচারাকে এখন অনেকখানি কুঁজোও দেখায়। তাকে দেখে কোনো মেয়েই সহজে পটত না। তাই একজন যেই না একটু পটেছে, ওমনি আশিক প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে গেছে।
ওয়েটারকে ডেকে এক কাপ চা আর দুটো স্যাণ্ডউইচের অর্ডার দিলো আসিফ। আহা! হোক একটু খরচ। আশিককে দেখে মনে হচ্ছে, অনেকক্ষণ খাওয়াদাওয়া কিছু হয়নি। হয়ত পকেটে বিশেষ পয়সাও নেই! খাবার আসার আগে দুজনে আবার তাদের মামার প্রসঙ্গে ফিরে গেল। (ক্রমশ)
©somewhere in net ltd.