| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে
দহিল হৃদয় মন সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে।
দেখি সেথা একজন পদ নাহি তার
অমনি জুতার খেদ ঘুচিল আমার।
পরের দুঃখের কথা করিলে চিন্তন
আপনার মনে দুঃখ থাকে কতক্ষণ” ( কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার)
একসময় আমাদের গ্রামীণ কর্দমাক্ত ,পিচ্ছিল এবং শ্বাপদসংকুল জনপদে জুতা ছিলো দুষ্প্রাপ্য ও বিলাসীতার সামগ্রী । তখন চাইলেই জুতার দুঃখ ঘুচানো ছিলো অতীব দুষ্কর ,তাই উপায়ান্তর না দেখে কবি নিজের দুঃখ ব্যাথা ভুলে থাকার জন্য আরো অধিকতর দুঃখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার প্রতি গুরুত্ত্বারোপ করেছিলেন।এখন জুতা পরিণত হয়েছে নিত্যব্যবহার্য পণ্য হিসেবে, কাঁচা মটির রাস্তা রুপান্তরিত হয়েছে পিচঢালা পথে। নতুন পথের যাত্রা এনে দিয়েছে নতুন গান, নতুন ভাবনা আর নতুন স্বপ্ন । এই স্বপ্ন জাল বুনে ডানা মেলে চলা শুরু করেছে গ্রামের নিভৃত পল্লির অলি-গলি,হাট বাজার আর পথে প্রান্তরে দূর থেকে সুদূরে। সুখে,দুঃখে কারণে অকারণে আমরা পথকেই বেছে নিয়েছিলাম সাথী হিসেবে , রচনা করেছিলাম গল্প কবিতা উপন্যাস । পথ আমাদের বিমুখ করেনি; ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থ্যান বা স্বাধীনতার আন্দোলন সব রাজপথেই চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছিল। আমরা পেয়েছিলাম অগ্নিঝড়া মার্চ, বিজয়ের ইতিহাস ,আর স্বাধীন এক ভূখন্ড।
ভৌগলিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে এই মসৃণ পথ। এমনও সময় ছিল পণ্য পরিবহনের খরচ, পণ্য উৎপাদনের চেয়ে অধিক শ্রমসাধ্য, চ্যেলেঞ্জিং ও সময়সাপেক্ষ ছিল। এখন এই রাস্তার অবদানে পচনশীল পণ্য অল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে পৌঁছে যাচ্ছে বাজারে , অনেক ক্ষেত্রে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে। একদা মোস্ট আনপ্রডিক্টেবল রাস্তার কথা বিবেচনায় গাঁওগেরামে প্যান্ট পড়ে কোথাও যেতে হলে পায়ের জুতা হাতে নিতাম আর প্যান্টের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সাথে লুঙ্গি রাখতাম ছোট খাল-নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য । এখন আর সেদিন নাই, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বা চর এলাকায় যেখানে সরাসরি রোড কমিউনিকেশনে যাওয়া দুরুহ সেখানকার আভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাটও আজ পাঁকা হয়ে যাচ্ছে । এখন দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দিবালোকেই পৌঁছে যেতে পারি এই পথের কল্যানে।
ছবি:ঝালকাঠি এলজিইডির একটি উপজেলা সড়ক ।
এই পাঁকা রাস্তা দিয়েই আমরা স্কুল ,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সহজেই যেতে পারছি । প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ড্রপআউট রেটে পার্শ্ববতী দেশকেও আমরা ছাড়িয়ে গেছি , অর্থনীতির চাকা হয়েছে গতিশীল।পথের কাজে নিয়োজিত লক্ষ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে , তাদের সন্তানসহ যখন গ্রামের একজন রিক্সাচালকের সন্তানও সেরা ছাত্র হিসেবে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয় তখন এটা বলাই বাহুল্য যে আমরা সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছি । পথ দিয়েছে সময় আর শ্রমের মর্যাদা ও মূল্যবোধ। আমরা বিশ্ব অর্থনীতিতে উদীয়মান বাঘ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছি তা কিন্তু এই পথের সফলতাতেই। এই সফলতা দেশের গন্ডি পেরিয়ে দৃষ্টি কেড়েছে আন্তর্জাতিকভাবেও ।যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন পরিমাপে যে কয়টি বৈশ্বিক সূচক রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে গ্রামীণ চলাচল অবকাঠামো সূচক বা আরএআই। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক সূচকে সবার ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ, এক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারতও আমাদের থেকে পিছিয়ে!এরকম দারুণ খবরে বাংলাদেশী হিসেবে আমরা গর্বিত ও আনন্দিত।
এই গর্ববোধের সাথে একজন কিংবদন্তির অবদান ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে, তাঁকে স্মরণ না করলে আমরা অকৃতজ্ঞই থেকে যাবো । তিনিই প্রথম জুতা পড়তে না পারা, বা না থাকার কষ্টের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তাঁর সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনাতে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার রাস্তা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে ; রাস্তাকে বাজার ,বিদ্যালয়,গণতন্ত্র চর্চার কেন্দ্র ও ওয়ান ষ্টপ সার্ভিস সেন্টার ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের সাথে সংযোগ করেছে; গ্রামীণ জনসাধারণের জন্য এনে দিয়েছেন এক কম্পমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সর্ববৃহৎ জালিকা , যিনি দেশের প্রয়োজনেও ঝাপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, নিজ হাতে বপন করেছিলেন দেশের সর্ববৃহৎ প্রকৌশল সংস্থার বীজ ; তিনি গ্রামবাংলার অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার স্পপ্নদৃষ্ট্রা প্রবাদ পুরুষ,এলজিইডির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রকৌশলী, প্রয়াত কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ।
তিনি একাধারে দারিদ্রতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাজার অবকাঠামো , নবায়নযোগ্য শক্তি , দুর্যোগ মোকাবেলা এবং পানি সম্পদ ও সেচ ব্যবস্থাপনায় অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষুদ্রখ্রণের মাধ্যমে দারিদ্রতার বিরুদ্ধে কাজ করেছিলেন, কেনিয়ার ওয়ানগারি মাথাই বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে অবদান রেখেছিলেন এবং মালালা ইউসুফজায়ী অশিক্ষার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন এবং অর্জন করেছেন নোবেল শান্তি পুরষ্কার । যদিওবা সবকিছুরই সমালোচনা আছে এবং থাকবে, তবুও আজ তাঁরা বিশ্ববরেণ্য ও সর্বজনসমাদৃত। এগুলো মানুষের কাজের স্বীকৃতি, তাঁরা হয়তো পুরষ্কারের জন্য কাজ করেননি, কাজকে ভালোবেসেই করেছেন।
হতে পারে প্রয়াত জানব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছেন মাত্র, বিনিময়ে কোন অনার বা পুরষ্কারের আশা করেননি। তবে যাঁরা গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে বিশেষ অবদান রাখেন তাদেরকে পুরষ্কৃত করা হলে সমাজে আরো ভালো উদ্যোগ আর উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়। তাই হয়তো দেশসেবার পুরষ্কার হিসেবে তাঁকে দেয়া হয়েছে কবি জসিমউদ্দিন স্বর্ণপদক, আইইবি স্বর্ণপদক, ইঞ্জিনিয়ারস গোল্ড মেডাল, জাইকা ফেলো। ১৯৯৯ সালে বিশ্বব্যাংক তাঁকে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে পারসন অব দ্যা ইয়্যার ঘোষণা করে। সরকারের তরফ থেকে একজন কর্মবীরকে তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পিডিবির চেয়ারম্যান,গণপূর্ত বিভাগের সচিব,ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন, একজন কর্মবীরকে তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ আরো অধিতর ও ভিন্নমাত্রার কর্ম দিয়ে সন্মানিত করা হয়েছে , কিন্তু উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রীয় কোন পদকে ভূষিত করা হয়নি, কর্মপাগলরা অবশ্য এতেই সন্তুষ্ট থাকার কথা।
তিনি ভারত ও পাকিস্তানের স্বনামধন্য পানি বিশেষজ্ঞদের পিছনে ফেলে শুধুমাত্র তাঁর যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের কারণে গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রথম চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন ।তিনি শূন্য থেকে কাজ তৈরি করতেন আর কাজও তাকে খুঁজে খুঁজে বের করতো ,তাই আমৃত্যু কাজের মাঝেই ছিলেন। বর্তমানে তিনি আমাদের মাঝে নেই, সরকার চাইলেই তাঁকে এখন আর কাজ দিয়ে তুষ্ট করতে পারবেন না।তাঁর মতো প্রতিভার যত চর্চা অনুসরণ ও পরিচর্যা হবে ততই আমাদের উৎকর্ষ সাধিত হবে। তাই বৃত্তের বাইরে ও জনস্বার্থে কাজ করার স্বীকৃতি স্বরূপ ,কাজের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ এবং বাংলাদেশের জীবনমানের উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে স্বাধীনতা পদক বা একুশে পদকে ভূষিত করা হলে দেশ উন্নয়নের হাইওয়েতে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে এবং উন্মোচন হবে নতুন নতুন সম্ভাবনা আর নতুন দিনের।
©somewhere in net ltd.