![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পুরোপুরি একজন অতি সাধারন মানুষ । আমি যা আমি তাই ই । শয়তানও নই কিম্বা ফেরেশতা । একজন মানুষ আপনারই মতো দু'টো হাত, চোখ আর নিটোল একটা হৃদয় নিয়ে আপনারই মতো একজন মানুষ । প্রচন্ড রকমের রোমান্টিক আবার একই সাথে জঘন্য রকমের বাস্তববাদী...
রোববারের সকাল। যথারীতি আমার ল্যাপটপ খুলে ইউটিউবে দেশের এবং বিশ্বের খবর দেখছিলুম এবং ফাঁকে ফাঁকে সামুতে ঢুঁ মারছিলুম । স্কুল বন্ধ বলে গিন্নি এখন বাসায়। গত কয়েক মাস যাবৎ প্রতি রোববারের সকালের এ সময়টায় তার একটা জুম মিটিংয়ের প্রোগ্রাম থাকে। জুম মিটিংটি হয় জুলাই অভ্যুথানের আহতদের সাহায্যার্থে আমার এখানের বাংলাদেশীদের গঠন করা একটি সাহায্য সংস্থার কার্যনির্বাহী সদস্যদের মাঝে। আমাকে তখন ল্যাপটপের সাউন্ড ভলিউম যথাসম্ভব কমিয়ে দিতে হয়। রোববারে এই একটা ঝামেলা আমার! তো আজও তাই!
আমি তখন দেশের গরম গরম খবর নিয়ে করা ইউটিউব কণ্টেন্ট দেখছিলুম। এই সময় গিন্নি বলে বসলো, তোমার মোবাইলটা বের করো! বললো চুপিসারে যাতে তার মিটিংয়ের লোকেরা শুনতে না পায়। কি যন্ত্রনা! আমি অবাক! তাদের মিটিংয়ে আমার মোবাইল দিয়ে কি হবে! কথা না বাড়িয়ে ফোনটি তার হাতে দেয়ার আগেই একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললো , “ এই নম্বরটা সেভ করে তোমার হোয়াটসএ্যাপে ফোন দাও।” অথচ ওসব আমাকে কিছুই করতে হলোনা গিন্নি নিজেই সবটা করলেন। অনেকটা মেয়েলী একটা কন্ঠ ভেসে এলো আমার ফোন থেকে, “ম্যাডাম আমি তো আপনাদের মিটিংয়ের লিংকে ক্লিক কইরাও ঢুকতে পারতেছিনা।” গিন্নি বললো – “ তোমার ভাবীকে যেভাবে বলে দিয়েছি সেভাবেই তাকে দিয়ে আর একবার চেষ্টা করে দেখো হয় কিনা। ”
ওধার থেকে জবাব এলো, “ম্যাডাম, করছে কিন্তু কি সব নম্বর চায়।”
এবারে গিন্নি, ” ঠিক আছে সমস্যা নাই। তুমি এখানেই বলো, একটু জোরে জোরে বলো। আমি তোমার কথা আমার ফোনে সবাইকে শোনাচ্ছি।”
গিন্নি আমার ফোনটা তার ফোনের স্পিকারের সামনে ধরে রাখলো যাতে তাদের জুম মিটিংয়ের সদস্যরা কথাগুলো শুনতে পারেন ।
ব্যাপারটা আমার কাছে এবার অনেকটা পরিষ্কার। আমার গিন্নিকে একটু আগেই তার মিটিংয়ে বলতে শুনেছি- “ভাই আমি তো মবিনকে মিটিংয়ের লিংকটা পাঠিয়ে দিয়েছি কিন্তু মবিনতো এখনো যোগ দেয়নি…… আচ্ছা আমি ওকে হোয়াটসএ্যাপে ফোন দিয়ে দেখছি ব্যাপারটা কি”।
বুঝতে পারলুম, আমার মোবাইলটা কেন দরকার হয়েছিলো।
গিন্নি ওধারের মবিন নামের মেয়েলী কন্ঠের কাউকে বললো, মবিন তোমার গুলি লাগার ঘটনার পুরোটা আর কি কি চিকিৎসা হয়েছে সব খুলে বলো। ফিসফিস করে গিন্নিকে বললুম- মেয়ের গলা অথচ নাম বলছো মবিন। ঘটনা কি? গিন্নি ব্যস্ত দু’টো ফোনে, জবাব দিলেন না।
ল্যাপটপে আমার হাত তখন নিশ্চল। আমি মবিনের কথা শুনছিলুম। অনেকক্ষন মবিন জুলাই অভ্যুত্থানে তার আহত হওয়ার ঘটনা বলে যাচ্ছিলো। ঘটনা যা বোঝা গেলো তা সংক্ষেপে এই ----------
মবিন নামের ছেলেটির বয়স ১৭ বছর (কিশোর বয়েস বলেই তার গলাটি আমার কাছে মেয়েলী লেগেছিলো্)। বাবা নেই। ঢাকার উত্তরার রাজলক্ষী কমপ্লেক্সের পিছন দিকের লতিফ এমপোরিয়ামে ফটোকপিয়ার-কম্পিউটার কম্পোজ-বিকাশ ইত্যাদি ব্যবসা নিয়ে একটি ষ্টেশনারী দোকানে কাজ করে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বড়ভাই বুদ্ধিপ্রতিবন্দি। বাকী ভাইটির সাথে সে তাদের মামার এই দোকান সামলায়। জুলাইয়ের উত্তাল সময়গুলিতে উত্তরায় ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের যে ঢেউ উঠেছিলো তা তার চোখের সামনেই, রাজলক্ষীর সামনের রাস্তায়। তারও যেতে ইচ্ছে হয়েছিলো জনতার মিছিলে মিশে যেতে কিন্তু সাথে থাকা ভাইটির কঠিন শাসানির কারনে ইচ্ছে পূরণ হচ্ছিলোনা। কিন্তু জুলাই যোদ্ধা আবু সাঈদের হত্যার ঘটনাটি তাকে এতোই ক্ষিপ্ত করে তোলে যে, সে পারলে তখনই মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্ত ভাইয়ের শাসানির কারনে সেদিন সে উত্তাল মিছিলে যোগ দিতে পারেনি। পরের দিন ১৭ই জুলাই উত্তরায় জনতার ঢল নামেনি। মবিনের ইচ্ছেটা সেদিনও পূরণ হয়নি। পরের দিন ১৮ই জুলাই ভাইকে এড়িয়ে ভাইয়ের আগেই সে দোকানের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টর এলাকা জুড়ে তখন ছাত্র-জনতা বনাম পুলিশ আর লীগ কর্মীদের ধুন্ধুমার লড়াই চলছে। ভাই নেই , এইতো সুযোগ প্রতিরোধের মিছিলে যোগ দেয়ার। হলোও তাই! উত্তরা পূর্ব থানার সামনে ( যেটা রাজলক্ষীর ঠিক উল্টো দিকে ) উত্তেজিত জনতার সাথে মবিনও নেমে পড়ে স্বৈরাচার হঠাতে। কিছু পুলিশ তখন থানার দোতলা থেকে ছাত্র জনতাকে লক্ষ্য করে এলোপাথারি গুলি ছুঁড়ছিলো। সে সময়ই পুলিশের অনেকগুলি ছররা গুলি তার দুটো চোখ দিয়েই ঢুকে মাথায় আটকে যায়।
লোকজন ছুটে আসে। তাকে ধরাধরি করে নেয়া হয় উত্তরার মৈত্রী হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা না পাওয়ায় পর্যায়ক্রমে তাকে নেয়া হয় সোহরাওয়ার্দী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ্ জানায়, সরকারের নিষেধ আছে মিছিলে আহতদের চিকিৎসা দিতে। সুতরাং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা হবেনা। তখন মবিনের সাথের লোকজন বুদ্ধি করে বলে যে , মিছিল নয় জমিজমা সংক্রান্ত ঘটনায় রোগী আহত হয়েছে। মবিনের চোখ থেকে ঝরে পড়া রক্তের বীভৎসতা আর তার সর্বাঙ্গীন অবস্থা দেখে চিকিৎসকরা আর কথা বাড়ায়নি। তাকে ভর্তি করে চোখের অপারশন করানো হয়। কিন্তু ছররা গুলির আঘাতে তার দুটো চোখের রেটিনাই তখন ছিন্নবিচ্ছিন্ন। চিকিৎসকদের কিছুই করার নেই। মবিনের কথা মতো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার ছেঁড়াখোড়া রেটিনা জোড়া দেয়ার চেষ্টা করা হয়, মাথার ভেতরে থাকা কিছু ছররার টুকরাও বের করে আনা হয়। অনেক ছররা থেকে যায় মাথার ভেতরেই।
আগষ্টের পরে সরকারী তত্ত্বাবধানে তাকে সি,এম, এইচে ভর্তি করা হয়। সেখানে আজো তার চিকিৎসা চলছে কিন্তু মবিনের ভাষায়, চিকিৎসকরা বলেছেন তার দু’টি চোখই সকল চিকিৎসার উর্দ্ধে।
এখন মবিন প্রায় সম্পূর্ণ অন্ধ। চোখের সামনে পানির ঢেউয়ের মতো শুধু নাচানাচি দেখে সে, আর কিছু নয়। মাথায়ও ছররা গুলি এখনও রয়ে গেছে। তার কাছে দিন রাত্রি এখন সব একাকার!
আমি জুলাই বীভৎসতা আর অভ্যুত্থানের আহতদের নিয়ে আমাদের দায়বদ্ধতার কথা লিখতে বসিনি। লিখতে বসেছি একটি কিশোরের বলা শেষ কথাটির রেশ ধরে।
মিটিংয়ে থাকা গিন্নি ও তার সাথের লোকজন হতভাগ্য কিশোরটির কথা শেষে জানতে চাইলেন, মবিনের জন্যে তারা কি ধরনের সাহায্য করতে পারেন। কি ধরনের সাহায্য তার লাগবে তা জানালো মবিন। মবিনের কথা শেষ হলে গিন্নি বললেন, ” তোমার ওখানে এখন অনেক রাত। এবার সবাইকে সালাম দিয়ে বিদায় নাও মবিন। দেখি তোমার জন্যে আমরা কি করতে পারি।”
মবিন সবাইকে সালাম দিয়ে বললো, “আমি আর কিছু চাইনা ম্যাডাম! দোয়া কইররেন, আমি য্যানো আমার পিরথিবীডারে আর একবার দেইখ্যা যাইতে পারি……………………….”
সোমবারের সেই সকাল থেকে আজ লিখতে লিখতে আমার কানে এখনও বাজছে মবিন নামের একটি কিশোরের করুন আর্তি , জীবনের সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন - আমি য্যানো আমার পিরথিবীডারে আর একবার দেইখ্যা যাইতে পারি..”
শিরোনামের ছবি সূত্রঃ
www.vecteezy.com
১৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:০১
আহমেদ জী এস বলেছেন: মেঠোপথ২৩ ,
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রথম মন্তব্য ও লাইক দেয়ার জন্যে।
লিখতে গিয়ে আমারও গলায় কান্না জমাট বেঁধে আসছিলো।
২| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:৫০
অপ্সরা বলেছেন: মবিনের কথা জেনে খুব খারাপ লাগছে ভাইয়া। তরতাজা দৃষ্টি এভাবে বন্ধ হয়ে গেলো!
তার চোখ কি আবার ভালো হবার কোনো সুযোগ আছে?
১৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:৩৯
আহমেদ জী এস বলেছেন: অপ্সরা,
না... তার চোখ আর ভালো হবার সুযোগ নেই।
মবিনের কথায় যা বোঝা গেছে তাতে মনে হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার চোখের ছেঁড়া রেটিনা জোড়া দেয়া হয়েছে কিন্তু কোনও ফল হয়নি। পরে সি,এম, এইচ'য়ের চিকিৎসকেরা নাকি বলেছেন, সে আর দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবেনা।
দুঃখজনক!
৩| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১০:০২
জুল ভার্ন বলেছেন: জি এস ভাইজান, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লেখা! এই লেখাটা যেন কেবল একটা কাহিনি নয়- এ যেন এক টুকরো রক্তাক্ত বাস্তব, যেখানে এক কিশোরের স্বপ্ন, সাহস আর বেঁচে থাকার আকুল আর্তনাদ একসাথে মিশে আছে।
মবিন নামের ১৭ বছরের ছেলেটি, যে চোখে দেখতো স্বপ্ন, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, দেশের মুক্ত বাতাসে বাঁচার আশা। আজ সেই চোখ দুটোতে শুধু অন্ধকার।
তবু তার শেষ প্রার্থনা ছিল না টাকা, ছিল না ক্ষমতা বা প্রতিশোধের দাবি- ছিল একটাই মানবিক মিনতিঃ
“আমি য্যানো আমার পিরথিবীডারে আর একবার দেইখ্যা যাইতে পারি…!”
এই একটি বাক্যে যেন সমস্ত দেশের কান্নাবদ্ধ হয়ে আছে।
আমরা হয়তো প্রতিদিন খবর দেখি, স্ক্রল করি, আলোচনা করি- কিন্তু মবিনের মতো কত নিরীহ প্রাণ যে এই পৃথিবীর আলো হারিয়ে ফেলছে, তা অনুভব করি না।
আপনার এই লেখাটা আমাদের বিবেকের দরজায় এক নিঃশব্দ কড়া নাড়া;
জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কি এখনো মানুষ আছো?”
মবিনের জন্য দোয়া করি-
যেন কোনো অলৌকিক আলো আবার তার চোখে আলো ফোটে, যেন সে সত্যিই একবার দেখতে পারে-
তার ভালোবাসার পৃথিবীটা, যে পৃথিবীর জন্য সে চোখ হারিয়েছে।
১৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১০:১৪
আহমেদ জী এস বলেছেন: জুল ভার্ন,
আপনার এই মন্তব্যটিও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া। ++++++++++++
ঠিকই বলেছেন - কেবল একটা কাহিনি নয়- এ যেন এক টুকরো রক্তাক্ত বাস্তব,
এমনি শত শত বাস্তবতা ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে, কে তার খোঁজ রাখে!!!!
মবিনের মতো দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা শত মবিনদের জন্যে আমাদেরও দোয়া থাকুক--
যেন অলৌকিক কোনো আলো আবার তাদের চোখে আলো ফোটায়.....
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:৪৮
মেঠোপথ২৩ বলেছেন: কিছু বলার বা লেখার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।